সেই কবে কোন কলকাতা শহরের পথে পুরোনো নতুন মুখ ঘরে ইমারতে। সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর কিছু মনে রাখা কথা। যা আজকে বড্ড বেশি প্রাসঙ্গিক।
স্কটিশ চার্চ ইস্কুলে পড়ার সময়ে খুব ভালো ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও এক জল্লাদ মাস্টারমশাইয়ের কাছে যে নির্দয় প্রহারের শিকার হয়েছিলাম, সে কথা এই জীবনসায়াহ্নেও ভুলতে পারিনি। এই নিষ্ঠুরতা আমাদের দেশে ও সমাজে মজ্জাগত। এগুলোকে আবার জাস্টিফাই করারও অনেক লোক আছে।
"এই মার খেয়েছিলাম বলেই আজ মানুষ হতে পেরেছি", এসব কথাও শোনা যায়।
অথচ, এই নিষ্ঠুর প্রহারে যে ট্রমার জন্ম হয় বালক বা কিশোর বয়েসে, তার প্রভাব মনের ভেতরে সারা জীবন থেকে যায়। "কেউ ভোলেনা, কেউ ভোলে।"
বেশির ভাগই বয়ে বয়ে বেড়ায়। যেমন আমি।
ৱ্যাগিংও তাই। যৌন লাঞ্ছনাও তাই। আমার প্রথম স্মৃতিকথা "ঘটিকাহিনি"তে এসব কথা বিশদ লিখেছি।
আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তাতে আমার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারতো সেই ক্লাস এইটে।
বিশদ বর্ণনা এখানে দিলামনা। চাইলে বইটা পড়ে নিতে পারেন। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আমাকে ফোন করে দেখা করতে বলেছিলেন। গিয়েছিলাম।
বললেন, "পার্থ, কী সাংঘাতিক! যেসব কথা তুমি লিখেছো, তা কি সত্যি? সত্যিই কি কলকাতায় এসব ঘটনা ঘটে?"
বললাম, "বুদ্ধদা, একটা কথাও বানিয়ে লিখিনি।"
বানিয়ে কখনো লিখিনা।
যৌন বিকৃতির শিকার কীভাবে সেই বয়সে আমরা হয়েছি, সেসব কথাও একশো ভাগ সৎভাবে লিখে রেখেছি। বিশেষ করে স্কটিশ স্কুল নিয়ে অনেক কথা লিখেছি। আমাদের বয়ঃসন্ধিতে যৌনশিক্ষার সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি, এবং যৌন বিকৃতি। বাথরুমের দেওয়ালে বিকৃত রুচির প্রকাশ। টীচারদের স্নেহ ভালোবাসা, আবার জল্লাদদের বেধড়ক মার।
সমরেশ, সুনীল, শীর্ষেন্দু, শংকর তাঁদের লেখায় এই বাস্তবতা নেই। তাই মানুষ বোঝেনা ব্যাপারগুলো আসলে কতটা ভয়ঙ্কর।
আজকে ৱ্যাগিং'এর শিকার হয়ে যাদবপুরে একটা বাচ্চা ছেলে মরে গেলো। তাই নিয়ে একদিকে রাজনীতি চলছে, আর একদিকে মিডিয়ার কুৎসিত মুনাফাবাজি ও বেআইনি ভাবে যার তার নামে তালিবানি প্রচার চলছে। সবকিছু দুদিন পরেই ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। মিডিয়া তখন নতুন একটা ইস্যুতে আবার মুনাফাবাজি করবে।
কিন্তু সমাজের অনেক গভীরে লুকিয়ে রাখা এই বিষয়গুলো নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা কখনো হবেনা। কত মেয়ে ভয়ে লজ্জায় সারাটা জীবন কাটাচ্ছে, কত বধূ বিকৃতকাম পড়শী বা শ্বশুর ভাসুরের লালসার শিকার হচ্ছে, কত অল্পবয়েসী ছেলেকে দৈহিক অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে, লোকসভা, রাজ্যসভা অথবা বিধানসভাতে তার আলোচনা কোনোদিন হবেনা।
মিডিয়া চাইবে ঘটনা ঘটুক। কারণ তাতে তাদের লাভ। ঘটনা যাতে না ঘটে তা তারা চাইবেনা।
ঠিক যেমন ওষুধ বা হেলথ কেয়ার, হাসপাতাল, নার্সিং হোম কোম্পানিগুলো চাইবে রোগ বেড়ে যাক, এবং তাহলেই তাদের ওষুধ বিক্রি বেশি, হাসপাতালে ভর্তি বেশি। সুস্থ জীবনযাত্রা করে অসুখ থেকে দূরে থাকা তারা পছন্দ করবেনা, কারণ তাহলে তাদের কোনো বিক্রি বা মুনাফা নেই।