এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • ময়ূরঝর্ণা - পর্ব ৬ 

    বিতনু চট্টোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ২২ ডিসেম্বর ২০২৩ | ৭২৮ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • অরিন্দমের কথা শেষ হলে বলতে শুরু করল অনিরুদ্ধ।
    ‘সেটা ২০০০ বা ২০০১ সাল হবে, আমি ঝাড়গ্রামে পোস্টেড। ওখানে জয়েন করার পর আমরা মূলত বেলপাহাড়ির বিভিন্ন গ্রামে ভিজিট করতে শুরু করলাম। তখন কিন্তু ওই এলাকায় এমসিসি’র অ্যাক্টিভিটি জোর কদমে শুরু হয়ে গিয়েছে, কিছু বড় ঘটনা ঘটছিল না বলে বিষয়গুলো সেভাবে প্রচারে আসেনি। বাইরের লোকজনের মুভমেন্টের খবর প্রায়ই আসছিল, যার জন্য গ্রামে ভিজিট করতাম। ভোর পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটা নাগাদ এক একটা গ্রামে পৌঁছে যেতাম। পায়ে হেঁটে জঙ্গলে ঢুকতাম, জঙ্গল লাগোয়া গ্রামে যেতাম। মানুষের সঙ্গে কথা বলতাম। একদিন এরকম একটা গ্রামে ঢুকছি, দেখি জঙ্গল থেকে একটা ন’দশ বছরের বাচ্চা ছেলে বেরিয়ে আসছে। ছেলেটার মাথায় অনেক কাঠ। জঙ্গলটা যেখানে শেষ হচ্ছে তারপর একটা মাঠ, তারপর গ্রাম শুরু হচ্ছে। বুঝলাম ছেলেটা খুব ভোরে উঠে জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে গিয়েছিল। ছেলেটাকে থামতে বললাম। বলল, রোজ সকালে জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে যায়। এখন বাড়ি ফিরে স্কুলে যাবে। জিজ্ঞেস করলাম, কী খেয়ে স্কুলে যাবি? কিছু বলে না। তারপর বলল কোনও দিন মুড়ি, কোনও দিন কিছুই না। ছেলেটাকে দেখে খুবই খারাপ লাগছিল, দুর্বল চেহারা, কোন ভোরে উঠে কাঠ কুড়োতে বেরিয়েছে, এরপর স্কুলে যাবে। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ, ছেলেটার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললাম। তারপর একটা কাগজে ঝাড়গ্রামে আমার অফিসের ফোন নম্বর লিখে ওর হাতে দিলাম। বললাম যদি কখনও ঝাড়গ্রামে যায় আমার অফিসে যেতে বা কোনও দরকার হলে যেন ফোন করে।’
    ‘ফোন নম্বর দিলেন কেন? এটা কি সবাইকে দিতেন?’ অনিরুদ্ধকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল অরিন্দম।
     
    ‘সবাইকে না হলেও অনেককেই দিতাম। আমি দেখেছি গ্রামের লোকের কোনও কিছু দরকার থাকলে কোথায় জানাবে, কীভাবে জানাবে তাই বুঝতে পারে না। তাছাড়া সেই সময় আমরা চাইছিলাম গ্রামে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করতে। যত লোকের কাছে আমাদের নম্বর থাকবে তত ভালো। কিন্তু ওই ছেলেটার ব্যাপারটা আলাদা ছিল। অতটুকু বাচ্চা ছেলে, দেখে খারাপই লাগছিল। তাই ভাবলাম, যদি ওর কোনও কাজে লাগে। এরপর ছেলেটার কথা একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম। এর বছরখানেক পর হবে, একদিন দুপুরে কোয়ার্টারে আছি। সম্ভবত কোনও ছুটির দিন ছিল বা দুপুরে অফিস থেকে কোয়ার্টারে গিয়েছিলাম। তিনটে-সাড়ে তিনটে হবে, কনস্টেবল এসে খবর দিল, আমার সঙ্গে দেখা করতে বেলপাহাড়ি থেকে একটা বাচ্চা ছেলে এসেছে। বেলপাহাড়ি শুনে ছেলেটাকে আমার কোয়ার্টারে নিয়ে এসেছে। বাচ্চা ছেলে শুনে বললাম পাঠিয়ে দিতে। ঘরে ঢোকার পর প্রথমে চিনতে পারিনি, ছেলেটা আরও লম্বা হয়েছে। ঘরে ঢুকে আমার হাতে লেখা কাগজটা দেখাল। বলল, আমি বলেছিলাম ঝাড়গ্রামে এলে দেখা করতে। তখন মনে পড়ল। ছেলেটা বসল, তারপর বলল, স্কুলের তিন বন্ধুর সঙ্গে ঝাড়গ্রামে এসেছিল বই কিনতে। বেলপাহাড়ির বাস ছাড়তে কিছু দেরি আছে, বন্ধুরা বাস স্ট্যান্ডে আছে। ও এসেছে আমার সঙ্গে দেখা করতে। বসতে বললাম। বলল, বসবে না, সময় নেই। আমার অফিসে গিয়েছিল, এখনই বাস স্ট্যান্ডে না গেলে দেরি হয়ে যাবে। বেলপাহাড়ির লাস্ট বাস মিস হয়ে গেলে আর বাড়ি ফিরতে পারবে না। স্ত্রীকে গিয়ে বললাম ছেলেটাকে কিছু খাবার দিতে। দেখি বাড়িতে তেমন কিছুই নেই দেওয়ার মতো। মহা বিপদ, দোকান থেকে কিছু কিনে আনারও সময় নেই। টেবিলের ওপর দুটো আপেল ছিল। একটা ওর হাতে দিলাম। এরপর যা ঘটল তা আপনি ভাবতে পারবেন না। ছেলেটা হাত বাড়িয়ে আপেলটা নিল, তারপর দেখি আপেলটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। আমি বললাম, কী হল, এটা খেয়ে নে। ছেলেটা বলল, এটা কী? ওর প্রশ্ন শুনে আমি তো অবাক। আমি স্ত্রীর দিকে তাকালাম, স্ত্রী আমার দিকে। আমরা দুজনেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না একটা দশ বছরের বাচ্চা আপেল চেনে না। তারপর আপেলটা হাতে নিয়ে ছেলেটা বেরিয়ে গেল। আমরা দু’মিনিট কোনও কথা বলতে পারিনি ঘটনাটা দেখে।’ টানা বলে থামল অনিরুদ্ধ। তারপর বলল, ‘তাহলে ভাবুন সেই সময় কী অবস্থা ছিল বেলপাহড়ির!’
     
    অনিরুদ্ধর বলা ঘটনাটা পাল্টে দিল ঘরের পুরো পরিবেশ, আর সেই পাল্টে যাওয়াটা ঠিক কেমন, তা এই ময়ূরঝর্ণা যে লিখছে তার পক্ষে লিখে বোঝানো সম্ভব না, সে দক্ষতা তার নেই। মোট কথা, ওপর থেকে দেখলে মনে হবে, একটু আগেও ঘরের পরিবেশটা যেমন ছিল, তেমনই আছে। আসলে কিন্তু তা নেই। হঠাৎই অরিন্দম বুঝতে পারল, সব কিছু আগের মতো নেই। সে বিশ্বাসই করতে পারছে না, একটা দশ বছরের বাচ্চা আপেল চেনে না। এমনও নয়, ঘটনাটা পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের। মাত্র পনেরো বছর আগে বেলপাহাড়ি এমন ছিল যে, একটা দশ বছরের বাচ্চা কোনও দিন আপেল খাওয়া তো দূরের কথা, তা দেখেইনি চোখে! একথা ঠিক অরিন্দম সারা জীবনই জানত, আপেল বড়লোকের ফল। গরিবের ফল পেয়ারা। একথাও ঠিক, ওই বয়সে সেও আপেল খুব একটা খেত না। কিন্তু তা বলে একটা দশ বছরের ছেলে আপেল চিনবে না! কোন  দুনিয়ায় ছিল বেলপাহাড়ি?
    অরিন্দম প্রশ্নটা করেই ফেলল অনিরুদ্ধকে, ‘আমি প্রথমবার বেলপাহাড়ি গিয়েছিলাম ২০০৬ সালে। ওখানে হাতিডোবা নামে একটা গ্রাম আছে, সেখানে একটা বিস্ফোরণ হয়েছিল, তখন। যদিও মাত্র দু’দিন ছিলাম। কিন্তু বেলপাহাড়ি বাজার, থানার সামনে দোকানপাট দেখে মনে হয়নি, তার মাত্র কয়েক বছর আগে ওখানে এমন গ্রামও ছিল যেখানে দশ বছরের ছেলে আপেল চিনবে না!’
     
    ‘দেখুন, আমি যখন বেলপাহাড়ি প্রথম গেলাম, আমি অন্তত চোখে দেখে বিশ্বাস করতে পারিনি এত গরিব এলাকাও হয়। কোনও জায়গার বেশিরভাগ মানুষই গরিব, কিছু মানুষ মধ্যবিত্ত, সামান্য কয়েকজন বড়লোক, এটাই স্বাভাবিক অবস্থা ছিল পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু বেলপাহাড়িতে গিয়ে যা দেখলাম তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। গ্রামের পর গ্রামে মানুষের চরম দুর্দশার ছবি। খাবার নেই, জল নেই, আলো নেই, চিকিৎসা ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। মানুষগুলো কীভাবে বছরের পর বছর বেঁচে আছে, এটা ভেবেই আমি অবাক হতাম মাঝে মাঝে। আমি যখন ওখানে গেলাম, শুনলাম প্রচণ্ড ম্যালেরিয়া হয়। বেলপাহাড়িতে একটা স্বাস্থ্য কেন্দ্র ছিল, তার পরের স্বাস্থ্য কেন্দ্র ঝিলিমিলি, মানে বাঁকুড়া বর্ডার। জ্বর হলে কেউ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যেত না। টাকাও ছিল না যাওয়ার, পরিবহণ ব্যবস্থাও ছিল না বললেই চলে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোক থেকে মাঝে মধ্যে গ্রামে ঘুরে ঘুরে ব্লাড স্যাম্পেল কালেক্ট করত। কিন্তু যখন সেই রিপোর্ট আসত, তখন ওই লোক হয় ম্যালেরিয়ায় মরে গিয়েছে, নয়তো জ্বর সেরে গিয়েছে। লোক জানতেও পারত না কেন মরে গেল।’
    আরও কিছুক্ষণ একথা-সেকথা বলে অনিরুদ্ধর ঘর থেকে বেরোল অরিন্দম। সন্ধে হয়ে গিয়েছে, অফিস যেতে হবে। অরিন্দম অফিসে ফিরল, অন্যান্য দিনের মতো সব কাজ করল, এর-ওর সঙ্গে গল্প করল, তারপর নির্দিষ্ট সময়ে বাড়িও ফিরে গেল। সব কিছু তো অন্য দিনের মতো স্বাভাবিকই আছে, তবু অরিন্দমের মনে হচ্ছে, কিছুই আগের মতো নেই। অনিরুদ্ধর বলা ঘটনাটা হঠাৎ করেই ওলটপালট করে দিয়েছে সব কিছু। সারাক্ষণ অরিন্দমের মাথায় ঘুরছে শুধু বাচ্চা ছেলেটার একটা সম্ভাব্য মুখ। ঘটনাটা শোনার পর অনেকক্ষণ পেরিয়ে গিয়েছে, অরিন্দম এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না। রাতে শুয়ে অরিন্দম বুঝতে পারল, ঘটনাটা পাকাপাকি মাথায় গেঁথে বসছে, কিছুতেই ঘুম আসছে না তার। অরিন্দমের মনে হচ্ছে এই ছেলেটাকে একবার দেখা দরকার, জানা দরকার ছেলেটার কথা। সেই ২০০০-২০০১ সালে, যে সময় বেলপাহাড়ির এক গ্রামের একটা দশ বছরের বাচ্চা আপেল দেখেনি, সেই সময়টা নিজের জীবনে কেমন ছিল ভাবার চেষ্টা করে অরিন্দম।
     
    ভাবনা কোথা থেকে কোথায় চলে যায়! অরিন্দমের মনে হল, এভাবে ঘুম আসবে না। খাট থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। সিগারেটটা খেয়ে ফের এসে শুল খাটে। মনের ভেতরে ঠিক কী চলছে তা বুঝতে পারে না। এমন নয়, যে ছেলেটাকে কোনও দিন দেখেইনি, তার জন্য প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। এমন নয়, ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ির মানুষ কত গরিব তা সে জানতো না। কিন্তু ঠিক কী কারণে তার ছেলেটাকে দেখতে ইচ্ছে করছে, জানতে ইচ্ছে করছে সেই সময়ের বেলপাহাড়ির কথা বুঝতে পারল না অরিন্দম। ঝাড়গ্রামের বিভিন্ন গ্রামে ২০০৩-২০০৪ সালের পর থেকে মাওবাদী আন্দোলনের যে প্রভাব, তার বীজ তো নিশ্চয় পোঁতা হয়েছিল তার অনেক আগে কোনও না কোনও দিন। যদিও ঠিক কবে তা অরিন্দম জানে না। কিন্তু একটা জায়গার আর্থিক পরিস্থিতি ঠিক কেমন হলে সেখানে এই ধরনের বীজ শত পুষ্পে বিকশিত হয় তাও অরিন্দমের পুরোপুরি জানা নেই। আজ ঘটনাটা শোনার পর থেকে ওর বারবারই মনে হচ্ছে, এই যে একটা এলাকার একটা বছর দশেকের ছেলে আপেল চেনে না, তা কি সেখানকার আর্থিক অবস্থার বা মাওবাদী আন্দোলনের বিকশিত হওয়ার একটা সূচক হতে পারে! যদি সত্যিই তাই হয় তবে তো এই ছেলেটাকে একবার দেখা দরকার! নানান ভাবনা এসে ভিড় করতে থাকে অরিন্দমের মাথায়। সে চোখের সামনে দেখতে থাকে বছর দশেকের রোগা, মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল, ঝকঝকে সাদা দাঁত, কোমর থেকে নেমে আসা প্যান্ট, সস্তার গেঞ্জি পরা একটা চেহারা। তারপর অরিন্দম কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে তা বুঝতে পারে না। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে অরিন্দম ঠিক করে, অনিরুদ্ধদাকে ফোন করতে হবে। জানতে হবে ছেলেটার কোথায় বাড়ি তা অনিরুদ্ধদার মনে আছে কিনা। যদি মনে থাকে তবে সেখানে যেতে হবে। যতক্ষণ না যাচ্ছে ততক্ষণ দশ বছরের একটা বাচ্চার আপেল না চেনা মুখের চেহারা তাড়া করবে তাকে!
     
    ‘কাল যে ঘটনাটা বললেন, সেই ছেলেটা কোন এলাকার মনে আছে?’ সকাল ন’টা নাগাদ অনিরুদ্ধকে ফোন করল অরিন্দম।
    ‘আপনাকে কাল বললাম না, খুব সম্ভবত ময়ূরঝর্ণা।’
    ‘ময়ূরঝর্ণা? আরে ময়ূরঝর্ণা গ্রামে তো আমি গিয়েছি। অনেক বছর আগে, ২০০৬ হবে হয়তো। কীভাবে নামটা শুনেছিলাম মনে পড়ছে না, কিন্তু গ্রামটার নাম শুনে দারুণ লেগেছিল। মনে আছে অনেকটা রাস্তা হেঁটে ওই গ্রামে গিয়েছিলাম।’
    ‘আমি যদি খুব ভুল না করি, ছেলেটার বাড়ি ময়ূরঝর্ণা গ্রামেই।’
    ‘ছেলেটার নাম তো নিশ্চয় মনে নেই? মানে আমি যদি যাই ওখানে, কীভাবে ছেলেটাকে খুঁজে পেতে পারি?’ 
    ‘ছেলেটার নামটাও মনে আছে, ধর্মা। মনে থাকার কথা না, কিন্তু মনে আছে। আপনি জানেন তো মেদিনীপুর শহরে ঢোকার মুখে ধর্মার মোড় বলে একটা ক্রসিং আছে। সেই জায়গাটা আর ছেলেটার নাম এক বলে ভুলিনি।’
    ‘ধর্মার মোড় চিনি তো। একদিকে মেদিনীপুর শহর, অন্যদিকে কেশপুর। ছেলেটার নাম ধর্মা? এতেই হবে, আমি খুঁজে নেব। ২০০০-২০০১ সালে ছেলেটার বয়স ছিল দশ-এগারো। তার মানে এখন বয়স হবে পঁচিশ-ছাব্বিশ। একই নামের ওই বয়সী আর ক’জন থাকবে ওই এলাকায়?

    ১৯-০৮-১৯৯৯, চাকাডোবা
     
    চাকাডোবা মোড়ে রাস্তা অবরোধের খবরটা বেলপাহাড়ি থানায় এসে পৌঁছল সন্ধে সাতটা নাগাদ। বাঁশপাহাড়ি আউট পোস্টের এএসআই মহাদেব হাতি ফোন করলেন থানায়, একবার রিং হতেই ফোন ধরল প্রভাত।
    ‘স্যর, একটা প্রবলেম হয়েছে, খবর পেলাম চাকাডোবা মোড়ে লোকাল লোক রাস্তা অবরোধ করেছে।’
    ‘মানে? এই সন্ধেবেলা রোড ব্লকেড?’ কেন?
    ‘বুঝতে পারছি না স্যর। মনে হচ্ছে হেলথ সেন্টারের ব্যাপারটা নিয়ে। আমি একবার দেখে আসব? একটু বাদেই তো মিনিস্টার সাহেবের ফেরার কথা এই রাস্তা দিয়ে।’
    ‘তাড়াতাড়ি যাও, আধ ঘণ্টার মধ্যে আমাকে জানাও।’
    কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল বেলপাহাড়ির ওসি প্রভাত সেনাপতির। বলা নেই, কওয়া নেই, এই সন্ধেবেলা হঠাৎ রোড ব্লকেড কেন? ফোনটা নামিয়ে রেখে দু’মিনিট চুপ করে বসে থাকল প্রভাত। তারপর ফোন করল অনিরুদ্ধকে।
     
    ‘স্যর, চাকাডোবার মোড়ে একটা রোড ব্লকেডের খবর পাচ্ছি। এখনও কনফার্ম নয়, বাঁশপাহাড়ি আউট পোস্ট থেকে অফিসার পাঠিয়েছি দেখতে।’
    ‘কারণ কিছু জানা গেল? আমি আসব?’
    ‘এখনই বেরনোর দরকার নেই স্যর। চাকাডোবায় হেলথ সেন্টারের ডিমান্ড নিয়ে যে মুভমেন্টটা হচ্ছিল তার জন্য হতে পারে, আমি দেখছি। কিছু খবর পেলেই আপনাকে জানাচ্ছি। আসলে আমাদের মিনিস্টার সাহেবের আজ বিকেলে বাঁকুড়ায় একটা প্রোগ্রাম ছিল, ওই রাস্তা দিয়ে ফেরার কথা একটু বাদে। হয়তো মিনিস্টার সাহেবের অ্যাটেনশনের জন্য এই সময়টা বেছে থাকতে পারে।’
    ‘শোনও কখন তোমার অফিসার খবর দেবে তার জন্য ওয়েট করার দরকার নেই, তুমি বেরিয়ে পড়ো। আমিও বেরচ্ছি। বাঁকুড়া কন্ট্রোল রুমে একবার বলে দাও, এই রাস্তা দিয়ে যেন মিনিস্টার সাহেবের কনভয় না ফেরায়। আর শোনও পরিস্থিতি যাই হোক, ফোর্স অ্যাপ্লাই করবে না। কথা বলে ব্লকেড তোলার চেষ্টা কোরও।’ ওসির ফোনটা ছেড়েই মেদিনীপুরে এসপি অফিসে ফোন করল অনিরুদ্ধ। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, সিগনালটা ভালো না। বড় সাহেবকে একবার জানিয়ে রাখা দরকার। সওয়া সাতটা বাজে, বড় সাহেবের এখন অফিসেই থাকার কথা। কিন্তু অফিসে ফোন করে বড় সাহেব, মানে মেদিনীপুরের এসপিকে পেল না অনিরুদ্ধ। এসপি সাহেব কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে গিয়েছেন শুনে কনস্টেবলকে লাইনটা কোয়ার্টারে ট্রান্সফার করতে বলে একটা সিগারেট ধরাল। কিন্তু কোয়ার্টারেও এসপি সাহেবকে পাওয়া গেল না। ফোনের অন্যদিকে কনস্টেবলকে অনিরুদ্ধ জানিয়ে দিল, একটা রাস্তা অবরোধের খবর পেয়ে সে বেলপাহাড়ি যাচ্ছে। এসপি সাহেব ফিরলে যেন জানিয়ে দেয়।
     
    রাত পৌনে ন’টা, চাকাডোবায় পৌঁছল অনিরুদ্ধ। ঘন অন্ধকার চারদিকে, কারও মুখ দেখা যাচ্ছে না, গাড়ি থেকে নামতেই একটা জমায়েত টের পেল সে। তাকে দেখে এগিয়ে এল প্রভাত। অনিরুদ্ধর মনে হল, চাকাডোবার মোড়ে এই রাতে মেলা বসেছে। প্রচুর মানুষ রাস্তার দু’ধারে লাইন দিয়ে মাটিতে বসে। খাবারের প্রস্তুতি চলছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আরও অনেক লোক চারদিকে।
    ‘স্যর, দু’ঘণ্টা হয়ে গিয়েছে অবরোধ চলছে। লোকজনের ডিমান্ড, প্রাইমারি হেলথ সেন্টার বাঁশপাহাড়ির বদলে চাকাডোবায় করতে হবে। নয়তো টানা আন্দোলন চলবে।’
    এমনই একটা কিছু আঁচ করেছিল অনিরুদ্ধ। আস্তে আস্তে এগোতে থাকল ভিড়টার দিকে। ‘এদের নেতা কে, কিছু বুঝতে পারলে?’
    ‘স্যর, নেতা কেউ থাকলেও এখানে নেই। এখানে সবাই গ্রামের লোক।’
    প্রভাতের সঙ্গে কথা বলতে বলতে একদম ভিড়টার মধ্যে ঢুকে পড়ল অনিরুদ্ধ। ভাতের গন্ধ বেরোচ্ছে, কাছাকাছিই রান্না হচ্ছে কোথাও। রাস্তার দু’দিকেই মাটিতে বসে বহু মানুষ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সবাই স্থানীয়। পুরুষরা অধিকাংশ খালি গা, গামছা পরা। জামা বা গেঞ্জি এবং প্যান্ট পরাও কিছু লোক আছে। অরিন্দমের মনে হল মহিলার সংখ্যা পুরুষের থেকে বেশি। মানুষগুলো রাস্তার দু’ধারে লাইন করে বসেছে, তিন-চারটে ছেলে শাল পাতা পেতে দিচ্ছে তাদের সামনে। বোঝাই যাচ্ছে খাওয়াদাওয়া শুরু হবে এখন। রাস্তায় বসে থাকা মানুষগুলোর পাশ কাটিয়ে সোজা রান্নার জায়গাটায় চলে গেল অনিরুদ্ধ। রাস্তার পাশে একটা বড় গাছের নীচে উনুন বানিয়ে রান্না হচ্ছে। দু-তিন’জন তার তদারকি করছে। তাদের দিকে এগিয়ে গেল অনিরুদ্ধ।
    ‘ভাই শোনও, তোমার নাম কী?’  যে ছেলেটাকে অনিরুদ্ধ ডাকল তার নাম অনন্ত। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে ভালো নম্বর পাওয়া শিলদা কলেজ ড্রপআউট সেই ছেলেটা, যাকে দু’মাস আগে এই চাকাডোবাতেই মিটিং করে আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিল বনমালী দেশোয়ালি ওরফে সুকান্ত। সেদিন অনিরুদ্ধ বেলপাহাড়ি থানাতেই অনেকক্ষণ ছিল, কিন্তু সেই মিটিংয়ের খবর গত দু’মাসে পৌঁছয়নি থানায়। অনিরুদ্ধর প্রশ্নে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল অনন্ত। সাদামাটা একটা গেঞ্জি, কালো ট্র্যাকস্যুট পরা ছেলেটার চেহারায় বাড়তি কোনও বিশেষত্ব এই রাতের অন্ধকারে দেখতে পেল না অনিরুদ্ধ। যদিও দিনের বেলা ছেলেটার চোখের দিকে দেখলে বা কিছুক্ষণ বিভিন্ন বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বললে অনিরুদ্ধ বুঝতে পারত, এই ছেলেটা চাইলে হয়তো তারই মতো সরকারি চাকরির পরীক্ষা পাশ করে ফেলতে পারত। কিন্তু ছেলেটা অন্য কিছু চেয়েছে, অন্য কিছু ভেবেছে জীবন নিয়ে। আসলে নিজের জীবন নিয়ে কিছুই ভাবেনি ছেলেটা।      
     
    ‘আমি ঝাড়গ্রামের এসডিপিও। তোমরা কী চাও?
    ‘বাঁশপাহাড়ির বদলে চাকাডোবায় স্বাস্থ্য কেন্দ্র করতে হবে। স্থানীয় লোকজন অনেকদিন ধরে এই কথা বলছে। বিডিওকে চিঠিও দিয়েছে। কিন্তু বারবার প্রশাসনকে জানানোর পরও এব্যাপারে কোনও উদ্যোগ সরকারের তরফে নেই। এই দাবিতেই আমরা সব স্থানীয় মানুষ রাস্তা অবরোধ করেছি।’
    অনিরুদ্ধর নজরে এল ছেলেটার কথায় কোনও জড়তা নেই, আদিবাসী টান নেই। পুলিশের প্রতি বাড়তি সম্ভ্রমও নেই। যতটা বলার ততটাই বলে থামল ছেলেটা।
    ‘কিন্তু স্বাস্থ্য কেন্দ্র কোথায় হবে তা তো এই রাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। তা বলে তো সারা রাত অবরোধ চলতে পারে না। কাল আমরা এব্যাপারে কথা বলতে পারি।’
    ‘আমরা অনেকদিন ধরে প্রশাসনকে বিষয়টা জানিয়েছি, কেউ আমাদের কথার গুরুত্ব দেয়নি। এখন রাস্তা অবরোধ হয়েছে বলে আপনি বলছেন কাল কথা বলতে পারেন!’ 

    ক্রমশ।.. 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২২ ডিসেম্বর ২০২৩ | ৭২৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ২২ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৮:৫৫527112
  • খুবই আগ্রহ নিয়ে পড়ছি।
  • তরুন দাস , বাঁকুড়া | 2409:4061:2d83:ec50::ba48:***:*** | ২২ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৯:০০527113
  • খুব সুন্দর । অনেক তথ্যবহুল । পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা করছি
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে প্রতিক্রিয়া দিন