গল্পকার এবং ঔপন্যাসিক প্রতিভা সরকার সাহিত্যপ্রেমী মানুষের মজলিশে আত্মপ্রকাশ করেন ২০১৯ সালে তাঁর প্রথম গল্পের সংকলন ‘ফরিশতা ও মেয়েরা’ গ্রন্থটি প্রকাশ করে। ‘ফরিশতা ও মেয়েরা’ প্রকাশিত হয়েছিল ‘গুরুচণ্ডালী’ থেকে। প্রথম গল্পের বই প্রকাশের পর থেকে অনেকগুলি গল্পের বই প্রতিভা লিখেছেন। প্রতিভার গল্পের হরেক চরিত্রের মিছিল সমাজ ও পরিবেশ নিয়ে আবর্তিত হয়েছে। তাঁর সাম্প্রতিকতম উপন্যাস ‘রসিকার ছেলে’ প্রকাশিত হল ২০২৪ এর বইমেলায়। ‘রসিকার ছেলে’ উপন্যাসটি একটি সামাজিক উপন্যাস। এই উপন্যাস পাঠককে উথালপাথাল করে দেয়। স্তরবিন্যস্ত এই সমাজের নিম্নবর্গের মানুষদের উপর উচ্চবর্ণের মানুষের অবহেলা, অপমান, ঘৃণা হতচকিত করে দেয় অনুভবী পাঠককে। করে দেয় - কারণ দেশের সর্বোতকৃষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতেও এই বঞ্চনা, অবহেলা একই ভাবে সতত ক্রিয়াশীল।
আমাদের চারিপাশের সমস্ত প্রতষ্ঠানই- বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, আইআইটি, আইএসআই, আইআইএম ইত্যাদি, এমনকি মন্দির, মসজিদ, অফিস-আদালত, ক্রীড়াঙ্গন - সবই যেন সমাজের ছিন্ন ছিন্ন একেকটা অংশ। সমাজের ভালো-মন্দ সব প্রতিষ্ঠানে একইভাবে থিতু হয়ে থাকে। জমাট বেঁধে থাকে সমাজের বর্ণচেতনা, বৈষম্য, বিদ্বেষ। মানুষকে বিচার করতে তার মেধা, সৃজনশীলতার পরিবর্তে তার জাত, লিঙ্গ, বর্গ এইসবই প্রধান হয়ে ওঠে। এর থেকে বেরিয়ে আসতে শিক্ষার কী কোনো ভূমিকা আছে? যে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয় সমাজের উচ্চবর্গের মানুষদের সক্রিয় উদ্যোগে - যেখানে উচ্চবর্গের মানুষ আর প্রশাসন হাতে হাত ধরে থাকে- সেখানে দরিদ্র নিম্নবর্গের ছাত্রদের জন্য কী খোলা হাওয়া বয়? যদি বইতো, তাহলে আমরা জানতে পারতাম না রোহিত ভেমুলা, ফয়জান আহমেদ, অনিল কুমার, আয়ুষ আশনি, দর্শন সোলাঙ্কি, অনিকেত আম্ভোরে, পায়ল তদভির মতো হতভাগ্য কয়েকটি নাম। এদের মতো আরও অনেকে শিডিউলড কাস্ট পরিবার থেকে মেধার ভিত্তিতে উঠে আসা সত্বেও উচ্চবর্ণের সতীর্থদের অবহেলা, ঘৃণা, উপহাস সহ্য করতে না পেরে আত্মঘাতী হয়েছে। এইরকম বহু নাম সাম্প্রতিক কালে উঠে এসেছে দেশের সংবাদপত্রে। সংবেদী মানুষের মনে সাময়িক অসাড় তরঙ্গ তুলেই যে সংবাদ দৈনন্দিনতার মধ্যে হারিয়ে গেছে সহজে। সমাজ-কাঠামোয় এই বিষয়টি এমনই গুরুত্বপূর্ণ যে, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেছেন-
‘Incidents of suicides of students from marginalized communities are becoming common. These numbers are not just statistics. They are stories of centuries of struggle’. (D Y Chandrachud J).
উল্লেখিত নামগুলো নিয়ে আমাদের উদ্বেগের কারণ কী? এরা সকলেই সমাজের নিম্নবর্গীয় পরিবার থেকে উঠে আসা যুবক। এরা সকলেই মেধার জোরে, সরকারী নিয়মে শীর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে উচ্চশিক্ষায় নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। আর এরা সকলেই জাতপাতের বিচারে উচ্চবর্ণের সহপাঠীদের কাছ থেকে বৈষম্য, ঘৃণা, অবহেলা, অপমানের শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে, অথবা নিহত হয়েছে। সামূহিক প্রতিবাদ দাবী করে – এমন একটি বিষয়কে নিয়ে ‘রসিকার ছেলে’ উপন্যাসটি লিখেছেন প্রতিভা সরকার।
বাংলায় লেখালেখির জগতে গল্পকার প্রতিভা সরকার এখন সুপরিচিত এবং যথেষ্ট পাঠকপ্রিয়। গদ্যে যা বলার তা তিনি বলেন ঋজুভাবে। কখনও আখ্যানে পাঠক কাব্যময়তার স্বাদ পান। গল্পের পটভূমি সযত্নে সংগ্রহ করেন সমাজ, অর্থনীতি, পরিবেশ, অবক্ষয়ী রাজনীতির গহ্বর থেকে। সমস্ত রকম বঞ্চনাকে গল্পে উচ্চকিত করে পাঠককে আলোড়িত করার ক্ষমতা আছে প্রতিভার। তাঁর গল্প পাঠ করে বোঝা যায় যে প্রথমে তিনি একজন সচেতন সমাজবীক্ষক, তাঁর দ্বিতীয় পরিচয় তিনি সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট গদ্যশিল্পী।
আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে নিম্নবর্গের ছাত্রদের হত্যা-আত্মহত্যার যে সব ঘটনা ঘটে চলেছে তার সামান্যীকরণ (generalisation) করতে প্রতিভা বেছে নিয়েছেন কর্নাটকের একটি, অন্ধ্র প্রদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পূর্বভারতের খড়্গপুর আইআইটির একটি করে ঘটনা। কাহিনিতে রোহিত এসেছে রোশন নামে আর ফয়জান আহমেদ এসেছে শেখ ফয়জুল নামে। তৃতীয় ব্যক্তি ভেঙ্কটেশ। ভেঙ্কটেশ স্কলার হওয়ার পরেও সাড়ে তিন বছর গাইড পায়নি। অন্যান্য কারণ ব্যতিরেকে তাঁর বর্ণ-পরিচয় কী কোনো কারণ? পাঠকের মনে এই প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই দেখা দেয়। উপন্যাসে রোশন, ফৈজু বা ভেঙ্কটেশেদের বঞ্চনা মূল বিষয় হলেও বইটি শেষ করে পাঠকের মনে গভীর রেখাপাত করে রোশনের মা রসিকা। সেই হিসেবে গল্পগ্রন্থটির নামকরণ ‘রসিকার ছেলে’ ছাড়া আর কিছুই হতে পারত না।
এমন এক বেদনাদায়ক বিষয় নিয়ে গল্প পড়তে পাঠক কখনও মানষিক পীড়ায় ভোগেন না, কারণ প্রতিভার লেখার তারুণ্য আর কাব্যময় ভাষার ব্যবহার। একটি ছোট্ট নমুনা এই রকম-
"তখন সূর্য পাহাড়ের সবচেয়ে নীচু চূড়োটার মাথায় থ্যাবড়া মেরে বসে রয়েছে। যেন তার সেদিন বাড়ি ফেরার ইচ্ছে নেই, কিম্বা প্রচুর তাড়ি খেয়ে ব্যাটা নড়তে চড়তে পারছে না। পাহাড়ি মৌচাকে জমানো গাঢ়-মধুর মতো আলো চুইয়ে পড়ছে গোটা বনের ওপর, স্বর্ণচম্পার সোনালি রঙের সঙ্গে তার কোনো তফাত নেই। এইরকম আলোতে নাকি প্রাচীন মন্দিরের গায়ে খোদাই করা অপুর্ব দেব দেবীরা জ্যান্ত হয়ে আকাশ পথে ঘুরে বেড়ায়"।
প্রতিভা এমন একটি মনোরম দৃশ্যকল্প রচনা করেছেন এর অব্যবহিত পরেই একটি ঘৃন্য অপরাধের প্রিল্যুড হিসেবে।
-"দুহাতে ঢিবি আউলানো মাত্র বেরিয়ে এল একটা চার পাঁচ বছরের মৃত বাচ্চার মৃতদেহ। সারা গায়ে একটা সুতোও নেই। দেহের নানা লক্ষণ দেখেই বোঝে সিদ্ধা, বাচ্চাটাকে মানুষ-বাঘে খেয়েছে উলুতপুলুত করে চেটে। আশেপাশের কোনো গ্রাম থেকে তুলে নিয়ে এসেছিল আর কী!"
কাহিনির আগাপাশতলা বুঝিয়ে দেয় বাচ্চাটি কোনো এক দলিত পরিবারের। বুঝিয়ে দেয়, কারণ দেশ আর সময় যতই এগিয়ে যাক –
"অবস্থা খুব একটা পাল্টায়নি। গরীব গরীবই থেকে গেছে, বড়লোকেরা বড়লোক। জাতিবাদও তেমন রয়ে গেছে, শুধু বাইরে রূপটা পাল্টেছে। আগে তারা গ্রামের বাইরে থাকতে বাধ্য হত, এখন তারা গ্রামের ভেতরে আলাদা পাড়ায় থাকতে বাধ্য হয়। আগে জমিদার তাদের জুতোর ডগায় রাখত, এখন ভোটের সময় ছাড়া এমএলএ বাবুদের একই মূর্তি। দিন আর পাল্টাল কোথায়?"
এই যে দেশের সমাজ – তার সর্বোতকৃষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম হল দেশের আইআইটিগুলো। সেখানকার অন্দরমহলে চোখ রাখলে দেখা যায় –
"যারা পড়তে আসে তারা প্রায় সবাই সম্পন্ন পরিবারের সন্তান, পরিবার এবং ছাত্র হিসেবে নিজেদের স্ট্যাটাস নিয়ে অতিমাত্রায় সচেতন। তার মধ্যেই অনেক কারণে অনেকে কোণঠাসা। কারণগুলোও বিচিত্র, হয়তো কেউ সচ্ছল নয়, বা কোটায় পড়তে এসে মহা অপরাধ করে ফেলেছে। অথবা তার কোটায় পাবার অধিকার থাকলেও, নিজের মেধার জোরে সফল ছাত্রের তালিকায় নাম তুলতে পেরেছে, কিন্তু সে জাতিগত ভাবে কোটার ছাত্র, এইটা সে ছাড়া বাকি সবাই মনে রেখেছে"।
কেউ ইংরেজি মিডিয়ামে পড়েনি, পড়েছে আঞ্চলিক (vernacular) ভাষামাধ্যমে- যাদের ডাকনাম ভার্নু, কেউ বেজায় কালো, কেউ মেদবাহুল্যে পৃথুল। শুধু এইটুকুই কি শীর্ষ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোর সবটুকু কাহিনি?
–"এত বিভেদের মাঝে যে মহান মিলন নিজের বর্ষামুখ উঁচিয়ে থাকে, তাঁকে কাচে মোড়ানো লম্বা ডাইনিং হলটার সারা গা থেকে ঠিকরে বেরোতে দেখা যায়। তবে অবশ্যই দূর থেকে। রাতে দূর থেকে দেখলে অগুনতি হাজার ওয়াটের বাতি, ভেতরে সারি সারি চেয়ার টেবিল, ছেলেমেয়েরা খাচ্ছে, গল্প করছে, ঢুকছে, বেরোচ্ছে, স্টিলের থালায় চামচের আওয়াজ, গানের কলি, হাহা অট্টহাসি। মিলে সুর তুমহারা!
অন্ধকার মাঠে দাঁড়িয়ে ওটার দিকে তাকালে মনে হয় বিরাট আলো ঝলমলে স্পেশশিপ একটা, অন্ধকারে পথে ভুলে নেমে এসেছে, ভেতরে গিজগিজ করছে অন্য গ্রহের বাসিন্দা! তবে হ্যাঁ, দূর থেকেই। কাছে গেলেই নজরে পড়তে পারে এ ওর পাশে বসে খাবে না বলে থালা নিয়ে উঠে গেল, … মোদ্দা কথা, অন্য গ্রহ থেকে আসা
ঐ স্পেশশিপের মধ্যে ঠাসা রয়েছে এক টুকরো অক্ষয় ভারতবর্ষ। খাবার থালাতে যার মহত্তম প্রকাশ"।
এমন মোচড়ের ম্যাজিক যে উপন্যাসে, তা পাঠককে কি মুগ্ধ করবে না? উপন্যাসের কাহিনি কেবল পাটা ন্যারেটিভ হয়ে থেকে গেলে একরকম হত। প্রতিভা ‘রসিকার ছেলে’ উপন্যাসে ম্যাজিক রিয়ালিজমের চমৎকার ব্যবহার করেছেন। দলিত ছাত্রদের প্রতিবাদে সমাজ-সংসার আশ্চর্যজনকভাবে উদাসীন। শীর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও অন্যায় আর বিদ্বেষের আবহে অপরিসীম শৈত্য বইছে যেন।
"… সামনেই সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা প্রশাসনিক ভবনটা বরফে মোড়া! দূরে লাইব্রেরিটাকে মনে হচ্ছে একটা সাদা অতিকায় পাহাড়! … রোশন স্টাডি সার্কেলে বলেছিল, কিন্তু এখন মানুষের মনের অনেক গভীরে ঢুকে পড়েছে সেই ভয়াবহ শৈত্য। সবাই এখন তুষার যুগে বাস করছি আমরা। শরীর উষ্ণ, ভেতরে হৃদয় মরে কাঠ, বরফের মতো ঠান্ডা"।
এই যে ‘রসিকার ছেলে’ উপন্যাসে নায়িকার ভূমিকায় উঠে আসা রসিকা – কেমন মেয়ে সে?–
"ডেইলি ওয়জ লেবারদের বাচ্চারা প্রায়ই বড় রাস্তায় খেলতে খেলতে গলিটায় ঢুকে পড়ে। নাকে শিকনি গড়ানো, হাতে পায়ে ধুলো কালিমাখা যতো হাভাতের দল। রসিকাই একমাত্র অন্যরকম। গায়ের রঙ ফর্সা, ধনী বাড়ির মেয়েদের মতো, আর কী শান্ত! … রসিকার পড়া ইলেভেনের পর আর না এগোলেও ঘরের কাজকম্মো, রান্নাবান্নায় সে পোক্ত… রান্না করে সবাইকে খেতে দিয়ে, এঁটো স্টিলের বাসন রূপোর মতো ঝকঝকে করে মেজে, সীতালক্ষ্মীর খোঁপায় পরবার মালা গেঁথে, পাথরের বাটিতে সেটা জলে ভিজিয়ে রেখে, সিঁড়ির নীচের ভাঁড়ার ঘরে ঢুকে শোবার কাঠের চৌকিতে উপুর হয়ে রসিকা কবিতা লিখত"।
রসিকার মুখে কিছু কবিতাও পাঠক পড়বেন ‘ব্রহ্ম রাক্ষসের লোভ’, ‘ইয়েলাম্মার সন্তানসন্ততি’ অধ্যায়ে। বোঝাই যায় কবিতাগুলি প্রাসঙ্গিকতা অনুসারে লিখেছেন ঔপন্যাসিক নিজেই। তাঁর কলম অনাবিল গদ্য উগড়ে দিলেও, তাঁর মনে যে একজন কবি প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে, পাঠকের বুঝতে অসুবিধে হয় না। এইজন্যই প্রতিভার প্রতিবাদী কাহিনির ভাষাও দুরন্ত কাব্যময় হয়ে উঠতে পারে।
রসিকাকে লেখিকা কীভাবে তৈরি করেছেন? না, ভেঙে পড়া একজন সন্তানহারা, দলিত সন্তানের মা নয়। সন্তানের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর পরেও একজন লড়াকু মা হিসেবে গড়ে উঠেছে চরিত্রটি। ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসের পাভেলের মায়ের মতো। গল্পগ্রন্থের শেষ গল্প ‘রসিকার জীবন’ থেকে দেখা যাকঃ
-"আপনি দেখছি খুব সাহসী মহিলা। শুনেছি রোশনও খুব সাহসী ছিল। এই সাহস কি সে আপনার কাছ থেকে পেয়েছিল?"
-ছেলের রক্তাক্ত মৃতদেহ যে মা নিজের চোখে দেখেছে, তাঁর সাহসের সঙ্গে তুলনা হতে পারে শুধু আহত বাঘিনীর। আগের আমি আর এই আমি, দুজনের মধ্যে কোনো মিল নেই।
এবার টিভি ক্যামেরাম্যানের পাশ থেকে মুখ বার করে মাথের পেছনে ঝুঁটি বাঁধা ছেলেটি রসিকাকে জিজ্ঞেস করে,
আপনি কি সত্যি বিশ্বাস করেন, এইভাবে দৌড়োদৌড়ি করে, কয়েকজনকে নিয়ে মিছিল করে, দুচাট্টি আন্দোলন আন্দোলন খেলা করে আপনা রাষ্ট্র, সরকার, প্রশাসনের ক্ষমতাবানদের কাছ থেকে সুবিচার আদায় করতে পারবেন? সিস্টেমে আনতে পারবেন কোনও পরিবর্তন? …
"মুখ ফিরিয়ে সাংবাদিক ছেলেটির চোখে চোখ রেখে বলল,
-আপনি ভেবেছেন আমি আন্দোলন করি, মিছিলে যাই, মিটিং-এ বক্তব্য রাখি, সন্তানহারা মায়ের হাত ধরে লাশকাটা ঘরে দাঁড়িয়ে থাকি, এই দুর্নীতিবাজ শক্তিধরদের মন পরিবর্তনের জন্য? রাষ্ট্রযন্ত্রের মন বলে কিছু থাকে?
আপনি একেবারেই ভুল ভেবেছেন বাবা। আমি এগুলো করি অন্যকে পরিবর্তনের জন্য নয়, আমি নিজেই যাতে পরিবর্তিত না হয়ে যাই, সেই জন্য। … "
প্রতিভা সরকার গল্প উপন্যাস লেখেন পাঠককে ভুলিয়েভালিয়ে মোহাবিষ্ট করে রাখতে নয়। চরিত্রগত ভাবে একজন পরিবেশ-কর্মী, মানবতাবাদী, নারীবাদী সংবেদনশীল লেখিকা হিসেবে পাঠককে ভাবিয়ে তোলাই প্রতিভার ‘হিডন এজেন্ডা’। সমাজের সমস্ত স্তরে জমাট বাঁধা অন্যায়ের বিরুদ্ধে পাঠক-সমাজকে মনে মনে আন্দোলনের ভাগীদার করে তোলাই প্রতিভার উদ্দেশ্য। ‘রসিকার ছেলে’ উপন্যাসে প্রতিভা সে ব্যাপারে সফল।
হাজার হাজার বছরের সামাজিক বিভাজন জনিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রযন্ত্র উদাসীন। রসিকা আমাদের শেখায় যে, এই নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তির পথ ভেঙে পড়া নয়, ধারাবাহিক আন্দোলন আর জনসচেতনতা সৃষ্টি। নিপীড়ণ আর বঞ্চনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের ভেতরের আগুনটুকু জ্বালিয়ে রাখতে হবে নিরন্তর, যতদিন না বাইরেটার বদল হচ্ছে। রসিকা শেখায় মর্যাদা কোনও মাধুকরী নয়। মাথা ঊঁচু করে, মেরুদণ্ড টান টান করে রাষ্ট্র-ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার দায় আসলে বঞ্চিতদের ওপরেই বর্তায়।
পাঠশেষে বোঝা যায় উপন্যাসটি লেখার পেছনে বিস্তৃত সাজঘরের কাজ করতে হয়েছে লেখিকাকে। জানতে হয়েছে শীর্ষ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলির ভিতরের কথা। বুঝতে শিখতে হয়েছে দলিত পরিবারের জীবনধারা, অল্পবিস্তর দক্ষিণ ভারতের ভাষা। বাস্তব খুঁটে তথ্য সংগ্রহ করে তার ওপরে কোথায় কতখানি কল্পনার মিশেল ঘটেছে, তা পাঠকের কাছে প্রহেলিকা হয়ে থেকে যায়।
‘রসিকার ছেলে’ উপন্যাসটি দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় অনুবাদ করা হলে সমাজবিজ্ঞানের কিছু উপকার হতে পারত। জাত-পাতের রাজনীতির বিরুদ্ধে জন-জাগরণে মৃদু তরঙ্গ উঠলেও উঠতে পারত। বইটির ইংরেজি অনুবাদ করবেন, প্রকাশ করবেন, বৃহত্তর আঙিনায় পাঠকের হাতে তুলে দেবেন – এমন প্রকাশনা সংস্থা কবে উদ্যোগ নেবে জানা নেই। এনবিটি বা সাহিত্য অকাদেমী কি এগিয়ে আসবে?
‘রসিকার ছেলে’ প্রকাশিত হয়েছে গুরুচন্ডালী থেকে। চটি সিরিজের বই হিসেবে। গুরুচন্ডালী ট্রাস্ট বুক বাজিয়ে বলে –‘ঘ্যামা ঘ্যামা বইয়ের বড় বড় ব্যাপার। যেমন গড়ন তেমনি দাম। ওদিকে নজর না দিয়ে আমরা বানিয়েছি সস্তা কাগজের চটি বই, যা সুলভ ও পুষ্টিকর’। যাঁরা বইয়ের সংগ্রাহক, পাঠক – অথচ পকেটে রেস্ত কম- তাঁদের পক্ষে দাঁড়িয়ে এই ইশতেহার প্রকাশনার দুনিয়াকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে বইয়ের উচ্চমূল্য প্রকাশনা সংস্থা ও পাঠকের মধ্যে প্রাচীর হয়ে উঠছে ক্রমশ। অন্ন, বস্ত্র সবকিছুরই মূল্য ক্রমবর্ধমান। বইয়ের দাম যে বাড়বে এতে আর আশ্চর্যের কী আছে? তবে পাঠকের বেঁচে থাকার জন্য প্রাথমিক চাহিদা অন্ন বস্ত্রের সংকুলান করে উদবৃত্তটুকু নিয়ে আসেন বই কিনতে। বই সুলভ হলে আরও দু-খানা বই কিনতে পারে্ন পাঠক।
আট ফর্মার বইটির বিনিময় মূল্য একশ’ পঞ্চাশ টাকা মাত্র। বইটি অবশ্যই সংগ্রহযোগ্য।