‘কমরেডরা এসে গেছে, এখনই মিটিং শুরু হবে,’ সরু গলায় বলল ছেলেটা। আর এক মিনিটের মধ্যেই গোল পোস্টের পিছন থেকে লম্বা পা ফেলে মাঠের মাঝখানে এগিয়ে এল পাঁচজন। তাদের মধ্যে একজন মহিলা, শুধু একজন ছাড়া সবারই বয়স কম। যে লোকটার বয়স অন্যদের থেকে একটু বেশি সে এসে দাঁড়াল মানুষগুলোর একদম সামনে। বাকিরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ভিড়টাকে ঘিরে দাঁড়াল। লোকটার পরনে গাঢ় রঙের জামা, প্যান্ট। তা সবুজ না কালো না বাদামি বোঝা গেল না অন্ধকারে, লোকটার পায়ে কেডসের মতো জুতো। শক্তপোক্ত চেহারা, ঝাঁকড়া চুল কপালে এসে পড়েছে, কাঁধে একটা ছোট ব্যাগ, ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে রেখে হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছল লোকটা। লোকটাকে কেউ চিনতে না পারলেও, সবাই বুঝল এর কথা শুনতেই আজ মিটিং ডাকা হয়েছে। এই লোকটার নাম বনমালী দেশোয়ালি, যদিও আজ মিটিংয়ে সবাই তাকে চিনবে সুকান্ত নামে।
‘আমার নাম সুকান্ত, একটা বিশেষ কারণে আজ আপনাদের ডেকেছি আমরা। আপনারা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছেন, অথচ আমাদের আসতে একটু দেরি হয়ে গেল। আপনাদের বেশি সময় আমি নেব না। আজ চাকাডোবা, বাঁশপাহাড়ি, কাঁকড়াঝোড় এবং এই এলাকার একটা বিশেষ বিষয় নিয়ে কিছু কথা বলতে আমরা এসেছি। মায়ের কাছে মাসির গল্প বলতে আমরা আসিনি, আমরা জানি এই এলাকার খবর, পরিস্থিতি আপনারা আমার থেকে অনেক ভালো জানেন। আপনারা কীভাবে বেঁচে আছেন তা আমরা জানি, কিন্তু তার থেকেও তা ভালো জানেন আপনারা। তবু আমরা আজ এসেছি কয়েকটা কথা আপনাদের বলতে। তা শোনার পর আপনারা যে সিদ্ধান্ত নেবেন তা আমরা মেনে নেব। আমরা আপনাদের ওপর কিছু চাপিয়ে দিতে আসিনি,’ টানা বলে একটু থামল লোকটা। নীচু হয়ে মাটিতে রাখা ব্যাগের চেন খুলে বের করল একটা গামছা, তা দিয়ে মুখ, মাথা বেয়ে নেমে আসা জল, ঘাম মুছল ভালো করে। মাঠে বসে থাকা লোকগুলো দেখল লোকটার জামা, প্যান্ট বৃষ্টিতে পুরো ভিজে গিয়েছে। কিন্তু সেদিকে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই তার, গামছাটা কাঁধের ওপর ফেলে লোকটা আবার বলতে শুরু করল।
‘আপনারা জানেন ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর দিন, সত্যিই কি আপনারা স্বাধীন হয়েছেন? আমার, আপনার মতো গরিব মানুষ কি সত্যিই স্বাধীনতা পেয়েছে? এই বেলপাহাড়ি, ঝাড়গ্রাম বা পুরো দেশের ষাট-সত্তর শতাংশ মানুষ কৃষক। তাদের বেশিরভাগেরই নিজের জমি নেই, অন্যের জমিতে চাষ করে। এর বাইরে দেশের প্রায় পঁচিশ-তিরিশ শতাংশ মানুষ শ্রমিক। এই কৃষক আর শ্রমিক মিলে দেশের পঁচানব্বই শতাংশ মানুষ চাল-গম-তেল উৎপাদন থেকে শুরু করে সূঁচ থেকে উড়োজাহাজ সব তৈরি করছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একজন মানুষের জীবনে যা যা প্রয়োজন তার সব উৎপাদন করছে কৃষক আর শ্রমিক। কিন্তু দেশের এই কৃষক বা শ্রমিক কেউ কি নিজের জীবনে প্রয়োজনীয় যে মৌলিক চাহিদা রয়েছে তা ঠিকমতো পায়? ছেড়ে দিন দেশের কথা, আপনারা তো এখানে চাকাডোবা, বাঁশপাহাড়ির সব মানুষ রয়েছেন। আপনারা বলুন, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম যে প্রয়োজনগুলো রয়েছে, দু’বেলা ভাত, চিকিৎসা, ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা, বৃষ্টি হলে জল পড়বে না এমন একটা ঘর, একটু ঠিকঠাক জামাকাপড়, এর একটা জিনিসও আপনারা কেউ পান? আমার কথা বিশ্বাস করতে হবে না, নিজেরা নিজেদের প্রশ্ন করুন, যে তিন-চারটে জিনিসের কথা বললাম, তার একটাও আপনাদের একজনেরও জীবনে নিশ্চিত? সারা বছর দু’বেলা ভাত খেতে পান? বাড়ির কারও রোগ হলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেন? ছেলে-মেয়েকে পড়াতে পারেন?’ পরপর প্রশ্নগুলো করে চুপ করে যায় সুকান্ত। দেখে কেউ কোনও সাড়া দেয় কিনা। কিন্তু সুকান্তর প্রশ্নের কী জবাব দেবে মানুষগুলো! এই মৌলিক চাহিদাগুলো যে তাদের জীবনে পূরণ হয় না, কোনও দিন হয়নি এবং কোনও দিনই পূরণ হবে না, এটাকে তো তারা নিজেদের ভাগ্য বলেই ধরে নিয়েছে এতদিন। এগুলো যে তাদের অধিকার, তাই তো জানে না তারা। তারা কী উত্তর দেবে এই সব প্রশ্নের, ভেবে পায় না চাকাডোবার মাঠে জড়ো হওয়া একজন মানুষও। কোনও প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকলে স্কুলের বাচ্চারা যেমন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, সেভাবেই প্রাপ্তবয়স্ক মানুষগুলো এই বর্ষার সন্ধ্যায় চুপ মেরে বসে থাকল চাকাডোবার মাঠে। একটা পিন পড়লেও শব্দ শোনা যাবে এমনই নিস্তব্ধতা কাটাতে পারত যে, সেই সুকান্তও কোনও কথা না বলে তাকিয়ে থাকে মানুষগুলোর দিকে। এই পরিবেশ তার চেনা, প্রায় প্রতিটা মিটিংয়েই সে এভাবে প্রশ্ন করে, দেখে নেয় মানুষগুলো কীভাবে রিঅ্যাক্ট করছে। মানুষগুলোর প্রতিক্রিয়া দেখে সে বুঝে নেয়, তার কথা মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করছে কিনা। সে জানে তার বলা কথার ততক্ষণ কোনও দাম নেই, যতক্ষণ না মানুষ তা অভিজ্ঞতায় মিলিয়ে দেখছে। কারণ তার বলা কথার সঙ্গে এই গরিব মানুষের অভিজ্ঞতার মিলমিশ না হলে তা কিছুতেই কারও হৃদয়ে ঢুকবে না, এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যাবে। শুধু তার কেন, এই দুনিয়ার কারও কথারই কোনও দাম নেই, যতক্ষণ না মানুষ তা নিজের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারছে। তাই মানুষের রিঅ্যাকশনটা বোঝার চেষ্টা করে সে। মিনিট খানেক চুপ থেকে আবার বলতে শুরু করে।
‘আপনারা অনেকেই শুনেছেন, সরকার ঠিক করেছে বাঁশপাহাড়িতে একটা স্বাস্থ্য কেন্দ্র করবে,’ এবার সুকান্ত কথা শুনে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে কেউ কেউ। ‘সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কয়েকটা কথা বলতে আজ আমরা এসেছি এখানে। এই এলাকার মানুষ, চাকাডোবা, কাঁকড়াঝোড়, ভূলাভেদা, সিঁদুরিয়া আশাপাশের সমস্ত গ্রাম থেকে আপনারা এসেছেন। আপনারা জানেন, এই বিস্তীর্ণ এলাকায় মানুষের কথা, মানুষ কীভাবে বেঁচে আছে সেকথা, রোগ হলে মানুষ বাঁচে না মরে, সেকথা কোনও দিন সরকার ভাবেনি। আমরা অনেক দিন ধরে দাবি জানিয়েছি, চাকাডোবার মানুষের জন্য একটা স্বাস্থ্য কেন্দ্র দরকার। কিন্তু সরকার তাতে কান দেয়নি। যখন শেষ পর্যন্ত এই এলাকায় স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত হল, তখন সরকার কী ঠিক করল? সরকার ঠিক করল, স্বাস্থ্য কেন্দ্র হবে বাঁশপাহাড়িতে। আমরা কেউ বাঁশপাহাড়ির মানুষের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন, বাঁশপাহাড়ি থেকে সামান্য দূরে ঝিলিমিলিতে স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে। বিরাট কোনও বন্দোবস্ত না থাকলেও ঝিলিমিলি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কিছু চিকিৎসা তো হয়। বাঁশপাহাড়ির মানুষ সেখানে যেতে পারেন। কিন্তু চাকাডোবার মানুষ কি রাতেবেরাতে বিপদে পড়লে ঝিলিমিলি বা বেলপাহাড়ি যেতে পারে? পারে না। তাহলে কেন চাকাডোবাতে স্বাস্থ্য কেন্দ্র না করে তা বাঁশপাহাড়িতে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার? আসলে বাঁশপাহাড়ির মানুষের ভালোর জন্য নয়, সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিপিএমের কথায়। বাঁশপাহাড়িতে সিপিএমের পঞ্চায়েত, ওখানে সিপিএমের বড় নেতা অর্জুন পাল, সুধীর সিংহের বাড়ি। গত পঞ্চায়েত ভোটে চাকাডোবা, ভূলাভেদা এলাকায় সিপিএম হেরে গিয়েছে। তাই এই এলাকার গরিব মানুষের ওপর প্রতিশোধ নিতে সিপিএম ঠিক করেছে, চাকাডোবায় না করে বাঁশপাহাড়িতে স্বাস্থ্য কেন্দ্র হবে। আপনারা তো এখানে চাকাডোবার মানুষ আছেন, বাঁশপাহাড়ির মানুষও আছেন। আপনারা আমাকে বলুন, মানুষ কাকে ভোট দেবে তার ওপর ভিত্তি করবে সরকার ঠিক করবে কোথায় স্বাস্থ্য কেন্দ্র হওয়া উচিত? নাকি যেখানে স্বাস্থ্য কেন্দ্র হওয়া দরকার, যেখানে তা হলে বেশি মানুষের উপকার হবে, সেখানে হওয়া উচিত? আসলে সিপিএম আপনাদের উন্নতি চায় না, চায় না আপনারা ভালো থাকুন। সিপিএম চায় আপনাদের আনুগত্য। আপনারা প্রশ্ন করলে, ওদের ভোট না দিলে সরকারি পরিষেবা পাবেন না। আর ওদের সমর্থন করলে ওরা আপনাকে চালটা, মুলোটা পাইয়ে দেবে। এই হচ্ছে সিপিএমের রাজনীতি। আপনারা বলুন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত আপনারা সমর্থন করেন? আমরা আজ আপনাদের পাশে দাঁড়াতে বন-জঙ্গল পেরিয়ে, এরাস্তা ওরাস্তা দিয়ে লুকিয়ে, নাওয়া নেই, খাওয়া নেই গ্রামে গ্রামে ঘুরে আপনাদের দাবিদাওয়ার কথা বলছি। আমরা নিজেদের জন্য কিছু চাইতে আসিনি আপনাদের কাছে, শুধু বলতে এসেছি, আপনারা যদি সবাই চান এই স্বাস্থ্য কেন্দ্র চাকাডোবায় হোক, তবে কাল থেকেই আমরা আন্দোলন গড়ে তুলব। সরকারকে বাধ্য করব তারা যেন এই স্বাস্থ্য কেন্দ্র চাকাডোবায় বানায়। আপনারা বলুন, এই চাকাডোবা, কাঁকড়াঝোড়ের গ্রামের পর গ্রামের মানুষ কি দেশের নাগরিক নন? আপনাদের অধিকার নেই চিকিৎসার সুবিধা পাওয়ার? সিপিএমেকে ভোট দেননি বলে আপনারা সাধারণ চিকিৎসারও সুযোগ পাবেন না? কোন এলাকায় মানুষের কী দরকার তা না দেখে সিপিএম যেমনভাবে বলবে সেভাবে সরকার চলবে? এই যে ধরুন কুড়ি বছরের বেশি হয়ে গেল সিপিএম সরকার চালাচ্ছে। আমাকে একজনও বলতে পারবেন, এই কুড়ি বছরে আপনাদের জীবন কিছু পাল্টেছে? আপনাদের কাছে আজ এই প্রশ্নের জবাব চাইতে এসেছি আমরা।’
ফের কথা থামায় সুকান্ত, এদিক ওদিক ঘাড় ঘোরায়, তারপর তাকায় একজনের দিকে। সে বেছে নিতে চায় কোনও একজনকে। সুকান্ত জানে সমবেতভাবে মানুষের মধ্যে থেকে কোনও জবাবই আসবে না। তাই কাউকে বেছে নিতে হবে। সে জানে এখানকার সব মানুষেরই অভিজ্ঞতা এক, গরিব মানুষের নিয়ম করে বয়স বেড়ে চলা ছাড়া জীবনে আর কিছু পরিবর্তন হয় না। মাঝবয়সী লোকটা লোকটা হাঁটু মুড়ে বসেছিল, মন দিয়ে শুনছিল তার কথা। লোকটার দিকে তাকিয়ে একটু এগোয় সুকান্ত, তারপর গলা নামিয়ে সামান্য থেমে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার বাড়ি কোথায়? কী নাম আপনার? কী করেন?’ গোটা ঘটনায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় মানুষটা। প্রথমে সে বুঝতেই পারে না তাকে প্রশ্নগুলো করা হয়েছে। যখন বুঝতে পারে তখন দেখে অনেকগুলো চোখ তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাতে আরও ঘাবড়ে যায় সাধারণ মানুষটা। এদিক-ওদিক তাকায়, বুঝতে পারে না কী বলবে! তাছাড়া বলারই বা কী আছে তার, সে তো প্রায় কিছুই করে না। যখন যেমন কাজ পায় তখন তাই করে, কখনও অন্যের জমিতে চাষের কাজ, কখনও মুটের কাজ, কখনও খাদানে পাথর ভাঙা, কখনও আবার মাটির হাঁড়ি, কলসি বানানো। বাড়ির পাঁচটা মানুষের খাবার জোগাড় করতে কোন কাজটা করে না সে? লোকটা ভেবে পায় না কী জবাব দেবে। সুকান্তর বলা শেষ কথাগুলো তার মনে পড়ে যায়, সে ভাবার চেষ্টা করে গত কুড়ি বছরে কী পাল্টেছে তার জীবনে! ভেবে পায় না। সেই ছোট থেকে মাঠে-ঘাটে কাজ করছে দুটো পয়সা রোজগার করতে। বছরে দুটো মাস দু’বেলা ভাত হয় বাড়িতে, সারা জীবনে বছরের বাকি দশ মাস একবেলাই খেয়ে আছে সে। কিছুই তো বদলাল না, একটা জিনিস অবশ্য হয়েছে, বড় ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করেছে, সে নিজে কোনও দিন স্কুলে যায়নি। এটুকুই বদল, আর তো সব এক! বাড়িতে বউ অসুস্থ, জ্বরে পড়ে আছে তিন দিন। দু’দিন ধরে বাড়িতে তেমন কিছু খাবার নেই। মিটিংয়ে আসার সময় বড় ছেলে সিংরাইকে বলে এসেছে মাকে দেখতে, গা বেশি গরম হলে জল দিতে মাথায়। আর বলে এসেছে ছোট ভাই-বোন দুটোকে দেখে রাখতে, যেন পুকুর ধারে চলে না যায়। বেলপাহাড়ির ময়ূরঝর্ণা গ্রামের বিধ্বস্ত এক দিনমজুর সুবল মান্ডি ভাবতে থাকে কী জবাব দেবে সে এই লোকটার প্রশ্নের। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, একটা কথাও বলতে পারে না, তার দু’চোখ দিয়ে নেমে আসে জলের ধারা। কোমরে বাঁধা গামছা দিয়ে চোখ মোছে লোকটা, কিন্তু চোখের জল বাধ মানে না। সে বুঝতেও পারে না কত যন্ত্রণা জমা ছিল তার মনের ভেতরে।
‘কী হল কাকা, শরীর খারাপ লাগছে? দাদা কী জিজ্ঞেস করছে বল,’ লোকটার দিকে এগিয়ে আসে বাঁশপাহাড়ির সেই মেয়েটা, যে কয়েক মাস আগে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল বনপার্টির সঙ্গে, যার নাম জবা সর্দার। যার গলা শুনেই খটকা লেগেছিল বাঁশপাহাড়ির ব্যবসায়ী ধনঞ্জয় মাহাতোর। একটা নিরীহ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এতগুলো মানুষের সামনে পড়ে যে লোকটা কোনও কথা বলতে পারে না, দু’চোখ বেয়ে নেমে আসে কত বছরের জমে থাকা কান্না, সেই লোকটাকে দেখে হঠাৎই উনিশ বছরের জবার মনে পড়ে যায় নিজের বাবার কথা। বাঁশপাহাড়ির এক গ্রামে দরিদ্র আদিবাসী পরিবারে জন্ম জবার। আদিবাসীদের মধ্যেও আবার তারা সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা ভূমিজ। বাবা শ্রীমন্ত সর্দার, মা লক্ষ্মী সর্দার, তাদের বড় মেয়ে জবা। তার পরে আরও দুই বোন। কোনওভাবে চলে সংসার। বাবা আজ এক বছর অসুস্থ। কোনও দিন কাজে যেতে পারে, কোনও দিন পারে না। মা আর তিন মেয়ে সকাল সকাল জঙ্গলে চলে যায়। কেন্দু পাতার মরশুমে কেন্দু পাতা তুলে আনে, অন্য সময় কাঠ কুড়োয়। তা মাথায় করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিক্রি করে জ্বালানির কাঠ। এভাবেই একবেলা খেয়ে কোনও রকমে চলছে সংসার। কয়েক মাস আগের কথা, সন্ধেবেলা মুদি দোকান থেকে ছোট একটা শিশিতে এক টাকার তেল কিনে বাড়ি ফিরছিল জবা, হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে কোথা থেকে সামনে এসে হাজির হল অনন্তদা। পাশের গ্রামের অনন্তকে চিনতো গোটা বাঁশপাহাড়ির মানুষ। পুরো এলাকায় মাধ্যমিকে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছিল অনন্ত, ইতিহাসে পেয়েছিল নব্বইয়ের বেশি। শিলদা কলেজে ভর্তি হয়েছিল, বারো ক্লাসের পরীক্ষাতেও বাঁশপাহাড়ি তো বটেই, গোটা বেলপাহাড়িতেই সেরা ছাত্র অনন্ত। সেই অনন্ত একদিন চলে গেল বাড়ি ছেড়ে, কোথায় গেল প্রথমে জানা যায়নি। বোঝা গেল বাঁশপাহাড়ির মোড়ে রেশন দোকানের ঘটনাটায়। সেদিন শীতের বিকেল। মাহাতো ফেয়ার প্রাইজ শপের মালিক জগদ্বন্ধু মাহাতো বিকেলে দোকান বন্ধ করছে বাড়ি ফিরবে বলে। আচমকাই তার সামনে এসে হাজির হল তিনটে ছেলে। সবার গায়ে চাদর। তারা কারা, কোথা থেকে এসেছে, কী চায় বোঝার সময় পেল না জগদ্বন্ধু। একজন চাদরের তলা থেকে বের করল একটা রিভলভার, সোজা তাক করল তার মাথায়। ‘শুনুন, আপনি বয়স্ক মানুষ, আপনাকে শুধু একটা কথা বলতে এসেছি। রেশনের চাল, গম, তেল বাইরে বিক্রি বন্ধ করুন, সমস্ত মানুষকে যার যা প্রাপ্য জিনিস দিন। গরিব মানুষকে ঠকিয়ে রেশনের জিনিস আর বাইরে বিক্রি করবেন না। আজ সাবধান করে দিয়ে যাচ্ছি, ভবিষ্যতে যেন আর অনিয়ম হয়েছে না শুনি। তা হলে কিন্তু ফল ভালো হবে না।’ অন্ধকার নেমে আসছে এলাকায়, যেভাবে বেলপাহাড়িতে সন্ধে নামে কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই। সেভাবেই আচমকা ছেলেগুলোর আসা এবং কথা বলার মুহূর্তে মাহাতো ফেয়ার প্রাইজের মালিক, ষাট বছরের জগদ্বন্ধু মাহাতোর মনে হল তার পায়ে আর জোর নেই কোনও। সে বুঝতেও পারল না ক্রমশ বসে পড়ছে মাটিতে, তবে সেই অন্ধকার নামার মুহূর্তেও চিনতে পারল হাতে বন্দুক ধরে যে ছেলেটা কথাগুলো বলল, সে তার পাশের পাড়ার অনন্ত। কোনও দিন যে ছেলেটা মাথা তুলে কথা বলেনি কারও সঙ্গে, সেই ছেলেটার কথা শুনে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে বসে পড়ল জগদ্বন্ধু। বসে বসেই দেখল অনন্তর পাশে দাঁড়ানো অন্য একটা ছেলে চাদরের নীচ থেকে বের করল কয়েকটা কাগজ, প্যান্টের পকেট থেকে আঠা বের করে কাগজগুলো লাগিয়ে দিল দোকানের বন্ধ দরজার বাইরে। তারপর যেভাবে এসেছিল, ঠিক সেভাবেই দোকানের পিছনের মাঠে নেমে পড়ল ছেলেগুলো, তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল জগদ্বন্ধু। কাঁপুনিটা আবারও ফিরে এসেছে, জীবনে এই প্রথম জগদ্বন্ধুর মনে হল সে আর বাঁচবে না। আর ঠিক সেই সময় চাকাডোবার দিকে থেকে এসে বাঁশপাহাড়ির মোড়ে দাঁড়াল বেলপাহাড়ি-ঝিলিমিলি রুটের শেষ ট্রেকারটা। আবছা অন্ধকারে জগদ্বন্ধু দেখল দু’জন নামল ট্রেকার থেকে, তারপর পা চালিয়ে ধরল গ্রামের রাস্তা। ধুলো উড়িয়ে ঝিলিমিলির দিকে চলে গেল ট্রেকারটা। ওই দুটো লোক বা ট্রেকারের কেউ দেখল না, মৃত্যুভয় চোখে নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে মাটিতে বসে আছে বাঁশপাহাড়ি ফেয়ার প্রাইজ শপের মালিক, এলাকার নামকরা বড়লোক জগদ্বন্ধু মাহাতো! যার বাড়িতে এই আকালের দিনেও রাত দশটা পর্যন্ত আলো জ্বলে, যার বাড়ির বাচ্চাদের বছরে তিনবার নতুন জামা হয়, যার বাড়িতে রান্না করতে এক মাসেই লাগে প্রায় দশ লিটার সর্ষের তেল, যার বাড়ির বড় বউয়ের বাচ্চা হয়েছে ঝাড়গ্রামের নার্সিংহোমে। বড় বউ মানে ধনঞ্জয় মাহাতোর স্ত্রী, যে ধনঞ্জয় এখন চাকাডোবার মাঠে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জবার দিকে। আর হ্যাঁ, যার বাড়িতে লাইসেন্সওয়ালা বন্দুক আছে, সেই জগদ্বন্ধু মাহাতো বুঝতে পারছে না এই সামান্য পাঁচশো মিটার রাস্তা হেঁটে বাড়ি ফিরবে কীভাবে? পায়ে কোনও জোর নেই তার।
পরদিন সকালে নিয়মমাফিক ঘুম ভাঙল বাঁশপাহাড়ির, আর বেলা গড়ানোর আগেই সবাই জেনে গেল মাহাতো ফেয়ার প্রাইজ শপের দেওয়ালে লাল আলতা দিয়ে লেখা পোস্টার পড়েছে, ‘গরিব মানুষকে ঠকানোর শাস্তি মৃত্যু।’ মুখে মুখে রটে গেল, আগের দিন সন্ধ্যায় অনন্তর গ্রামে আসার কথা। সবাই বুঝে গেল মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে ভালো নম্বর পাওয়া, বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া ছেলেটার জন্য শুধরে গিয়েছে গ্রামের রেশন ব্যবস্থা!
ক্রমশ।.....
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।