ছবিঃ বামাবোধিনী পত্রিকা ১২৮৩ বঙ্গাব্দ, বৈশাখ
কেমন ছিল তাঁর কর্মজীবন? খুবই কম জানা যায়। বস্তুত আমার কিছুটা নেড়েচেরে মনে হয়েছে, মিসেস হুইলার হয়ত একটা নো ম্যান্স ল্যান্ডে বসবাস করতেন। ধর্মের কারণে তাঁকে হিন্দু সমাজ আপন করে নেয়নি। কৃষ্ণমোহন নিজের প্রতিভায় নিজেকে বাইরের জগতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তবে সাধারণ দেশী পাদ্রীরা কিন্তু সে আমলে বেশ ডিসক্রিমিনেশনের মুখোমুখি হতেন। অর্থ খুবই কম হওয়ায় বিক্ষুব্ধ হয়ে তাঁরা চিঠি চাপাটিও লিখতেন, এই চার্চ ছেড়ে অন্য চার্চেও চলে যেতেন। সেটা একটা দিক। কিন্তু তাঁদের বাড়ির মেয়েদের জীবনের খোঁজ কেউ রেখেছিল কি? কতটা আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগতেন তাঁরা? পরিণত বয়সের ধর্ম ত্যাগের আর সেই সঙ্গে জুড়ে যাওয়া চেনা পরিবেশ-সংস্কৃতি ত্যাগের বাধ্যতার ফল তাঁদের স্ত্রীদের জীবনে কিভাবে আসত? বা তাঁদের পুত্র-কন্যাদের জীবনে একজন পিতার সিদ্ধান্তের ঠিক কি প্রভাব পড়ত? জানা নেই, কারণ দেশি খ্রিস্টানদের স্ত্রীদের বা প্রথম প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের কোন গভীর বিশদ আত্মজীবনী আমি হাতে পাইনি।
যাই হোক মনোমোহিনীতে ফিরি। যেটুকু জানা যায়, মনোমোহিনী একদা নর্মাল স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। তাঁর চাকরি প্রাপ্তির খবর দিয়ে বামাবোধিনী জানায় যে ভালই হয়েছে উনি এই চাকরি পেয়েছেন। কারণ হিন্দু অন্তঃপুরিকারা যতই শিক্ষিত হোন, এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে কি করে কাজ করবেন? আবার শিক্ষা বিভাগের কর্তাদের সঙ্গেও বা যোগাযোগ রাখবেন কি করে? উল্টোদিকে ইউরোপিয়ান মহিলা দিয়ে কি আর দেশীয় মেয়েদের শিক্ষা পরিদর্শন সম্ভব? মনে রাখতে হবে পরিদর্শক তখনও ছাত্রদের শিক্ষার মানও পরীক্ষা করে দেখতেন। অবশ্য সেই সঙ্গে তাঁরা এও উপদেশ দিতে ছাড়েনি যে বিবি হুইলার যেন কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জী বা কেশব সেন বা বিদ্যাসাগর এঁদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে বালিকাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেন।
তখনও মেয়েদের একাকী চলাফেরা খুব প্রচলিত তো নয়। এমনকি সতীত্বের ধারণার সঙ্গে মেয়েদের চলাফেরার স্বাধীনতা মাপার হিসেব আজকের দিনেও আছে, কাজেই সেদিন যে আরও বেশি থাকবে এটা আর আশ্চর্য কি! সে সব কোনকিছুই কিন্তু মনোমোহিনীকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি বেশ এই জেলা ওই জেলায় ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। তাঁর ঢাকা, ময়মনসিংহ, বরিশাল আর ত্রিপুরাতে অফিসের কাজে পাক দেওয়ার সময় কিছু একটা জনগণের বিরূপতার মুখেও তাঁকে পড়তে হয়, যদিও তার কোন বিশদ বৃত্তান্ত জোগাড় করতে পারিনি। অবশ্য কাজ উপলক্ষে দুবার বিলেত ঘুরে আসতেও তাঁর আটকায় নি। সেখান থেকে ঘুরে ঘুরে ইউরোপিয়ান উপায়ে স্কুল পরিদর্শনের বিভিন্ন উপায় শিখে এসেছিলেন তিনি।
সেই সময়ে মেয়েদের পড়ানো দরকার এই বোধ কিছুটা তৈরি হয়েছে, বোধহয় বিয়ের বাজারে শিক্ষিত সুপ্রতিষ্ঠিত পরিবারে নাহলে মেয়েদের দাম মিলত না, অথচ ভদ্রবাড়ির মেয়েরা অনেকেই বাড়ির বাইরে আসতে পারতেন না। তাই মিশনারিরা লোকের বাড়িতে বাড়িতে মেয়েদের পড়ানোর জন্য লোক পাঠাতেন। একে বলা হত জেনানা স্কুল। হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই এই প্রথা চালু ছিল। মনোমোহিনী এই জেনানা স্কুলগুলির দায়িত্ব পেলেন। এই স্কুলগুলোর সব থেকে বড় সমস্যা হল এগুলোতে পড়ানোর কোন নির্দিষ্ট মান ছিল না। না শিক্ষকের কোন মানের স্থিরতা ছিল, না পাঠ্যপুস্তকের কোন স্থিরতা ছিল, সব কিছুই এলোমেলো অগোছালো ব্যবস্থা। আসলে জেনানা মিশনের তলে তলে আসল ইচ্ছে তো ছিল খ্রীস্টধর্মেরও প্রসার, কাজেই হয়ত সংযোগ স্থাপন যতটা গুরুত্ব পেত, শিক্ষা ততটা পেত না। আর বহুযুগের স্থিতাবস্থা কাটিয়ে সব মেয়েও নিশ্চয় সমান আগ্রহী হতেন না। সে যাই হোক, নতুন পরিদর্শিকা অনেক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে এখানে একটা সিস্টেমেটিক ব্যবস্থা চালু করেন। বোর্থউইক সোমপ্রকাশের সূত্র ধরে এও বলেছেন যে খুব ভাল বাংলা না জানায় নাকি ১৮৯৬ সালে মনোমোহিনী কিছু একটা বড় ভুল করেন, কিন্তু খবরটার মূল জোগাড় করতে পারিনি, তাই একটু খটকা আছে। কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জীর মেয়ে ভাল মতন বাংলা জানতেন না, এও কি সম্ভব ?
মনোমোহিনী সম্বন্ধে সরাসরি কিছু জানার উপায় আমি অন্তত এখনও পাইনি। তবে বিভিন্ন সূত্র ঘেঁটে যা জানতে পেরেছি সেগুলো জুড়লে মূলতঃ তিনটে ব্যাপার পাচ্ছি, ইনি খুব সম্ভবতঃ মিশনারিদের দেওয়া শিক্ষাকে বিশেষ সুবিধার বলে ভাবতেন না। বিদেশী নির্দেশিত শিক্ষায় দেশজ মূল্যবোধের ক্ষতি হয় এই গোছের কিছু বক্তব্য বোধহয় মনোমোহিনীর ছিল। এঁর বক্তব্য ব্যবহার করে একসময় বাঙালি নির্দেশিত জাতীয়তাবাদী শিক্ষার স্বপক্ষে সওয়াল করা হয়। আর দ্বিতীয়টা হল এই যে সেই সময়ের ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতার আদর্শের দ্বারা এঁর মগজ ধোলাই সম্পূর্ণ হয়েছিল। যে শিক্ষিকা ছাত্রীদের পাঠ দেবেন তাঁকে নিষ্কলুষ চরিত্রের হতে হবে, তাঁর পোশাক থেকে শুরু যাবতীয় আচরণ সমাজ কড়া নজরে দেখতে থাকবে যাতে কোথাও বিচ্যুতি দেখলেই ঘাপ করে লাফিয়ে পড়তে পারে - এই যে একটা সামাজিক ধারা এখনও এদেশে কিছুটা হলেও বিদ্যমান, এই রকম আদর্শে বোধহয় এঁরও বিশ্বাস ছিল। নিজে ইউরোপীয় পোশাক পড়লেও বাঙালি মেয়েদের শাড়ি-সেমিজ, পোশাকের শালীনতা ইত্যাদি নিয়ে মনোমহিনীর খুব সম্ভবত প্রভূত বক্তব্য ছিল। আর সেই কড়া মনোভাব তাঁর কাজের আদর্শের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। সেই বিষয়ে এমনকি প্রকাশ্য আদালতে সাক্ষীও দিয়েছেন তিনি। আর তৃতীয় বক্তব্যটা ছিল যে ইনি মেয়েদের বাঁধাধরা পরীক্ষা দেওয়ার দিকে ঠেলে দেওয়ায় বিশ্বাসী ছিলেন না। এঁর ধারণা ছিল এতে মেয়েরা নাকি উদ্ধত হয়ে যায়, এমনকি হিস্টেরিকও হয়ে যায়। বংশে পড়াশোনার ধারা না থাকলে নাকি বড্ড মাথায় চাপ পড়ে। মোদ্দা কথা পরীক্ষা দিয়ে টিয়ে মেয়েদের বিশেষ কিছু উপকার হয় না। এই ধারণা সেই সময়ে প্রভূত শক্তিশালী ছিল। বলা যায় যে তিনি সেই শক্তিশালী ধারণারই বাহক ছিলেন। হয়ত নিজের একটাও পাস না দেওয়া জীবনের স্থিতি আসতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি বলে এমন একটা ব্যক্তিগত ধারণা ছিল। কিন্তু তিনি বোঝেন নি, কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জীর কন্যা হওয়ার বংশকৌলীন্য ও যোগাযোগের দৌড় তাঁকে যে সুবিধা দিয়েছিল, সেই সুবিধা কিন্তু দেশের সব মেয়ে পাবে না।
এইসব শুনলে একটাই কথা ভেবে সান্ত্বনা পেতে হয় যে আসলে প্রতিটা মানুষই তো সময়-পরিবেশ-পরিস্থিতির ফসল। আর নতুন যুগের চোখের বিচারে সবারই সীমাবদ্ধতার পাল্লাটা অনেকটা বেশি নেমে যায়। তাই সেদিকে কম কম তাকানোই ভাল। তার থেকে বরঞ্চ ফোকাস করা যাক এঁর অবদানটুকুর দিকে। মনে রাখা যাক, ১৮৭৯ সালে কলকাতায় একটি চিত্রকলা প্রদর্শনী হলে সেখানে ভদ্রমহিলাদের আকৃষ্ট করার জন্য তাঁদের জন্য সপ্তাহে একটি নির্দিষ্ট দিনের বিশেষ সময় নির্ধারণ করা হয়। আর সেখানে মনোমোহিনী উপস্থিত থাকতেন যাতে কেউ ক্যাটালগ থেকে বুঝতে না পারলে তাঁকে তিনি বুঝিয়ে দিতে পারেন। মেয়েদের অন্দরের বাইরে আনার জন্য এই ধরণের প্রচেষ্টার দরকার ছিল বইকি আর তাতে সক্রিয় সাহায্য করে মনোমোহিনী নাহয় আমাদের শ্রদ্ধাই পান খানিকটা।
আজকের দিনে বসে সেদিনের পরিস্থিতির কথা কল্পনা করাও হয়ত কঠিন। সত্যি বলতে নাবালক সন্তানসহ বিধবা মহিলার পরিস্থিতি সে সময়ে খোদ ইংরেজ পরিবারেও খুব সুবিধার ছিল না। কাজেই ধর্ম ও বিবাহ ও কর্ম পরিচিতি সব দিক দিয়েই প্রান্তিক একজন বঙ্গসন্তানকে কতটা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল ভাবলেও অবাক হতে হয়। তবে এঁরা ছিলেন বলেই আমরা আজ যেখানে সেখানে আসতে পেরেছি। সেই কৃতজ্ঞতাটুকু মনোমোহিনী হুইলার (nee Banerjea) কে জানিয়ে রাখি এই সুযোগে।
ছবিঃ বিলিংটনের উইমেন ইন ইন্ডিয়া বই থেকে সংগৃহীত
তথ্যসূত্র ঃ
১) মেরিডিথ বোর্থউইক, দ্য চেঞ্জিং রোল অফ উইমেন
২) জ্ঞানেন্দ্র নাথ কুমার, বংশ পরিচয় একাদশ খন্ড
৩) মেরি ফ্রান্সেস বিলিংটন, উইমেন ইন ইন্ডিয়া