শঙ্করীপ্রসাদ বসু ছিলেন পেশায় অধ্যাপক। নেশায় বিবেকানন্দ গবেষক। সাত খণ্ডে "বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ" গ্ৰন্থ রচনার জন্য তিনি সাহিত্য আকাদেমী পুরস্কারে সম্মানিত হন। একদা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শঙ্করীপ্রসাদ দীর্ঘদিন ওখানে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করে অবশেষে নয় বছর বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করে অবসর নেন। গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচারে ১৯৯৫তে স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কিত আর্কাইভের জন্মলগ্ন হতে আমৃত্যু সংযুক্ত ছিলেন। হয়েছিলেন সেই আর্কাইভের ডিরেক্টর। ডঃ নিমাইসাধন বসুও একজন ঐতিহাসিক, শিক্ষাবিদ। মাধ্যমিকে ওনার ইতিহাস বই পড়েছি। সাবলীল ভাষা, সুন্দর বিষয় বিন্যাস, আকর্ষণীয় উপস্থাপনা, ঝকঝকে ছাপার বইটি ছিল আমার খুব প্রিয়। ডঃ ভোলানাথ চক্রবর্তী ছিলেন এক প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথ। রাষ্ট্রপতি, রাজ্যপালের চিকিৎসার জন্যও ওনার ডাক পড়তো।
উপরোক্ত তিন বিখ্যাত ব্যক্তিত্বই ১৯২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হাওড়া বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশন নামক স্বনামধন্য বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। ১৯৫৬ সালে সেই বিদ্যালয়ের উচ্চমাধ্যমিক শাখার ভবনটির উদ্বোধন করেন আর এক মহান ব্যক্তিত্ব - তদানীন্তন রাজ্যপাল ডঃ হরেন্দ্রনাথ মুখার্জী। মণিশংকর মুখোপাধ্যায় বা জনপ্রিয়, সাহিত্য আকাদেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক - শংকরও ছিলেন বিবেকানন্দ ইন্সটিটিউশনের ছাত্র। বয়সে ৫ বছরের অগ্ৰজ বিবেকানন্দ স্কুলের শঙ্করীপ্রসাদ শংকরকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহভরে তুই তোকারি করতেন। লেখার ব্যাপারে উৎসাহ, তথ্য, পরামর্শ, দিশা জুগিয়েছেন। অবশ্য শংকর তাঁর স্বভাবজ বিনয়ে অনেক অগ্ৰজ লেখকের স্নেহভাজন ছিলেন - যেমন বিমল মিত্র। শংকরের প্রথম বই "কত অজানারে" ও দ্বিতীয় বই "চৌরঙ্গী" প্রকাশের পর শঙ্করীপ্রসাদ অনুজ শংকরকে পরামর্শ দিয়েছিলেন - হাইকোর্টের অভিজ্ঞতা, হোটেলের আখ্যান তো হোলো - এবার নতুন কোনো বিষয়ে লেখ্। দীর্ঘ এক বছরের প্রচেষ্টায় শংকর লিখলেন - "নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরি"।
২০২২ এর সেপ্টেম্বরে - "শারদীয়া বর্তমান" ১৪২৮এ প্রকাশিত শংকরের একটি বিশেষ রচনা - "কেমনে তোমারে ভুলি?" পড়ে বেশ লাগলো। নানা অজানা বিষয় জানলাম। যেমন ঐ নিবন্ধের কেন্দ্রীয় বাস্তব চরিত্র - বশী সেনের আদলেই নির্মিত হয়েছিল নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরি উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র - বিজ্ঞানী জীমূতবাহন সেন।
শংকরের এই বিশেষ রচনার চরিত্র - বিশ্ববিখ্যাত কৃষিবিজ্ঞানী
বশীশ্বর সেন - আদিতে বিষ্ণুপুর নিবাসী বশী সেন। হায়! এনার প্রেক্ষাপট, কর্মকাণ্ড তো দুরের কথা - ২০২২এ শংকরের লেখাটি পড়ার আগে অবধি আমি ওনার নাম পর্যন্ত শুনিনি। কী লজ্জা! শংকরের লেখায় ওনার সম্পর্কে অনেক কথা জানলাম - যেমন কীভাবে লেওনার্ড এলমহার্স্ট বারংবার ওনাকে নানাভাবে আর্থিক সাহায্য করেছেন। কেমব্রিজ ও কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত এই বিশ্ববিখ্যাত ব্রিটিশ কৃষিবিজ্ঞানীর কথা অবশ্য কিছুটা জানা ছিল। জানতাম তিনি শান্তিনিকেতনে বেশ কিছুদিন থেকে রবীন্দ্রনাথের আশ্রমে কাজ করেছেন, সেখানে স্থাপনা করেছেন Institute of Rural Reconstruction.
শংকরের ঐ লেখায় মহান বিজ্ঞানী আচার্য্য জগদীশ চন্দ্রের কিছু চারিত্রিক ক্ষুদ্রতা জেনে দুঃখ পেলাম। বশী সেন তাঁর সাহায্যকারী হিসেবে বারো বছর কাজ করে একদিনও ছুটি নেননি - কিন্তু ছোট ভাই সতীশ্বরের প্রবল অসুস্থতার জন্য একটি রবিবার না আসায়, আচার্য্য বিরক্তি প্রকাশ করলেন। বশী সেন তিন বছরের মেহনতে তৈরী করে তাঁর মৌলিক গবেষণার খসড়া দেখতে দিয়েছিলেন জগদীশ চন্দ্রকে। মহান আচার্য্য বশী সেনের নামোল্লেখ অবধি না করে তা বিদেশের জার্নালে নিজের নামে ছাপিয়ে দিলেন!
অন্য লেখাতে পড়েছি সমসাময়িক ঋষিপ্রতিম বিজ্ঞানী আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের প্রকাশিত গবেষণাপত্রে সেই গবেষণায় তাঁর সহকারীদের নামও থাকতো। জগদীশ চন্দ্রর তেমন সৌজন্যবোধ, মানবিক উদারতা ছিল না। তাই জগদীশ চন্দ্রের র প্রকাশিত গবেষণা পত্রে তাঁর বিশেষ সহকারীদের নামও থাকতো না।
একবার আমেরিকান গবেষক গ্ৰেন ওভারটন বশীকে এক বছরের জন্য সহকারী হিসেবে নিয়ে যেতে চাইলেন। বশী আচার্য্যর কাছে এক বছরের ছুটি চাইলেন। বিরক্ত হয়ে আচার্য্য বসু বললেন -"যদি তোমার এখানে কাজ করতে ভালো না লাগে তাহলে যেখানে খুশী যেতে পারো"। একযুগ ধরে নিরলস কর্মসেবার যোগ্য পুরস্কার!
চলে গেলেন বশী আমেরিকায়। তবু বশী যে দুজন মানুষের শতায়ু কামনা করতেন - তাঁদের একজন রবীন্দ্রনাথ। অন্যজন জগদীশ চন্দ্র। এতেই 'সদানন্দর কুত্তা' বশীশ্বর সেনের মহানুভবতা উপলব্ধি করা যায়।
বিবেকানন্দ যখন স্বামীজী হয়ে বিশ্ববিখ্যাত হননি, সেই তখন যে মানুষটি নির্দ্বিধায় এক অচেনা রমতা যোগীর শিষ্যত্ব গ্ৰহণ করে হেলায় উত্তরপ্রদেশে হাতরাশ স্টেশনের রেল কর্মচারীর চাকরি ছেড়ে বিবেকানন্দর সাথে অনির্দিষ্ট সন্ন্যাসযাত্রায় পথে নামেন - স্বামীজীর সেই প্রথম শিষ্যই সদানন্দ। পরে বশী সেন শিষ্যত্ব গ্ৰহণ করেন সদানন্দর। বশীদের বিষ্ণুপুরের নিবাসে স্বামী সদানন্দ এসেছেন, থেকেছেন। বশী পেয়েছেন গুরুসেবার সুযোগ। মৃত্যুর আগে বশীশ্বর, ভাই মতীশ্বর ও বশীর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের সহপাঠী বিভূতি ঘোষকে সদানন্দ সস্নেহে বলেছিলেন - "যা শালারা ডালকুত্তা রেখে গেলাম - তোদের কিছু করতে পেরেছি কী পারিনি জানি না - তোদের কর্তার (স্বামীজীর) সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি"। আজীবন বশী তাই তাঁর গুরু সদানন্দর কুকুর হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেছেন।
আমেরিকা থেকে ফিরে বশী পুনরায় আচার্য্য জগদীশ চন্দ্রের কাছে বসু বিজ্ঞান মন্দিরে যোগ দিতে চাইলেন। ইচ্ছা প্রকাশ করলেন আচার্য্য একটি ঘর দিলে বশী নিজের মতো কিছু গবেষণা করতে পারেন। আচার্য্য বশীর ইচ্ছায় সাড়া দিলেন না।
তখন বশী কলকাতায় তাঁদের আট নম্বর বোসপাড়া লেনের ছোট্ট বাড়ির রান্নাঘরে স্থাপনা করলেন - "বিবেকানন্দ ল্যাবরেটরি"। ঐ বাড়িতেই ১৯১১তে দেহাবসানের আগে অবধি বশী ও ভাই মতী দু বছর তাঁদের মৃত্যুপথযাত্রী গুরু সদানন্দর সেবা করেছেন। মৃত্যুর পর দোতলায় সদানন্দর স্মৃতি রক্ষিত। একতলায় একটিমাত্র কক্ষ। তাই রান্নাঘরে দুটি চাকা লাগানো বাক্সের ওপর শুরু হোলো ল্যাবরেটরির কাজ। রাতে যন্ত্রপাতি সরিয়ে ওটাই শোয়ার জায়গা।
আচার্য্য জগদীশ চন্দ্র পিছিয়ে গেলেও এহেন অভিনব বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টায় এগিয়ে এলেন অন্য অনেকে। যেমন বিবেকানন্দের আমেরিকান বন্ধু (হ্যাঁ, তিনি নিজেকে স্বামীজীর শিষ্যার বদলে বন্ধুই ভাবতেন) যোশেফিন ম্যাকলাউড। বিবেকানন্দে নিবেদিতপ্রাণা এই মহিলা বহুভাবে অর্থসাহায্য করে গেছেন। বেলুড় মঠের স্থাপনাতেও তাঁর আর্থিক সাহায্য ছিল। এগিয়ে এলেন শিল্পী নিকোলা বোয়েরিস, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভারতীয়। এবং আবার সেই লেওনার্ড এলমহার্স্ট! তিনি বিনামূল্যে কিছু যন্ত্রপাতি পাঠানো ছাড়াও নিয়মিত বশীকে ডলার পাঠাতেন। লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি পাঠাতো বছরে সত্তর পাউন্ড অনুদান।
পরে সেই ল্যাবরেটরি স্থানান্তরিত হয় আলমোড়ার কুন্দন হাউসে। ১৯৪৩এর দুর্ভিক্ষ দেখে বিচলিত বশী উচ্চফলনশীল বীজের গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। আজও উইকিপিডিয়া খুললে দেখা যাবে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সময়ে পাঞ্জাবে যে সবুজ বিপ্লবের শুরুয়াৎ হয়েছিল - তার রূপকার ছিলেন কৃষি বিজ্ঞানী এম এস স্বামীনাথন - সেই এন্ট্রিতে বশী সেনের কোনো উল্লেখ অবধি নেই। কিন্তু স্বামীনাথন জানতেন বশী সেনের বৈজ্ঞানিক অবদান। মান্য করতেন তাঁকে। বশী সেন সম্পর্কে লিখিত গিরিশ মেহরার গ্ৰন্থের ভূমিকায় স্বামীনথন কৃষিবিপ্লবে বশী সেনের অবদান কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে লিখেছেন - one of the greatest classics of our time.
বশী সেনের সাথে নেহরুর সুসম্পর্ক ছিল। ১৯৫৭ সালে বশী পদ্মভূষণ উপাধি পান। ১৯৫৯ সালে উত্তরপ্রদেশ সরকার হাবালবাগে কৃষি গবেষণার জন্য বিবেকানন্দ ল্যাবরেটরিকে ২১৫ একর জমি দান করে। বশীর মৃত্যুর পর ইন্দিরা গান্ধীর উদ্যোগে সেই ল্যাবরেটরি একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে সংযুক্ত হয় ভারতীয় কৃষি গবেষণা কেন্দ্র - ICAR বা Indian Council of Agricultural Research এর সাথে। তখন ICAR এর ডিরেক্টর ছিলেন স্বামীনাথন। বশীর অনুরোধ ছিল ল্যাবরেটরির জন্মলগ্ন থেকে জড়িত "বিবেকানন্দ" নামটি যেন বাদ না যায়। কথা রেখেছিলেন স্বামীনাথন। বশী সেন স্থাপিত সেই গবেষণাগারের নাম হয় - "বিবেকানন্দ পার্বত্য কৃষি অনুসন্ধান সংস্থান"।
শংকরের সেই লেখাতেই পড়েছিলাম এমন একটি বৈজ্ঞানিক তথ্য যা সেযাবৎ ছিল আমার অজানা। ইলেকট্রিসিটি, কম্প্রেসর ছাড়াই শূণ্য ডিগ্ৰি অবধি তাপমান নামিয়ে দিতে সক্ষম ১৯২০ দশকের এক গুপীযন্ত্র - কেরোসিন রেফ্রিজারেটর! মৃত্যুর চার বছর আগে রবীন্দ্রনাথ বশী সেনের আমন্ত্রণে আলমোড়ায় এসে কিছুদিন ছিলেন। তাঁর জন্য ভাড়া নেওয়া হয়েছিল সেন্ট মার্কস ভবন। বিবেকানন্দের মতো রবীন্দ্রনাথও ছিলেন আইসক্রিমের ভক্ত। আলমোড়ায় কবির সেই বাসভবন থেকে মাঝে মাঝে ডাণ্ডিতে করে নিয়ে আসা হোতো বশী সেনের গবেষণাগার কাম বাসস্থান কুন্দন হাউসে। কেরোসিন ফ্রীজে জমানো আইসক্রিম তৃপ্তি সহকারে খেতেন কবি।
জানলাম বশী সেন ছিলেন এক বিশেষ ধরণের বডি ম্যাসাজে দক্ষ। বশী সেন দিল্লিতে গেলে নিদ্রাহীনতায় আক্রান্ত জহরলালের কপালে ম্যাসাজ করে দেওয়ার জন্য কখনো তিনমুর্তি ভবনে সাদর ডাক পড়তো বশীর। তাঁর আঙুলের জাদুচলনে অচিরেই ঘুমিয়ে পড়তেন নেহরু।
এমনই সব নানা বিষ্ময়কর, অজানা তথ্যের খাজানা শংকরের ঐ লেখাটি। এমন লেখা পড়ে সেই পাঠানন্দ নিজের মধ্যে রেখে দেওয়া মুশকিল। তাই তার কিছু নির্যাস এখানে শেয়ার করলাম।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।