সিংরাইকে মাঠে বসিয়ে দ্রুত পা চালায় সহদেব, ধজুড়িতে ঢোকার মুখে জমায়েতটার সামনে গিয়ে মনসার নাম ধরে খোঁজ করে। সহদেবকে বলা ছিল ধজুড়ির মনসা রায়ের বাড়িতে পৌঁছতে হবে রাত ন’টার মধ্যে। অন্ধকারেই একজন হাত উঠিয়ে দেখায় একটা বাড়ির দিকে। আধ ঘণ্টা লেট হয়ে গেছে, হুড়মুড়িয়ে সেদিকে এগোয় সহদেব। বাড়িটার সামনে উঠোনে মাটিতে কলা পাতা পেতে খেতে বসেছে পনেরো-কুড়ি’জন। দু’জন বালতি হাতে খাবার দিচ্ছে সবার পাতায়। মনসার নাম বলতেই দু’জনের মধ্যে একজন এগিয়ে আসে, হাতে একটা বালতি।
‘আমি সহদেব সিংহ সর্দার, চাকাডোবা থেকে আসছি।’
‘এত দেরি হল! বেরনোর সময় তো হয়ে গেছে, মনসা নামক লোকটার গলায় একটু যেন বিরক্তি।’
কী আর বলবে সহদেব, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
‘চাকাডোবা থেকে দু’জনের আসার কথা ছিল না?’ প্রশ্ন করে লোকটা।
‘হ্যাঁ এসেছে, সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,’ অন্ধকারেই সিংরাইয়ের দিকে হাত দেখায় সহদেব।
‘এটাই লাস্ট ব্যাচ, তাড়াতাড়ি ওকে ডেকে এনে খেতে বসে যাও। এখনই বেরতে হবে।’ ব্যস্ত হয়ে খেতে বসা লোকগুলোর দিকে এগোয় সে। সিংরাইকে ডাকতে আবার উল্টোদিকে ছোটে সহদেব। একটু আগেই এত খিধে পাচ্ছিল, এখন সহদেব কাকার ডাক শুনে সিংরাইয়ের মনে হল, খেতে না গিয়ে আর একটু শুয়ে থাকলে ভালো হত। কিন্তু তা আর হল না। মনসার বাড়ির উঠোন পর্যন্ত সাইকেলটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে এসে মাটিতে বসে গেল দু’জন।
‘এ তো এক্কেবারে বাচ্চা ছেলে, ও পারবে?’ সিংরাইয়ের পাতায় ভাত দিতে দিতে বলল মনসা। আশপাশের অনেকেই খাওয়া শেষ করে উঠে পড়েছে। সহদেব আর সিংরাইকে বেশি করে ভাত আর ডাল দিয়ে মনসা নিজেও খেতে বসে গেল। মিনিট দশেকের মধ্যেই খাওয়া শেষ হল তাদের। পাশে প্লাস্টিকের ড্রামে জল ছিল, তা দিয়ে হাত ধুয়ে নিল তারা। খাওয়া শেষ করে উঠোনের এক ধারে অপেক্ষা করছে চল্লিশ-পঞ্চাশ জন, কয়েকজন পাশের মাঠে দাঁড়িয়ে। সিংরাই এখনও বুঝতে পারছে না কী হবে এই রাতে, এত লোক কেন এসেছে এখানে! তার মাথায় ঘুরছে তাকে দেখে লোকটার প্রশ্ন, ও পারবে? কী পারবে সে? কী করতে হবে তাকে, বুঝতে পারল না সিংরাই। সহদেব কাকাকে একবার জিজ্ঞেসও করল, কিন্তু জবাব পেল না কিছু। ‘আমিও জানি না কেন ডেকেছে, দেখ না কী হয়,’ বলে থেমে গেল সহদেব কাকা। ‘চল সবাই, এবার সময় হয়ে গেছে,’ ভিড়টার কাছে এসে বলল মনসা। সহদেব আস্তে করে সিংরাইকে বলল, আর একটু দেরি হলেই সব বেরিয়ে যেত।’ সবাই মিলে যখন ধজুড়ির মনসা রায়ের বাড়ি থেকে হাঁটা শুরু করল তখন রাত প্রায় দশটা।
ধজুড়িতে জড়ো হওয়া চল্লিশ-পঞ্চাশটা লোক হাঁটতে শুরু করল গ্রামের রাস্তা ধরে। সামনে মনসা আর অন্য দু’জন লোক। মনসার বাড়িতেই সাইকেল রেখে এসেছে সিংরাই। মিনিট দশেক হেঁটে তারা পৌঁছল একটা বড় মাঠের ধারে, সেখানে একটা বড় কুসুম গাছের তলায় পৌঁছে থামল সবাই। অমাবস্যা আর পূর্ণিমার মাঝামাঝি সময় এখন, কারও মুখ স্পষ্ট করে দেখা না গেলেও, চেহারার আদল বোঝা যাচ্ছে সবার। সিংরাই দেখল সবার মধ্যে তার বয়সই সবচেয়ে কম। এতটা রাস্তা সাইকেল চালিয়ে আসার ক্লান্তি কেটে গেছে সিংরাইয়ের। কী হবে বুঝতে না পারলেও একটা উত্তেজনা হচ্ছে তার ভেতরে। হালকা ঠান্ডা হাওয়া বইছে, কুসুম গাছের তলায় অপেক্ষা করতে থাকল তারা। ঠিক কতক্ষণ বলা মুশকিল, তবে বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎই ‘ওই যে, ওই যে’ বলে উঠল একজন। সেদিকে তাকিয়ে সিংরাই দেখল আট-দশটা লোক মাঠের আল ধরে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। মাঠে ধান হয়ে আছে, তার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে লোকগুলোর এগিয়ে আসা। অন্ধকারে দূর থেকে মনে হল কয়েক জনের হাতে বড় লাঠি। লোকগুলোর হেঁটে আসার দিকে তাকিয়ে থাকল কুসুম গাছের নীচে অপেক্ষা করতে থাকা চল্লিশ-পঞ্চাশ জন। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই লোকগুলো এসে গেল কুসুম গাছের তলায়। লোকগুলো একদম কাছাকাছি এলে সিংরাই দেখল যেগুলোকে লাঠি ভাবছিল, তা আসলে বন্দুক। মোট আটজনের মধ্যে চারজনের কাঁধে লম্বা রাইফেল ঝুলছে। বন্দুক হাতে এরা কারা, উত্তেজনায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল সিংরাইয়ের।
‘মনসা সবাই এসে গেছে?” আটজনের দলের মধ্যে থেকে একজনের গলা শুনে সবাই বুঝল এই লোকটাই এদের মধ্যে নেতা।
‘হ্যাঁ, দাদা।’
‘তাহলে যাওয়া যাক। বন্ধুরা, আমরা এখন যাব তালপুকুরিয়ার মাঠে। সেখানে বাকিরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।’ ফের শুরু হল হাঁটা। মাঠের জায়গায় জায়গায় ধান হয়ে আছে, তাই সাবধানে আল ধরে হাঁটতে লাগল সবাই। একদম সামনে পিঠে বন্দুক নেওয়া লোকটা, তার পাশে মনসা। কারও মুখে কথা নেই, টানা প্রায় আধ ঘণ্টা হেঁটে পুরো দলটা পৌঁছল তালপুকুরিয়া গ্রামের মাঠে। কী হতে চলেছে বুঝতে পারে না সিংরাই, কিন্তু এক অজানা উত্তেজনায় লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে থাকে সে। হঠাৎই আলের কাদায় তাল সামলাতে না পেরে একজন পা পিছলে পড়ে যায় ধান ক্ষেতে, তাকে ধরতে গিয়ে আরও একজন। তা দেখে হেসে ফেলে সিংরাই। তালপুকুরিয়া মাঠে ইতিমধ্যেই জড়ো হয়েছে অনেক মানুষ। অন্তত দেড়শো-দুশো লোক। তার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি মহিলা। সিংরাই দেখল অধিকাংশ মহিলারই শাড়ির ওপরে জামা পরা। প্রায় সবার হাতে কাস্তে আর বড় বস্তা, অনেকের হাতে লাঠি। দুটো দল মিশে গেল তালপুকুরিয়া মাঠে।
‘এবার সবাই কয়েকটা কথা একটু শুনে নিন। আপনারা অনেকেই জানেন কেন এই মাঝরাতে আমরা এখানে জড়ো হয়েছি। আমরা আজ কেন্দিশোলের যদু মন্ডলের জমির ধান কাটতে যাব। আপনাদের মধ্যে বেশিরভাগেরই বাড়ি কেন্দিশোলে। তাছাড়া এখানে তালপুকুরিয়া, ধজুড়ি থেকে শুরু করে চাকাডোবা, লালজল এবং আরও কিছু গ্রামের মানুষ আছেন। আপনারা বেশিরভাগই কেন্দিশোলের জোতদার যদু মণ্ডলের জমিতে চাষ করেছেন। এমন অনেকেও এখানে আছেন, যার জমি জোর করে দখল করেছে যদু মন্ডল। সেই জমিতে আপনাদের মতো অনেককে দিয়ে চাষ করাচ্ছে বছরের পর বছর। কিন্তু তার বদলে আপনারা কী পাচ্ছেন? প্রায় কিছুই না। আপনাদের মতো গরিব মানুষকে শোষণ করে যদু মন্ডল যে ধান চাষ করেছে তাতে যদি কারও অধিকার থেকে থাকে তবে তা আপনাদের। সেই অধিকার আপনাদের দিতে আজ আমরা এসেছি। পরিশ্রম করবেন আপনারা, ফসল ফলাবেন আপনারা, জমি আপনাদের, আর ফসল ঘরে তুলবে কেন্দিশোলের জোতদার যদু মন্ডল, তা আর হবে না। মেহনত যার, ফসল তার। আমাদের লড়াই আপনাদের জন্য, যদু মন্ডলের মতো জমিদারদের বিরুদ্ধে,’ জমায়েতটার সামনে দাঁড়িয়ে বলে চলে রোগা, লম্বা লোকটা।
লোকটার কথা শুনতে শুনতে গায়ে কাঁটা দেয় সিংরাইয়ের। সিংরাই তো দূরের কথা অনেক বয়স্ক লোকই বিশ্বাস করতে পারে না সত্যিই যদু মন্ডলের জমির ধান কাটবে তারা। সবাই অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে লোকটার দিকে। লোকটার মুখ স্পষ্ট করে দেখা যায় না অন্ধকারে। লোকটার পরনে কালো ফুল সোয়েটার, পায়ে কেডসের মতো সাদা জুতো। কাঁধে লম্বা বন্দুক। লোকটার চারদিকে তারই দলের আরও তিন-চারজন দাঁড়িয়ে। একটা পিন পড়লেও শব্দ শোনা যাবে, লোকটা বলে চলে, ‘আজ রাতে আসল কাজ আপনাদের। আমরা শুধু এসেছি আপনাদের নিরাপত্তা দিতে। যদু মন্ডলের লেঠেল বাহিনী যদি আপনাদের আক্রমণ করে, তবে আপনাদের রক্ষা করতে। আপনাদের মেহনতে, রক্ত জল করা পরিশ্রমে যে ধান আজ মাঠে পেকেছে, তা আপনাদেরই কাটতে হবে। আমরা শুধু আপনাদের নিরাপত্তা দেব। আপনারা কেউ ভয় পাবেন না, আমরা আটজন যতক্ষণ বেঁচে আছি, ততক্ষণ যদু মন্ডলের লেঠেল বাহিনী আপনাদের একজনের গায়েও হাত দিতে পারবে না। এবার কয়েকটা দরকারি কথা বলি। কেউ মুখে কোনও শব্দ করবেন না। এখন সাড়ে এগারটা বাজে। এখান থেকে কেন্দিশোলের যদু মন্ডলের ধান জমিতে যেতে মিনিট দশেক লাগবে। আমরা সবাই এক লাইনে সার বেঁধে যাব। এখানে কেন্দিশোলের যারা আছেন তার মধ্যে একজন সামনে সামনে আমাকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাবেন। তিনি ধান জমি দেখিয়ে দেবেন। আমার সঙ্গে থাকবে কমরেড সাঁওতা। লাইনের একদম শেষে থাকবে আরও দু’জন কমরেড, ধ্রুব আর অর্জুন। মাঝখানে কিছু মানুষের গ্যাপে থাকবে আমাদের আরও চারজন। তাই আপনাদের ভয়ের কিছু নেই। ওখানে পৌঁছে কেউ কথা বলবেন না, অকারণ শব্দ করবেন না। এখানে কম বয়সী যারা আছেন এবং যাদের কাছে লাঠি আছে তারা একদিকে সরে দাঁড়ান। তারা জমির চারদিকে একটু দূরে দূরে পাহারায় থাকবেন। যে জমিতে ধান কাটা হবে আমরা আটজন থাকব সেই জমির চারদিকে। আপনারা লাঠি হাতে দূরে দূরে পাশের জমিতে চুপ করে মাটিতে বসে থাকবেন। চারদিকে নজর রাখবেন কেউ আসছে কিনা। যদি দেখেন যদু মন্ডলের লোকজন আসছে দৌড়ে আমাদের খবর দেবেন। যারা মাঠে থাকবেন তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ধান কাটবেন। একদল ধান কাটবে, এক দল পর পর বস্তায় ভরবে। যদি বারোটায় ধান কাটা শুরু হয়, দু’আড়াই ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত ধান কেটে ফেলতে হবে। পুরো মাঠের ধান কাটা হলে আমরা আবার এই তালপুকুরিয়া মাঠে ফিরে আসব।’ টানা বলে থামে লোকটা। সিংরাই হাঁ করে শুনতে থাকে লোকটার প্রতিটা কথা। বিশ্বাস করতে পারে না। কেন্দিশোলের জমিদার যদুনাথ মন্ডলকে কে না চেনে! পুলিশ, পঞ্চায়েত সব ওর হাতে। যদুনাথ মন্ডলের জমির ধান কাটতে তারা এসেছে, বিশ্বাস হয় না সিংরাইয়ের। সে ভাবে যদি যদু মন্ডলের লোকজন টের পেয়ে যায়! যদি তারা আক্রমণ করে। তখন যদি এই লোকটার দলের সঙ্গে যদু মন্ডলের বাহিনীর মারপিট হয়! নানান জিনিস ভাবতে ভাবতে উত্তেজনায় বুকের কাছটা ধড়ফড় করতে থাকে সিংরাইয়ের। কিন্তু তার ভাবনাকেও ছাপিয়ে যায় লোকটার প্রতি তার আকর্ষণ। সিংরাই মন দিয়ে দেখতে থাকে লোকটাকে। যদিও সে বুঝতে পারে না লোকটাও মাঝে মাঝেই আড়চোখে দেখছে তাকে, আর ভাবছে এত বাচ্চা একটা ছেলেও এসেছে এই রাতে ধান কাটার কাজে হাত লাগাতে!
লোকটার কথা শেষ হতেই আবার হাঁটতে শুরু করে তারা, মিনিট কয়েকের মধ্যে পৌঁছে যায় যদু মন্ডলের ধান জমিতে। শ’দুয়েক লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে মাঠে। দশ-বারো’জন লাঠি হাতে সরে যায় একটু দূরে। বন্দুক হাতে পাঁচ-ছ’জন ঘিরে ফেলে ধান জমিকে। আর মাঠে নেমে পড়ে বাকি সবাই। কারও মুখে কোনও শব্দ নেই, সিংরাই দেখে মাঠে উবু হয়ে ধান কাটছে একশো-দেড়শো মানুষ। ধান কাটা তো সিংরাই অনেক দেখেছে, কিন্তু তার মধ্যে এমন প্রাণের অস্তিত্ব এই প্রথম দেখল সে। যারা ধান কাটছে তারাও বোঝে এই ধান কাটা আর জমিদারের লেঠেল বাহিনীর নজদারিতে ধান কাটার তফাৎ। যে মানুষগুলো সারা জীবন ধরে এই মরশুমে জমিদারের জমিতে ধান কেটে আসছে, তারা বুঝতে পারে আজকের এই রাত কতটা আলাদা। এক-দেড়শো পুরুষ, মহিলা হাতে হাত লাগিয়ে ঘণ্টা’দুয়েকের মধ্যে ফাঁকা করে ফেলল গোটা মাঠ। সেই ধান হাতে হাতে ভরে ফেলল বড় বড় বস্তায়। গোটা মাঠের ধান কেটে লোকগুলো যখন রওনা দিল তালপুকুরিয়ার দিকে তখনও আড়াইটে বাজেনি। হাল্কা ঠান্ডার রাতে তখন গভীর ঘুমে যদু মন্ডলের জমিদার বাড়ি, আরও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন প্রশাসন, পুলিশ। পরদিন যখন গোটা ঘটনাটা জানতে পারবে বেলপাহাড়ির সমস্ত জোতদার, জমিদার পরিবার, প্রশাসন এবং পুলিশ, ততক্ষণে এই এলাকার গরিব, একবেলা খেতে না পাওয়া মানুষ স্বাদ পেয়ে গিয়েছে এক নিঃশব্দ বিপ্লবের, যা সশব্দে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে অনেকখানি এলাকায়। যদিও এই মুহূর্তে এই মানুষগুলো জানে না বিপ্লব কাকে বলে, কী কাণ্ড তারা ঘটাল আজ রাতে!
তালপুকুরিয়ার মাঠে পৌঁছে ধানের বস্তা মাথা থেকে নামিয়ে মিনিট দশেক জিরিয়ে নিল লোকগুলো। তারপর সবার মিনিট পনেরো লাগল নিজেদের মধ্যে ধান ভাগ করতে। যে যতটা জমিতে চাষ করেছে সবাই নিজের ধান সেভাবে ভাগ করে নিজের নিজের বাড়ির রাস্তা ধরল। থেকে গেল শুধু আটজনের দলটা, যাদের তত্ত্বাবধানে কাটা হল ধান। থেকে গেল ধজুড়ি গ্রামের মনসা রায় আর চার-পাঁচজন। আর থেকে গেল চাকাডোবার বাঁশলাটা গ্রামের সহদেব সিংহ সর্দার, ময়ূরঝর্ণার সিংরাই মান্ডি। এখন এতটা রাস্তা ফের সাইকেল চালিয়ে না ফিরে রাতটা ধজুড়িতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সহদেব। কারণ, সাইকেল আনতে সেই ধজুড়ি যেতেই হবে। তাতেই তো সাড়ে তিনটে বেজে যাবে। তালপুকুরিয়া থেকে অন্ধকার রাস্তায় মাঠের আল ধরে ধজুড়ি গ্রামে ফিরে এল ছোট্ট দলটা। মনসা আর তিনজন চলে গেল নিজেদের বাড়ি। ধজুড়ি গ্রামের পাশেই উঁচু মতো একটা জায়গা, বড়সড় টিলা বলা যায়, স্থানীয় লোক তাকে চেনে মহুল পাহাড় বলে। সেই মহুল পাহাড়ের এক পাশে বাঁশ, খড় দিয়ে তৈরি একটা ঘর। ধান পাকলে ওই ঘরে বসে হাতি পাহারা দেয় গ্রামের মানুষ। মনসারা ঘরে চলে যাওয়ার সময় ঠিক হল ওই আটজন মহুল পাহাড়ের সেই খড়ের ঘরে বাকি রাতটা কাটিয়ে দেবে। ওদের সঙ্গেই মহুল পাহাড়ে হেঁটে গেল সিংরাই আর সহদেব। খড়ের ঘরের যে যার মতো শুয়ে পড়ল। অনেকক্ষণ ঘুম এল না সিংরাইয়ের। এতটা রাস্তা সাইকেল চালানোর ক্লান্তিও ধান কাটার উত্তেজনায় উধাও হয়ে গিয়েছে, তারপর থেকে যা যা ঘটল, তার চেয়েও বড় কথা লোকটার প্রতি একটা টান, সহজে ঘুমোতে দেয় না সাড়ে তেরো বছরের সিংরাই মান্ডিকে। অবশ্য এটা বোঝার মতো তার বয়স হয়নি যে, একে জেগে থাকা বলে না, একে বলে জেগে ওঠা। সে শুয়ে বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে লোকটাকে।
সকালে সিংরাইয়ের যখন ঘুম ভাঙল তখন বাকিরা সব উঠে পড়েছে। সিংরাই চোখ খুলে দেখল আশপাশে কেউ নেই, তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক দেখে সহদেব কাকার পাশে গিয়ে বসল। তখনই তার চোখ পড়ল লোকটার দিকে। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাকি সব আলোচনা থামিয়ে লোকটা সিংরাইকে জিজ্ঞেস করল তার নাম। নাম, বাড়ি, স্কুল পরপর জিজ্ঞেস করে লোকটা যে প্রশ্নটা করল তার জন্য তৈরি ছিল না সিংরাই।
‘তুমি বাজেয়াপ্ত শব্দের মানে জান?’
হাঁ করে তাকিয়ে থাকে সিংরাই। দু’দিকে ঘাড় নেড়ে নীচু গলায় না বলে। এতক্ষণ ঘরের মধ্যে ঠান্ডায় যে শিরশিরানি ভাবটা লাগছিল, তা যেমনভাবে কেটে যাচ্ছে পূর্ব দিক থেকে আসা রোদের আলোয়, সেভাবেই যেন এক উষ্ণতার চাদর সিংরাইয়ের ওপর বিছিয়ে নরম গলায় কথা শুরু করে লোকটা। ‘কাল রাতে আমরা এই এলাকার এক বড় জমিদারের জমি থেকে ধান কেটেছি। জমিদারের লোকজন যেন সাধারণ মানুষের এই ধান কাটার কথা জানতে না পারে তার জন্য আমাদের রাতের অন্ধকার বেছে নিতে হয়েছে। তাই হয়তো এই ধান কেটে নেওয়াকে তোমার চুরি বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এটা চুরি করা নয়। একে বলে বাজেয়াপ্ত করা। কাল গরিব, সাধারণ মানুষ যা করেছে তাকে বাজেয়াপ্ত করা বলে। বড়লোকের বেআইনি ভাবে তৈরি করা সম্পদকে গরিব মানুষ কাল রাতে বাজেয়াপ্ত করেছে। আমরা মানুষকে নিরাপত্তা দিয়েছি শুধু। কারণ, আমরা গরিব মানুষের পক্ষে। কাল রাতে এই কেন্দিশোল, ধজুড়ি, তালপুকুরিয়া এবং আশপাশের গ্রামের যত গরিব মানুষ এসেছিল তারা সবাই যদু মন্ডলের জমিতে চাষ করেছে। তিন মাস চাষ করার জন্য তারা প্রায় কিছুই টাকা পায়নি বললে চলে। প্রায় বিনা পয়সায় এই জোতদার, জমিদাররা গরিব মানুষকে দিয়ে চাষ করায়। যখন ফসল ওঠে তখন কিছু ধান, সামান্য কিছু টাকা পাবে বলে গরিব মানুষ কাজ করতে বাধ্য হয়। অনেক গরিব মানুষের জমি যদু মন্ডলের মতো জোতদাররা জোর করে দখল করে রেখেছে। পুলিশ, প্রশাসন সব ওদের হাতে। এই গরিব মানুষ যখন নিজের জমিতে, নিজের খাটনিতে ফলন হওয়া ফসল কেটে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়, তখন তাকে চুরি বলে না। তাকে বলে বড়লোকের দখল করে রাখা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা, যা কাল রাতে এখানকার মানুষ করেছে।’
লোকটার কথা শুনতে শুনতে কোন দুনিয়ায় চলে যায় সিংরাই তা নিজেই বুঝতে পারে না। বিহ্বল ভাব কাটলে সে দেখে হাতেই থেকে গিয়েছে বিস্কুট, ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে এক গ্লাস চা।
‘আমরা এবার চলি। আমাদের অনেক দূরে যেতে হবে। তোমরা সাবধানে বাড়ি চলে যেও।’ সিংরাইয়ের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে লোকটা। মন খারাপ হয়ে যায় সিংরাইয়ের। সে ভাবে এই সকালটা যদি শেষ না হত, আরও কিছুক্ষণ যদি কথা বলা যেত লোকটার সঙ্গে। লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্টের ধুলো ঝাড়ে, তাকে দেখে তার সঙ্গীরাও উঠে পড়ে। লোকটা দু’পা এগিয়ে যায় সিংরাইয়ের দিকে। তারপর তার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি জান আমরা কারা? আমার নাম জান?’
দু’দিকে মাথা নাড়ে সিংরাই।
‘আমার নাম বনমালী দেশোয়ালি। আবার দেখা হবে।’
মনের সমস্ত জড়তা, সংকোচ কাটিয়ে সরু অথচ স্পষ্ট গলায় সিংরাই জিজ্ঞেস করে, ‘কবে?’
‘খুব তাড়াতাড়ি। আমি তোমাকে খবর পাঠাব। তোমার গ্রাম আমি চিনি, একদিন চলে যাব তোমাদের গ্রামে,’ বলে বনমালী দেশোয়ালি ওরফে সুকান্ত। তারপর আটজন নামতে শুরু করে মহুল পাহাড় থেকে। যতক্ষণ তাদের দেখা যায়, সেদিকে তাকিয়ে থাকে সিংরাই। বিশ্বাস করতে পারে না, এই লোকটা তাদের গ্রামে যাবে। সিংরাই বুঝতে পারে না, কাল সন্ধে সাড়ে সাতটা থেকে আজ সকাল পর্যন্ত বারো ঘণ্টায় তার বয়স বেড়ে গিয়েছে চার বছর।
‘তাড়াতাড়ি পা চালা। মনসার বাড়ি থেকে সাইকেল নিয়ে আমাদের আবার চাকাডোবা ফিরতে হবে।’ সহদেব কাকার কথায় সম্বিত ফেরে সিংরাইয়ের। দু’জনে প্রায় দৌড়ে নেমে আসে মহুল পাহাড় থেকে, মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে যায় মনসার বাড়িতে। উঠোনে নিম গাছে দাঁড় করিয়ে রাখা সাইকেলে চেপে বসে সিংরাই। পিছনে বসে সহদেব। বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরে ওরা। গতকাল রাতে সিংরাইয়ের জানা ছিল না কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে। আজ সাইকেল চালিয়ে নয়, উড়তে উড়তে ফিরতে থাকে সে। সহদেব কাকাকে চাকাডোবার বাড়িতে নামিয়ে ময়ূরঝর্ণার রাস্তা ধরে সিংরাই। গতকাল রাতের ঘটনাগুলো পরপর সিনেমার দৃশ্যের মতো দেখতে দেখতে বাড়ি ফেরে। বাড়ি ফিরে সিংরাই দেখে বাবা উঠোনে বসে আছে।
‘মা কাঠ আনতে গেছে। তুমি ফিরলে সাইকেল নিয়ে বেরব বলে বসে আছি,’ বলতে বলতে মাটি থেকে উঠে দাঁড়ায় সুবল।
‘আজ স্কুলে যাব না,’ সাইকেলটা উঠোনে দাঁড় করিয়ে বাবার সামনে দাঁড়ায় সিংরাই। সুবল কিছু বলে না, দড়িতে ঝোলানো গামছাটা টেনে কোমরে বেঁধে সাইকেলের দিকে এগোয়।
‘হাওয়া আছে?’
‘হ্যাঁ।’
সাইকেলে বসে প্যাডেলে চাপ দেয় সুবল। এক হাতের মধ্যে নিজের ছেলেকে দেখেও সে বুঝতে পারে না, যে সিংরাই কাল সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল আর যে ছেলেটা এখন বাড়ি ফিরল, দু’জনে এক লোক নয়। এক রাত এক কিশোরকে সাবালক করে দিয়েছে।
বাবা বেরিয়ে যাওয়ার পর সিংরাই টানা বসে থাকে উঠোনে। মাথার মধ্যে কী হতে থাকে বুঝতে পারে না, শুধু ভাবতে থাকে আবার কবে দেখা হবে বনমালী নামের এই লোকটার সঙ্গে। ভাবে সে যদি বনমালীর মতো হতে পারে কোনও দিন! বাড়ি ফেরার সময় ভাবতে ভাবতে এসেছিল, কাল রাতে যদু মন্ডলের জমির ধান কাটার কথা বলবে বাবাকে। বলবে, বনমালী দেশোয়ালি নামের একজনের সঙ্গে দেখা হয়েছে তার, কিন্তু সময়ের অভাবে বলতে পারে না। সে বাড়ি ফেরা মাত্রই মাটি কাটতে যাওয়ার তাড়ায় বাবা বেরিয়ে পড়ে। আধ ঘণ্টাখানেক বসে থাকার পর উঠে পড়ে সিংরাই। স্নানে যেতে হবে। ভাবে, দুপুরে বাবা বাড়ি ফিরলে বলবে। যদিও সিংরাইয়ের একথা জানা নেই, মাত্র মাস দু’য়েক আগেই চাকাডোবা ফুটবল মাঠে এক মিটিংয়ে এসেছিল বনমালী দেশোয়ালি এবং সেখানে গিয়েছিল বাবাও। শুধু তাই নয়, কবে, কোন কারণে এই এলাকায় প্রথম এসেছিল বনমালী দেশোয়ালি এবং এমসিসি, তাও জানা নেই সিংরাইয়ের। যেমন সে জানে না এমসিসি কী? সেই ঘটনাটা আজ থেকে প্রায় দশ মাস আগের।
ক্রমশ।..
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।