এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • ময়ূরঝর্ণা - পর্ব ১৪ 

    বিতনু চট্টোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ৬৩৮ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • চাকাডোবায় স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দাবিতে যেমন আন্দোলন শুরু করেছিল এমসিসি, অনেকটা একইভাবে বাঁকুড়ার সারেঙ্গা ব্লকে ইটভাটার শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন চালাচ্ছিল জনযুদ্ধ গোষ্ঠী বা পিপলস ওয়ার গ্রুপ। বেলপাহাড়ি, চাকাডোবা, রানিবাঁধের এমসিসি নেতা যেমন বনমালী দেশোয়ালি, দ্বিজেন হেমব্রম, সুধাংশু সিংহ বা নিশিকান্ত মাহাতো, তেমনভাবে জনযুদ্ধের নেতা মদন মাহাতো, শশধর মাহাতো, সুচিত্রা মাহাতো, কল্পনা মাইতিরা। এবং আরও একজন আছে জনযুদ্ধে, সে ভিন রাজ্যের, তাকে সবাই তেলেগু দীপক নামে চেনে। সেটা ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ। ইটভাটা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি এবং আরও কিছু সুযোগসুবিধের দাবিতে বছর খানেক ধরে আন্দোলন চালিয়ে সারেঙ্গার বিভিন্ন গ্রামে ভালো সাড়া পাচ্ছিল জনযুদ্ধ। তাতে চিন্তায় পড়ে যায় স্থানীয় সিপিএম। সামনেই মে মাসে বিধানসভা ভোট, এবার এসপার-ওসপার ভোট রাজ্যে। সিপিএম বুঝতে পারে দ্রুত জনযুদ্ধের মোকাবিলা করতে না পারলে গরিব মানুষের সমর্থন হারাতে বেশি সময় লাগবে না। জনযুদ্ধের রাজনৈতিক মোকাবিলায় সারেঙ্গার একের পর এক গ্রামে টহলদারি শুরু করে সিপিএম, সেই সঙ্গে নামে পুলিশও।
     
    বিধানসভা ভোট ছিল ১০ই মে, আর এই ঘটনাটা তার মাসখানেক আগের। সারেঙ্গার সিপিএম নেতা শিবরাম শতপথীকে খুন করল তেলেগু দীপকের নেতৃত্বে জনযুদ্ধ। বাঁকুড়া জেলায় জনযুদ্ধের হাতে প্রথম বড়মাপের হত্যা। একইভাবে চাকাডোবায় স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দাবিতে এমসিসি’র আন্দোলনে সিঁদুরে মেঘ দেখতে শুরু করে বাঁশপাহাড়ির সিপিএম নেতৃত্ব। বেলপাহাড়ি, মানে বিনপুর দু’নম্বর ব্লকের চাকাডোবা, ভূলাভেদা এলাকা বরাবরই ঝাড়খন্ড পার্টির শক্ত ঘাঁটি, আর তার সামান্য দূরেরই বাঁশপাহাড়িতে সিপিএমের প্রভাব বেশি। এই যে বনমালীরা বাঁশপাহাড়ির বদলে চাকাডোবায় স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দাবি তুলে মানুষকে সংগঠিক করতে শুরু করেছে, তাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিল বাঁশপাহাড়ি সিপিএম। এমসিসি’র দাপট ভাঙতে সংগঠন বৃদ্ধির পাশাপাশি সিপিএম গ্রামে প্রচার করতে শুরু করল, অচেনা লোককে এলাকায় ঢুকতে দিলে ফল ভালো হবে না। এবার খুন হলেন বাঁশপাহাড়ির ভীমার্জুন গ্রামের সিপিএম নেতা সুধীর সিংহ। বাঁশপাহাড়ির গ্রামের মানুষ বুঝে গেল সিপিএম নেতার খুনের কারণ। রাজ্যে একুশ শতকের প্রথম বিধানসভা ভোটের আগে বাঁশপাহাড়ি এবং সারেঙ্গার দুই সিপিএম নেতার খুন কলকাতা, দেশ বা দুনিয়ায় কোনও প্রভাব ফেলল না, কিন্তু জঙ্গলমহলের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বদলে দিল পুরোপুরি। বিধানসভা ভোটের পর থেকেই গ্রামে গ্রামে টহলদারি শুরু করল সিপিএম, খোঁজ নেওয়া শুরু হল গ্রামে কোনও নতুন লোক এসেছে কিনা। কোনও গ্রামে নতুন কোনও লোক এলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানাতে হবে বলে জঙ্গলমহলের সমস্ত ব্লকের স্থানীয় নেতাকে নির্দেশ দিল পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার সিপিএম নেতৃত্ব। সেই সঙ্গে সক্রিয় হল পুলিশও। সব মিলিয়ে রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের জঙ্গলমহল যখন এক নতুন রক্তক্ষয়ী লড়াই, সংঘর্ষের অপেক্ষায়, সেই সময় এক ডিসেম্বরের সকালে রানিবাঁধের বিঠুলা গ্রামে দুই কিশোর, একজন সিংরাই মান্ডি, যার বয়স দু’মাস বাদে ষোল হবে, অন্যজন বছর পনেরোর মনোহর কথা বলে ঠিক করল, আজ রাতেই এলাকা ছাড়তে হবে।
     
    মনোহরের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে উঠে পড়ল সিংরাই। মনোহর চলে গেল জলধরের বাড়িতে। ঘরে ঢুকে ব্যাগ থেকে গামছা বের করে সিংরাই গেল পুকুরে স্নান করতে। পুকুরটা ধনঞ্জয়ের বাড়ি থেকে মিনিট তিনেকের হাঁটা, পুকুরের এক পাশ দিয়ে সরু মাটির রাস্তা চলে যাচ্ছে পাশের কুমোর পাড়ায়। কুমোর পাড়ায় ঢোকার মুখে পুকুরের পাশে কোণাকুণিভাবে দাঁড়িয়ে একটা খেজুর গাছ। সিংরাই জানতেও পারল না স্নান করতে নেমে জলে ডুব দেওয়ার সময় একটা মোটরসাইকেল কুমোর পাড়া থেকে বেরিয়ে আদিবাসী পাড়ার দিকে চলে গেল, যেখানে ধনঞ্জয়ের বাড়িতে সে থাকছে। মিনিট পাঁচেক বাদে মোটরসাইকেলটা যখন ফিরছে তখন সেটাকে দেখল সিংরাই, নীল জামা পরা একটা লোক পুকুরের ধার দিয়ে জোরে বেরিয়ে গেল। ব্যাপারটাকে সেই মুহূর্তে গুরুত্ব দিল না সিংরাই, কিন্তু মিনিট খানেক পরই মনটা খচখচ করতে শুরু করল। কে লোকটা? পুকুর থেকে উঠে তাকালো উল্টোদিকে। প্রথমে দেখা যায়নি, একটু মন দিয়ে দেখে সিংরাই বুঝতে পারল খেজুর গাছের আড়ালে মোটরসাইকেলটা দাঁড়িয়ে আছে। স্পষ্ট দেখা না গেলেও বোঝা যাচ্ছে নীল জামা বসে আছে মোটরসাইকেলের ওপর। পুকুর থেকে উঠে তাড়াতাড়ি ধনঞ্জয়ের বাড়ির রাস্তা ধরল সিংরাই। ‘কাকা, একটু আগে পাড়ায় কেউ এসেছিল মোটরসাইকেলে চেপে?’ ধনঞ্জয়কে সামনে দেখে জিজ্ঞেস করল সিংরাই।
    ‘হ্যাঁ, পাশের গ্রামের একজন। বিকেলে কী একটা ফুটবল টুর্নামেণ্ট আছে, জিজ্ঞেস করতে এসেছিল কিছু রান্না করে দিতে পারব কিনা।’
    ‘তোমাকেই শুধু জিজ্ঞেস করল রান্নার কথা?’
    ‘না, পাশের ঘরেও কথা বলেছে।’
    ‘লোকটাকে চেন? আগে দেখেছ?’ সিংরাইয়ের মনে সংশয় কিছুতেই যায় না।
    ‘তেমন চিনি না, তবে বাজার-হাটে দেখেছি বোধয়।’
    ঘরে ঢুকে যায় সিংরাই, আবার বেরিয়ে আসে কিছু বাদে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সতর্ক পা ফেলে পুকুর পারের দিকে যায়, ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে খেজুর গাছটার দিকে, না দেখা যাচ্ছে না লোকটাকে। নিশ্চিন্ত হয় সিংরাই। ধনঞ্জয়ের বাড়ি ফিরে সিংরাই ঠিক করে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করবে না আর। বিকেলে যখন টুর্নামেণ্ট আছে, তার মানে লোকজনের ভিড় হবে, কেউ না কেউ দেখে ফেলতে পারে। দুপুরে খেয়েই চলে যেতে হবে। কিছুক্ষণ ঘরে বসে থাকে সিংরাই, সাড়ে দশটা মতো বাজে। ধনঞ্জয়কে বলে জলধরের বাড়িতে গিয়ে মনোহরকে জানিয়ে আসতে যে, তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে যেন রেডি হয়ে থাকে। সময় কাটতে চায় না সিংরাইয়ের। প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে, ভাত হয়ে গিয়েছে। বাড়ির পিছনে উঠোনে যায়, স্নানের পর ভেজা গামছাটা শুকোতে দিয়েছিল। ঠিক করে, গামছাটা এনে একেবারে ব্যাগ গুছিয়ে খেতে বসবে। গামছা আনতে ঘরের বাইরে উঠোনে গিয়ে চমকে ওঠে সিংরাই। পিছনের চওড়া মোরাম রাস্তা দিয়ে পুলিশের জিপ ঢুকছে গ্রামে। সঙ্গে সঙ্গেই সিংরাইয়ের চোখে পড়ে নীল জামা পরা লোকটাকে, আগে আগে মোটরসাইকেল চালিয়ে পুলিশের জিপটাকে নিয়ে আসছে গ্রামের ভেতর। সিংরাই বুঝে যায় লোকটা ঘণ্টা দেড়েক আগে কেন গ্রামে এসেছিল, দৌড়ে চলে আসে ঘরে। আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা করা যাবে না। পুলিশের জিপটাকে নিয়ে বাড়ির পিছন দিক দিয়ে আসছে লোকটা, বাড়ির সামনে দিয়ে বেরিয়ে দৌড় লাগায় সিংরাই। কিন্তু তার জানা ছিল না বাড়ির সামনের দিকে পুকুর পারে আগে থেকেই অপেক্ষা করছে আরও তিনজন পুলিশের লোক। দৌড়ে পালাতে গিয়ে তাদের মুখোমুখি পড়ে যায় সে, সঙ্গে সঙ্গে মাটির রাস্তা ছেড়ে পাশের মাঠে নেমে সিংরাই দৌড়ে বাঁশ বনে ঢুকে পড়ে। কোন দিকে যাচ্ছে বুঝতে পারে না, পড়িমরি করে ছুটতে থাকে, কিন্তু কতক্ষণ এভাবে একা দৌড়বে সে! ততক্ষণে গাড়ি করে আসা পুলিশগুলোও বাকিদের চিৎকার শুনে বাঁশ বনে ঢুকে পড়েছে। তিন দিক থেকে পুলিশ ঘিরে ফেলে তাকে, পুলিশের নাগালের মধ্যে এসে সিংরাই দাঁড়িয়ে পড়ে। একটা পুলিশ এগিয়ে আসে তার দিকে, কোনও কথা নেই সপাটে থাপ্পড় মারে তার গালে। শক্তপোক্ত হাতের প্রচণ্ড থাপ্পড় খেয়ে টাল সামলাতে পারে না রোগাসোগা ছেলেটা, সঙ্গে সঙ্গে আবার একটা চড় এসে পড়ে তার গালে। পরপর আরও দুটো, এবার মাটিতে পড়ে যায় সিংরাই। তার হাত দুটো পিছনে নিয়ে শক্ত করে একটা দড়ি দিয়ে বেঁধে দেয় একজন, তারপর টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে তোলে জিপে।         

    ১৪-১২-২০০১, খাতরা থানা,  দুপুর দেড়টা

    ‘তোর নাম কী?’
    ‘সিংরাই।’
    ‘সিংরাই কী?’ চিৎকার করে ওঠে টেবিলের উল্টোদিকে চেয়ারে বসা পুলিশ অফিসার। খানিকক্ষণ আগে সিংরাইকে নিয়ে খাতরা থানায় ঢুকেছে পুলিশের গাড়ি। থানায় ঢুকে প্রথমেই একটা ঘর, সেখানে দুজন পুলিশ বসে। একজন কিছু একটা লিখছে কাগজে। দেওয়ালের বড় ঘড়িটায় সিংরাই দেখে সওয়া একটা বাজে। স্নান করার সময় নীল জামাকে দেখেই মনোহরকেকে নিয়ে পালানো উচিত ছিল, মনে মনে বলে নিজেকে। মনোহরও কি ধরা পড়ে গিয়েছে, বুঝতে পারে না! থানার প্রথম ঘরটা ছাড়িয়ে ভেতরের একটা ছোট ঘরে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। ছোট একটা টেবিল, তার এক পাশে একটা কাঠের চেয়ার। ঘরটার একদিকে আর একটা ঘর, তার ওপরে লেখা মালখানা। সিংরাইকে কোমরের কাছটা শক্ত করে ধরেছিল একজন। ছোট ঘরটায় ঢুকে তাকে ছেড়ে দেয় পুলিশটা। চোখ দিয়ে মাটির দিকে দেখিয়ে পুলিশটা তাকে বসতে বলে। তারপর বাইরে বেরিয়ে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দেয়। সিংরাই বুঝতে পারে চড়, ঘুষিতে ঠোঁটের কোণাটা কেটে গিয়েছে, জিভ দিয়ে চাটতে জ্বলে যায় জায়গাটা। কতটা কেটেছে সে বুঝতে পারে না, হাত দুটো এখনও পিছন দিকে বাঁধা। মাটিতে বসে পড়ে সিংরাই, প্রচণ্ড জল তেষ্টা পাচ্ছে, সেই সঙ্গে খিধে, কিন্তু বলার মতো কেউ নেই ঘরে। কতক্ষণ কেটেছে বুঝতে পারে না, আন্দাজ মিনিট পনেরো-কুড়ি পর দরজা খোলার আওয়াজ পায় সিংরাই। অন্য একজন অফিসার এসে ঢোকে ঘরে, হাতে একটা বড় খাতা। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পুলিশের লোকটা। মাটি থেকে উঠে টেবিলের উল্টোদিকে দাঁড়ায় সিংরাই। তার নাম, পদবী, কোথায় বাড়ি সব খাতায় লিখে নেয়।
    ‘তোর সঙ্গে আর কে ছিল?’
    তার মানে মনোহর ধরা পড়েনি, পুলিশ অফিসারের প্রশ্নটা শুনে প্রথমেই ছেলেটার কথা মাথায় আসে সিংরাইয়ের। তারপর আস্তে করে বলে, ‘আমি একাই ছিলাম।’
    ‘উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখলে মনে পড়ে যাবে সঙ্গে আর কে ছিল,’ চিৎকার করে ওঠে খাতরা থানার সেকেন্ড অফিসার। উঠে দাঁড়ায় চেয়ার থেকে। সঙ্গে সঙ্গে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।
    ‘স্যর, বড়বাবু এসে গিয়েছে।’
    বলতে বলতে ঘরে এসে ঢোকে একটু বয়স্ক এক পুলিশ অফিসার। সিংরাই বুঝতে পারে এই লোকটাই ওসি। চেয়ারটায় গিয়ে বসে খাতরা থানার ওসি। সেকেন্ড অফিসার উঠে সিংরাইয়ের পাশে দাঁড়ায়।
    ‘বেলপাহাড়ি থেকে এখানে কী করতে এসেছিলি?’
    চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সিংরাই।
    ‘কবে থেকে আসছিস এই এলাকায়? বিঠুলা ছাড়া রানিবাঁধের আর কোন কোন গ্রাম চিনিস?’
    ‘আগে একবার এসেছিলাম রাতের বেলায়, তারপর কাল এসেছি। অন্য কোথাও যাইনি কোনও দিন,’ সিংরাই বুঝতে পারে বানিয়ে বানিয়ে কিছু অন্তত উত্তর দিতে হবে। কিন্তু দলের অন্যদের ব্যাপারে কিছু বলা যাবে না।
    ‘তোদের নেতা কে?’ বনমালী দেশোয়ালিকে চিনিস?’
    এক সেকেন্ডও না ভেবে সিংরাই সিদ্ধান্ত নেয় বনমালীর কাকার কথা বলা যাবে না পুলিশকে। ‘না, সুকান্ত বলে একজন আমাকে নিয়ে এসেছিল। বাড়িতে খুব অভাব। বলেছিল এখানে কিছুদিন থাকতে, কোথাও একটা কাজে ঢুকিয়ে দেবে।’ সুকান্তই যে বনমালী তা বলে না পুলিশ অফিসারদের।
    ‘আর একটা যদি মিথ্যে বলেছিস, জিভ ছিঁড়ে নেব তোর,’ সিংরাইয়ের দিকে তেড়ে আসে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা খাতরা থানার সেকেন্ড অফিসার, ‘কাজে ঢুকিয়ে দেবে! বেলপাহাড়িতে কাজ না করে এখানে এসেছিস কাজ করতে?’
    সেকেন্ড অফিসারকে হাত উঠিয়ে থামতে বলে ওসি।
    ‘স্যর আপনি ঘরে যান। উল্টো করে ঝুলিয়ে না মারলে কথা বেরোবে না।’
    ‘তুমি একবার বিঠুলা গ্রামে যাও। যার বাড়িতে ছিল তাকে তুলে নিয়ে এস। ওকে পরে দেখছি,’ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় ওসি। তারপর হাঁক দেয় জোরে, ‘এই কে আছিস, ওকে লক আপে ভরে দে।’
    দরজার সামনেই দাঁড়িয়েছিল একজন কনস্টেবল, ঘরে ঢুকে সিংরাইয়ের কোমরের কাছে ধরে নিয়ে যায় লক আপের দিকে। তারপর খুলে দেয় ওর হাতের বাঁধন। ফাঁকা লক আপে ঢুকে এক কোণায় গিয়ে বসে সিংরাই। নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ হয় ওর। নীল জামা লোকটাকে দেখে ওর সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। কীভাবে ব্যাপারটা ক্যাজুয়ালি নিল ভেবে পায় না সিংরাই! ও ধরা পড়ে গিয়েছে তা নিশ্চয় আজ-কালের মধ্যে জেনে যাবে বনমালী কাকা। সিংরাইয়ের মনে হয়, বনমালী কাকা কি ভাববে যে, ছেলেটাকে একটা দায়িত্ব দিলাম, কিন্তু ধরা পড়ে গেল!
    ডিসেম্বরের বেলা ছোট হয়ে আসে দ্রুত, সাড়ে চারটে-পৌনে পাঁচটার মধ্যে আলো কমে এসেছে বাইরে। বাইরের আলো দেখে সময় আন্দাজ করে সিংরাই। লক আপের বাইরে একটা হলুদ বাল্ব জ্বলছে, একটু দূরে টুলে বসে একজন কনস্টেবল। অ্যারেস্ট হওয়ার পর থেকে বারকয়েক খিধে পেয়েছে, কিন্তু এখন আর পাচ্ছে না সিংরাইয়ের। সিংরাই ভাবে, কাল কি তাকে কোর্টে তুলবে পুলিশ? আরও বেশ কিছুটা সময় কাটে নানা কথা ভেবে, হঠাৎই সেকেন্ড অফিসারের গলা শুনে মাথা তুলে তাকায় সিংরাই, ‘বের কর ওকে।’ টুলে বসা কনস্টেবলকে বলে থানার গেটের দিকে এগোয় সেকেন্ড অফিসার। লক আপের দরজা খুলে সিংরাইকে বের করে একজন থানার বাইরে নিয়ে আসে। ঘাড় ঘুরিয়ে সিংরাই দেখে সাড়ে সাতটা বাজে, তাকে তোলা হয় পুলিশ জিপে। তার দু’দিকে বসে দু’জন। জিপের সামনে বসে সেকেন্ড অফিসার। অন্ধকার রাস্তায় চলতে শুরু করে পুলিশের গাড়ি। সামনে বসা অফিসারের দিকে চোখ যায় সিংরাইয়ের। সে দেখে তার ব্যাগটা পুলিশের অফিসারের হাতে ধরা। তার মানে ধনঞ্জয় কাকার বাড়ি থেকে ব্যাগটা নিয়ে এসেছে পুলিশ। মিনিট কয়েক বাদে সিংরাইকে নিয়ে গাড়িটা থামে খাতরার সাব ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার বা এসডিপিও অফিসের সামনে। দু’দিকে দু’জন কনস্টেবল, গাড়ি থেকে নেমে অফিসে ঢোকার পর সিংরাই দেখে ঘরের বাইরে কাঠের বোর্ডে লেখা, সৈয়দ নাসিরুদ্দিন মির্জা, এসডিপিও খাতরা।
     
    নীল জিনসের প্যান্ট, কালো টি শার্ট পরা কম বয়সী এসডিপিও চেয়ারে বসে, খাতরা থানার সেকেন্ড অফিসার শুভজিৎ রায় ঘরে ঢুকেই স্যালুট করে এক পাশে দাঁড়ায়। পিছন পিছন ঘরে ঢুকল সিংরাই।
    ‘এই বয়সেই মানুষ মারা শুরু করেছিস? সারেঙ্গায় খুনটা কে করেছে?’
    এসডিপিও মির্জা’র প্রশ্নে কিছু বলে না সিংরাই। সে জানে সারেঙ্গায় সিপিএম নেতা খুন হয়েছে, কিন্তু সেটা এমসিসি নয়, করেছে জনযুদ্ধ। কিন্তু তা বলল না সে, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
    ‘তুই নাকি এখানে কাজের খোঁজে এসেছিস, তা কী কাজ করবি এখানে?’ কথা বলতে বলতেই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় এসডিপিও।
    এবারও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সিংরাই।
    ‘হাতের আঙুলগুলো টেবিলের ওপর পেতে রাখ।’
    একটুও না নড়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সিংরাই।
    ‘কী হল, হাতটা রাখ টেবিলে,’ চিৎকার করে ওঠে খাতরার এসডিপি। ভয়ে ভয়ে বাঁ হাতটা এগিয়ে হাতের চেটোটা ওপর দিকে করে টেবিলের ওপর রাখে সিংরাই। টেবিলের পাশে দাঁড় করানো লাঠিটা নিয়ে কালো টি শার্ট, নীল জিন্স এগিয়ে আসে। ওর হাতের পাতাটা উল্টে দেয়, তারপর লাঠিটা রাখে সিংরাইয়ের আঙুল চারটের ওপর। সিংরাই কিছু বুঝে ওঠার আগেই সিংরাইয়ের কড়ে আঙুলটা উল্টে দেয় জোরে। মট করে একটা আওয়াজ হয় শুধু, পাট কাঠির মতো ভেঙে যায় সরু কড়ে আঙুলটা। আঃ করে চিৎকার করে ওঠে সিংরাই, যন্ত্রণাটা ছড়িয়ে পড়ে গোটা হাতে, হাত থেকে শরীরে। হাতটা সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। লাঠিটা শক্ত করে সিংরাইয়ের আঙুলের ওপর চেপে রেখেছে মির্জা। চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে সিংরাইয়ের। এখনও লাঠিটা হাতের পাতার ওপর চেপে ধরা। কড়ে আঙুলটা ছেড়ে দেয়, তারপর পরপর আরও তিনটে আঙুল উল্টে ভেঙে দেয় খাতরার এসডিপিও মির্জা। যন্ত্রণায় গোঙানোর মতো শব্দ বের হয় সিংরাইয়ের মুখ দিয়ে। মুখ দিয়ে আর কোনও আওয়াজ হয় না।
    ‘কিছু মনে পড়ছে? কে কে ছিল তোর সঙ্গে? গত কয়েক মাসে খাতরায় কোন গ্রামে কোন বাড়িতে ছিলি, মনে পড়ছে কিছু?’
    গলা শুকিয়ে আসছে সিংরাইয়ের। বাঁ হাতের আঙুলের অসহ্য যন্ত্রণাটা কনুই, কাঁধ বেয়ে মনে হচ্ছে মাথা পর্যন্ত উঠে আসছে। বাঁ হাতের দিকে তাকাতে পারে না কয়েক সেকেন্ড, তারপর মাথা তুলে দেখে, চারটে আঙুল ঝুলছে হাত থেকে। সিংরাইয়ের মনে হয় পায়ে কোনও জোর নেই, যে কোনও সময় মাটিতে পড়ে যাবে। শরীরটাকে কোনও ভাবে শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে ষোলয় পা দিতে যাওয়া ছেলেটা। বাঁ দিক থেকে কালো টি শার্ট পরা এসডিপিও তার ডান দিকে চলে আসে, হাতে লাঠিটা। সিংরাই বুঝতে পারে না এরপর কী হতে চলেছে। এবার আর অন্য হাতের পাতা টেবিলের ওপর রাখতে বলে না, মির্জা নিজেই সিংরাইয়ের ডান হাতটা ধরে আগের মতো হাতের পাতাটা উল্টো করে টেবিলের ওপর রাখে। তার ওপরে রাখে লাঠিটা। বাঁ হাত দিয়ে লাঠিটা শক্ত করে চেপে ধরে, তারপর পরপর চারটে আঙুল উল্টে দেয় নিজের ডান হাত দিয়ে। আগের বারের মতো মট মট করে চারটে শব্দ হয় শুধু, ভেঙে যায় সিংরাইয়ের আঙুলগুলো। এবার আর ব্যথা সহ্য করতে পারে না, মাগো বলে চিৎকার করে ওঠে সিংরাই। তারপর টানা গোঙাতে থাকে সে। মনে হয় যন্ত্রণায় মরে যাবে। খিধেটা ফিরে আসে, গলা শুকিয়ে আসে, পা দুটো কাঁপতে থাকে তার। কেন জানি তার মনে হয় ডান হাতের থেকেও বাঁ হাতে যন্ত্রণাটা বেশি হচ্ছে। দুটো হাতের দিকে তাকায় সে, আর কি আঙুল দিয়ে কোনও কাজ করতে পারবে! বুঝতে পারে না, ঝাপসা হয়ে আসে চোখ। টেবিলের ওপর ছোট্ট বাক্স থেকে কাগজে লাগানোর একটা পিন হাতে তুলে নেয় এসডিপিও। ‘থাকিস বেলপাহাড়িতে, আর এখানে এসেছিস আন্দোলন করতে? সারা জন্মের মতো তোর আন্দোলন ঘুচিয়ে দেব শালা! এই বয়সেই মাওয়িস্ট হয়েছিস?’ কথা বলতে বলতেই সিংরাইয়ের হাতটা ধরে আবার টেবিলের ওপর রাখে মির্জা, তারপর আচমকাই একটা পিন ফুটিয়ে দেয় সিংরাইয়ের ভাঙা আঙুলগুলোর ওপরের অংশে। প্রথমে ডান হাতে, তারপর বাঁ হাতে। সিংরাইয়ের দু’হাতে আঙুলের ওপরে আট-দশ জায়গায় পিন ফুটিয়ে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে খাতরার এসডিপিও। ভোটের আগে সারেঙ্গার খুনটার পর ওপর থেকে প্রচণ্ড চাপ ছিল, সমস্তটা রাগ যেন আজই বের করে দেয় সিংরাইয়ের ওপর। দু’হাতের আঙুলের ওপরের অংশ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে নাগাড়ে, সিংরাই আস্তে আস্তে মাটিতে বসে পড়ে।                                       
    নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে মির্জা। বেল দিয়ে ডাকে আর্দালিকে। চোখের ইশারায় শুভজিৎকে বলে সিংরাইকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়েছিল খাতরা থানার দুই কনস্টেবল, সিংরাইয়ের কাঁধের কাছে দু’দিক থেকে দু’জন ধরে তাকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসে, নিয়ে গিয়ে বসায় গাড়িতে। মিনিট খানেক বাদে এসডিপিও’র ঘর থেকে বেরিয়ে এসে জিপে ওঠে খাতরার সেকেন্ড অফিসার। গাড়ির সামনের দু’দিকের জানলা দিয়ে হু হু করে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছে, কিন্তু সিংরাইয়ের কপালে, গলায়, জমাট বাঁধা ঘাম। দপদপ করছে মাথাটা, বুক ধড়ফড় করছে টানা, চোখ বন্ধ করে বসে থাকে সিংরাই। সিটের পিছনে হেলান দেয়, সিংরাইয়ের মনে হয়, যে কোনও সময় বমি হয়ে যাবে। জিভ দিয়ে চাটে শুকনো ঠোঁট, সঙ্গে সঙ্গে জ্বালা করে ওঠে ঠোঁটের এক কোণা। সিংরাইয়ের মনে হয়, তার জীবন এখানেই শেষ। আর কি কোনও দিন বেরোতে পারবে? বনমালী কাকার কথা মনে পড়ে, বাবা, মা, ধর্মা, মালতীর কথা মনে পড়ে। শুধু একটা কথা মনে পড়ায় নিশ্চিন্ত হয় সিংরাই, পুলিশ বিঠুলা গ্রামে গেলেও মনোহর ধরা পড়েনি।
     
    রাত প্রায় ন’টা, সিংরাইকে নিয়ে খাতরা থানায় ঢোকে পুলিশের গাড়ি। কনস্টেবল দু’জন তাকে ঢুকিয়ে দেয় লক আপে। এক কোণায় গিয়ে বসে সে। সারা দিন কিছু খাওয়া হয়নি, কিন্তু খিধে পায় না সিংরাইয়ের। হাত দুটো অবশ হয়ে আসছে, দু’হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে সে, হাতের চেটোর উল্টো দিকে রক্ত শুকিয়ে গেছে, আঙুলগুলো অদ্ভুত ভাবে ঝুলছে। আঙুলের ডগা থেকে কাঁধ পর্যন্ত অসহ্য যন্ত্রণা, ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা বাঁ হাতের ভাঙা আঙুলগুলোর ওপর বোলায় সিংরাই, কোনও সাড় নেই। সামান্য চাপ দিতেই ব্যথায় কুঁচকে যায় চোখ, ফের ঠোঁট চাটে সিংরাই। তারপর একবারে ডান হাতের বুড়ো আঙুল বাঁ হাতে, একবার বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল ডান হাতের ভাঙা আঙুলের ওপর বোলাতে থাকে, সামান্য আরাম লাগে তার। হঠাৎ লক আপ খোলার আওয়াজ পায় সিংরাই। মাথা তুলে তাকায়, একটা লোক একটা থালা লক আপে ঢুকিয়ে মাটিতে রেখে ঠেলে দেয় তার দিকে। এতক্ষণ যন্ত্রণায় শরীর খারাপ লাগছিল, বমি পাচ্ছিল। সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি, খিধেটা ফিরে ফিরে আসছিল মাঝে মাঝেই। থালায় রুটি, সবজি দেখে খিধেটা ফিরে আসে। একবার থালার চারটে রুটি আর একবার নিজের দু’হাতের দিকে তাকায় সিংরাই। কীভাবে খাবে, কীভাবে রুটি ছিঁড়বে ভেবে পায় না। যত সময় যায়, ততই খিধে বাড়তে থাকে। শেষমেশ এক উপায় বের করে সে। মাটিতে বসা অবস্থাতেই একটু ঘষটে ঘষটে থালাটার দিকে এগিয়ে যায়, তারপর মাটিতে আধশোয়া হয়ে মাথাটা নামিয়ে আনে থালার ওপর। যেভাবে চার পায়ের প্রাণী মাটিতে রাখা থালা থেকে খায়, সেভাবে সরাসরি মুখ দিয়ে খাবার চেষ্টা করে রুটি, সবজি। একবারে পুরো একটা রুটি মুখে ভরে দাঁত দিয়ে কিছুটা কেটে বাকিটা থালায় নামিয়ে রাখে। কুমড়োর তরকারি খেতে গিয়ে ঝোল লেগে যায় গালে, প্রচণ্ড খিধের সময় চারটে রুটি, কয়েক টুকরো কুমড়ো খেতে প্রায় আধ ঘণ্টা সময় লেগে যায় সিংরাইয়ের। খাবার শেষ করে মাটিতে এক পাশে সরে শুয়ে পড়ে।
     
    পরদিন সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যায় সিংরাইয়ের। হাতের ব্যথাটা এখন কিছুটা কম, আঙুলগুলো ফুলে আছে মারাত্মকভাবে। তার চেয়েও খারাপ অবস্থা আঙুলের ওপরের অংশে, যেখানে পিন ফোটানো হয়েছে। ঘুম থেকে উঠে লক আপে ঝিম মেরে বসে থাকে সিংরাই। বেলা একটু বাড়তে থানায় শুরু হয়ে যায় এক হঠাৎ তৎপরতা। কনস্টেবল থেকে মেজবাবু সবাই ব্যস্ত, যেন কিছু একটা ঘটতে চলেছে। কেন এই সাজো সাজো রব, সবাই কেন ব্যস্ত বুঝতে পারে না সিংরাই। দুপুর বারোটা নাগাদ একটা থালায় ভাত দেওয়া হয় তাকে। ভাত আর ডাল। হাত দিয়ে ভাত খাওয়ার চেষ্টা করে সে, অল্প অল্প ভাত তুলে মুখে দেয় কোনও ভাবে। খাওয়ার পর সিংরাইকে বের করা হয় লক আপ থেকে, নিয়ে যাওয়া হয় ওসির ঘরে।
    ‘শোন, বাঁকুড়া থেকে বড় সাহেব আসছে তোকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে, যা জানিস বলবি। নয়তো কপালে দুঃখ আছে।’ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সিংরাই।
    দুপুর তিনটে নাগাদ খাতরা থানায় পৌঁছলেন বাঁকুড়ার এসপি মহাদেব বাগ। সিংরাইকে ফের নিয়ে যাওয়া হল ওসির ঘরে। সিংরাই দেখে, ওসির চেয়ারে বসে একজন বয়স্ক অফিসার, দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই লোকটা জেলার পুলিশ সুপার। উল্টোদিকের চেয়ারে পাশাপাশি বসে এসডিপিও মির্জা আর ওসি। এসডিপিও’র দিকে তাকিয়ে থাকে সিংরাই। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় এসপি, সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায় বাকি দুই অফিসার। কোনও কথা নেই, কিছু প্রশ্ন নেই, সিংরাইয়ের দিকে এগিয়ে এসে ফুট দুয়েক দূরে থেমে যায় মহাদেব বাগ, সোজা লাথি মারে সিংরাইয়ের কোমরে। এক ফুট দূরে ছিটকে পড়ে সে। কাত হয়ে মাটিতে শুয়ে থাকে, এসপি এগিয়ে আসে তার দিকে, সিংরাই চোখ বন্ধ করে না, নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখে। এবার লাথি এসে পড়ে তার পিঠে। তারপর নীচু হয়ে সিংরাইয়ের গেঞ্জি ধরে তাকে দাঁড় করায় এসপি, এবার গালে প্রচণ্ড এক থাপ্পড়। সিংরাই নড়ে না, আবার থাপ্পড়, পরপর তিনবার। তারপর তাকে ছেড়ে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয় মহাদেব বাগ। সিংরাই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ওসি উঠে গিয়ে ঘরের দরজা খুলে বাইরে মুখ বাড়িয়ে কিছু একটা বলে কনস্টেবলকে, একজন ঘরে ঢুকে সিংরাইকে নিয়ে যায়। ফের তাকে ঢুকিয়ে দেয় লক আপে। সিংরাই বুঝতে পারে না, এত দূর থেকে শুধু তাকে মারার জন্য খাতরায় এল এসপি!
     
    আরও ঘণ্টা দেড়েক এসডিপিও এবং ওসির সঙ্গে কথা বলে থানা থেকে বেরিয়ে যায় মহাদেব বাগ। সিংরাই ভেবেছিল, আজ তাকে কোর্টে তোলা হবে, কিন্তু তাকে আদালতে নিয়ে যায় না পুলিশ। লক আপের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকে সিংরাই। পিঠে লাথিটা খেয়ে সামান্য সময়ের জন্য দম বন্ধ হয়ে এসেছিল, এখনও বুকের ধড়ফড়ানি টের পায় সে। বসে হাঁফাতে থাকে, চেয়ে থাকে দু’হাতের আঙুলগুলোর দিকে। বনমালী কাকা নিশ্চয় এতক্ষণে জেনে গিয়েছে তার ধরা পড়ার খবর, অপরাধবোধ হয় সিংরাইয়ের। এত বড় একটা দায়িত্ব পেলাম, কিন্তু দলের কাজে লাগার আগেই ধরা পড়ে গেলাম, নিজেই নিজেকে বলে। সিংরাই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, একটা ভুল হয়ে গিয়েছে, পুলিশ যাই করুক, একটা কথাও সে বলবে না পুলিশকে। সন্ধে সাড়ে ছ’টা নাগাদ ফের সিংরাইকে বের করা হয় লক আপ থেকে, আগের দিনের মতোই তোলা হয় গাড়িতে। গাড়ি গিয়ে থামে খাতরা এসডিপিও অফিসের সামনে। সিংরাই বুঝতে পারে না কী অপেক্ষা করছে তার জন্য।

    ক্রমশ... 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ৬৩৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Z | 49.207.***.*** | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৪:৩৯528518
  • এই সব ..... …
    কী আর বোলবো/লিখব..
  • | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৪:২৭528613
  • এদের কারো কোন শাস্তি হয় নি নিশ্চয়। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন