২২-০১-২০১৬, ঝাড়গ্রাম
অনিরুদ্ধর সঙ্গে কথার পর পেরিয়ে গিয়েছে এক মাস, তারপর যাব যাব করেও ঝাড়গ্রাম যেতে পারেনি অরিন্দম। যেদিন থেকে ধর্মা নামের ছেলেটার কথা শুনেছে, দশ-এগারো বছরের যে ছেলেটা আপেল চিনতে পারেনি, বারবার অরিন্দমের মাথায় ঘুরেফিরে আসছে সেই ঘটনাটা। ছেলেটার চেহারা কল্পনা করার চেষ্টা করে অরিন্দম। নিজের ছেলে এবং আশপাশে বা শপিং মলে দেখা ওই বয়সী বাচ্চাদের সঙ্গে ছেলেটার তুলনা করার চেষ্টা করে। অনিরুদ্ধর কাছে শোনা বেলপাহাড়ির ময়ূরঝর্ণা গ্রামের ছেলেটার কথা মনে পড়লে এক অপরাধবোধে ভোগে অরিন্দম। বাজারে ফলের দোকানে দাঁড়ালেও মাঝেমাঝে মনে হয় ছেলেটার কথা। এই অপরাধবোধ অরিন্দমকে শান্তি দেয় না। সে ঠিক করে একবার যেতে হবে ময়ূরঝর্ণা গ্রামে। দেখা করতে হবে সেই ছেলেটার সঙ্গে, যে এখন যুবক। জানতে হবে তার জীবনের কথা। কীভাবে বড় হল ছেলেটা, এখন কী করে, তার বাড়ির কী অবস্থা, নানা কথা ভাবার চেষ্টা করে অরিন্দম।
শেষ পর্যন্ত অফিস থেকে ছুটি নিয়ে অরিন্দম বেরিয়েই পড়ল। সকাল সকাল চেপে বসল ঝাড়গ্রামের ট্রেনে। অরিন্দম ঠিক করেছে, দুপুরে ঝাড়গ্রামে পৌঁছে আজ আর বেলপাহাড়ি যাবে না। প্রপার বেলপাহাড়ি গেলেই তো হবে না, যেতে হবে ময়ূরঝর্ণা। তারপর তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা কে জানে! এমনিতেই শীতকাল, তাড়াতাড়ি সন্ধে হবে। কাল বরং ভোর ভোর বেলপাহাড়ি যাওয়া যাবে।
ট্রেনে উঠে অরিন্দম জানলার পাশে একটা সিট পেয়ে যায়। ময়ূরঝর্ণা গ্রামের নামটা প্রথম কবে, কোথায় শুনেছিল মনে করার চেষ্টা করে। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি, অফিস থেকে অরিন্দমকে পাঠানো হয়েছিল ঝাড়গ্রামে। দু’মাস বাদেই ছিল রাজ্যে বিধানসভা ভোট। তার আগে রাজ্যের মাওবাদী প্রভাবিত এলাকার খবর করতে দিন সাতেকের জন্য অরিন্দম ঝাড়গ্রাম গিয়েছিল। একদিন রাতে ঝাড়গ্রামের হোটেলে ও খবর পায়, বাঁশপাহাড়ির কাছাকাছি একটা পিচ রাস্তা তৈরির কাজে বাধা দিচ্ছে মাওবাদীরা। সরকার গ্রামে পাকা রাস্তা বানাচ্ছিল, সেখানে রাতের অন্ধকারে পিচ গলানোর গাড়িতে মাওবাদীরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। অরিন্দম ঠিক করে পরদিন সেই স্পটে যাবে। সকালে ঝাড়গ্রাম থেকে বেরিয়ে সোজা চলে যায় বেলপাহাড়ি। তারপর চাকাডোবা পেরিয়ে গিয়েছিল সেই গ্রামে, জায়গাটার নাম এখন আর মনে নেই। রাস্তার এক ধারে দাঁড়িয়েছিল আগুনে পোড়া পিচ গলানোর গাড়িটা। প্রশাসন জানিয়েছিল, মাওবাদীরা উন্নয়ন চায় না বলেই রাস্তা তৈরিতে বাধা দিতে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। সেই এলাকার অনেক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলেছিল অরিন্দম, কেউই মাওবাদীদের কথা বলেনি ওকে। অরিন্দমের মনে হয়েছিল, মানুষ হয়তো ভয়ে বলতে পারছে না কে ওই গাড়িতে আগুন ধরিয়েছে। সেখানে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই কারও মুখে অরিন্দম শুনেছিল ময়ূরঝর্ণা জায়গাটার কথা। চাকাডোবা না বাঁশপাহাড়ি, কোথায় শুনেছিল ময়ূরঝর্ণার নাম, তা এত বছর পর আজ আর মনে নেই। কিন্তু গ্রামটার নাম শুনেই পছন্দ হয়েছিল ওর। কিছুটা গাড়িতে, কিছুটা হেঁটে পৌঁছেছিল গ্রামটায়। হয়তো ভেবেছিল ময়ূর বা ঝর্ণা কিছু তো একটার দেখা মিলবে! কিন্তু গ্রামটায় আলাদা করে বিশেষ কিছু চোখে পড়েনি অরিন্দমের। যেমন হয় এই সব এলাকা। ছোট গ্রাম, কয়েকটা ঘর। প্রায় সকলেই আদিবাসী পরিবার। গ্রামের চেহারা দেখেই মনে হয়েছিল দারিদ্র আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে এলাকাটাকে। তার আগে বা পরে কাজের সূত্রে জঙ্গলমহল তো বটেই, অরিন্দম রাজ্যের বহু গ্রামে গিয়েছে। কিন্তু ময়ূরঝর্ণা নামটা মাথায় গেঁথে আছে আজও। নামে সত্যিই এসে যায়!
হঠাৎই তেলেভাজা, তেলেভাজা চিৎকার অরিন্দমকে এক সেকেন্ডে ২০০৬ থেকে ২০১৬ সালে ফেরত নিয়ে আসে। বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে দশ বছর আগে চলে গিয়েছিল মনে পড়ে না। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে থামেনি এখনও, কিন্তু তেলেভাজার ঝুড়ি হাতে কয়েকজন লাফ মেরে চলন্ত কামরায় উঠে পড়েছে। লোকগুলোর হাতে লাল শালুতে মোড়া তেলেভাজার ঝুড়ি দেখে অরিন্দম বুঝতে পারে মেচেদা এসে গিয়েছে। চপের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে কামরায়। পাঁশকুড়ার চপে কী যে ম্যাজিক আছে, সুভাষ মাহাতোর মুখটা হঠাৎই ভেসে ওঠে চোখের সামনে। মাঝারি উচ্চতা, গায়ের রং কালোর দিকে, বাঁদিকে সিঁথি করে পেতে আঁচড়ানো চুল, বহু বছর কোনও যোগাযোগ নেই। বেলপাহাড়ির সুভাষ মাহাতো এখন কেমন আছে কে জানে!
সেটা ২০০৯ সাল, জঙ্গলমহলে লোকসভা ভোটের ঠিক আগের দিন। অরিন্দম গিয়েছিল ঝাড়গ্রাম লোকসভা সিটের ভোট কভার করতে। ভোটের আগের দিন সকালে গিয়েছিল লালগড়। লালগড় তখন জঙ্গলমহল এবং মাওবাদী নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে। ঠিক করেছিল ভোটের আগের দিন এলাকার ছবি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি ঝাড়গ্রামের হোটেলে ফিরে যাবে। পরদিন খুব ভোরে বেরতে হবে। লালগড়ে কাজ সেরে ঝাড়গ্রামের দিকে রওনা দেওয়ার সময় ফোন করেছিল সুভাষ মাহাতোকে। সুভাষ মাহাতো বেলপাহাড়িতে ঝাড়খন্ড পার্টি করত। কয়েক বছর আগে পরিচয়, একটা স্কুটার ছিল সুভাষ মাহাতোর, সেটা নিয়েই ঘুরে বেড়াত বেলপাহাড়ির নানা জায়গায়। বেলপাহাড়ির রাজনীতির অনেক খবর রাখত সুভাষ মাহাতো। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যেত নানা অজানা তথ্য। ঝাড়গ্রাম শহরের একদিকে লালগড় তো অন্যদিকে বেলপাহাড়ি। দু-তিন’বার রিং হতেই ওপার থেকে সুভাষ মাহাতোর ভারী গলা।
‘হ্যালো...’
‘কেমন আছেন? বেলপাহাড়ির কী খবর?’
‘বেলপাহাড়ি এসেছেন নাকি?’
‘বেলপাহাড়িতে ঠিক আসিনি, তবে ঝাড়গ্রামে এসেছি। সকালে লালগড় গিয়েছিলাম। বেলপাহাড়ির কী খবর?’
‘খবর পুরো জঙ্গলমহলেই এক, এবার পরিস্থিতি আলাদা। চলে আসুন না, সামনাসামনি কথা হবে।’
একটু ইতস্তত করে অরিন্দম, লালগড় থেকে বেলপাহাড়ি অনেকটা রাস্তা। ঝাড়গ্রামে ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে।
‘আমি শিলদা এসেছি একটা কাজে। চলে আসুন এখানে,’ ফোনে কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে বলে সুভাষ মাহাতো।
ঠিক আছে। শিলদায় আপনি কতক্ষণ থাকবেন? এখন তিনটে বাজে, আমার যেতে যেতে চারটে হবে।’
‘চলে আসুন, আমি আছি। শিলদা মোড়ে এসে ফোন করবেন।’
লালগড় থেকে শিলদা পৌঁছতে খুব বেশি সময় লাগেনি অরিন্দমের। ভোটের আগের দিন, রাস্তাঘাটও অনেক ফাঁকা।
‘চলুন চায়ের দোকানে গিয়ে বসি,’ শিলদা মোড়ে পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমে সুভাষ মাহাতোকে ফোন করেছিল অরিন্দম। এমনিতে শিলদা মোড় খুবই জমজমাট জায়গা। প্রচুর দোকান, কলেজ, লজ। ভিড়ভাট্টা লেগেই আছে। শিলদা মোড়ের একদিকে রাস্তা ফুলকুসমা, রাইপুর হয়ে বাঁকুড়ায় ঢুকছে, একদিকে বিনপুর হয়ে ঝাড়গ্রাম, একদিকে বেলপাহাড়ি। সারাক্ষণ বাসের হর্ন আর নানা জায়গার নাম ধরে কন্ডাক্টরদের চিৎকার, শিলদা মোড়ে বিভিন্ন দিকে যাওয়ার বেসরকারি বাসগুলো দাঁড়ায়ও সব অদ্ভুতভাবে। একটার প্রায় ঘাড়ে আর একটা। খাতরায় যাওয়ার লোক মাঝে মাঝেই ভুল করে সারেঙ্গার বাসে উঠে বসে। কিছু বাদে পাশের চা দোকান থেকে উঠে মুখে পান, হাতে বিড়ি নিয়ে কন্ডাক্টর সেই বাসের পাশে এসে দাঁড়ায়। তারপর কন্ডাক্টরকে জিজ্ঞেস করে সেই লোকটা হাতে রেশন ব্যাগ নিয়ে হুড়মুড় করে নেমে আসে বাসটা থেকে। ব্যাগ থেকে গলা বাড়াচ্ছে একটা কালো হাঁস। ততক্ষণে হয়তো সারেঙ্গার বাস চলে গিয়েছে! এমন নানান কাণ্ড সারাদিন ধরে ঘটতেই থাকে শিলদায়। কিন্তু ভোটের আগের দিন অবেলায় শিলদা মোড়ে ভিড়ভাট্টা অনেকটাই কম। এই শিলদার নাম রাজ্যবাসী জানতে পারবেন আরও আট-দশ মাস বাদে, যখন সেখানে ইস্টার্ণ ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস বা ইএফআর ক্যাম্পে দিনেদুপুরে আক্রমণ করবে মাওবাদীরা। যদিও সেদিন, মানে সুভাষ মাহাতোর সঙ্গে কথা বলতে শিলদা গিয়ে অরিন্দমের দূরতম ভাবনাতেও আসেনি যে, এমন জনবহুল একটা জায়গায় কোনও দিন পুলিশ ক্যাম্পে আক্রমণ হতে পারে!
রাস্তা পেরিয়ে সটান অরিন্দমের সামনে এসে দাঁড়াল সুভাষ মাহাতো,
‘চলুন ওই চায়ের দোকানটায় গিয়ে বসি।’
‘মুড়ি-তেলেভাজা খাবেন?’ সুভাষ মাহাতো প্রশ্নটা করার আগেই অরিন্দমের চোখে পড়েছিল পাশেই তেলেভাজার দোকান, উনুনে কড়াই চাপানো হয়েছে। চপ, বেগুনি ভাজার প্রস্তুতি চলছে।
‘তা খেতে পারি, তবে মুড়ি খাব না। শুধু তেলেভাজা। আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রামের তেলেভাজার বিশেষত্বটা কী? অনেক জায়গায় চপ খেয়েছি। কিন্তু পাঁশকুড়া থেকে যখনই মেদিনীপুরে ঢুকলাম, হেঁড়িয়া থেকে শুরু করে দিঘা, সবং, ঝাড়গ্রাম, তেলেভাজা বাকি রাজ্যের থেকে একদম আলাদা।’
অরিন্দমের প্রশ্ন শুনে ভাবতে এক মিনিটও লাগল না সুভাষ মাহাতোর, ‘বিশেষত্ব কিছুই না। আসলে তফাৎ হচ্ছে তেলেভাজা যে ব্যাসনে চোবানো হয় সেটায়। এখানে অনেকে ব্যাসনের মধ্যে অল্প খেসারির ডাল বাটা মেশায়, যার জন্য তেলেভাজাটা একটু মুচমুচে হয়।’
‘ঠিক বলেছেন, সবসময় ভাবতাম মেদিনীপুরের সঙ্গে কলকাতার তেলেভাজার তফাৎটা কী? এখানকার এই মুচমুচে ভাবটার জন্য তেলেভাজা খেতে ভালো লাগে। আচ্ছা, এবার বলুন বেলপাহাড়ির কী খবর?’
‘খবর আর কী? পুরো জঙ্গলমহলেই এবার পরিস্থিতি আগের থেকে আলাদা। একটা কথা বলছি, সরকার কিন্তু পুলিশ দিয়ে আর পরিস্থিতি কন্ট্রোল করতে পারবে না।’
‘পুলিশ দিয়ে কন্ট্রোল করা ছাড়া তো আর কোনও রাস্তাও নেই সরকারের কাছে। মাওবাদী সমস্যা যেভাবে ছড়াচ্ছে একের পর এক গ্রামে, এত খুন, সন্ত্রাস...’
কথা শেষ করতে পারে না অরিন্দম। তাকে থামিয়ে সুভাষ মাহাতো বলে ওঠে, ‘একটা কথা বলুন তো, এই এলাকার কথা উঠলেই আপনারা মাওবাদী সমস্যা বলেন কেন? মানুষের সমস্যা আছে বলেই তো মাওবাদী আছে। মাওবাদীরা সমস্যা হবে কেন?’
সুভাষ মাহাতোর প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় অরিন্দম। কিছু একটা বলার চেষ্টা করতে গিয়েও থেমে যায়, চুপ করে থাকে। ফের বলে ওঠে সুভাষ মাহাতো, ‘আসলে আপনাদের দোষ নেই, সরকার সব সময় বলে মাওবাদী সমস্যা, মাওবাদী সমস্যা, মিডিয়াও বলছে মাওবাদী সমস্যা। আপনারা মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখুন, মানুষ মাওবাদীদের সমস্যা বলে মনে করে কিনা। যেদিন মানুষ মাওবাদীদের সমস্যা বলে মনে করবে, সেদিন সরকার, পুলিশ কিছু লাগবে না, খুন, সন্ত্রাস এমনিই থেমে যাবে। কিন্তু মানুষ যদি মাওবাদীদের সমস্যা বলে মনে না করে, তবে পুলিশ দিয়ে সরকার কিছু থামাতে পারবে না।’ টানা বলে থামে সুভাষ মাহাতো। চায়ে লম্বা চুমুক দিয়ে একটা সিগারেট ধরায়। চুপচাপ বসে থাকে অরিন্দম। সুভাষ মাহাতোর কথার কোনও জবাব দিতে পারে না। তেলেভাজা খেতে খেতে কথা বলছিল, কাঠের বেঞ্চে রাখা কাগজের কাপে চা ঠান্ডা হয়ে যায়। অরিন্দম একটা সিগারেট ধরায়, তারপর বলে, ‘আপনি ঠিক বলেছেন। আমি কোনও দিন ভাবিনি এভাবে, এটা আমাদেরই দোষ। একটা রাজনৈতিক আন্দোলনকে সমস্যা বলা ঠিক না। আসলে আমরা যারা কলকাতায় থাকি অনেক কিছুই একদিক থেকে দেখি, অন্য দিকটা সবসময় দেখা হয় না।’
অরিন্দম বলল বটে সবসময় অন্য দিকটা দেখা হয় না, সত্যি কথা বলতে কখনই দেখা হয় না। অন্যদিকে থাকা মানুষ প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায় তা ভালোই জানেন! এর কিছু বছর বাদে, বয়স আরও খানিকটা বাড়লে অরিন্দম একদিন বুঝবে, কোনও কোনও জিনিসকে শুধু দুটো দিক থেকে নয়, চাইলে একশো দিক থেকেও দেখা যায়। আর একশো দিক থেকেই তাকে আলাদা আলাদা লাগে।
হঠাৎ জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে আস্তে হয়ে যায় ট্রেন, এক ধাক্কায় শিলদা থেকে খড়গপুরে পৌঁছে যায় অরিন্দম। ট্রেন থামে খড়গপুর স্টেশনে। আর খুব বেশি সময় লাগবে না, পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে সময় দেখে অরিন্দম। অনেকদিন পর ঝাড়গ্রামে যাচ্ছে।
১০-০৪-২০০০, ময়ূরঝর্ণা
কেন্দিশোলের জোতদার যদুনাথ মন্ডলের জমির ধান কাটার ঘটনার পর পেরিয়ে গিয়েছে কয়েক মাস। কিন্তু এখনও প্রতিটা দিনই এক ঘোরের মধ্যে কাটে সিংরাইয়ের। সেই ধান কাটার রাত, পরদিন সকালে মহুল পাহাড়ে বনমালী দেশোয়ালির সঙ্গে কথা, বাজেয়াপ্ত শব্দের মানে, এক ধাক্কায় যেন সিংরাইয়ের জীবনটাকেই ওলটপালট করে দিয়েছে। এমন নয় যে অনিল বা তার অন্য বন্ধুরা, বাবা-মা বা ভাই, বোন সবটা বুঝতে পারছে তার মনের ভেতর কী চলছে, কিন্তু সিংরাই নিজে বুঝতে পারে মাঝে মাঝেই অস্থির অস্থির লাগছে তার। মনে হয় দৌড়ে চলে যায় বনমালী আর তার সঙ্গীদের কাছে। মনে হয় বড় একটা দল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে যদু মন্ডলের মতো অন্য কোনও জোতদার, জমিদারের মাঠে। এখন বেশিরভাগ সময় একা একাই কাটায় সিংরাই। স্কুলে যেতে ওর কোনও দিনই ভালো লাগত না, কিন্তু টিফিন টাইমে বা ছুটির পর ফুটবল খেলত। এখন সব দিন খেলতেও ইচ্ছে করে না চোদ্দ বছরের ছেলেটার। এই ইচ্ছে না করার কারণ যে মাথায় চেপে বসা বনমালী দেশোয়ালির কথাগুলো তা বুঝতে পারে সিংরাই। মাঝে মাঝে মনে হয়, লোকটা হয়তো ভুলেই গেছে তাকে। অথচ সেদিন সকালে মহুল পাহাড় থেকে চলে যাওয়ার সময় লোকটা বলেছিল একদিন আসবে তার গ্রামে। পাঁচ মাস হয়ে গেল, এল না তো কেউ। নাকি এসেছে, সে জানতে পারেনি!
অন্য পাঁচটা দিনের মতো আজও আর একটা দিন শুরু হয় ময়ূরঝর্ণা গ্রামে। সকালে ঘুম থেকে উঠে মাঠে প্রাতঃকৃত্য সেরে ঘরের সামনে উঠোনে গিয়ে বসে সিংরাই। সকাল সকাল চড়া রোদ এসে পড়েছে উঠোনে। মা জঙ্গলে যাবে কেন্দু পাতা তুলতে। বাবা কাজে বেরনোর তোড়জোড় করছে, সিংরাই ঠিক করে আজও স্কুলে যাবে না। সব বই নেই, খাতা নেই, ক্লাসে পড়া ধরলে পারে না, শুধু শুধু বকা খেতে স্কুলে যাওয়ার মানে নেই। সকালবেলাটা বাবাকে একটু এড়িয়ে চলে সিংরাই। যদি বাবা স্কুলে যেতে বলে, তাই বাবার থেকে সরে সরে থাকে। হঠাৎই সিংরাই দেখে সহদেব কাকা আসছে তাদের বাড়ির দিকে। এই সকালে সহদেব কাকা কেন আসছে, উঠে দাঁড়ায় সে। সিংরাই প্রথমে ভাবে সহদেব কাকা বাবাকে ডাকতে এসেছে, হয়তো দু’জনের একসঙ্গে কোথাও কাজে যাওয়ার কথা। কিন্তু সহদেব সোজা এসে দাঁড়ায় সিংরাইয়ের সামনে।
‘কাল রাতে বনমালী এসেছে পাশের গ্রামে। এইমাত্র আমাকে খবর পাঠাল, তোকে বলতে বলেছে। তুই কি দেখা করতে যাবি?’
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না সিংরাই, উত্তেজনায় হৃদপিণ্ডের কম্পন বেড়ে যায় তার।
‘হ্যাঁ যাব। কোথায় যেতে হবে?’
‘জুজারধারা। এখনও গ্রামে আছে, একটু বাদেই চলে যাবে। আমাকে বলে পাঠাল তোকে খবর দিতে। দেখা করতে হলে এখনই যেতে হবে।’
‘এক মিনিট দাঁড়াও কাকা,’ দৌড়ে ঘরের ভেতর চলে যায় সিংরাই। একটাই ফুল প্যান্ট ওর, ভাঁজ করে রাখা ছিল ঘরের এক কোণে। ফুল প্যান্টটা কোনওভাবে পরে দৌড়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। দেখে বাবা সহদেব কাকার সঙ্গে কথা বলছে। সিংরাই এসে দাঁড়ায় সহদেবের সামনে।
‘তাড়াতাড়ি চল,’ তোকে পৌঁছে দিয়ে আমাকে আবার কাজে যেতে হবে। পা চালায় সহদেব। বাবাকে কিছু না বলে সহদেবের সঙ্গে এগোয় সিংরাই। বাবা কি জানে বনমালী তাকে ডেকে পাঠিয়েছে? একবার ভাবে, সহদেব কাকাকে জিজ্ঞেস করবে বাবা জানে কিনা। কিন্তু জিজ্ঞেস করে না আর। সিংরাই যেন উড়তে উড়তে চলতে থাকে, তার গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে হাঁফিয়ে ওঠে সহদেব। হাঁটার গতি একটু কমিয়ে সহদেবের সঙ্গে চলতে থাকে সিংরাই। ময়ূরঝর্ণা থেকে জুজারধারা বেশি দূর নয়। এক-দেড় কিলোমিটার রাস্তা, কিন্তু উত্তেজনায় তাই যেন অনেকটা মনে হয় সিংরাইয়ের।
জুজারধারাও ময়ূরঝর্ণার মতোই ছোট গ্রাম। প্রায় সবাই গরিব মানুষ, দিন আনা, দিন খাওয়া পরিবার সব। কোনও দিন না খাওয়াও আছে। জুজারধারা যাওয়ার রাস্তা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। সহদেব আর সিংরাই জঙ্গলের রাস্তায় ধরে। মিনিট দশেক লাগল বড়জোর, গ্রামে ঢুকে চার-পাঁচটা বাড়ি পেরিয়েই সিংরাই দেখল একটা বাড়ির সামনে উঠোনে খাটিয়ার ওপর বসে আছে বনমালী দেশোয়ালি। তার সামনে একটা লাল প্লাস্টিকের চেয়ারে আরও একজন লোক, বনমালীর মতোই হবে বা সামান্য বেশি বয়স। ‘আমি তবে যাই, কাজে যাব,’ বনমালীকে বলে সহদেব।
গত কয়েক মাস ধরে যে দিনটার অপেক্ষায় ছটফট করছিল, আজ বনমালী দেশোয়ালিকে সামনে দেখে সিংরাই বুঝতে পারে না কী বলবে। সে এটাও বুঝতে পারে না বনমালী ঠিকই বুঝেছে সিংরাই কী ভাবছে। নিজের পাশে খাটিয়ায় বসার জন্য সিংরাইকে কাছে ডাকে বনমালী। লোকটার গলায় সেই একই উষ্ণতা, যা সেই মহুল পাহাড়ে শীতের সকালে গরম চাদরের মতো জড়িয়ে ধরেছিল তাকে। সিংরাই গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে বসে খাটিয়ার এক পাশে।
‘কেমন আছ? স্কুলে যাচ্ছ তো?
‘যাচ্ছি,’ সিংরাই বলতে পারে না স্কুলে যেতে তার ভালো লাগে না। কয়েক মাস আগে স্কুলে একটা ঝামেলাও সে করেছে। তারপর থেকে স্কুলে প্রায় অনিয়মিতই। সে কথা বলতে পারে না লোকটাকে।
কিন্তু তারপরই স্কুলে যাওয়া নিয়ে সত্যি কথাটা বনমালীকে না বলার জন্য মনের ভেতর খচখচ করতে থাকে তার। গলার স্বর আরও একটু নামিয়ে বলে, ‘রোজ যাই না। স্কুলে আর যাব না ঠিক করেছি।’ সিংরাই ভাবে একবার বলে, সে বনমালীর সঙ্গে যেতে চায়। কিন্তু বলতে পারে না। সবই বুঝতে পারে বনমালী, কিন্তু বুঝতে দেয় না সিংরাইকে। সিংরাই তাকিয়ে থাকে বনমালীর দিকে। সিংরাইয়ের কথার কোনও জবাব না দিয়ে সত্যেন বলে জোরে ডাক দেয় বনমালী। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা ছেলে। ‘আমাদের একটু মুড়ি দিতে পারিস বাবা?’ সত্যেনকে মুড়ি দিতে বলে সিংরাইয়ের দিকে মুখ ফেরায় বনমালী, ‘সকালে কিছু খাওয়া হয়নি তো?’ দু’দিকে ঘাড় নাড়ে সিংরাই মান্ডি।
‘তোমাকে বলেছিলাম, তোমাদের গ্রামে বা কাছাকাছি কোথাও গেলে তোমাকে খবর পাঠাব। তোমার সঙ্গে গল্প করার জন্য তোমাকে ডেকে পাঠালাম। তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব আমি।’ বনমালীর কথায় ঘাবড়ে যায় সিংরাই, অদ্ভুত এক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে।
‘এখন আমরা যেখানে বসে আছি, এই জুজারধারা বা তোমার যেখানে বাড়ি, সেই ময়ূরঝর্ণা বা আশপাশে যত গ্রাম আছে তার অনেক মানুষকে তুমি চেন। এদের প্রায় সবাই কৃষক বা শ্রমিক। সবাই গরিব মেহনতি মানুষ। শুধু এই চাকাডোবা বা বেলপাহাড়ি নয়, এরাই আমাদের দেশের প্রায় আশি শতাংশ মানুষ। আমরা বলি দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু দেশের এই আশি শতাংশ মানুষ কি সত্যিই স্বাধীন হয়েছে? আমাদের সমাজে বা দেশে এমনই আইন যে, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে পাঁচটা মৌলিক জিনিস দরকার, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসা, এর একটাও কি এই আশি শতাংশ মানুষের জীবনে নিশ্চিত? একটা জিনিসেরও কি গ্যারান্টি আছে গরিব মানুষের জীবনে? বাকি সব ছেড়ে দাও, শুধু দিনে দু’বেলা খাবারেরও কি গ্যারান্টি আছে এই গরিব মেহনতি মানুষের জীবনে? নেই। তুমি বল, আমরা যদি সত্যিই স্বাধীন হয়ে থাকি, তবে মানুষের যে মৌলিক অধিকার তার একটারও কেন গ্যারান্টি থাকবে না আমাদের জীবনে? তোমার বাবা অন্যের জমিতে চাষ করে, মা কেন্দু পাতা কুড়োয়। তোমাদের কি বাড়িতে দু’বেলা খাবারের গ্যারান্টি আছে? ঠিকমতো ঘর আছে থাকার? পরার জামাকাপড় আছে ঠিকঠাক? লেখাপড়ার বইখাতা আছে যা দরকার? বা ছোট-বড় রোগ হলে হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে? এই যে তোমরা কয়েকটা পরিবার জঙ্গলে গিয়ে ঘর বানালে, থাকতে পারলে সেখানে? যে পুলিশ তোমাদের ঘর ভাঙল, সেই পুলিশই তাকে পাহারা দিচ্ছে যে জঙ্গলের গাছ কেটে বাইরে বিক্রি করছে!
তোমার বাবা যার জমিতে ধান উৎপাদন করে বা মা যে কেন্দু পাতা তোলে, তা নিয়ে গিয়ে যে লোকটা ব্যবসা করে, তাদের ঘরে কিন্তু এই পাঁচটা জিনিসের কোনও অভাব নেই। তাদের খাবারের জন্য যথেষ্ট চাল আছে, পরার জামাকাপড় আছে, ভালো ঘর আছে। তা হলে একে কি ঠিকঠাক সমাজ ব্যবস্থা বলা যায়?’ বনমালীর একের পর এক প্রশ্ন তীরের মতো বিঁধতে থাকে সিংরাইয়ের মাথায়। সে তো এত কিছু ভাবেনি কোনও দিন, কিন্তু চোদ্দ বছরের ছেলেটা বুঝতে পারে বনমালী যা বলছে তা আসলে তাদেরই জীবনের কথা। শুধু তাদের নয়, তাদের মতো ময়ূরঝর্ণা, জুজারধারা থেকে শুরু করে একদিকে চাকাডোবা, ভূলাভেদা, বাঁশপাহাড়ি, অন্যদিকে কাঁকড়াঝোড়, আমলাশোল, হাজার হাজার মানুষের জীবনের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে বনমালীর কথা। সিংরাই একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারে না। এরই মাঝে একজন দুটো কাঁসার বাটিতে মুড়ি আর কাঁচা ছোলা রেখে যায় তাদের সামনে। একটু আগেও খিধে পাচ্ছিল, বনমালী কাকা সত্যেনকে খাবার দিতে বলার পর খিধেটা আরও বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু যখন মুড়ির বাটি হাতের সামনে, খেতে ভুলে যায় সিংরাই। আবার বলে চলে বনমালী দেশোয়ালি, ‘আমরা সবাই জানি একটা কথা আছে, যেমন কর্ম তেমন ফল। কর্ম মানে তো কাজ। তাহলে এই কথার মানে হওয়া উচিত, যে যেমন কাজ করবে, সে তেমন ফল পাবে। আচ্ছা সব কাজ তো তোমার, আমার মতো সব সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, গরিব মানুষই করছে। ধান, গম চাষ থেকে শুরু করে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, সব উৎপাদন করছে কৃষক আর শ্রমিক। সেই অনুযায়ী ফল কি তারা পাচ্ছে? একটু ভালো থাকা দূরের কথা, বেঁচে থাকার জন্য সামান্য দু’বেলা খাবারও কি তারা পাচ্ছে? পাচ্ছে না। কিন্তু এটা কেন? তুমি কখনও ভেবে দেখেছ, কেন সমস্ত কর্ম করা সত্ত্বেও গরিব মানুষ তার ফল পায় না?’ টানা বলে সামান্য একটু থামে বনমালী। দেখে কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ছেলেটার মধ্যে। অভিজ্ঞ সংগঠক বনমালী দেশোয়ালি জানে তার এত কথার দু’আনা দামও নেই, যতক্ষণ না তা কারও অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলছে। সে জানে সেই থিওরির মূল্য শূন্য যা মানুষের অভিজ্ঞতায় মেলে না। আর যদি একবার থিওরির সঙ্গে অভিজ্ঞতা মিলে যায়, মানুষ যা শুনছে তার সঙ্গে জীবনের প্রতিটা ঘটনা খাপে খাপ মিলতে থাকে, তখন এক রাসায়নিক বিক্রিয়া হতে থাকে মানুষের মনে। সেই রাসায়নিক বিক্রিয়া তখন আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ, দুর্বল মানুষকে দিয়েও অসাধ্যসাধন করিয়ে নেয়। মানুষের মধ্যে সেই রাসায়নিক বিক্রিয়া হওয়ার আগের মুহূর্তে তার চোখ, মুখের চেহারা কেমন হয় তা অনেকটাই জানা আছে বনমালীর। সিংরাইয়ের চোখে সেই মুহূর্তটা দেখার জন্যই খানিক অপেক্ষা করে বনমালী।
তারপর ফের বলতে শুরু করে, ‘এখন তাহলে প্রশ্ন, সমস্ত কর্ম করা সত্ত্বেও গরিব মানুষ তার ফল পায় না কেন? তুমি জান, জমিতে চাষের জন্য জলের দরকার। কিন্তু জমিতে যদি ভুলুক থাকে, তুমি জান ভুলুক মানে কী?’ এর উত্তর জানা ছিল সিংরাইয়ের।
‘জানি, ফুটো।’
‘হ্যাঁ, জমিতে যদি ভুলুক থাকে, মানে ফুটো বা ছিদ্র থাকে তবে তুমি যতই জল ঢালো না কেন, জমিতে সেই জল দাঁড়াবে না। জল তখন ভুলুক দিয়ে বেরিয়ে যাবে, সেই জমিতে ফসল হবে না। ঠিক তেমনি আমাদের মানব সমাজেও শোষণের ভুলুক বা ছিদ্র আছে। কৃষক, শ্রমিক, সমস্ত গরিব মানুষ যে কাজ বা শ্রম করছে, তার ফল শোষণের ওই ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে সমাজের দশ শতাংশ মানুষের কাছে চলে যাচ্ছে। এই দশ শতাংশ মানুষের মধ্যে আছে কেন্দিশোলের যদু মন্ডল, চাকাডোবার অমিয় মন্ডলের মতো জোতদার-জমিদাররা, ওই দশ শতাংশের মধ্যে আছে ধনী থেকে সমাজের মুষ্টিমেয় বড়লোক, জঙ্গলের গাছ কেটে বিক্রি করা ব্যবসায়ী। এই শোষণের ছিদ্র দিয়ে তোমার বাবা-মা, তাদের মতো লক্ষ লক্ষ মানুষের শ্রমের ফল চলে যাচ্ছে ওই মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে। এর ফলে সমাজের বিরাট অংশের মানুষ অভাবে আছে, সামান্য সংখ্যক মানুষ সমস্ত সুবিধে ভোগ করছে।’ বনমালী দেশোয়ালির কথা শুনতে শুনতে যেন এক ঘোরের মধ্যে চলে যায় সিংরাই। বুঝতেই পারে না তার জীবনের প্রতিটা দেখা জিনিস, প্রতিটা অভিজ্ঞতা, যে কথা সে নিজে কখনও ভাবেনি, তা এই লোকটা কীভাবে বলে যাচ্ছে পরপর! সে এত দিন ভেবেছে নিজেদের কষ্টের কথা, কিন্তু তার কারণ তো বুঝতে পারেনি কোনও দিন। আজ এই লোকটা পাশে বসে যা যা বলছে, সবই তার ছোট্ট মাথায় গেঁথে যেতে থাকে। মনে হতে থাকে, বনমালী কাকা যে কথাগুলো বলছে তার থেকে বড় সত্যি আর কিছু হতে পারে না।
বনমালীও বুঝতে পারে কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে চোদ্দ বছরের ছেলেটার মধ্যে। কয়েক মাস আগে প্রথম যখন ছেলেটাকে দেখেছিল, তখনই সিংরাইকে পছন্দ হয়েছিল তার। তারপর কিছুদিন অপেক্ষা করেছিল বনমালী, চেয়েছিল সিংরাইকে আরও কিছুটা সময় দিতে। দেখতে চেয়েছিল জোতদারের ধান বাজেয়াপ্ত করার ঘটনা কতটা প্রভাব ফেলেছে ছেলেটার মনে, দেখতে চেয়েছিল ছেলেটা সত্যিই তাদের জন্য অপেক্ষা করছে কিনা। আজ জুজারধারায় কিছুক্ষণ কথার পর বনমালী বুঝতে পারে সিংরাই মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়েই আছে!
ক্রমশ...
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।