২২-১২-২০১৫, কলকাতা
ডিসেম্বর মাসের এই সময়টা কলকাতায় যেমন ঠান্ডা পড়ে আজও ওয়েদার তেমনই। খাতায়-কলমে শীত পড়ার কথা ঠিকই, কিন্তু ঠান্ডা নেই তেমন। তবে এটাও ঠিক অরিন্দমের ঠান্ডা একটু কম। একটু না, অনেকটাই কম। কেন যে তার শীত কম, এর কারণ জানা নেই অরিন্দমের। অরিন্দমের মনে এই প্রশ্ন অনেকবারই ঘুরে ফিরে এসেছে, কোনও নির্দিষ্ট জায়গায় এই যে এক একজনের এক এক রকম শীত, এক এক রকম গরম লাগে, তা কেন? একই জিনিসে আলাদা মানুষের আলাদা সহ্যশক্তি, এর কারণই বা কী? এর পিছনে কি কোনও অর্থনৈতিক কারণ আছে? অরিন্দম এমনও অনেককে দেখেছে তেমন ঠান্ডা পড়েনি অথচ তারা শীতের পোশাক পরে ঘুরছে। তারা মাঝে মাঝে আফসোসও করে কলকাতায় ঠান্ডা পড়ছে না, তাই শীতের পোশাক পরতে পারছে না! এমনই এক ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে অফিসের কাজে ভবানীপুরের দিকে এসেছে অরিন্দম। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ হয়ে গেল, ভাবল এখনই অফিস না গেলেও চলে। হঠাৎই ওর মনে পড়ল অনিরুদ্ধদা এখন সিআইডিতে পোস্টেড, ভবানীভবনে অফিস। অরিন্দম ফোন করল অনিরুদ্ধকে।
‘আপনি কি অফিসে? এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম ফাঁকা থাকলে আধ ঘণ্টা গল্প করে আসব।’
‘চলে আসুন, চলে আসুন।’
ড্রাইভারকে ভবানীভবনের দিকে গাড়ি ঘোরাতে বলল অরিন্দম।
‘কেমন আছেন বলুন, সিআইডির কী খবর,’ ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসতে বসতে প্রশ্নটা করল অরিন্দম।
‘সিআইডির আর নতুন কী খবর হবে, একই রকম। খবর এখন কলকাতা পুলিশে, নতুন সিপি কে হবে তা নিয়েই চারদিকে আলোচনা। আপনি বরং বলুন দেশ, রাজ্যের কী খবর?’
‘দেশের, দশের কথা বলতে পারব না, তবে রাজ্যের খবর খুবই ইন্টারেস্টিং জায়গায় দাঁড়িয়ে।’
‘কেন বলছেন?’ প্রশ্ন করে অনিরুদ্ধ সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিল অরিন্দমের দিকে।
‘আগে চা বলুন, তারপর সিগারেট খাব। প্যাকেটটা ফিরিয়ে দিল অরিন্দম।
বেল দিয়ে আর্দালিকে ডেকে চা দিতে বলল অনিরুদ্ধ। তারপর বলল, ‘হ্যাঁ বলুন কী বলছিলেন।’
‘সামনে বিধানসভা ভোট আসছে। আর কয়েকটা দিন গেলেই ভোটের ঢাকে কাঠি পড়ে যাবে, সে তো ঠিকই আছে। কিন্তু যেটা ইন্টারেস্টিং তা হল, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে সিপিএমের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট হবে।’
‘কী বলছেন? চেয়ারটা একটু এগিয়ে সোজা হয়ে বসল অনিরুদ্ধ। বিশ্বাসই করতে পারছে না অরিন্দমের কথা।
‘দেখুন, রাজনীতি আমি যা বুঝি তার ভিত্তিতে বলছি, একদিনে কিছুই হয় না। সব কিছুর একটা প্রস্তুতি থাকে, সলতে পাকানো থাকে। সেই নিরিখে বলছি, এখন আমার মনে হচ্ছে সিপিএমের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট হবে। ওপর তলায় অনেক কিছুই ঘটে যা প্রথমেই জানা যায় না, কিন্তু কয়েকটা পরিস্থিতি দেখে কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়। যখন ঘটনাগুলো ম্যাচিওর করে তখন সবাই তা দেখতে পায়। যেমন ধরুন, কয়েক মাস আগে হঠাৎই বুদ্ধদেববাবু বললেন, একা বামেদের পক্ষে তৃণমূলকে হারানো সম্ভব নয়। উনি যখন কথাটা বলেছিলেন তখন এটা ধরতে পারিনি, কেন একথা বললেন। আস্তে আস্তে তা স্পষ্ট হচ্ছে। এই যে বুদ্ধদেববাবু বললেন একা বামেদের পক্ষে তৃণমূলকে হারানো সম্ভব নয়, এটা কেন বললেন? তার মানে কি একা হারানো সম্ভব নয় বলে বামেরা বিধানসভা ভোটে লড়বে না? আসলে বুদ্ধদেববাবু বোঝাতে চেয়েছেন তৃণমূলের সঙ্গে লড়তে বামেদের একটা দোকা প্রয়োজন, সঙ্গী প্রয়োজন। কিন্তু এই দোকাটা কে? নিশ্চয় বিজেপি নয়। তবে পড়ে থাকল কংগ্রেস। পশ্চিমবঙ্গে গত পঞ্চাশ বছর ধরে সিপিএম-কংগ্রেস নিজেদের মধ্যে প্রচুর মারপিট করেছে। এখন হঠাৎ জোট হলে দুই দলেরই কর্মীদের একটা ধাক্কা লাগবে, তারা সহজে মেনে নিতে পারবে না। তাই দুই দলেরই, বিশেষ করে বাম কর্মীদের কাছে পরিস্থিতিটা সহজ করতে বুদ্ধদেববাবু এই কথাটা বললেন। এর ফলে সিপিএমের নানা স্তরে কথাটা নিয়ে আলোচনা শুরু হল। এটা কিন্তু বুদ্ধদেববাবু না বলে অন্য কোনও সিপিএম নেতা বললে হত না, কারণ বাকি কোনও নেতার দলের নেতা-কর্মীদের কাছে তেমন গ্রহণযোগ্যতা নেই। এবার দেখবেন আস্তে আস্তে সিপিএমের মাঝারি বা নীচের সারির নানা নেতা তৃণমূল বিরোধী সমস্ত দলের সঙ্গে সমঝোতা করার কথা বলতে শুরু করবে। দলের মধ্যে আলোচনাটা শুরু হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের জোট হবে কিনা, হলে কতটা মসৃণভাবে হবে, কত আসনে হবে তা এখনই বলার সময় আসেনি। কিন্তু আমি নিশ্চিত জোট প্রক্রিয়ার দিকে বিষয়টা যাচ্ছে,’ অরিন্দমের কথায় বাধা পড়ল দরজা খোলার শব্দে। একজন চা নিয়ে ঢুকলেন ঘরে।
‘খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হবে কিন্তু সিপিএম-কংগ্রেসের জোট হলে,’ চায়ে চুমুক দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল অনিরুদ্ধ। তারপর আবার প্যাকেটটা এগিয়ে দিল অরিন্দমের দিকে।
‘আপনি সিগারেটটা একটু কমান,’ বলে একটা সিগারেট ধরাল অরিন্দম। তারপর আবার বলতে শুরু করল, ‘তত্ত্বগত আলোচনা জন্য হয়তো সিপিএম-কংগ্রেস জোটের ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং। কিন্তু আপনি যদি আজকের পরিস্থিতিতে রাজ্যে ইলেক্টোরাল পলিটিক্স নিয়ে কথা বলেন, তবে বলব, এর কোনও গুরুত্ব নেই। আগামী বিধানসভা ভোটে এর কোনও প্রভাবই পড়বে না। তৃণমূল হিউজ ম্যান্ডেট নিয়ে জিতবে। আমার মনে হচ্ছে সিপিএমের রাজনীতিতে একটা বড় ভুল হচ্ছে। হয় ওরা সেই ভুলটা বুঝতে পারছে না, নয়তো ইচ্ছে করেই কঠিন পরিশ্রমের রাস্তা না বেছে শর্টকাট নেওয়ার চেষ্টা করছে।’
‘কেন বলছেন?’
‘গত তিন-সাড়ে তিন বছরে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সিপিএমের মূল রাজনৈতিক বক্তব্য কী? মূলত দুটো ইস্যুকে সামনে রেখে সিপিএম এবং বামেরা সমস্ত ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে, তা হল সন্ত্রাস এবং দুর্নীতি। ধরুন সন্ত্রাস। ২০১১ সালে তৃণমূল সরকার গঠনের পর রাজ্যের কিছু জায়গায় কয়েকজন সিপিএম নেতা, কর্মীর ওপর হামলা হয়েছে, সিপিএমের অনেক পার্টি অফিস, অনেকের বাড়ি ভাঙচুর হয়েছে, কয়েকজন খুনও হয়েছেন, সবই ঠিক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে দুটো। কোথায় হয়েছে এবং কাদের ওপর আক্রমণ হয়েছে? এই সব ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে গড়বেতা, কেশপুর, আরামবাগ, গোঘাট, ক্যানিং, বর্ধমানের কিছু অংশ এবং সেই সব জায়গায় যেখানে সিপিএমের আমলেও গণ্ডগোলের, সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সিপিএম নেতারা যদি আক্রান্ত হন, সিপিএম নেতা, কর্মী যদি খুন হন, সিপিএমের পার্টি অফিস যদি ভাঙচুর হয়, তাকে কি রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার অবনতি বলা যায় বা তাকে কি সার্বিক সন্ত্রাস বলা যায়? কেউ বলতে পারেন, সিপিএমই বা কেন খুন হবে, কেন সিপিএম বলেই কারও বাড়ি ভাঙচুর হবে, এই প্রশ্নগুলো ঠিকও। কিন্তু রাজ্যে রাজনৈতিক সংঘর্ষের যে পরম্পরা তাতে কোনটা ক্রিয়া এবং কোনটা প্রতিক্রিয়া তা নিয়ে তর্কের মীমাংসা হওয়া মুশকিল। আমার পয়েন্ট হচ্ছে, যদি ঐতিহাসিকভাবে সন্ত্রাসপূর্ণ এলাকায় শুধু সিপিএম আক্রান্ত হয় বা খুন হয় এবং তাকে কেউ যদি রাজ্যজুড়ে সন্ত্রাস হচ্ছে বলে ব্যাখ্যা করে, তা হবে একমাত্রিক। তা রাজ্যের অবজেক্টিভ কন্ডিশনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমি এই ব্যাপার মাওয়িস্ট এরিয়াতেও দেখেছি এক সময়। যতদিন মাওবাদীরা সিপিএমকে খুন করছিল, ততক্ষণ কিন্তু ওই এলাকার সাধারণ মানুষ বিষয়টাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছিল না। যখন সাধারণ মানুষ, দোকানদার, শিক্ষক আক্রান্ত হল, যখন মাওবাদীদের ডাকা বনধে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হল, তখন মানুষ কালেক্টিভভাবে রিঅ্যাক্ট করল। তৃণমূলের বিরুদ্ধে সিপিএম ২০১১-২০১২ সাল থেকে সন্ত্রাসের যে অভিযোগ করছে, আমার এখনও মনে হচ্ছে তা সিপিএমের ইস্যু, কোনও এলাকার সাধারণ মানুষের ইস্যু নয়। তাই সিপিএমের এই সন্ত্রাসের ইস্যু আগামী ভোটে সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনও প্রভাব ফেলবে না। বরং আমি কিছু জায়গায় এমনও দেখেছি, কোনও সিপিএম নেতা খুন হয়েছেন বা কোথাও সিপিএম পার্টি অফিস ভাঙচুর হয়েছে, সেখানকার মানুষ বলেছে ঠিক হয়েছে।
এরপর আপনি যদি ধরেন দুর্নীতির কথা। দুর্নীতির অভিযোগ যা বিরোধীরা করছে তা মূলত তৃণমূলের কিছু নেতার বিরুদ্ধে। কিছু পঞ্চায়েতের নেতা, নিচুতলার কর্মী বা যদি ধরেও নিই কয়েকজন বড় নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, তাতে কিন্তু সরকার যায় না। সরকারের বিরুদ্ধে বড় কোনও দুর্নীতির প্রমাণ এখনও নেই। কয়েকজন নেতা চুরি করছে, আর আমি সরকার পাল্টে দিচ্ছি, এটা সচরাচর হয় না। সরকারের বিরুদ্ধে সামগ্রিকভাবে বিরাট অংশের মানুষের অনাস্থা তৈরি না হলে, শুধু শাসক দলের কয়েকজন নেতার দুর্নীতির জন্য মানুষ সরকার বদল করে না। আমি ছোট থেকে বাসে, ট্রামে সিপিএমের বিরুদ্ধে অনেক কথা শুনেছি, তাতে কিন্তু বামফ্রন্ট সরকার যায়নি। তখনই সরকার গিয়েছে যখন সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের পর জমি অধিগ্রহণ ইস্যুতে গোটা রাজ্যে বহু মানুষের মধ্যে এই ভয় তৈরি হয়েছিল যে, বুদ্ধদেববাবু আবার জিতে এলে আমার জমি চলে যাবে,’ টানা বলে থামল অরিন্দম।
তারপর আবার শুরু করল, ‘তাছাড়া এবার বিধানসভা ভোটে আরও একটা বিষয় আছে। গত পঁচিশ-তিরিশ বছরে রাজ্যে এই প্রথম একটা ভোট হতে যাচ্ছে যেখানে জঙ্গলমহল কোনও ইস্যু নয়। জঙ্গলমহল মানে বলছি মাওয়িস্ট ইস্যু। হয়তো জঙ্গলমহলে বেশি সিট নেই, কিন্তু ওখানকার রাজনীতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি গোটা রাজ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। জঙ্গলমহলে শান্তি ফেরা এবার বিধানসভা ভোটে গোটা রাজ্যেই একটা বড় প্রভাব ফেলবে বলে আমার ধারণা।’
‘ঠিকই, কিষেণজির মৃত্যুর পর মাওবাদীদের পক্ষে রিগ্রুপ করা সোজা হবে না,’ বলল অনিরুদ্ধ।
‘কিষেণজির মৃত্যু তো নিশ্চয় একটা বড় ব্যাপার। মাওবাদীদের পক্ষে এখন নতুন করে সংগঠন তৈরি করা খুবই মুশকিল, প্রায় অসম্ভব। কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে বড় ইস্যু ওই এলাকায় শান্তি ফেরা। আইনশৃঙ্খলার সমস্যার জন্য ওই এলাকাগুলোতে টানা অনেক বছর মানুষের স্বাভাবিক জীবন বিপর্যস্ত ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক এবং শান্তিপূর্ণ থাকলে কী হয় তার স্বাদ একবার মানুষ পেয়ে গিয়েছে, এখন মানুষই চাইবে না এমন কিছু ঘটুক যাতে আবার গণ্ডগোলের দিন ফিরে আসে। তাছাড়া গত তিন-চার বছরে কয়েকবার জঙ্গলমহলে গিয়ে সরকারি কিছু প্রকল্প এবং নানা কারণে আমার কয়েকটা অভিজ্ঞতা হয়েছে।’
জঙ্গলমহল, বিশেষ করে ঝাড়গ্রাম নিয়ে যে কোনও আলোচনাতেই অনিরুদ্ধর অসম্ভব উৎসাহ। তার কারণ দীর্ঘদিন ঝাড়গ্রামে কাজ করা। সেই উৎসাহ থেকেই অনিরুদ্ধ প্রশ্ন করল, ‘কেমন অভিজ্ঞতা?’
‘২০১১ সালের পর আমার অ্যাসাইনমেন্টে ঝাড়গ্রামে যাওয়ার খুব একটা দরকার পড়েনি। বিশেষ কিছু ঘটছিল না বলেই যেতে হয়নি। এই ঘটনাটা সম্ভবত ২০১৪ সালের। শালবনিতে জিন্দলদের কারখানার জমিতে কিছু সমস্যা হচ্ছিল, সেই খবর করতে ভোর ভোর কলকাতা থেকে বেরিয়ে শালবনি গিয়েছিলাম। সকাল আটটার মধ্যে শালবনি পৌঁছে জিন্দলদের কারখানার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু লোকের সঙ্গে কথা বলে এগোলাম গ্রামের দিকে। গ্রামে দু’একজনের সঙ্গে কথা বলছি, এমন সময় দেখলাম দূর থেকে একজন সাইকেল চালিয়ে আসছে। একটু কাছাকাছি আসতে দেখি সাইকেলের সামনে হ্যান্ডেলের দু’দিকে দুটো বড় ব্যাগ। সাইকেলটা আরও একটু এগোতে দেখলাম একটা ন’দশ বছরের বাচ্চা ছেলে ক্যারিয়ারে বসে আছে, ছেলেটার হাতেও একটা রেশন ব্যাগ। অন্য হাত দিয়ে ছেলেটা সামনের লোকটাকে ধরে আছে। লোকটাকে থামতে বললাম। তিনি সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যাচ্ছেন? লোকটা বলল কেশপুরে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, কেন? বলল, কেশপুরে বাজার করতে যাচ্ছে। কৌতূহল হল, বুঝতে পারলাম না শালবনি থেকে এত দূরে কেশপুরে বাজার করতে যাচ্ছে কেন? শালবনিতে বাজার নেই নাকি? লোকটা বলল, সে দু’টাকা কিলোর চাল পায় সরকার থেকে। বাড়িতে পাঁচজন লোক। দুটো বাচ্চা, বুড়ি মা আর স্ত্রী। সেই সময় জঙ্গলমহলে রাজ্য সরকারের প্রকল্প ছিল, প্রতি পরিবারকে দু’টাকা কিলো দরে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল দেওয়া হত। শালবনি ব্লক ছিল জঙ্গলমহলের মধ্যে। লোকটা বলল, সে ওই চাল পায় প্রতি সপ্তাহে। কিন্তু পুরো চাল বাড়িতে লাগে না, প্রতি সপ্তাহেই কিছুটা করে চাল বেঁচে যায়। এভাবে সারা মাসে বারো-পনেরো কিলো চাল বেঁচে যায়। কিন্তু যেহেতু কেশপুর জঙ্গলমহলে পড়ত না, তাই সেখানকার লোক ওই দু’টাকা কিলোর চাল পেত না। সারা মাসে যে চালটা বেঁচে যেত লোকটা মাসে একবার তা নিয়ে প্রায় পঁচিশ-তিরিশ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে কেশপুর চলে যেত। কেশপুরে বাজারে ওই চাল কোনও গরিব লোককে পনেরো-ষোল টাকা কিলো দরে বিক্রি করে দিত। কেশপুরেও তো অনেক গরিব লোক আছে, সেই কোয়ালিটির চাল বাজারে কুড়ি-বাইশ টাকা দরে বিক্রি হত। লোকটা সেই চাল কেশপুরে বিক্রি করে সেখান থেকে মাছ কিনে আনত। মাসে ওই একদিনই মাছ হত ওদের বাড়িতে। আমি পুরো ঘটনাটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। লোকটার চেহারা, পোশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছিল খুব গরিব। চালের ভারে প্রায় বেঁকে যাওয়া সাইকেলটাকে লোকটা দু’হাতে শক্ত করে ধরে আছে, পিছনে বাচ্চা ছেলেটা শক্ত হয়ে বসে আছে একটা চালের ব্যাগ জাপটে ধরে। আর আমি ভাবছি, কত কম চিনি, জানি নিজের রাজ্যটাকে। সরকার দু’টাকা দামে গরিব লোককে যে চাল দেয় তার যৌক্তিকতা, তার গুণমান নিয়ে কত বক্তব্য শুনি। টিভিতে কখনও এমনও খবর দেখি, কোথাও চাল খারাপ বলে রেশন দোকানে মানুষের বিক্ষোভ। কিন্তু কোনও দিন ভাবতেও পারিনি এই প্রকল্পটা আছে বলে একটা গরিব পরিবার মাসে একদিন মাছ খায়। কোনও দিন ভাবতেও পারিনি একজন গরিব দিনমজুর তার দশ বছরের বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে মাসে একদিন জঙ্গলমহলের ব্লক থেকে পাশের ব্লকে যায় চাল বিক্রি করতে, বদলে মাছ কিনে বাড়ি ফেরে। বাড়িতে মা, স্ত্রী, এক সন্তান অপেক্ষা করে বসে থাকে লোকটা কতক্ষণে চালটা বিক্রি করতে পারবে তার জন্য। যেদিন চাল তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়ে যায়, সেদিন সে ফিরবেও তাড়াতাড়ি, সেদিন হয়তো দুপুর দুটো নাগাদ গোটা পরিবার দু’টাকা কিলো চালের ভাত দিয়ে দেড়শো টাকা কিলোর মাছ খাবে।
গোটা ঘটনাটা বলে লোকটা আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি সরকারের লোক কিনা। আমার গাড়ি, আমার পোশাক-আশাক দেখে বুঝেছে আমি স্থানীয় কেউ নই। তারপর আমাকে বলল, আমি তার এই অতিরিক্ত চাল বিক্রির কথা যেন কাউকে না বলি। তার ভয়, এই কথা সরকারের কানে গেলে যদি প্রকল্প থেকে তার নাম কাটা যায়। তারপর লোকটা আবার সাইকেলে উঠে রওনা দিল কেশপুরের দিকে। যতক্ষণ দেখা যায় আমি তাকিয়ে থাকলাম সাইকেলটার দিকে। বাচ্চাটা শক্ত করে এক হাতে চালের ব্যাগটা ধরে অন্য হাতে বাবাকে ধরেছে। চাল বিক্রি করে মাছ কিনতে যাওয়া সহজ, সরল সোগাসোগা চেহারার বাচ্চাটা ছোট হতে হতে মিলিয়ে গেল একসময়। তার এক-দু’বছর পর হবে, কবে ঠিক মনে নেই, শুনলাম সরকার জঙ্গলমহলের দু’টাকার চালের প্রকল্প তুলে গোটা রাজ্যেই বিনামূল্যে চাল দেওয়া চালু করছে। সেদিন আমার মনে পড়ছিল শালবনির ওই লোকটা আর তার ছেলের কথা, তাদের বেঁচে যাওয়া চাল কেশপুরে বিক্রি করে মাছ কেনার কথা। রাজ্যে সবার জন্য বিনামূল্যে চাল দেওয়ার কথা শুনে খুশিই হয়েছিলাম। কিন্তু ভাবছিলাম, সবাই বিনামূল্যে চাল পেলে ওই পরিবারটা মাছ খাবে কীভাবে? মাঝে মাঝে ভাবি ২০১৪ সালেও কী অবস্থা ছিল জঙ্গলমহলের বহু মানুষের!’ টানা বলে থামল অরিন্দম। দম নিল খানিকটা। তারপর অনিরুদ্ধর প্যাকেটটা টেনে আর একটা সিগারেট ধরাল।
মন দিয়ে অরিন্দমের কথা শুনছিল অনিরুদ্ধ, তারপর বলল, ‘আপনি তো একটা ঘটনা বললেন। আমি একটা ঘটনার কথা বলি। ঘটনাটা নিয়ে আমি আর আমার স্ত্রী এখনও মাঝে মাঝে বাড়িতে আলোচনা করি, বিষয়টা আমাদের এতটাই অবাক করেছিল। সেটা ২০০০ বা ২০০১ সাল হবে, আমি ঝাড়গ্রামে পোস্টেড।
ক্রমশ।..
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।