১৫-১২-২০০১, খাতরা এসডিপিও অফিস, সন্ধে সাতটা
এসডিপিও’র ঘরের বাইরে সিংরাইকে দাঁড় করিয়ে ভেতরে চলে যায় খাতরা থানার সেকেন্ড অফিসার। দু’দিকে দু’জন কনস্টেবল, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সিংরাই। মিনিট দশেক বাদে খুলে যায় মির্জার ঘরের দরজা, চোখের ইশারায় খাতরা থানার অফিসার ভেতরে ডাকল তাকে। কনস্টেবল দু’জন বাইরে থেকে যায়। সিংরাই ঘরে ঢুকে দেখল আগে থেকেই এসডিপিও’র ঘরে বসে আছে খাতরা থানার ওসি।
‘কী রে, খাতরার কোন কোন গ্রামে ছিলি মনে পড়ছে কিছু?’
‘আমাকে কাজ দেবে বলে একজন নিয়ে এসেছিল এখানে,’ এক লাইন বলে থেমে যায় সিংরাই।
‘স্যর, হার্ডকোর মাল, অনেক মাস বাড়িছাড়া আছে,’ বলে ওঠে খাতরা থানার ওসি।
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল এসডিপিও মির্জা, এগিয়ে গেল সিংরাইয়ের দিকে। ‘হাতটা দেখি, ঠিক আছে?’ সিংরাইয়ের একটা হাত টেনে নিল। দুটো হাত এখনও ফোলা, কালচে হয়ে যাওয়া রক্তের দাগ, আঙুলগুলো অসাড়। সিংরাইয়ের ডান হাতটা টেবিলের ওপর রাখে মির্জা, তারপর আগের দিনের মতোই একটা লাঠি চাপা দিয়ে মটমট করে ফের আঙুলগুলো উল্টে ভেঙে দেয়, সঙ্গে বুড়ো আঙুলও। প্রচণ্ড ব্যথায় চিৎকার করে ওঠে সিংরাই। তারপর তার অন্য হাতটা ধরে একই কায়দায় টেবিলের ওপর রেখে পরপর পাঁচটা আঙুল ভেঙে দিল খাতরার এসডিপিও। যন্ত্রণায় দাঁড়াতে পারছে না সিংরাই, না চাইলেও চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে। যাতে শব্দ না হয় তার জন্য ঠোঁট শক্ত করে চেপে মুখ বন্ধ করে রেখেছিল, দ্রুত শ্বাস পড়তে থাকে তার। সিংরাইয়ের থেকে একটু সরে টেবিলের নীচে হাত নিয়ে গিয়ে বেল দেয় মির্জা, ঘরের দরজা একটু খুলতেই ভেতরে ডেকে নেয় দু’জন কনস্টেবলকে। দুটো হাতের যন্ত্রণায় সিংরাই কুঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ভাবে, তাকে বোধহয় ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাবে এবার, জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটে। বুঝতে পারে, না চাইলেও চোখ দিয়ে সামান্য জল বেরিয়ে এসেছে। হাত তুলে যে চোখের জল মুছবে, তাও পারে না। হাত দুটোয় কোনও সাড় নেই, সঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণা। গলা শুকিয়ে আসে তার। তাকিয়ে থাকে মির্জার দিকে।
‘মাটিতে শুইয়ে দে’, দু’জন কনস্টেবলের দিকে তাকিয়ে বলে মির্জা। সিংরাইকে উপুড় করে মাটিতে শুইয়ে দু’দিক থেকে দু’জন কাঁধটা চেপে ধরে মাটিতে। একজন এক হাত দিয়ে তার থুতনিটা মাটিতে চেপে ধরে। সিংরাই চোখ খোলা রাখে, কিন্তু দেখতে পায় না ওপরের দিকে। বুঝতে পারে না কী হতে চলেছে। প্রথমে সিংরাইয়ের ডান পাটা তুলে উল্টো করে ঘুরিয়ে বাঁ’দিকে টানতে থাকে মির্জা। সিংরাইয়ের মনে হয় কুঁচকি থেকে ছিঁড়ে যাবে পা, প্রচণ্ড চিৎকার করতে থাকে সে। এসডিপিওর ঘরের বাইরে দূরে বসে থাকা লোকও শুনতে পায় সেই চিৎকার। তারপর মির্জা তার অন্য পা’টা ধরে একই ভাবে উল্টো করে মুচড়ে ঘুরিয়ে ডান’দিকে টানতে থাকে। কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করতে থাকে সিংরাই। দেখতে পায় না বলে বুঝতে পারে না পা দুটোর কী অবস্থা, মনে হয় আর জীবনে কোনও দিন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না সে। পা দুটো ছেড়ে মির্জা এরপর জুতো পরে সিংরাইয়ের পিঠে উঠে পড়ে, তারপর হাঁটতে থাকে বাচ্চা ছেলেটার পিঠ থেকে পা পর্যন্ত। আবার চিৎকার করতে শুরু করে সিংরাই, মনে হয় সে আর বাঁচবে না। পরপর কয়েকবার সিংরাইয়ের পিঠ থেকে পা পর্যন্ত হেঁটে নেমে পড়ে মির্জা, গিয়ে বসে নিজের চেয়ারে। তারপর বেল টিপে একজনকে বলে চা আনতে। ওঠা তো দূরের কথা, নড়ারও শক্তি নেই সিংরাইয়ের। তাকে ছেড়ে কনস্টেবল দু’জন উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। মরার মতো মাটিতে শুয়ে থাকে সিংরাই। যন্ত্রণায় গোঙাতে থাকে, জিভ লেগে যায় মাটিতে। জিভে বালি বালি কিছু লাগে, সঙ্গে সঙ্গে মুখ বন্ধ করে নেয়। শুয়েই থুথু ফেলার চেষ্টা করে, গাল বেয়ে নেমে আসে তা। হাতে ভর দিয়ে যে উঠবে, তাও পারে না। একদিকে মাথা কাত করে মাটিতে শুয়ে থাকে। জোরে জোরে শ্বাস পড়তে থাকে। টের পায় কপাল, গলা ভিজে গিয়েছে ঘামে। সিংরাই দেখতে পায় না বলে বুঝতে পারে না, নিজের চেয়ারে বসে মির্জাও তখন হাঁপাচ্ছে।
কিছুক্ষণ বাদে চা নিয়ে ঘরে ঢোকে একজন। মির্জা কনস্টেবল দু’জনকে বলে সিংরাইকে গরম চা খাইয়ে হাঁটাতে। দু’জন কনস্টেবল দু’দিক থেকে ধরে টেনে তোলে তাকে, চেষ্টা করে তাকে সোজা করে দাঁড় করানোর। চায়ের কাপ এগিয়ে দেয়। কিন্তু কাপ ধরার ক্ষমতা নেই সিংরাইয়ের। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, তাকে দু’দিক থেকে শক্ত করে ধরে থাকে দু’জন। চা কিছুটা ঠান্ডা হলে কাপটা কোনভাবে দু’হাতের চেটো দিয়ে চেপে ধরে সিংরাই, আস্তে করে চুমুক দেয়। তারপর কনস্টেবল দু’জন তাকে দু’দিকে ধরে মিনিট দশেক হাঁটায়, পা ফেলতে যন্ত্রণায় মুখ কুঁকড়ে আসে তার, ঝনঝন করে হাঁটু থেকে কুঁচকি পর্যন্ত। তারপর এসডিপিও’র কথায় সিংরাইকে ঘর থেকে বের করে তোলা হয় গাড়িতে। খাতরা থানায় পৌঁছে তাকে ধরে লক আপে ঢুকিয়ে দেয় দু’জন। দরজার সামনেই শুয়ে পড়ে সিংরাই। কতক্ষণ চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল বুঝতে পারে না, ঘণ্টাখানেক হবে হয়তো, একজন এসে আগের রাতের মতোই লক আপে ঢুকিয়ে দিয়ে যায় চারটে রুটি, সবজির থালা। আজ আর শরীরে শক্তি অবশিষ্ট নেই সিংরাইয়ের, পাশে পড়ে থাকে খাবারের প্লেট। কাত হয়ে লক আপের এক কোণে পড়ে থাকে সিংরাই। এতক্ষণ বুঝতে পারেনি, এবার বুঝতে পারে মুখ দিয়ে যেন শব্দ না হয় তার জন্য ঠোঁট দুটো শক্ত করে চেপে ছিল, তখন দাঁতের কামড়ে ঠোঁটের এক জায়গা কেটে গিয়েছে। জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে গিয়ে রক্তের স্বাদ পায় সিংরাই, তারপর আবার চোখ বুজে শুয়ে থাকে।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতে পারে না, সিংরাইয়ের যখন ঘুম ভাঙে তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। কিন্তু উঠে দাঁড়ানোর মতো ক্ষমতা নেই তার, কনুইয়ে ভর দিয়ে একটু এগোয় রুটির থালাটার দিকে। প্রচণ্ড খিধেতে পেট জ্বলে যাচ্ছে, আগের রাতের মতো থালাটার দিকে মুখ নিয়ে যায় সিংরাই। তারপর রুটি মুখে পুড়ে চিবোতে থাকে।
আজ সিংরাইকে গ্রেফতার করার তৃতীয় দিন। কিন্তু আগের দু’দিনের মতো আজও তাকে কোর্টে নিয়ে যাবে না খাতরা থানার পুলিশ। তাই আসলে তার ধরার পড়ার তৃতীয় দিন হলেও, বেলপাহাড়ির ময়ূরঝর্ণা গ্রামের ষোল ছুঁইছুঁই কিশোর সিংরাই মান্ডি এখনও আইনত গ্রেফতার হয়নি। আজ সারাটা দিন সিংরাই লক আপে থাকবে। থাকবে মানে, সারাটা দিন মরার মতো লক আপে শুয়ে থাকবে। হাতে-পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা, পা নাড়াতে পারবে না ঠিক করে। উঠে দাঁড়াতে পারবে না সোজা হয়ে। শুয়ে শুয়ে সিংরাই দেখবে লক আপের সামনে দিয়ে কখনও হেঁটে যাবে ওসি, কখনও বা থানার সেকেন্ড অফিসার। বুঝতে পারবে না, আসলে ও ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য মাঝেমাঝে ঘুরে যাচ্ছে ওরা। আজ দুপুরে সিংরাইকে ভাত দেওয়া হবে, কিন্তু ও হাত দিয়ে তা খেতে পারবে না। যেভাবে গত দু’রাত খেয়েছে, থালার ওপর মাথা নামিয়ে সরাসরি জিভ দিয়ে রুটি টেনে মুখে ভরেছে, আজ সেভাবে থালার ওপর মাথা নামিয়ে ভাত খাবে। ঠোঁটের দু’দিকে, গালে লেগে যাবে ভাত, ডাল, কুমড়োর তরকারি। সিংরাই আজ সারা দিন লক আপে শুয়ে ভাববে, এতদিনে নিশ্চয় বনমালী কাকা জেনে গিয়েছে তার গ্রেফতারের খবর। বনমালী কাকা ভাববে না তো, সে পুলিশকে অনেক কিছু বলে দিয়েছে! যত অত্যাচারই হোক, কোনও নেতা, দলের কারও কথা বা কাজকর্ম পুলিশকে বলবে না ঠিক করে রেখেছে সিংরাই। কিন্তু বনমালী কাকা তা বুঝতে পারবে তো? এই প্রশ্নটা বারবার মাথায় আসবে তার। কখনও সিংরাইয়ের মনে পড়বে বাবা, মা, ধর্মা, মালতীর কথা। বাড়ির লোক নিশ্চয় জানে না সে ধরা পড়েছে। কখনও সিংরাইয়ের মনে পড়বে মনোহরের কথা। কিন্তু যে প্রশ্নটা আজ সারাদিন তাকে চিন্তিত রাখবে তা হল, যখনই ছাড়া পাবে সে আবার সংগঠনের কাজ করতে পারবে তো? যদিও তার জানা নেই কবে ছাড়া পাবে, পুলিশ তো এখনও কোর্টেই তুলল না!
সারাটা দিন লক আপে এমন নানা কথা ভাবতে ভাবতে কাটবে সিংরাইয়ের। সন্ধে ছ’টা নাগাদ তাকে লক আপ থেকে বের করবে দু’জন কনস্টেবল, তার প্রথমে মনে হবে আবার বোধহয় এসডিপিও অফিসে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে। কিন্তু না, লক আপ থেকে বেরিয়ে সিংরাই দেখবে থানার বাইরে পাঁচটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে। প্রতিটাতে চার-পাঁচজন করে পুলিশ বসে। একদম সামনের গাড়িটায় তাকে মাঝের সিটে বসানো হবে, দু’পাশে দু’জন কনস্টেবল। সামনের সিটে বসবে সেকেন্ড অফিসার। পিছনের গাড়িতে খাতরা থানার ওসি, তার পিছনে পুলিশ ভর্তি আরও তিনটে জিপ। পাঁচ জিপের কনভয় চলতে শুরু করবে। খাতরা ছাড়িয়ে গাড়ি যাবে রাইপুর হয়ে সারেঙ্গার দিকে। সুখজোড়া, নিশ্চিন্দিপুর, শ্যামনগর, নেকড়া আঁচড়া, একের পর এক গ্রামে সিংরাইকে নিয়ে হানা দেবে খাতরা থানার পুলিশ। তাকে দিয়ে চেনানোর চেষ্টা হবে এই সব গ্রামে কোন বাড়িতে সে আগে থেকেছে, কোন বাড়িতে মিটিং করেছে। গ্রামবাসীদের ডেকে এনে জিজ্ঞেস করা হবে, কে তাকে চেনে! এভাবে যে বাড়িগুলোকে পুলিশের সন্দেহজনক মনে হবে, দেশবিরোধী মনে হবে, যে মানুষগুলোকে মাওয়িস্টদের সহযোগী বলে মনে হবে, তেমন সমস্ত বাড়ি ভাঙচুর করবে পুলিশ। ঘরে ঢুকে উল্টে ফেলে দেবে খাবারের সরঞ্জাম, বাচ্চাদের বই-খাতা, জমিয়ে রাখা কেরোসিন তেল। পুলিশের পাহারায় অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখবে সিংরাই। নিজেকে অপরাধী মনে হবে তার। মনে হবে, সে ধরা পড়েছে বলেই এই গরিব মানুষগুলোর ওপর এমন অত্যাচার হচ্ছে। নেকড়া আঁচড়া গ্রামে একটা বাড়িতে দশ-এগারো বছরের একটা বাচ্চাকে এই শীতের রাতে ঘুম থেকে তুলে তার সামনে দাঁড় করায় পুলিশ। জিজ্ঞেস করে, সে সিংরাইকে চেনে কিনা। ঘুমচোখে উঠে বাচ্চাটা বুঝতে পারে না কিছু, ভয়ে হ্যাঁ বলে দেয়। তারপর আবার না বলে। সিংরাই তো নিজে জানে, এই বাড়িতে সে আসেনি কখনও। কিন্তু পুলিশ ভাবে বাচ্চাটা মিথ্যে কথা বলছে। বাচ্চাটাকে টানতে টানতে জিপের দিকে নিয়ে যায়। দৌড়ে আসে বাচ্চাটার বাবা, মা। তাদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় একজন কনস্টেবল। তারপর তাদের বাড়ি ভাঙতে শুরু করে চার-পাঁচজন। সিংরাইয়ের মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা, যেদিন পুলিশ নিয়ে এসে ফরেস্টের লোকজন তাদের বাড়ি ভাঙছিল। এই বাচ্চাটার মতোই সেদিন সে বোনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে দেখছিল, চোখের সামনে ভেঙে পড়ছে একটার পর একটা টালি, মাটির দেওয়াল। সিংরাই দেখে বাচ্চাটা টানা চিৎকার করছে। চেষ্টা করছে পুলিশের হাত ছাড়ানোর, পারছে না। কান্না পেয়ে যায় তার। চেষ্টা করেও চোখের জল আটকাতে পারে না সিংরাই। বুঝতে পারে না, এই যে এখন চোখে জল এল তার কারণ কী? এমন তো আগে হয়নি কখনও, অন্য কারও কষ্ট দেখে কান্না পায়নি তো কোনওদিন! যেদিন নিজের বাড়ি ভাঙা হচ্ছিল, সেদিন চরম আক্রোশ, ঘৃণা নিয়ে সে তাকিয়েছিল পুলিশ, ফরেস্ট ডিপার্টমেণ্টের লোকগুলোর দিকে, আর আজ অন্যের বাড়ি ভাঙা, বাচ্চাটার চিৎকার শুনে চোখে জল এল কেন? উত্তর খুঁজে পায় না সিংরাই, শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অবশ্য তার তো বয়স কম, অনেক বয়স হওয়া সব মানুষও কি আর বোঝে, যে তীব্রভাবে কাউকে ঘৃণা করতে পারে, একমাত্র সেই এমন ভালোবাসতে পারে, যে ভালোবাসা অচেনা কারও কষ্ট দেখলে চোখে জল নিয়ে আসে! কারণ, এও পদার্থ বিদ্যার সেই সূত্রের মতো, তীব্র ঘৃণার উল্টোদিকে আছে তীব্র ভালোবাসা! শেষ পর্যন্ত বাচ্চাটাকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। প্রায় সাড়ে পাঁচ-ছ’ঘণ্টা বিভিন্ন গ্রামে এমন চলার পর শেষমেশ রাত বারোটা নাগাদ খাতরা থানায় ফেরে পাঁচ গাড়ির পুলিশ কনভয়। সিংরাইকে ঢোকানো হয় লক আপে।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সিংরাইয়ের মনে হল, আজ কিছু একটা ঘটতে চলেছে। সকাল সকাল একজন কনস্টেবল এসে চা দেয় তাকে, জিজ্ঞেস করে শরীর ঠিক আছে কিনা। ঘাড় নেড়ে সে জানিয়ে দেয় ঠিক আছে। বেলা এগারোটা নাগাদ থানার সেকেন্ড অফিসার সিংরাইকে নিয়ে জিপে ওঠে। ‘তোকে আজ কোর্টে তোলা হবে। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে একটা কথাও বলবি না।’ সিংরাই চুপ করে বসে থাকে, বুঝতে পারে কী বলতে না করছে লোকটা। তাকে প্রথমে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় মেডিকেল টেস্টের জন্য, কিন্তু ডাক্তারের ঘরের বাইরে কনস্টেবল দিয়ে পাহারায় বসিয়ে সেকেন্ড অফিসার ভেতরে চলে যায়। কিছু বাদে সিংরাই দেখে, পুলিশ অফিসার দূর থেকে একজন ডাক্তারকে তার দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছে। তারপর ঘরের ভেতর থেকে মেডিকেল রিপোর্ট নিয়ে বেরিয়ে আসে অফিসার, ফের তাকে গাড়িতে তুলে খাতরা আদালতে নিয়ে যায় পুলিশ। প্রায় এক ঘণ্টা জিপে বসিয়ে রেখে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কোর্টের ভেতর। সিংরাই বুঝতে পারে আগে থেকে কাগজপত্র দেওয়াই ছিল, ম্যাজিস্ট্রেট তার দিকে একবার শুধু চোখ তুলে তাকায়। তারপর মাথা নীচু করে মিনিট দুয়েক কিছু কাগজে চোখ বুলিয়ে পনেরো দিনের জন্য জেলে পাঠিয়ে দেয় সিংরাইকে।
২৪-০৪-২০০২, জেল থেকে জঙ্গলে
তিন দিন আগে খবরটা পেয়েছিল সিংরাই। তখন বিকেল, সেলের বাইরে ফাঁকা জায়গাটায় দু’তিনজনের সঙ্গে কথা বলছিল। পাশের সেলের শঙ্করদা এসে ডাকল তাকে, ‘তোর জামিন হয়েছে।’ জেলে আসার প্রথম দিন থেকে শঙ্করদা আগলে রেখেছে তাকে। সিংরাই তাকিয়ে থাকে শঙ্করদার দিকে, কী বলবে ভেবে পায় না। তার মনে পড়ে প্রায় চার মাস আগের কথা, সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে বিকেল পাঁচটা নাগাদ ঢুকেছিল বাঁকুড়া জেলে। জেল গেট দিয়ে ঢোকার পর পুলিশের ভ্যান থেকে নেমে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না। খাতায় নামধাম লেখার পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় দু’নম্বর ওয়ার্ডে, জেলের ভাষায় যাকে বলে এন্ট্রি ওয়ার্ড। বাচ্চা ছেলেটাকে দেখে এগিয়ে এসেছিল কয়েক মাস আগে জেলে ঢোকা শঙ্কর বাউড়ি। বাঁকুড়ার শালতোড়ায় বাড়ি শঙ্করের। নিজে বিছানা করে সিংরাইকে শুইয়ে তার হাতে-পায়ে মালিশ করে দিয়েছিল শঙ্কর, ভাত এনে দিয়েছিল। তারপর দেখতে দেখতে বাঁকুড়া জেলে কেটে গেল চারটে মাস। কবে ছাড়া পাবে, কোনও দিন ছাড়া পাবে কিনা, কিছুই বুঝতে পারত না সিংরাই। পনেরো দিন অন্তর তাকে নিয়ে যাওয়া হত খাতরা কোর্টে। সে যে ধরা পড়ে জেলে আছে তা বাড়ির কেউ জানতে পেরেছে কিনা তাও প্রথম এক মাস বুঝতে পারেনি সিংরাই। একদিন খাতরা কোর্টে পুলিশ ভ্যান থেকে নামার সময় দেখে বাবা দাঁড়িয়ে আছে। এদিক-ওদিক চোখ ঘুরিয়ে সিংরাই দেখে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে শকুন্তলা দিদি। সিংরাই বুঝতে পারে, কে বাবাকে নিয়ে এসেছে তার সঙ্গে দেখা করাতে। বাবার দিকে এগিয়ে যায় সিংরাই, বলে চিন্তা না করতে। জিজ্ঞেস করে মা, ভাই, বোন কেমন আছে। বেশিক্ষণ বাবার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে না। বাবার চেহারা আরও খারাপ হয়েছে, তার জন্য বাবা এতটা রাস্তা কষ্ট করে এসেছে ভেবে খারাপ লাগে তার। সিংরাই তো সেই ছোট থেকে চেয়েছে যতটা সম্ভব বাড়ির কাজে বাবা-মাকে সাহায্য করতে, দেখেছে কত কষ্ট করে বাড়ির সবার ভাত জোগাড় করেছে বাবা-মা। আর আজ তার জন্য বাবাকে কষ্ট করে এতটা রাস্তা আসতে হল, মানতে পারে না সে। কী বলবে বাবাকে বুঝতে পারে না কিছুক্ষণ। সুবল শুধু জিজ্ঞেস করে সে কেমন আছে, সিংরাই তাকাতে পারে না বাবার দিকে। চোখ সরিয়ে খোঁজে শকুন্তলা দিদিকে, বলতে চায় বাবাকে যেন তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয়! চার-পাঁচ সেকেন্ড বড়জোর, পিছন থেকে পুলিশের লোকটা ঠেলা দেয় তাকে, এগোতে বলে কোর্ট রুমের দিকে। বাবার থেকে চোখ সরিয়ে দ্রুত কোর্টের দিকে এগোয় সিংরাই।
শঙ্করদার কথা শুনে প্রথমে বিশ্বাস হয়নি সিংরাইয়ের। কিছু বাদে জেল অফিস থেকে একজন তাকে জানায়, দশ হাজার টাকার বন্ডে খাতরা কোর্টে তার জামিন হয়েছে। জামিনদার কাগজপত্র জমা দিলেই ছাড়া পাবে সে। সিংরাইয়ের প্রথমেই মনে পড়ে বনমালী কাকার কথা। এত টাকা দিয়ে কে জামিনদার হবে? কিন্তু বনমালী কাকা কি খবর পেয়েছে যে, তার জামিন হয়েছে? তারপর পেরিয়ে গিয়েছে তিন দিন, আজ সকালে জেল অফিসের বড়বাবু খবর পাঠিয়েছে, বেল বন্ডের কাগজ এসে গিয়েছে। সে যেন ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হয়ে থাকে। একে একে জেলের সবার সঙ্গে দেখা করে সিংরাই, যাদের সঙ্গে কাটিয়েছে এই কয়েক মাস। বেলা বারোটা নাগাদ খবর আসে তার কাছে। নিজের কিছু জিনিসপত্র একটা পলিথিনের প্যাকেটে মুড়ে রেখেছিল, তা হাতে নিয়ে জেলের বাইরে এসে দাঁড়ায় সিংরাই। মাথার ওপর খটখটে রোদ, জেল থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক তাকায়, সকালে যখনই শুনেছে বেল বন্ডের কাগজ এসেছে, তখনই সিংরাই বুঝতে পেরেছিল নিশ্চয় বনমালী কাকা এই ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু জেল থেকে বেরিয়ে প্রথম কোথায় যাবে তা নিয়ে সংশয় ছিল তার। ঠিক করেছিল দলের কারও বাড়ি যাবে না, যদি সাদা পোশাকের পুলিশ ফলো করে তাকে! জেল গেট থেকে বেরিয়ে সিংরাই কিছুটা সময় নেয়, এদিক-ওদিক তাকায়। রাস্তা পার হয়ে গিয়ে বসে একটা চায়ের দোকানে। টানা প্রায় আধ ঘণ্টা দোকানটায় বসে থাকে সিংরাই, এক কাপ চা নিয়ে এদিক-ওদিক দেখে। বোঝার চেষ্টা করে কেউ তার ওপর নজর রাখছে কিনা। কাউকে তেমন সন্দেহজনক মনে হয় না। উঠে পড়ে চায়ের দোকান থেকে, পাশে একটা ভাতের হোটেল, তার পাশে জেরক্স সেন্টার, তারপর আরও একটা চায়ের দোকান। সিংরাই এতক্ষণ খেয়াল করেনি পাশের সেই চায়ের দোকানটায় বসে একজন লক্ষ্য রাখছিল তার ওপর।
দোকানটা ছাড়াতেই লোকটা উঠে তার পাশে চলে আসে, ‘সুকান্তদা পাঠিয়েছে, গ্যাপ রেখে আমাকে ফলো কর।’ কথাটা বলেই লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যায় সাধারণ জামা, প্যান্ট পরা লোকটা। ফুট বিশেক গ্যাপ রেখে লোকটার পিছনে হাঁটতে থাকে সিংরাই। টানা কিছুটা হেঁটে তারা পৌঁছয় বাস স্ট্যান্ডে। বাঁকুড়া-শিলদা বাস কোনটা খোঁজ নিয়ে লোকটা উঠে পড়ে তাতে। বাসে উঠে লোকটার পিছনে অন্য একটা ফাঁকা সিটে বসে সিংরাই, কিছু বাদেই বাস ছেড়ে দেয়। তালডাংরা, রাইপুর হয়ে বাস এগোয় শিলদার দিকে, সিংরাই টানা নজর রাখে লোকটার ওপর। এই সব রাস্তা ওর চেনা। ফুলকুসমা ছাড়ানোর পরই লোকটা উঠে পড়ে সিট থেকে, আরও কিছুটা গিয়ে কন্ডাক্টরকে বাস থামাতে বলে নেমে পড়ে লোকটা, পিছন পিছন সিংরাইও। বড় রাস্তা থেকে গ্রামের রাস্তা ধরে এগোয় দু’জন। কিছুটা এগিয়ে একটা ভুসি মালের দোকানে গিয়ে লোকটা থামে, সেখানে রাখা ছিল তার সাইকেল। সিংরাই সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে, গ্রাম এড়িয়ে লোকটা ধরে জঙ্গলের রাস্তা। এই রাস্তা শুশনিজুবি হয়ে সোজা চলে যাচ্ছে চাকাডোবা। শুশনিজুবি ঢোকার আগে লোকটা সাইকেল থামায়। এতটা রাস্তা সাইকেলে আসার সময় কথা হয় দু’জনের। লোকটার নাম বাবুরাম হেমব্রম। বাবুরাম জানায়, একদিন আগে একজন এসে তাকে বলে গিয়েছে, আজ বাঁকুড়া জেল থেকে একটা বাচ্চা ছেলেকে এনে তার বাড়িতে কয়েক দিন রাখতে হবে। সকাল সকাল সে তাই চলে গিয়েছিল বাঁকুড়া শহরে। সিংরাই জেল থেকে বেরোতেই একজন তাকে চিনিয়ে দিয়ে চলে যায়। কে জেলের বাইরে গিয়েছিল তাকে চেনাতে তা বলতে পারে না বাবুরাম।
বাবুরামের বাড়ি জঙ্গলের একটু ভেতরে। চারটে বাজতে যায়, শুশনিজুবির আকাশে হঠাৎ হাজির হয়েছে কালো মেঘ। স্নান করে উঠোনে এসে বসে সিংরাই, বাবুরামের বউ দু’জনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে যায় মুড়ির বাটি। ভেজানো ছোলা দিয়ে মুড়ি খেয়ে সিংরাই ঘরে ঢুকে যায়। প্রায় চার মাস পর খোলা আকাশের নীচে সিংরাই, তার মনে পড়তে থাকে সেই বিঠুলা গ্রামে ধরা পড়ার পর থেকে পরপর সব ঘটনা। তাকিয়ে থাকে নিজের দু’হাতের দিকে। আঙুলের অবস্থা এখন অনেকটাই ঠিকঠাক, কিন্তু পা এখনও ঠিক হয়নি। জোরে হাঁটতে গেলে এখনও ব্যথা লাগে কুঁচকির কাছে, মির্জার মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে।
পরদিন সকাল সকাল মাঠের কাজে চলে যায় বাবুরাম। সারাদিন ঘর থেকে বেশি বেরোয় না সিংরাই। বাবুরামের বাড়িতে কেটে যায় আরও দু’দিন, এখানে কত দিন থাকতে হবে বুঝতে পারে না সে। দু’দিন ধরে সিংরাইয়ের মাথায় শুধু ঘুরতে থাকে একটাই প্রশ্ন, আবার কবে থেকে সে আগের মতো দলের কাজ করতে পারবে? সত্যিই কি আবার দলের সঙ্গে আগের মতো যুক্ত হতে পারবে সে? আবার কি কোনও দায়িত্ব তাকে দল দেবে? কতদিন এই শুশনিজুবি গ্রামে এভাবে থাকতে হবে তাও বুঝতে পারে না সিংরাই। কিছু বলতে পারে না বাবুরামও।
শুশনিজুবিতে তিন দিন কাটানোর পর অপেক্ষা শেষ হয় সিংরাইয়ের। দুপুরে মাঠের কাজ থেকে বাড়ি ফিরে আসে বাবুরাম, ‘দাদা লোক পাঠিয়েছিল, আজ রাত ন’টার মধ্যে তোমাকে তালপুকুরিয়ায় উজ্জ্বল মাহাতোর বাড়িতে যেতে বলেছে। বলেছে সন্ধে নামলে বেরোতে।’ আনন্দে, খুশিতে যেন লাফিয়ে ওঠে সিংরাই, দৌড়ে ঘরের পিছনে গিয়ে দেখে গামছাটা শুকিয়েছে কিনা, প্যান্টটাও আজ কেচে দিয়েছিল পুকুরে। তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে নেয়, অপেক্ষা করে সন্ধে নামার। উজ্জ্বল মাহাতোর বাড়িতে সিংরাই আগেও থেকেছে কয়েকবার। তালপকুরিয়ার নাম শুনলেই এক অদ্ভুত অনুভূতি হয় ওর, মনে পড়ে যায় কেন্দিশোলের জোতদার যদুনাথ মন্ডলের জমির ধান বাজেয়াপ্ত করার রাত। মনে মনে হিসেব করে সিংরাই, সাড়ে ছ’টায় বেরিয়ে যাবে, চেষ্টা করবে গ্রামের রাস্তা যতটা পারে এড়িয়ে যাওয়ার।
তালপুকুরিয়ার উজ্জ্বল মাহাতো আগেই জানত সিংরাইয়ের আসার কথা। দু’জনে গল্প করে অনেক রাত পর্যন্ত, গত চার-পাঁচ মাসে কী ঘটছে গ্রামে তা শোনে সিংরাই। পরদিন সকাল থেকে প্রায় সারাটা দিন ঘরের মধ্যেই থাকে সে। অনেক রাতে উজ্জ্বল মাহাতোর বাড়িতে হাজির হয় বনমালী, সঙ্গে অর্জুন আর ধ্রুব। বনমালী কাকাকে দেখে কী বলবে ভেবে পায় না সিংরাই, দাঁড়িয়ে থাকে চুপ করে। সিংরাইয়ের মাথায় হাত দিয়ে তাকে কাছে টেনে নেয় বনমালী, শরীরটা শক্ত করে চোয়াল চেপে দাঁড়িয়ে থাকে ষোল বছরের ছেলেটা। মনে হয়, নিজের হারানো জীবন খুঁজে পেয়েছে সে, কিন্তু কিছু বলতে পারে না।
‘কেমন আছ?’
‘ভালো।’
‘এখন শরীর ঠিক আছে?’
‘হ্যাঁ’। সিংরাইকে প্রথম দিন দেখার কথা মনে পড়ে বনমালীর। মনে হয় ছেলেটা একই আছে, সেই আগের মতোই এক শব্দে জবাব।
‘সিংরাই তোমাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা হল, এখন তুমি কী করবে? তোমার সামনে দুটো রাস্তা, হয় তুমি বাড়ি যাবে। আবার আগের জীবনে ফিরবে। দু’দিন বাদে তোমাকে থানায় হাজিরা দিতে হবে। তোমার জামিনের শর্তে কোর্ট বলেছে সাত দিন অন্তর থানায় হাজিরা দেওয়ার কথা। প্রতি সপ্তাহে তোমাকে থানায় যেতে হবে হাজিরা দিতে। আর দ্বিতীয় পথ হচ্ছে, তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে। সংগঠনের কাজ করবে। তখন আর আগের জীবনে ফেরার রাস্তা থাকবে না, লুকিয়ে কখনওসখনও হয়তো বাড়ি যেতে পারবে। কিন্তু তোমাকে পুরোপুরি গোপন জীবনে চলে যেতে হবে।’ বনমালী জানে সিংরাইয়ের কী জবাব হতে পারে, তাও স্পষ্ট করে তাকে বলে সব কথা। ভাবার জন্য সময় নেয় না সিংরাই, ‘আমি তোমাদের সঙ্গে থাকব। সংগঠনের কাজ করব।’ সিংরাই একবার ভাবে বলবে যে, থানায় তার ওপর টানা অত্যাচারের সময়ও সে সংগঠনের কারও কথা বলেনি পুলিশকে, কিন্তু বলতে পারে না। সিংরাই বুঝতে পারে না, বনমালী তা আগে থেকেই জানে।
‘পরশু তুমি যদি থানায় হাজিরা না দাও, তবে কিন্তু পাকাপাকি তোমার নাম ওয়ান্টেড লিস্টে চলে যাবে। তখন পুলিশ যখন খুশি তোমাকে অ্যারেস্ট করতে পারবে,’ আবার সিংরাইয়ের সামনে অগ্নিপরীক্ষার প্রশ্ন রাখে বনমালী। আবারও একই জবাব দেয় ময়ূরঝর্ণার কিশোর সিংরাই মান্ডি, শুরু হয়ে যায় তার গোপন জীবন।
ঠিক হল, এখন কয়েকটা দিন তালপুকুরিয়াতেই থাকবে সিংরাই। ঘর থেকে খুব বেশি বেরোবে না। সাবধানে থাকতে হবে কয়েকটা দিন। ‘সিংরাই, আমি কয়েকদিনের জন্য বাইরে যাব। এখন আমাদের সামনে অনেক কাজ, তার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যানিং চলছে। সেই কাজের জন্য সংগঠনের তোমাকে দরকার। তোমার হাঁটাচলা তো এখনও স্বাভাবিক হয়নি, পায়ের ব্যথা কমেছে পুরো?’
‘হ্যাঁ, এখন অনেকটাই কম।’
‘আমাদের এখন আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে যেতে হবে, নয়তো সংগঠনের বিস্তার হবে না। পুলিশের অভিযান দিনদিন বাড়ছে। ঝাড়খন্ডে আমাদের যেমন সংগঠন আছে, তা এখনও এখানে নেই। আন্দোলনকে অ্যাডভান্স করতে গেলে প্রতিটা গ্রামে বেস তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে ঝাড়খন্ডের সঙ্গে করিডোর বানাতে হবে। মানে যে রাস্তা দিয়ে ফ্রি মুভমেন্ট করা যাবে এবং ফ্রি মুভমেন্টের জন্য মাঝে যত গ্রাম পড়বে তার সবকটায় আমাদের সংগঠন থাকতে হবে। যাতে ওই গ্রামে পুলিশ ঢুকতে না পারে, ঢুকলেও সেখানে তল্লাশি চালিয়ে যেন কাউকে গ্রেফতার করতে না পারে। প্রতিটা গ্রামে শক্ত সংগঠন তৈরি করতে না পারলে এই করিডোর বানানো যাবে না। ঝাড়খন্ড থেকে এই করিডোর বানানোর কাজ খুব তাড়াতাড়ি শুরু হবে। তার জন্য আমাদের বিশেষ টিম তৈরি করতে হবে,’ টানা বলে সামান্য থামে বনমালী। একটা বিড়ি ধরায়, তারপর আবার বলে, ‘তুমি এখন কিছুদিন বিশ্রাম নাও। সামনের সপ্তাহে শিবানী এসে তোমাকে শিলদায় ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যাবে। তোমার ঠিকঠাক ট্রিটমেন্ট দরকার। ডাক্তার ওষুধপত্র দিলে আগামী সপ্তাহে তুমি রঘুনাথপুরে চলে যাবে। এখানে এখন সিচুয়েশন ভালো নেই। টানা এখানে থাকা ঠিক হবে না। রঘুনাথপুরে কিছুদিন থাক, মাসখানেক বাদে আমি ফিরব। আমার ফিরতে দেরি হলে অর্জুন বা ধ্রুব তোমাকে সময় মতো খবর দেবে, তোমাকে ঝাড়খন্ড যেতে হবে।’
গ্রেফতার হওয়ার দিন থেকে একটাই ভয় ছিল সিংরাইয়ের, আবার আগের মতো সংগঠনের কাজ সে করতে পারবে কিনা। দল তার ওপর আগের মতো ভরসা করবে কিনা! বনমালীর কথায় এই সংশয় পুরোপুরি কেটে যায়, আনন্দে, উত্তেজনায় সোজা হয়ে বসে সিংরাই। দল যে তাকে আরও বড় দায়িত্ব দিতে চলেছে বুঝতে পারে সে। কাজের কথা শেষ হলে আরও কিছুক্ষণ তালপুকুরিয়ায় থাকে বনমালী, অর্জুন, ধ্রুবরা। তারপর মাঝরাতেই তারা বেরিয়ে যায় তালপুকুরিয়া থেকে। বেরনোর আগে উজ্জ্বল মাহাতোর বউ তাদের হাতে দিয়ে দেয় গোটা কয়েক রুটি আর অনেকটা গুড়। এই সময়টা গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই কিছুটা হলেও গুড় থাকে।
বনমালীরা বেরিয়ে যেতে শুয়ে পড়ে সিংরাই। তালপুকুরিয়ায় থাকে আরও আট দিন। তারপর একদিন সকালে শিবানী নিতে আসে তাকে। শিলদায় এক পরিচিত ডাক্তারের চেম্বারে সিংরাইকে নিয়ে যায় শিবানী। ডাক্তারকে আগে থেকেই বলা ছিল, চেম্বার থেকে বেরিয়ে শিবানী কিছু ওষুধ কিনে দেয় সিংরাইকে। শিলদা থেকে সিংরাই বাঁকুড়ার বাস ধরে। বাস ছাড়ার আগে একটা চায়ের দোকানে বসে দু’জন। অনেক বিষয়ে কথা হয়। ওঠার আগে শিবানী জানায়, বনমালীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে।
ক্রমশ।..
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।