ক্যালিডোস্কোপে স্মৃতির চল না একমুখী না সরলরৈখিক, এগিয়ে পিছিয়ে ঘুরতে থাকে।
আমাদের ছোটবেলায় আমাদের তিন ভাইকে যদি প্রশ্ন করা হত তোমাদের একটিমাত্র জায়গায় যাওয়ার বর দেওয়া হচ্ছে, কোথায় যেতে চাও, আমরা এক কথায় জানিয়ে দিতাম দত্তপুকুরে আমাদের মামাবাড়িতে। সু্যোগ পেলেই আমরা মামাবাড়ি গিয়ে হাজির হতাম। মামাবাড়ির দিক থেকে আমাদের বাড়ি এসে থাকা, খোঁজখবর নেওয়া, বেশিরভাগ সময়ে করত মা আর বাবার মাঝামাঝি বয়সের, আমাদের ছোটমামা। তার বিয়ের পরে মামিও এসেছে আমাদের বাড়ি। আমার বিয়ের পর যখন এই যুগল আমাদের বাড়ি এসেছে আমার স্ত্রীও তাদের অপার স্নেহের ধারায় সিক্ত হয়েছে। তাই বলে আমাদের ছোটবেলায় ছোটমামার উপস্থিতি কিন্তু বাকি মামাদের সান্নিধ্যের মতন সদা-সুখের ছিল না। যখন তখন আমাদের বাবা এইটা পারে না, ঐটা পারে না ইত্যাদি হাবিজাবি অভিযোগ অথবা ঘোষণায়, যেগুলি এখন আর একেবারেই মনে পড়ে না, সে আমাদের অস্থির করে ফেলত। আমরা রীতিমত প্রতাপশালী বাবা কিংবা স্নেহশীলা মা এমন কি আমাদের ঠাকুমার কাছে এই নিয়ে অভিযোগ করতে গিয়ে দেখতাম তারা মামাকে ত কিছু বলছেই না, বরং মুখ-টেপা হাসিতে পরিস্থিতিটা উপভোগ করছে। ঠাকুমা বললও একদিন, ‘হ্যায় ত তোমাগো বাপের শালা, হ্যায় ঠাট্টা করতেই পারে।’ বড়দের এই নাটকটা আমি কিছুতেই ধরতে পারতাম না। আজ অবশ্য অতীতে তাকিয়ে সেই হাসির শরিক আমিও। তবে সেদিনের সেই শিশু তিনটির জন্য মায়া হয় খুব।
সেই সময় ছোটমামা মানেই নাটক। থেকে থেকে অভিনয় করে বা না করে নাটকের সংলাপ বলে যাওয়া। তার প্রিয় সংলাপ ছিল – হাসি কিসের এত? এইটা কি নাট্যশালা? (না কি নাইট্যশালা, এই বিশেষ বাচনভঙ্গীতে বলত কি? হায় স্মৃতি, তুমি বড়ই প্রতারক!) কোন গল্পের বা কোন নাটকের থেকে এই সংলাপ, জানতাম না আমি, কিন্তু ছোটমামা বাড়িতে এসেছে আর এই সংলাপ শুনিনি এমন ঘটেনি কখনও। একটা সময় বুঝেছি জীবন যথার্থই নাট্যশালা।
অভিনয়ে কিভাবে নিজের অনুভবকে দর্শকের কাছে পোঁছে দেওয়া যায়, ছোটমামা ছিল তার আদর্শ উদাহরণ। আমাদের কোন আব্দার কি দাবি নাকচ করতে হলে এমন ভাবে জিভ বার করে, চোখ আধবোজা করে অল্প মাথা নাড়িয়ে সেটা মানা করত যেন আমরা একটা ভয়ানক লজ্জার কাজ করে ফেলেছি বা করতে বলছি। হঠাৎ হঠাৎ করে উপযুক্ত মুখভাব আর গলার স্বরের ওঠা-নামা সহ বিভিন্ন চরিত্রের মনোলগ বলে যেত। কখনো কখনো একাধিক চরিত্রের ডায়ালগ। সিরাজের ভূমিকায় জেলে বন্দি নবাবের অন্তিম মুহুর্তের দৃশ্যায়নে কথা বলতে বলতে সহসা এমন ‘আঁক’ করে থেমে গিয়ে চোখ বড় করে তাকাত যে আমরা পরিষ্কার বুঝতাম ঘাতকের ছোরা সিরাজের পেটে ঢুকে গিয়েছে। মুগ্ধ হয়ে ভাবতাম আমিও একদিন ছোটোমামার মত এমন অসাধারণ নাটক করব। কি কারণে জানা নেই, মঞ্চে মামার নাটক আমার কখনও দেখা হয়নি।
আমার নিজের অবশ্য মঞ্চে ওঠার সু্যোগ অনেক ছোটবেলাতেই এসে গিয়েছিল। আমি তখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে। ঠিক কি উপলক্ষে আজ আর মনে পড়ে না, আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়-এর একটা বড় অনুষ্ঠান হয়েছিল। রীতিমত মাঠ জুড়ে প্যান্ডেল বেঁধে। সেই উপলক্ষে প্রচুর বক্তৃতা আর নাচ-গান-আবৃত্তির সাথে একটা নাটকের আয়োজন করা হয়েছিল। রবিবুড়োর ডাকঘর থেকে একটা ছোট অংশ ছিল আমাদের পাঠ্যবইয়ে, অমল ও দইওয়ালা শিরোনামে। দিদিমণিরা সেটাই বেছে নিলেন মঞ্চস্থ করার জন্য। সম্ভবত: প্রচুর পটর-পটর করার যোগ্যতায় আমি মনোনীত হলাম অমল-এর ভূমিকায়। চতুর্থ শ্রেণীর এক শ্রীমান হল দইওয়ালা।
সেই প্রথম জেনেছিলাম রিহার্সাল কাকে বলে। শেষ ক্লাস-এর পরে শুরু হত। ভাল লাগত, তবে একটু ক্লান্ত হয়ে যেতাম – আমার তো কবে সব মুখস্থ হয়ে গেছে, ভাব ভঙ্গী সহ! দিদিমণিরা মাঝে মাঝে আলোচনা করতেন কেমন করে মঞ্চসজ্জা করলে বা আর কি কি করলে নাটকটা একেবারে সত্যির মত করে তোলা যায়। সেই সব কিছু কিছু শুনে আমার ধারণা হয়েছিল যে আসল অনুষ্ঠানের দিন আমাকে দইওয়ালা ছেলেটির হাত দিয়ে একটা সত্যি দই-য়ের ভাঁড় দেওয়া হবে। আমার কাছে নাটকের আসল আকর্ষণ ছিল সেটা এবং সেই নিয়ে ভিতরে ভিতরে খুব উৎফুল্ল থাকতাম।
এসে গেল দিনটা। আমরা কলা-কুশলীরা প্রথম থেকেই গ্রীনরুম-এ। মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে দেখে নিচ্ছি – সামনে মাথার পর মাথা, লোকের পর লোক। কালে কালে সম্ভাব্যতার যুক্তিতে সে সমাবেশের আকার ছোট থেকে ছোটতর হয়েছে, কিন্তু অন্তরের অন্ত:পুরে সেটা বিশাল-ই রয়ে গেছে। আমার চেতনায় সেটিই ছিল জনসমুদ্রের প্রথম ধারণা। মজার বিষয়, সেই জনসমুদ্র দেখে আমার কোন ভয় বা দ্বিধা হল না। বরং নিজের ভিতর থেকে একটা অজানা শক্তির জেগে ওঠা টের পেলাম। সেদিনের সেই অনুভূতিটা ফিরে এসেছে বারে, বারে – যতবার মঞ্চে উঠেছি ততবার। লাইম লাইটের আলোয় আমি অন্য মানুষ – আমি-ই তখন নিয়ন্তা।
কুচো ফর্মাটের সেই নিয়ন্তা একসময় মঞ্চে এসে বসল, ঘরের ভিতর জানালার পাশে। বসেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তার। এটা একটা মঞ্চ সজ্জা হল! আমার সামনে হাঁটুর উচ্চতায় একটা ছোট কাপড়ের আড়াআড়ি বেড়া আর তার দু’ধারে দুটো কাপড়ের টুকরো মেঝে থেকে ছাদের দিকে উঠে গেছে, একটা সরু লম্বাটে চৌখুপী বানানো হয়েছে। এটা একটা জানালা হল! একসময় সেই জানালার পাশের দিক থেকে আমার মুখের সামনে একটি মাইক্রোফোন এল। আমাকে বলা হল মাইকে কথা বলতে। ওনারা মাইক টেস্ট করবেন। আমি ভাবলাম আমাকেই বলছেন টেস্ট করে নিতে। কি করে করব! মঞ্চের সামনে থেকে বড্ড আওয়াজ আসছে। গোলমালের সমুদ্র চলছে যেন। ভেবে দেখলাম, নিশ্চয়-ই ছোট বাচ্ছারা বেশী কথা বলছে। আগেও কয়েকবার এই অবস্থায় যে ঘোষণাটি শোনা গেছে এবার আমি-ই সেটি দিয়ে দিলাম, সঙ্গে দিলাম নাটক শুরু করার বার্তা – ছোট বাচ্ছারা গোলমাল না করে চুপ করে বসে পড়, আমাদের নাটক এখন-ই শুরু হবে।
ব্যাস! জনসমুদ্র যেন হো হো হাসির গর্জন-এ ফেটে পড়ল। এক মাস্টারমশাই উইংসের আড়াল থেকে ছুটে এসে আমায় বললেন এখন আর যেন মাইকে কিছু না বলি। আমি ত হতবাক! দোষটা কি করলাম! পরে বুঝেছি, মহা দোষ করেছিলাম। শান্ত ভাবে, উচ্চকিত আড্ডার কলতানে চারিদিক মথিত না করে অনুষ্ঠানের জন্য অপেক্ষা করাটা আমাদের সংস্কৃতির সাথে মানানসই নয়। গোলমাল তো আর ছোটরা ততটা করছিলনা, যতটা করছিল বড়রা! তাই আমার তিরস্কার আসলে বিঁধেছে তাদের-ই। অতএব উপহাস আর মজার উল্লাসে আমার দোষের শাস্তি দেওয়া ছাড়া আর কি-ই বা তারা করতে পারতেন, এমন কি গোটা উপমহাদেশ জুড়েই আজো পারেন! আর একটা আঘাত-ও সইতে হল – দই-এর ভাঁড়-এ কোন দই ছিল না! দই-জনিত সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়াতে বড়রা হয়ত ঠিক ব্যবস্থাই নিয়েছিলেন, কিন্তু নাটক শেষের হাততালির ঝড়-ও আমার ক্ষোভ আর অপ্রাপ্তির দু:খ মুছে দিতে পারে নি। সেই সন্ধ্যায় আমি প্রস্তুতি ছাড়াই একদফা বড় হয়ে গিয়েছিলাম!
আর আশ্চর্যভাবে, আমার কোন শিক্ষা হয়নি। অনেক বছর বাদে আরেক বিদ্যায়তনে আবারো নাটকে অংশগ্রহণ করেছি, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে মঞ্চে সন্দেশের বদলে কলার টুকরো ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যদি সন্দেশ খেতে গিয়ে তাড়াহুড়োয় গলায় আটকে বিপদ বেধে যায় তাই এই সতর্কতা। খুবই সঙ্গত ব্যবস্থা। কিন্তু আমার যে কি বিপুল হতাশ লেগেছিল, সে আর বলবার নয়। তারপর থেকে অন্যের নির্দেশনায় মঞ্চে ওঠায় খানিকটা অনীহা হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুরা মিলে যখন নাটকের দল তৈরী করেছিলাম, নির্দেশনা হত সবার মিলিত সিদ্ধান্তে, কোন পরিচালক ছিলনা আমাদের। অবশ্য বাদল সরকার বা পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় কাজ করার যখন সু্যোগ এসেছে সেগুলো হাতছাড়া করিনি।
ছোটবেলার যে সমস্ত ঘটনা স্মৃতির কন্দরে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ অনুভবে রয়ে গেছে তার একটি ছিল এক মেলায় যাওয়া আর তার পরিণতি। সঠিক সময়কাল এখন খানিকটা ঝাপসা হয়ে গেছে। তবে তিন থেকে সাড়ে ছয় বছরের মধ্যে ঘটেছিল। বাবা আমি আর আমার পিঠোপিঠি মেজ ভাই তিন জনে মিলে মেলায় বেড়াতে গেলাম। মেলায় বেলুনওআলা বানিয়ে চলেছে নানা আশ্চর্য – কুকুর, মালা, মুকুট আরও কত কি! মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকি আমি। এক সময় আবিষ্কার করি – আমি হারিয়ে গেছি। বাবা-ভাই কাউকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। চিন্তায় পড়ে গেলাম। তবে ভয় করে নি আমার। চারপাশে এত লোক! উপায় হয়ে যাবে কিছু একটা। কিন্তু কি ভাবে! মাথায় যে কিছু আসছে না! এবার হতাশায় চোখে জল চলে আসে আমার!
হঠাৎ এগিয়ে আসে এক কাকু। প্রশ্ন করে করে বোঝার চেষ্টা করে বাড়ি কোথায় আমার। আমি যতটা পারি বলি। তারপর দুজনে মিলে রওনা হই বাড়ির উদ্দেশ্য। চলতে চলতেই মিলিয়ে নিতে থাকি পথ – হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই দিকে, এই ব্রীজ দিয়ে রেললাইন পার হতে হবে। এবার এই দিকে। একসময় বাড়ি এসে গেল। কাকুটা আমায় বলল, সাহসী ছেলে, ভাল ছেলে। আর সাহসের পুরস্কার হিসাবে আমায় একটা পয়সা দিল। সম্ভবত: পঞ্চাশ পয়সা ছিল সেটা। বাড়ির দরজায় আমায় পৌঁছে দিয়ে কাকু তার বাড়ি চলে গেল। আর, আমি বুক পকেটে পয়সা ভরে বিজয় গর্বে বাড়ি ঢুকে এলাম।
মা আমার কাছে ঘটনা শুনে আঁতকে উঠল। তারপর জিজ্ঞেস করল নাম কি সে কাকুর, সে কি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে? আমি বললাম – নাম জানি না, ভাল কাকু, বাড়ি চলে গেছে। মা অত্যন্ত হতাশ হয়ে জানাল এমন উপকারী মানুষের নাম না জানাটা আমার অত্যন্ত বোকামি হয়েছে। আর, এই প্রথম আমি উপলব্ধি করলাম কি অসাধারণ বেকুব ছেলে আমি! সেই সাথে মা-ঠাকুমা দুজনেই ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল বাবার অবস্থা ভেবে। তারা কথা বলতে বলতেই বাবা এসে পড়ল ভাইকে নিয়ে। আমায় দেখতে পেয়ে নিশ্চয়ই বিরাট এক আনন্দ হয়েছিল তার। কিন্তু মুখ দেখে আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। মার কাছ থেকে খুঁটিয়ে সব জেনে নিয়ে আমায় বলল – “চল।” ভাই বাড়িতে রইল। আমি চললাম বাবার সাথে – কোথায় কে জানে!
এ পথ সে পথ ঘুরে বাবা যেখানে আমায় নিয়ে এল তা দেখে আমি আর আমাতে নেই! চারিদিকে খাকি পোষাক। থানা। দারোগা টেবিলে বসে কি লিখছে। বাবা গিয়ে সামনে দাঁড়াল। আমার সামনেই গরাদ ঘেরা কি জায়গা ওটা? কি আবার? জেলখানা। জেলখানা ছাড়া আর কি হবে? বাবা কি যেন বলল দারোগাকে। আমি আর কিছু শুনতে পাচ্ছি না। দারোগা ফিরল আমার দিকে। সব বুঝে গেছি আমি। বাবা আমায় শাস্তি দিচ্ছে। দারোগা এবার আমায় জেলে ভরে দেবে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম আমি। বাবা ত থ। এত ঘুর-চক্কর খেয়ে যে ছেলের কোন উদ্বেগ দেখা গেল না এখন তার কি হল? আর কি হল। আমার হেঁচকি উঠতে রইল। অপ্রস্তুত বাবা কোনমতে কি সব সই-টই করে আমায় নিয়ে থানা থেকে বের হয়ে এল। বাবা যে কি সব বলে যাচ্ছিল – ডাইরী, জানিয়ে যাওয়া – এতক্ষণে একটু একটু করে আমার মাথায় ঢুকতে শুরু করল। আর তার পরে লজ্জায় মাথাটা আমার নীচে, আরো নীচে। সে’দিন আমি ভয় আর লজ্জা দুটোর-ই মুখোমুখী হয়েছিলাম এমন তীব্রতায় যা এর আগে আর কখনো ঘটেনি। পরে বহুবার ঘটেছে। সেই দিনটা ছিল সূচনা বিন্দু। জীবন নাটকের কঠিনতর অধ্যায়ের।
প্রচলিত মঞ্চ-নাটকের বাইরে আরেক নাটকের অভিজ্ঞতা মনে পড়ে মাঝে মাঝে। সেই সন্দেশের বদলে কলার টুকরোর স্কুলেই খুব ভাল লেগেছিল ঐ বিশেষ নাটকের অংশ হতে পেরে। ষষ্ঠ শ্রেণী। একদিন ভূগোলের ক্লাসে নিয়মিত শিক্ষকমশাইয়ের বদলে একজন তুলনায় কম বয়সের শিক্ষক এলেন। খুব উৎসাহী মানুষ। নিজে স্কুলের কাছাকাছি বি টি কলেজে পড়তে এসেছেন, পড়ানো শিখতে। শেখার প্রক্রিয়াটির একটি পর্যায় হাতে-কলমে শেখা, সেটিই উনি করতে এসেছেন আমাদের পড়িয়ে। পড়াবেন আফ্রিকার ভূগোল। তবে একটু অন্যভাবে পড়াবেন। আসলে উনি আমাদের পড়াবেনই না। আমাদের দিয়ে একটি নাটক করাবেন।
একটি ছেলে আফ্রিকায় বেড়াতে এসেছে, এক দেশ থেকে আরেক দেশ, এক শহর থেকে আরেক শহর ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই সব জায়গায় স্থানীয় কোন ছেলেকে সেখানকার কিছু কথা বলে তারপর সেই নিয়ে প্রশ্ন করবে। সেই স্থানীয় ছেলেটি সেই সব প্রশ্নের সাধ্যমত উত্তর দেবে। ভাল করে পার্ট মুখস্ত করতে হবে আমাদের। ওনার পড়ানোর যে সময়কাল তার পুরোটা জুড়ে এই নাটকের রিহার্সাল চলবে, দরকার পড়লে উনি প্রম্পট করবেন। তার পর একদিন ওনার পরীক্ষকরা আসবেন। সেইদিন তাদের সামনে কোন প্রম্পট ছাড়া আমাদের নাটক চলবে। পরীক্ষকরা নিজেরাও আমাদের যাকে খুশি কিছু কিছু প্রশ্ন করতে পারেন। কাকে কি প্রশ্ন করবেন সেটা এই মাস্টারমশাইও জানেন না। তবে আমরা যদি নাটকটা বা তার পরে ঐসব প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারি তাহলে তিনি ফেল করবেন। কিন্তু সেটা নিয়ে ওনার কোন দুশ্চিন্তা নেই কারণ উনি জানেন, আমরা নাটকটা এত ভাল ভাবে করব যে ওতেই উনি পাশ করে যাবেন। আর প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে পারলে ত আরও ভাল, অনেক ভাল পাশ হয়ে যাবেন।
এসে গেল অপেক্ষায় থাকা দিনটি। আমি বেড়াতে আসা ছেলেটির পার্ট পেয়েছিলাম। সারা ক্লাসের কোথায় কারা কারা বসবে সেটা এমনভাবে ঠিক করা ছিল যাতে সব বেঞ্চ থেকেই অন্ততঃ একজন করে অভিনেতা থাকে। কিছু বকবক, কিছু প্রশ্ন। কিছু চটপট উত্তর, কিছু থেমে থেমে। কিছু উত্তর ভুলে যাওয়া, তখন বাকিদের মধ্য থেকে কেউ হাত তুলে সে উত্তর বলে দেওয়া। পরীক্ষকরাও কেউ একজন মনে হয় কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলেন, আমাকে এবং অন্যদের, উত্তর শুনে সম্মতিতে মাথা নেড়েছিলেন। পরীক্ষার্থী শিক্ষকমশাই চমৎকার ভাবে পাশ করেছিলেন, সেই আনন্দ উদবেল করেছিল নাটকের পরিচালক এবং কুশীলবদের সবাইকে।
তবে কোন আনন্দ যে কিভাবে বিষাদ ডেকে আনে! অসাধারণ সাফল্যের আনন্দে মাস্টারমশাই ওনাদের হোস্টেলবাসের সমাপ্তি ভোজে সপ্তাহশেষের দুপুরে আমাকেও ডেকে নিয়েছিলেন। পৌঁছানোর পর খুব খুশি হয়ে সেখানে হাজির ওনার সহপাঠী অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আমার খুশির বেলুন ফুটো হতে বেশি সময় লাগেনি। একজন বললেন, হ্যাঁ, এখন ত সব জিনিয়াস মনে হয়, কালে কালে সেই ঢ্যাঁড়স না হয়ে যায়। বাড়িতে সব্জি বাগানে ঢ্যাঁড়স গাছ হতে দেখেছি। তার সাথে আমার কিসে মিল হতে পারে বুঝতে পারলাম না। ঘর ফাঁকা হতে ভূগোলের শিক্ষকমশাইকে জিজ্ঞাসা করলাম। উনি বিব্রতভাবে জানালেন, ঐ ঢ্যাঁড়স যেমন ছোটতে বেশ নরম সুখাদ্য থাকে আর বেশি পেকে গেলে শক্ত হয়ে অখাদ্য হয়ে যায় সেইটা বলেছে। ও লোক ঐরকমই। আমি যেন ওর কথায় দুঃখ না পাই। ভাবলাম, ভাগ্যিস ইনি আমাদের পড়াতে যাননি। কী খেয়েছিলাম সেদিন, মনে থাকেনি। দিনটাকেই মনে রাখতে চাইনি। ভুলতেও পারিনি।
সেই দূর অতীতে একটি অপূর্ব নাটক দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। যা দেখেছিলাম তার বেশির ভাগই কালের প্রবাহে ঝাপসা হয়ে গেছে। ফলে, যা মনে থেকেছে তা যত দিন গেছে তত আরো উজ্জ্বল হয়েছে। হয়ত, আসলের থেকেও বেশি মহিমান্বিত হয়ে স্মৃতিতে ঠাঁই করে নিয়েছে।
বিকেলের ঘুম দিয়ে উঠে এক সন্ধ্যায় আবিষ্কার করলাম বাড়িতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। ভাড়া বাড়ি। আশপাশের ঘরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল সবাই গেছে বড় মাঠে, নাটক দেখতে। আমিও ছুটতে ছুটতে গিয়ে হাজির। দেখি, নাটক শুরু হয়ে গেছে, মাঠ চুপচাপ শুনছে। বাড়ির কাউকে খুঁজে পাওয়ার অবস্থা নেই। আমি একেবারে সামনে গিয়ে মাটিতে বসে পড়লাম। সে এক অদ্ভুত নাটক। গল্প এগোচ্ছে। মঞ্চটা একটা ঘর। মঞ্চে চরিত্ররা ঘোরাফেরা করছে, কথা বলছে আর টুকটুক করে একটার পর একটা দেয়ালের টুকরো পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে মঞ্চের পিছনের পর্দার থেকে কিছুটা সামনে, বাঁদিক থেকে ডান দিক গোটা মঞ্চ জুড়ে একটা লম্বা দেয়াল বানিয়ে ফেলছে! সেই দেয়ালটায় পর্দা টাঙান জানালা আছে, প্রতি দুই জানালার মাঝে খোলা-বন্ধ হয় এমন আসল দরজা আছে। জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়ে লোকেরা কথা বলছে। বন্ধ দরজার পাল্লা খুলে ঘরে ঢুকে আসছে, ঘর থেকে বের হয়ে দেয়ালের ওপাশে কোথাও চলে যাচ্ছে!
কি নাটক ছিল সে প্রশ্ন করা হয়ে ওঠেনি, অথবা করে থাকলেও উত্তর এখন আর মনে নেই। যেটা মনে আছে তা হল, সেটা ছিল বড়দের নাটক। বড় হয়ে খোঁজ নিয়ে মনে হয়েছে সেটি ছিল কেয়া চক্রবর্ত্তী অভিনীত নান্দীকারের নাটক – ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’। যারা সেই নাটক দেখেছেন তারা সঠিক বলতে পারবেন। নাটকের নানা টুকরো ছবি গেঁথে আছে স্মৃতির নানা স্তরে। মঞ্চসজ্জার পাশাপাশি এই নাটক আমাকে উপহার দ্যায় আরো এক আশ্চর্য সন্ধান – নায়িকার অস্তিত্ব। সেই অস্তিত্ব-র সাথে তখনো যুক্ত হয়নি নিজের কোন ভাল লাগা-মন্দ লাগা, কিন্তু চেতনার কোন আবছা স্তরে বড় মেয়েদের আবিষ্কার করি মেয়ে হিসেবে। বড় হয়ে যাই আরো একটু।
বড়দের করা নাটক পুরোটা শুনে-বুঝে বেশ উপভোগ করেছিলাম কুচবিহারে ক্লাস ফোর কি ফাইভে পড়ার সময়, বাবার অফিসের নাটক দেখতে গিয়ে। অফিসের কর্মচারিদের করা, চেনা কাকুদেরও কেউ কেউ ছিল মনে হয়। সেই প্রথম জানলাম কালো টাকা কাকে বলে – ঘুষের টাকা বিছানার তোষকের নিচে লুকিয়ে রাখে দুষ্টু সরকারি কর্মচারি। কিন্তু সে পার পায় না। নাটকের শেষ দৃশ্যে ঠিক পুলিশ চলে এসে বিছানার তোষক উল্টে ফেলে সব টাকা পেয়ে যায়। তারপর সেই দুষ্টু লোকটাকে কোমরে দড়ি আর হাতে হাতকড়া পড়িয়ে জেলে নিয়ে চলে যায়। সেই সাথে নিয়ে যায় যার কাছ থেকে সে ঘুষ নিয়েছিল সেই ব্যবসায়ীকে। তার সংলাপের বিশেষ ধরণের বাংলা উচ্চারণ আর মাথার বিশেষ টুপিটি নজর কেড়েছিল। প্রাদেশিক প্রভাবের অস্তিত্বের ধারণা মনে হয়, সেই প্রথম হয়েছিল। আর, ঘুষ ব্যাপারটির ধারণা ঐ নাটকেই পেয়েছিলাম এবং অত্যন্ত আশ্বস্ত হয়েছিলাম এই জেনে যে ঘুষ দিলে বা নিলে রেহাই নেই, তার শাস্তি হবেই। নূতন যুগের রূপকথায় নূতন ভিলেনরা জায়গা করে নিতে শুরু করেছিল।
এক যুগের নায়ক, আরেক যুগের ভিলেনে বদলে যাচ্ছে। মঞ্চের রং, দেয়ালের লেখা, চিন্তার পরিসর বদলে যাচ্ছে। তার মধ্যেই কবির হুঁশিয়ারি জারি থাকছে,
“এই রাজা আসে ওই রাজা যায়
জামা কাপড়ের রং বদলায়
দিন বদলায় না!”
কিন্তু লড়াই জারি থাকে, নাটক চলতে থাকে। ধ্বংসের রকমারি আয়োজন, তবু জীবন বারে বারে তাকে হারিয়ে মঞ্চের দখল নিয়ে এগিয়ে চলছে।
তৃতীয় শ্রেণীতে থাকতে থাকতেই বাবা তাঁর সরকারী চাকরীতে বদলী হয়ে গিয়েছিলেন উত্তর বঙ্গে। আমার স্কুলের বছর শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা তাঁর কাছে যেতে পারিনি। তিন সন্তান আর প্রতাপান্বিত বিধবা শাশুড়ি নিয়ে মা কি করে একা সামলেছিল সেই সব দিনগুলো, দুবার ট্রেন বদলে, মাঝে স্টীমার চেপে গঙ্গা পার হয়ে দমদম ক্যান্টনমেন্ট থেকে কুচবিহারে গিয়ে পৌঁছেছিল, সে সব ভাবলে আজো আশ্চর্য লাগে। পরের দিনগুলোতেও যাত্রাপথ নানা বাঁকে কঠিন হয়েছে। তবে আমাদের সৌভাগ্য, এই সফর একেবারে একলার ছিল না। সমাজের নানা মানুষদের নানা সময়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াতে দেখেছি। জীবন নাটকের অপরাহ্নবেলায় পৌঁছে তাঁদের মহানুভবতার নানা টুকরো ছবি ক্যালিডোস্কোপে বর্নিল নকশা তৈরী করে স্মৃতিতে মিলিয়ে যায়।
ক্রমশ...