১৭-০৭-২০২২, রাজ্যত্যাগ এবং প্রশিক্ষণ পর্ব
পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে পাঞ্চেত পাহাড়ে এক ছোট্ট গ্রাম ধুনিয়া। কোথাও জঙ্গল, কোথাও ফাঁকা মাঠ, একদিকে টানা উঠে গিয়েছে পাহাড়। প্রথম যেদিন সিংরাই ধুনিয়া গ্রামে এসেছিল, ওর মনে হয়েছিল কাঁকড়াঝোড়ের আমলাশোলের কথা। দেখতে দেখতে এই গ্রামে প্রায় তিন মাস কেটে গেল সিংরাইয়ের। গ্রামের মাঝি রামজীবনের বাড়িতে ঠাঁই হয়েছিল সিংরাইয়ের। রামজীবন কাজকর্ম তেমন কিছু করে না, বাবার বয়সী এই মানুষটার সঙ্গে সিংরাই গল্প করত নানা বিষয় নিয়ে, আর ফাঁকা সময়ে ঘুরে বেড়াত আশপাশের নানা গ্রামে। পুরুলিয়ার এদিকটায় সিংরাই আগে আসেনি।
আজ ধুনিয়ায় শেষ দিন সিংরাইয়ের। গত এক-দেড়’মাস ধরে সিংরাই অপেক্ষা করছে কবে তার ডাক আসবে। পায়ের অবস্থা এখন পুরোপুরি ঠিক, হাঁটতে, দৌড়তে কোনও অসুবিধে নেই। অবশেষে পরশু রাতে খবর এসেছে আজ সন্ধ্যায় রেডি থাকার জন্য। সকাল থেকে সিংরাই আর বাড়ির বাইরে বেরোয়নি। রাতে সে চলে যাবে বলে রামজীবন একটা মোরগ কেটেছে আজ। দুপুরে খেয়ে চুপচাপ বসেছিল ঘরে। তিন-চারদিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে পুরুলিয়ায়, আজ সকাল থেকে কমেছে। রাতে খাওয়ার পর রামজীবনের বাড়ির উঠোনে বসেছিল সিংরাই। যত দূর চোখ যায় ঘন অন্ধকার, নানান পোকার ডাকের শব্দ। বৃষ্টিতে গরমটা অনেকটাই কম, ঠান্ডা হাওয়া আসছে দক্ষিণ দিক থেকে। হঠাৎই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে ওঠে সিংরাইয়ের। অভিজ্ঞতা তাকে বলে, যে কোনও মুহূর্তে এসে পড়বে কেউ। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই রামজীবনের বাড়ির পিছনের মাঠ দিয়ে এসে হাজির হয় অর্জুন, অনন্ত, সাঁওতা আর বিশ্বনাথ। উঠে দাঁড়ায় সিংরাই, জড়িয়ে ধরে একে অন্যকে। আজ রাতেই অনন্ত, সিংরাই আর বিশ্বনাথ রওনা দেবে ঝাড়খন্ডের উদ্দেশে। তিনজনকে সব কিছু বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বনমালীর কথায় এসেছে অর্জুন।
রঘুনাথপুরের ধুনিয়া গ্রাম থেকে আদ্রা বেশি দূরের রাস্তা না, হেঁটে বড়জোর দেড় ঘণ্টা লাগবে। ঠিক হয় রাত বারোটা নাগাদ তারা ধুনিয়া থেকে রওনা দেবে। আদ্রা স্টেশনে থেকে ভোর রাতে ট্রেন আছে রাঁচির। সেই ট্রেনে চাপবে তারা, অর্জুন আদ্রা থেকে চলে যাবে বারিকুলে। বাঁশপাহাড়ির অনন্তর সঙ্গে অনেক আগে থেকেই পরিচয় ছিল সিংরাইয়ের, যদিও সে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আর দেখা হয়নি। কিন্তু বিশ্বনাথের কথা শুনলেও তার সঙ্গে আগে দেখা হয়নি সিংরাইয়ের। বিশ্বনাথ হেমব্রম তারই বয়সী, বাড়ি পুরুলিয়া ঝালদার মাঠারিখামার গ্রামে। অর্জুন জানিয়ে দেয়, তিনজনের দলটাকে লিড করবে অনন্ত। রাত প্রায় সওয়া বারোটা নাগাদ চারজন হাঁটা শুরু করে রামজীবন মাঝির বাড়ি থেকে। গ্রামের রাস্তা ধরে কিছুটা গিয়ে জঙ্গলের রাস্তা নেয় তারা। এখনও এই এলাকায় বেলপাহাড়ি বা খাতরার মতো পুলিশের তৎপরতা শুরু না হলেও ঝুঁকি নেওয়া যাবে না একটুও। আদ্রা স্টেশনে পৌঁছে আলাদা আলাদা বেঞ্চে বসে তিনজন, ভোর চারটে নাগাদ উঠে পড়ে রাঁচির ট্রেনে।
তিনজনই ভেবেছিল ট্রেনে একটু ঘুমিয়ে নেবে, কিন্তু তা আর হয় না। সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ তারা পৌঁছয় রাঁচি। স্টেশনে ট্রেন থামতেই আলাদা আলাদা দরজা দিয়ে তিন জন নেমে পড়ে প্ল্যাটফর্মে। তারপর কেউ যেন কাউকে চেনে না এভাবে এগোয় প্ল্যাটফর্ম ধরে। একদম সামনে হাঁটতে থাকে অনন্ত, তার থেকে দশ-পনেরো ফুট গ্যাপ রেখে সিংরাই, আবার কিছু গ্যাপ রেখে বিশ্বনাথ। একটু এগিয়ে একটা ফলের দোকান থেকে দশটা বড় কলা কেনে অনন্ত, তারপর দুটো প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে তিন নম্বরে একটা ফাঁকা বেঞ্চে গিয়ে বসে। পরের বেঞ্চের দু’দিকে বসে সিংরাই আর বিশ্বনাথ। বেঞ্চে বসে ব্যাগ থেকে একটা বাংলা খবরের কাগজ বের করে অনন্ত, পাশে রাখে কলাগুলো। তারপর খবরের কাগজ পড়তে শুরু করে। এই কাগজটার একই খবর যে কতবার পড়া হয়ে গেল তার! কাগজে চোখ রেখে মনে মনে ভাবে অনন্ত। সাধারণ লোকজন, হেঁটে যাওয়া অন্য যাত্রীরা বুঝতেও পারে না এই একটা বিশেষ খবরের কাগজ খুলে বসা, পাশে দশটা কলা রাখা, সবই নির্দিষ্ট সংকেত। যে তাদের নিতে আসবে রাঁচি স্টেশনে সে যাতে চিনতে পারে তাকে। রাঁচির লোকটা জানে বাংলা থেকে তিনজন আসবে, কী দেখে তাদের চিনতে হবে তা তাকে জানানো আছে শুধু। দেখতে দেখতে প্রায় এক ঘণ্টা পেরিয়ে যায়, খিধেতে পেট চিনচিন করতে থাকে তিনজনেরই। সেই কাল রাতে দশটা নাগাদ রামজীবনের বাড়িতে খেয়েছে, অনন্ত ভেবেছিল তাদের নিতে আসা লোকটার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে কলাগুলো ভাগ করে খেয়ে নেবে। কিন্তু যতক্ষণ না লোকটা আসে তা খাওয়াও যাবে না! যদিও অনন্ত, সিংরাই বা বিশ্বনাথ কেউই বুঝতে পারে না, যে তাদের নিতে আসবে সে অনেকক্ষণ আগেই এসে গিয়েছে স্টেশনে। কিন্তু এটা রাঁচি, নতুন তৈরি হওয়া ঝাড়খন্ড রাজ্য, এখানে এমসিসি’র সংগঠন অনেক পোক্ত, এখানে পুলিশের নজরদারি অনেক সিরিয়াস, তাই এখানে এমসিসি’র লোকজনের সতর্কতাও অনেক বেশি। যে লোকটা স্টেশনে এসেছিল অনন্তদের রিসিভ করতে, সে দূর থেকে নজর রাখছিল ওদের ওপর। হঠাৎই অনন্তর চোখে পড়ে তার থেকে দুটো বেঞ্চ আগে এসে বসে একজন মাঝবয়সী লোক, তার হাতে একটা হিন্দি খবরের কাগজ। তারপর লোকটা কাগজটা খুলে কয়েকটা পাতা উল্টে একদম শেষের পাতা পড়তে শুরু করে। ইশারা বুঝে নেয় অনন্ত, সেও সোজা চলে যায় নিজের কাগজের শেষের পাতায়। তা দেখে লোকটা উঠে পড়ে বেঞ্চ থেকে, সোজা হাঁটতে শুরু করে স্টেশন থেকে বেরনোর রাস্তার দিকে। তাকে ফলো করে অনন্ত। অনন্তর পিছু নেয় বাকি দু’জন। স্টেশন থেকে বেরিয়ে খানিক এগিয়ে কিছু বাস দাঁড়িয়ে। তার একটায় উঠে পড়ে লোকটা, পিছন পিছন বাসে ওঠে অনন্তরা। লোকটার পাশের ফাঁকা সিটে বসে অনন্ত। পিছনের সিটে পাশাপাশি বসে সিংরাই আর বিশ্বনাথ। মিনিট দশেক বাদে বাস ছেড়ে দেয়। ছ’টা কলা পিছনের সিটে এগিয়ে দেয় অনন্ত। চড়া রোদ বাইরে, খোলা জানলা দিয়ে গরম হাওয়া ঢুকছে বাসে। তিনটে কলা খেয়ে চোখ বুজে সিটে হেলান দেয় সিংরাই, টের পায় না কখন চোখ লেগে গিয়েছে।
দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ তারা পৌঁছয় বুন্ডু। বাস থেকে নামার আগেই লোকটার কথায় অনন্ত সতর্ক করে দিয়েছিল সিংরাই আর বিশ্বনাথকে। বুন্ডুতে বাস থামতেই নেমে পড়ে তিনজন, লোকটা আর বাস থেকে নামে না। বুন্ডু বাস স্টপের ঠিক উল্টোদিকে থানা, বাস থেকে নেমে পিছন দিকে হাঁটতে থাকে অনন্ত। বাস থেকে নামার আগেই লোকটা অনন্তকে বলে দিয়েছিল কী করতে হবে, কোথায় যেতে হবে। একটু দূরত্ব রেখে অনন্তকে ফলো করে সিংরাই আর বিশ্বনাথ। বাস স্ট্যান্ডের থেকে দুশো’তিনশো মিটার পিছিয়ে একটা এসটিডি বুথ, তার পাশে একটা ভাতের হোটেল। ভাতের হোটেলে ঢুকে পড়ে অনন্তরা। শুরু হয় ভাতের হোটেলে অপেক্ষা, অন্য কেউ এখান থেকে নিতে আসবে তাদের। তবে বুন্ডু থানা থেকে সামান্য দূরের ভাতের হোটেলে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না তাদের। বাস থেকে নামার সময়ই লোকটা বলে দিয়েছিল ভাতের হোটেলে পৌঁছে মিনিট পনেরো অপেক্ষা করে সবজি ভাতের অর্ডার দিতে, আর তিনজন যেন আলাদা বসে, আলাদা করে খাবারের দাম দেয়। তাই করে অনন্তরা। খেতে-খেতেই অনন্ত দেখে একটা দশ-বারো বছরের বাচ্চা ছেলে হোটেলে ঢুকছে, পরনে হাফ প্যান্ট, কালো গেঞ্জি। একটা বেঞ্চে গিয়ে বসে ছেলেটা। খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে ওঠে অনন্ত, ছেলেটাও পিছন পিছন আসে, ‘মেরে পিছে আ যাও।’ কথাটা বলেই ছেলেটা হোটেল থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে দাঁড়ায়। সিংরাই আর বিশ্বনাথের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করে অনন্ত, তারপর তিন জন তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে পয়সা দিয়ে পিছু নেয় ছেলেটার। তিনজনকে আসতে দেখেই জোরে পা চালায় ছেলেটা, রাস্তা থেকে নেমে পড়ে মাঠে। মাঠের আল ধরে কিছুটা এগিয়ে একটা গ্রাম পেরিয়ে আবার উঠে পড়ে পিচ রাস্তায়, মিনিট পাঁচেক হেঁটে ছেলেটা ফের ধরে গ্রামের রাস্তা। তারপর হাঁটার স্পিড কমায় ছেলেটা, তার কাছাকাছি আসে অনন্তরা। ছেলেটার সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলতে বলতে এগোয় অনন্ত। কিছু কথা বোঝে, কিছু বোঝে না সিংরাই। হিন্দিতে এখনও সিংরাই ততটা সড়গড় হয়নি, বিশ্বনাথও পুরোপুরি ফলো করতে পারে না বাচ্চা ছেলেটার সঙ্গে অনন্তর কথা। শুধু বুঝতে পারে তারা এখন যেখানে যাচ্ছে সেই জায়গাটার নাম বারুহাতু, বুন্ডু থেকে প্রায় দশ-বারো কিলোমিটার দূরে। ঘণ্টা দেড়েক লাগবে হেঁটে যেতে। ছেলেটা জানায়, তার নাম সাগিনা মুন্ডা।
বারুহাতু গ্রামে একটা বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয় অনন্ত, সিংরাইদের। যদিও সেটাকে ঠিক বাড়ি বলা যায় না। বারুহাতু গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে চার-পাঁচটা পরিবারের বাস, সেখানে নন্দু মুন্ডা নামে একজনের ঘরে অনন্তদের পৌঁছে দেয় সাগিনা। সাগিনার বাড়িও বারুহাতু গ্রামেই, কিন্তু গ্রামের অন্যদিকে। সেখানে পৌঁছে অনন্তরা বুঝতে পারে বারুহাতু বেশ বড় গ্রাম। অনেকটা ছাড়া ছাড়া সব ঘর, গ্রামের একদিকে খোলা মাঠ কয়েক বিঘার। তারপর শুরু হয়ে যাচ্ছে জঙ্গল। অনন্তরা যখন পৌঁছয় তখন নন্দু মুন্ডা ঘরে ছিল না, কাজে গিয়েছিল মাঠে। কিন্তু অনন্তরা বুঝতে পারে মাঝে মাঝেই এখানে এসে থাকে বিভিন্ন অচেনা লোক। তাই তাদের দেখে অবাক হয় না গ্রামের কেউ বা নন্দুর বাড়ির লোকজন। এক মহিলা বেরিয়ে আসে ঘর থেকে, তাদের তিনজনকে নিয়ে যায় পাশের একটা ঘরে। মাটির ঘর, ওপরে খড়, ঘরের মেঝেতে একটা মাদুর পাতা। আর কোণায় একটা মাটির কলসি। প্রায় চারটে বাজে, এখনও বাইরে গনগনে রোদ। তিনজনেরই ব্যাগের জলের বোতল খালি হয়ে গিয়েছিল। কলসি থেকে বোতলে জল ভরে হাত, মুখ ধুয়ে নেয় তিনজন। নন্দুর বউ জিজ্ঞেস করে ওরা কিছু খাবে কিনা, কিন্তু তার কথা বুঝতে পারে না অনন্তরা কেউই। সাগিনা হিন্দিতে বুঝিয়ে দেয় মুন্ডারি ভাষায় নন্দুর বউ কী বলছে। এখন খাবে না বলে জানায় তারা। কাল রাত থেকে টানা হাঁটা, ট্রেন, বাস জার্নি, আবার হাঁটা চলছে, পরে খাবে বলে তিনজনেই ঘরের কোণে ব্যাগ রেখে শুয়ে পড়ে মাদুরে। যখন তাদের ঘম ভাঙল তখন সন্ধে হয়ে গিয়েছে। দুপুরে যেমন গরম ছিল এখন আর তা নেই।
নন্দুর ডাকে পরদিন সকাল সকাল ঘুম ভেঙে যায় অনন্তদের। ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে অনন্ত, দেখে তারই বয়সী একজন দাঁড়িয়ে আছে। ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে নন্দু বুঝিয়ে দেয় তাদের নিতে লোক এসেছে, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে বলে তাদের।
‘জলদি তৈয়ার হো যাও, লম্বা রাস্তা যানা হ্যায়,’ বলে অচেনা ছেলেটা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে রেডি হয়ে নেয় অনন্ত, সিংরাই, বিশ্বনাথ। নন্দুর বউ মোটা রুটি কাগজে মুড়ে দিয়ে দেয় তাদের নিতে আসা ছেলেটার হাতে। ভোর সাড়ে ছ’টা বাজে, তাদের নিতে আসা ছেলেটার সঙ্গে বারুহাতু গ্রামে নন্দুর বাড়ি থেকে রওনা দেয় অনন্তরা। বেশি দূর যেতে হয় না, গ্রাম শেষ হতেই ফাঁকা মাঠ, এক কিলোমিটার মতো গিয়ে অনন্তরা দেখে একটা বড় বট গাছের তলায় বসে চার-পাঁচজন, সবার বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের মধ্যে। মাটিতে রাখা দুটো লম্বা রাইফেল। অনন্তদের দেখেই উঠে দাঁড়ায় তারা। তারপর শুরু হয় হাঁটা, প্রায় অন্তহীন হাঁটা। জল, জঙ্গল, নদী পেরিয়ে টানা তিন দিন, তিন রাত ধরে পথ চলে তারা। মাঝে দুপুরে একবার, রাতে একবার বিশ্রাম। চারদিনের মাথায় অনন্তদের নিয়ে সশস্ত্র মাওবাদী স্কোয়াডটা যেখানে পৌঁছয়, সেই জায়গার নাম শিলাঘাটি। তিন দিক পাহাড়ে ঘেরা, মাঝখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদী, মাওয়িস্ট পার্টির মুক্তাঞ্চলের চেহারা কেমন হতে পারে শিলাঘাটিতে পৌঁছে তা দেখে চমকে যায় অনন্তরা। নদীর ধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে চোদ্দ-পনেরোটা টেন্ট। বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত অন্তত তিরিশ-চল্লিশ জন। কয়েকজনের পরনে কালো পোশাক, টুপি, কাঁধে রাইফেল। হাঁটাচলা সেনাদের মতো। অবাক হয়ে দেখতে থাকে অনন্ত, সিংরাইরা। এক পাশে একটা বড় টেণ্টে হলঘর, অন্তত চল্লিশ-পঞ্চাশ’জনের বসে মিটিং করার মতো ব্যবস্থা। সব দেখেশুনে ঘোর লেগে যায় অনন্তদের। ভাবে বেলপাহাড়ি, রানিবাঁধেও কি এমন ক্যাম্প বানানো যাবে কোনও দিন? শিলাঘাটি পৌঁছতে বিকেল হয়ে যায় অনন্তদের, আজকের দিনটা পুরো ক্যাম্প ঘুরে দেখে কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলেই কেটে যায়। সিংরাইদের আসল ট্রেনিং এবং যে কারণে ঝাড়খন্ডে আসা তা শুরু হয় পরদিন সকাল থেকে।
২৯-০৮-২০০২, ঘাটশিলা-কাঁকড়াঝোড় করিডোর
দেখতে দেখতে এমসিসি’র দক্ষিণ ছোটনাগপুর জোনাল কমিটির শিলাঘাটি ক্যাম্পে এক মাস কেটে গেল অনন্ত, সিংরাইদের। প্রতিদিন একই রুটিন, সামান্য হেরফের নেই। সকাল পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠা। তারপর প্রাতঃকৃত্য, ঠিক ছটায় রোল কল। তারপর কোনও গ্রুপ চলে যাচ্ছে রান্নার ব্যবস্থা করতে, কোনও গ্রুপ এক্সারসাইজ করতে। দেড় ঘণ্টা নানারকম শরীর চর্চার পর আধ ঘণ্টা খাবারের সময়। খাবারে কোনও দিন সুজি, কোনও দিন ছোলা-গুড়, কোনও দিন মুড়ি-ছোলা। খাবারের পর একটু বিশ্রাম নিয়ে বড় টেণ্টে রাজনৈতিক ক্লাস। দুপুরের খাওয়া সেরে অস্ত্র প্রশিক্ষণ। সন্ধ্যায় আবার রাজনৈতিক ক্লাস। রাত দশটায় খাওয়া। অনন্ত, সিংরাই, বিশ্বনাথরা ঘুরেফিরে এক এক দিন একটা গ্রুপে যুক্ত হয়। ক্যাম্পে যোগ দেওয়ার সাত দিনের মাথায় সিংরাইকে সেন্ট্রি ডিউটি দেওয়া হয়, বাকি কমরেডরা যখন রাতে শোবে তখন সেন্ট্রিরা বিভিন্ন পয়েন্টে ডিউটি করবে। আস্তে আস্তে রান্না থেকে সেন্ট্রি ডিউটি, রাজনৈতিক ক্লাস থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের গ্রামে গিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলা, বন্দুক চালানো, বিভিন্ন জিনিসে রপ্ত হয়ে ওঠে। হিন্দির পাশাপাশি কিছু মুন্ডারি ভাষাও শিখে নেয় তারা।
তিন-চার দিন আগেই শিলাঘাটি ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা কমরেড নগেন জানিয়েছিল, আপাতত ক্যাম্প উঠে যাবে। দুটো আলাদা গ্রুপ তৈরি করা হবে ক্যাম্পে যারা ট্রেনিং নিয়েছে তাদের নিয়ে। এক একটা গ্রুপে থাকবে দশ-বারোজন। এই দুটো গ্রুপকে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হবে, ক্যাম্পের বাকিরা চলে যাবে অন্য জায়গায়। তাদের কী দায়িত্ব পড়বে সেদিন জানতে পারেনি অনন্ত, সিংরাই, বিশ্বনাথরা। আজ সেই সিদ্ধান্ত হবে।
সকালের খাবারের পর নদীর ধারে বসেছিল অনন্ত আর সিংরাই। বিশ্বনাথ একটা গ্রুপে যুক্ত হয়ে সমস্ত তাঁবু গোটাচ্ছে। আজই শিলাঘাটিতে শেষ রাত। কিছু লোক আজই সন্ধ্যায় চলে যাবে অন্য জায়গায়। দুপুর বারোটা নাগাদ শিলাঘাটি ক্যাম্পে এসে পৌঁছয় বনমালী দেশোয়ালি, রাজারাম। তাদের সঙ্গে আরও সাত-আটজন যাদের চেনে না অনন্ত, সিংরাইরা। আটজন সশস্ত্র কমরেড তাদের নিয়ে এল ক্যাম্পে। বনমালী কাকা, রাজারামদের সঙ্গে যারা এল তাদের মধ্যে একজনকে দেখে সিংরাইয়ের মনে হয়, এই লোকটা বড়সড় কেউ হবে। এই লোকটা ঘুরেফিরে কথা বলছে নগেন, বনমালী কাকা, সোনু এবং অন্য নেতাদের সঙ্গে। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর বিকেল চারটে নাগাদ মিটিং শুরু হল বড় টেণ্টে। ক্যাম্প কেমন হয়েছে, কতজন কমরেড প্রস্তুত আছে নতুন দায়িত্ব নেওয়ার জন্য, পরবর্তী পরিকল্পনা কী, জানাল কমরেড নগেন। তারপর বলার জন্য উঠে দাঁড়াল সেই লোকটা, যাকে দেখা থেকেই সিংরাইয়ের মনে হচ্ছে, এ নিশ্চয় বড় কেউ হবে। নগেন লোকটার পরিচয় করিয়ে দিল কিষাণদা বলে। মিটিংয়ের শেষে সিংরাই জানতে পারবে কিষাণদার আসল নাম প্রশান্ত বোস।
‘এখানে অনেক নবীন কমরেড আছেন। আপনারা জানেন আমাদের লক্ষ্য কী। দেশে দিন দিন গরিবের সঙ্গে বড়লোকের ব্যবধান বেড়ে চলেছে, তা আগামী দিনে আরও বাড়বে। যেভাবে দেশ চলছে তাতে এই দুই শ্রেণির মধ্যে বিরোধ অনিবার্য। এবং এই পরিস্থিতিতে গরিব মানুষের মুক্তি এবং দেশের আমূল পরিবর্তন তখনই সম্ভব যখন নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব হবে। কিন্তু পরিস্থিতি বিপ্লবের পক্ষে অনুকূল থাকলেও তা নিজে থেকে হবে না। তা সংঘটিত করার জন্য বৈপ্লবিক রাজনৈতিক দল থাকা প্রয়োজন। নয়তো বিপ্লব হবে না। আপনারা জানেন সেই লক্ষ্যে আমাদের কাজ করতে হবে। দলের পক্ষ থেকে কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা আমি আজ আপনাদের জানাব। এই ঝাড়খন্ডের তামারবুন্ডু থেকে বাংলা পর্যন্ত দুটো আলাদা করিডোর তৈরির কাজ আজ থেকে শুরু হবে। শিলাঘাটির ক্যাম্প থেকে দুটো আলাদা গ্রুপ তৈরি হবে। দুটো গ্রুপই প্রথমে তামারবুন্ডু থেকে চান্ডিল পর্যন্ত যাবে গ্রামে সংগঠন তৈরি করতে করতে। তামারবুন্ডু থেকে চান্ডিল ইতিমধ্যেই একটা দল কাজ করছে, নতুন কমরেডরা তাদের সঙ্গে যুক্ত হবে। তারপর এই দুটো গ্রুপ চান্ডিল থেকে আলাদা হয়ে যাবে। একটা গ্রুপ চান্ডিল থেকে দলমা পাহাড় হয়ে পুরুলিয়ার বরাবাজার দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকবে। তারা বরাবাজার থেকে বলরামপুর, বান্দোয়ান এলাকায় কাজ করবে এবং সেফ করিডোর তৈরি করবে। অন্য গ্রুপটা চান্ডিল থেকে দলমা হয়ে ঘাটশিলা যাবে, সেখান থেকে কাঁকড়াঝোড় হয়ে বেলপাহাড়ি ঢুকবে। আগামী বছরের অগাস্ট-সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই দুটো গ্রুপকে ঝাড়খন্ড থেকে বাংলায় দুটো আলাদা করিডর তৈরির কাজ শেষ করতে হবে।’ এরপরও প্রশান্ত বোস ওরফে কিষাণদা বলতে থাকে নানা কথা, সংগঠন, রাজনীতির কথা। রাত ন’টা নাগাদ মিটিং শেষ হয়। তারপর খাওয়াদাওয়া, তারপর অনেক রাত পর্যন্ত সবাই নানা বিষয়ে কথা বলে নদীর ধারে বসে। ঠিক হয়, চান্ডিল থেকে যে দলটা ঘাটশিলা হয়ে কাঁকড়াঝোড় দিয়ে বেলপাহাড়ি ঢুকবে সেই দলে থাকবে অনন্ত আর সিংরাই। অন্য দলে থাকবে বিশ্বনাথ। আগামী কাল ভোররাতে দুটো গ্রুপ একসঙ্গে শিলাঘাটি থেকে যাত্রা শুরু করবে।
রাত প্রায় সাড়ে এগারটা, সবাই কিছুক্ষণ শুয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। সিংরাইকে কাছে ডাকে বনমালী। তারপর তাকে নিয়ে একটু সরে দাঁড়ায়, ‘সিংরাই, তোমাকে একটা কথা বলার আছে।’ সিংরাই বুঝতে পারে না তাকে আলাদা করে কী বলবে বনমালী কাকা।
‘আমরা তোমাকে খবর পাঠাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারিনি।’ একটু থামে বনমালী, লম্বা শ্বাস নেয়, ‘তোমার মা মারা গেছে। এমাসের দশ তারিখ।’ সিংরাইয়ে কাঁধে একটা হাত রাখে বনমালী। খবরটায় কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে ষোল বছরের ছেলেটার বুঝতে পারে না, চুপ করে থাকে। আকস্মিক এই বার্তা অপ্রস্তুত করে দেয় সিংরাইকে। সে বুঝতেও পারে না মায়ের মৃত্যুর খবরটা কিছুক্ষণ বাদে তার মধ্যে কী প্রভাব ফেলতে চলেছে, কিন্তু এই মুহূর্তে একটা শব্দও উচ্চারণ না করে দাঁড়িয়ে থাকে সে।
সিংরাইয়ের শ্বাস পড়ার শব্দও যেন শুনতে পায় বনমালী, ‘দু’তিন ধরে শরীর খারাপ ছিল। জ্বর কমছিল না। একদিন বিকেল থেকে শরীর হঠাৎই খুব খারাপ হয়ে যায়, তোমার বাবা আর ভাই বেলপাহাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু পৌঁছতে পারেনি।’ কোনও জবাব দেয় না সিংরাই। দু’মাস আগে পুরুলিয়ার পাঞ্চেত থেকে একদিনের জন্য বাড়ি গিয়েছিল, সেদিন মাকে শেষ দেখা। সিংরাইয়ের মনে পড়ে সেদিনের কথা। রাত ন’টার পর বাড়ি পৌঁছেছিল সিংরাই। তাকে দেখে ভাত বসিয়েছিল যমুনা মান্ডি। জানত ছেলে আর কোনও দিনই পাকাপাকি ফিরবে না, তাও বলেছিল ওদের ছেড়ে বাড়ি চলে আসতে। সিংরাই কোনও জবাব দেয়নি। পরদিন আলো ফোটার আগেই সিংরাই বাড়ি ছাড়ে। আজ শিলাঘাটিতে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে মাকে সঙ্গে নিয়ে আদিবাসী পাড়ায় ঘুরে ঘুরে মাটির হাঁড়ি, তাওয়া বিক্রির কথা মনে পড়ে তার। বনমালী সিংরাইকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগোয় তাদের জন্য নির্দিষ্ট তাঁবুর দিকে। সিংরাইয়ের মায়ের মৃত্যুর খবর আগেই কিষাণদাকে জানিয়ে রেখেছিল বনমালী। বলেছিল, আজ রাতটা সিংরাইয়ের সঙ্গে শোবে সে। টেণ্টে না ঢুকে একটা পাথরের ওপর বসে দু’জন। নদীর জলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। প্রায় আধ ঘণ্টা চুপ করে বসে থাকে তারা, কেউই প্রায় কোনও কথা বলে না। তারপর আস্তে আস্তে ঢুকে যায় টেণ্টে। সিংরাইয়ের স্বভাব জানে বনমালী। জানে ছেলেটা কোনও কথা বলবে না। বুঝতে দেবে না তার মনের মধ্যে কী চলছে। বনমালী লক্ষ্য করে, মায়ের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর প্রায় এক ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে, এখনও সিংরাইয়ের চোখে এক ফোঁটা জল দেখেনি। যদিও বনমালী বুঝতে পারে না, আজ থেকে ঠিক দু’দিন বাদে সিংরাইয়ের প্রথমবার মনে হবে, বাড়ি না ছেড়ে সে যদি বাবা-মাকে ঘরের কাজে সাহায্য করত, সংসারের কাজে লাগত, তবে হয়তো মা এই বয়সে মারা যেত না। বাড়ি ছাড়ার দু’বছর বাদে এক মুহূর্তের জন্য হলেও সিংরাইয়ের মনে প্রশ্ন আসবে, রোগে ভোগা, কষ্টে দিন কাটানো বাবা-মা’র বিপদের সময় যদি কোনও কাজে আসতে না পারি, তবে রাজ্যের, দেশের মানুষের মুক্তি আনব কীভাবে?
ক্রমশ...
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।