বড়দিনের পর শীত বাড়তে লাগলো। আমরা কোন রকমে গুটিশুটি মেরে, যতরকম কাপড়ের টুকরো আছে গায়ে চাপিয়ে রাত কাটানোর চেষ্টা করতাম। একটি হরিজন ছেলে আসতো ফাটকের পায়খানা পরিস্কার করতে, পরনে তার মোটা কাপড়ের হাত কাটা জামা আর হাফ প্যান্ট। শীতের এক সকালে সে দেখি কাজ করতে করতে ঠকঠক করে কাঁপছে। দেখে আমাদের এত খারাপ লাগলো, কল্পনা ওয়ার্ড্রেসকে বলেই, ওর একটা শাল দিয়ে দিল। কল্পনার দুটো শাল ছিল। যেই না ও কাজ শেষ করে পুরুষ বিভাগে ফিরবে, ওমনি ওয়ার্ড্রেস দৌড়ে ওয়ার্ডারকে বললো - ও নিশ্চয় আমাদের চিঠি বাইরে পাচার করছে - ভালো করে তল্লাশি করতে হবে। তল্লাশি হল - কিছু পাওয়া গেল না। কিন্তু অহেতুক সহমর্মিতা ব্যাপারটায় ওয়ার্ড্রেসের সন্দেহ হল, আর তার থেকে বেশি হল ঈর্ষা। সেটা অযৌক্তিকও কিছু না - ও হয়তো এত ভালো বা দামী শাল কখনে দেখেইনি জীবনে। পুরো ব্যাপারটাই একটা আবাঞ্ছিত পরিস্থিতি তৈরি করলো - ছেলেটির পায়ে বেড়ি পরা সলিটারি হয়ে গেল, আর হুকুম হলো ও আর কোনদিন জেনানা ফাটকে কাজে আসবে না। আমরা চিফ হেড ওয়ার্ডারের কাছে অনেক দরবার করলাম, কিন্তু কোন লাভ হলো না - 'নকশাল' কয়েদীপের সঙ্গে কারও মেলামেশা করার হুকুম নেই।
এর কিছুদিন পর, জেল সুপার জানালো বিহার সরকার অমলেন্দুর পরিবারকে আমার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দিয়েছে। মনে হচ্ছিল সরকার যেন আমাদের বিয়েটা "অনেকটা" মেনে নিয়েছে। অমলেন্দুর বাবা আসবে ফেব্রুয়ারি মাসে দেখা করতে।
অমলেন্দু আমাকে একটা চিঠি লিখেছিল। পাঠানোর সময় একজন ওয়ার্ডার সেটা ধরে ফেলে জেলারের কাছে রিপোর্ট করে দেয়। তার ফলে আমাদের দুজনেরই বাড়ির লোকের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি বাতিল হয়ে গেল, আর অমলেন্দুর ডান্ডাবেড়ির সাজা হলো। ডান্ডাবেড়িতে অমলেন্দুর কথা ভেবে আমার চোখের জল বাঁধ মানলো না।
ডান্ডা বেড়িতে হাতে পায়ে কড়া পরিয়ে দেওয়া হয়। কড়াগুলো একটা করে কুড়ি ইঞ্চি শিকের দু'মাথায়। সেই শিক গুলো পা থেকে কোমর পর্যন্ত লম্বা আরেকটা শিকের সঙ্গে আটকানো - আর সেই শিকটা বাঁধা কোমরে। এই ভারী ডান্ডাবেড়ি নিয়ে কোনরকম চলাফেরা, বসা, ঘুমনো, বাথরুম এক অমানুষিক কষ্ট।
মাঝে মধ্যে যতই খুচরো ছাড় থাকুক, এই ঘটনায় বুঝলাম আমাদের তখনও সরকার খুব সন্দেহজনক বা বিপজ্জনক বলেই মনে করছে।
জেল জীবনের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল উপোস। উপোস ব্যাপারটা যেন প্রায় একটা প্রতিষ্ঠানের মত। প্রতি রোব্বার কয়েদীদের উপোস করার অনুমতি ছিল। তাতে তারা বরাদ্দ খাবারের বদলে বিড়ি, খৈনি বা অন্য কোন মুখরোচক খাবার দাবার পেতে পারে। ব্যবস্থাটাকে আপাতদৃষ্টিতে মানবিক মনে হলেও, কয়েদীদের বশে রাখার জন্য এটা ছিল কর্তৃপক্ষের একটা খুব সুচিন্তিত কার্যকরী পদ্ধতি। ছোট ছোট সুযোগ দিয়ে কয়েদীদের সারাক্ষন এইসব হারানোর ভয়ের জালে বন্দী করে রাখা - তাতে, কয়েদীরা অন্য কোন কিছুতেই ভুলেও সাড়া শব্দ করবে না। জেলের মজুতখানার সঙ্গে যুক্ত সবার কাছে উপোস ছিল একটা আর্থিক লাভের উপায়। কয়েদীরা উপোস করে যেসব জিনিস নিত, তাতে খাবারের আর ঐ জিনিসের বাজারদামের বিরাট তফাত। মেয়েরা এই হিসেবটা খুব ভালৈ বুঝতো, কিন্তু মুখ খুলতো না, পাছে ব্যবস্থাটা পুরোই বন্ধ হয়ে যায়। উপোস করে পাওয়া সামান্য দুচার টাকা দিয়ে দিয়ে ওরা দরকার মত ওষুধ, কাচের চুড়ি, মরশুমি ফল, সব্জি আনাতো। সারা সপ্তাহ মেয়েরা একটু একটু করে চাল ডাল জমিয়ে রাখতো - যেন রোব্বার জেলের খাবার না নিতে হয়। সেদিন সকাল থেকে দেখা যেত মেয়েরা ভাত বা লপ্সিতে দেওয়ার জন্যে সব্জী ক্ষেতে ঘোরাঘুরি করছে। আসল সব্জী সব মেটিনের ভোগে যেত, তবে ক্ষেতের কিছু আলু, মুলো, সর্ষে শাক কয়েদীরা পেত। রান্না করার ব্যবস্থা ছিল খুবই সীমিত, তাই রোব্বার মেয়েদের খুব সমস্যা। উনুন ছিল দুটো - একটা আমাদের, আর একটা মেটিনের। মেটিন তার পেয়ারের লোকেদের উনুন ব্যবহার করতে দিত, তার নিজের পঞ্চব্যঞ্জন রান্না হওয়ার পর। সব মেয়েদেরই খুব ক্ষিদে পেয়ে যেত - কেউ কেউ কোন রকমে মাটির উনুন বানিয়ে দাঁতনের নিমডাল দিয়ে কিছু বানাতো। এছাড়া আমাদের তেলের টিনে মাটি লেপে বানানো ছোট কয়লার উনুনে ভিড় লেগে থাকতো সারাদিন, তাতে আমাদের কাউকে না কাউকে ক্ষিদে চেপে আগের জন্যের রান্না শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা তো করতেই হতো।
রোব্বারের আরেকটা বড় ঘটনা ছিল মুলাকাতি। যেসব মেয়েদের জেলেই কোন পুরুষ আত্মীয় আছে, রবিবার করে তারা জেল অফিসে গিয়ে, সহকারী জেলারের নজরদারিতে কয়েক মিনিট সেই আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে পারতো। আমি খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম দেখে যে প্রচুর মেয়েদের বাবা, ভাই, স্বামী, ছেলে - কেউ না কেউ ঐ একই জেলে, একই অপরাধের অভিযোগে আটক। অনেকেই তাদের পুরুষ আত্মীয়দের জন্যে টুকটাক কিছু রান্না করে রাখতো। হয়তো রাতে একটু চাল বা ছোলা ভিজিয়ে রাখলো - সকালে সেটা পাথরে বেটে, বেলে, বাঁচিয়ে রাখা সর্ষের তেলে ভেজে নিয়ে গেল।
বেলা তিনটে নাগাদ, সকালে কাচা শাড়ি পরে, চুল আঁচড়ে, পরিষ্কার কাপড় অথবা খবরের কাগজে খাবার মুড়ে মুলাকাতির জন্য তৈরি হত। কোন কোন দিন পাঁচটার একটু আগেই ঘন্টা বাজিয়ে গেট খুলে দিত ডিউটি ওয়ার্ডার। নুড়ি বিছানো পথ দিয়ে সবাই ঐ অতি যত্নে তৈরি খাবার নিয়ে যেত - যেন কোন অর্ঘ্য নিয়ে যাচ্ছে। ডিউটি ওয়ার্ডার খাতায় নাম মিলিয়ে মিলিয়ে সবাইকে বের করতো। পনেরো মিনিট বাদেই সব হইহই করে ফিরতো - নতুন নতুন গল্প নিয়ে। নক্শাল ছাড়া অন্য বন্দীদের জেলের ভেতর নানান কাজে ঘোরাঘুরি করার সুযোগ ছিল - তারা নানান খবর টবরও পেত। কোন কয়েদীর আদালতের তারিখ, কোন বড় লোকের ভিজিট, জেল কর্মচারীদের বদলি, কারো জামিন, কারো ছাড়া পাওয়া - এইসব নানান খবর। কল্পনা আর আমি মুলাকাতি থেকে ফেরা মেয়েদের জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম - যদি কোন খবর পাওয়া যায়!
শুরুর দিকে আমি একটু অসুবিধেয় পড়তাম - এখানে সবাই একজন আরেকজনকে কীভাবে সম্বোধন করে তা নিয়ে। আস্তে আস্তে বুঝলাম বড়দের মা, মাসি এইরকম ডাকতে হয় - ভারতীয় সংস্কৃতিতে বড়দের নাম ধরে ডাকাটা সহবত নয়। আমাকে সবাই হয় বেটি না হয় দিদি ডাকতো। একজন আমাকে দিদিমা বলে ডাকছিল - ওর বয়স আমার মা'র কাছাকাছি হবে! অন্যরা বকাঝকা করায় বললো, আমার বয়্স নিশ্চয় অনেক বেশি, কারন আমার তো সব চুলই সাদা।
এটা অবশ্য প্রথমবার না, আমার সোনালী চুলের জন্য পুলিশ, ওয়ার্ডার, অনেকেই আমাকে সাতাশ বছরের থেকে অনেক বেশি বয়সী বলে ভেবেছে নানা সময়!
ওখানে একজন ছিল, আমরা সবাই মা ডাকতাম, ওর নাম সাইবুন্নিসা। বছর পঁয়তাল্লিশের মুসলিম মহিলা। সাইবুন্নিসা, ওর বর, তিন ছেলে, এক ভাইপো - সবার কুড়ি বছরের জেল হয়েছে। জমি নিয়ে মারপিটে ওর দেওর খুন হয়েছিল। ওদের সাজা হওয়ার সময় ওর তেরো বছরের ছেলে পাঁচবছর জেলে কাটিয়ে নিয়েছে। সবচে বড়জনকে যখন আমরা প্রথম দেখি তখন ওর বয়স উনিশ। ওর আরো তিনজন ছোট ছোট মেয়ে - তারা জেলের বাইরে। জেলে আসার সময় ওদের বয়স তিন, চার আর ছ’বছর। সাইবুন্নিসা মা মাঝে মাঝেই কাঁদতো। কী করে এই মেয়েগুলি নিষ্ঠুর গ্রাম্য সমাজে বাঁচবে - গ্রামের মানুষ হয়তো ওদের বিনা মাইনের চাকরের মত খাটাবে, অথবা বিক্রি করে দেবে - ক্রীতদাস বা বেশ্যা হওয়ার জন্য।
সাইবুন্নিসার মায়ের স্নেহের লক্ষ্য ছিলাম আমরা। নিজের ছেলে মেয়েদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার যন্ত্রনায় ও আমাদের বিপদটা খুব ভালো বুঝতো।
সাইবুন্নিসার মা আমাদের জন্যে চালের পিঠে ভাজতো - একটু একটু করে চাটুর ওপর জলের ছিটে দিয়ে - আমি আর কল্পনা গরম গরম খেতাম যখন, ওর মুখে তৃপ্তি ঝরে পড়তো। বেশিরভাগ কয়েদীই খুব অবাক হতো ওদের রান্না খাওয়া নিয়ে আমাদের কোন আপত্তি নেই দেখে - ওদের অভিজ্ঞতায় অন্যত্র ওরা অস্পৃশ্য, অপবিত্র, নোংরা - এইসব বলে পরিচিত। যখন ওরা আবিষ্কার করলো ওদের রান্না আমাদের সত্যিই দারুন পছন্দ, সবাই আমাদের জন্য নানান রকম জিনিস বানাতে শুরু করে দিল - ওদের নিজেদের ভাগের খাবার দিয়ে!
মানুষ হৃদয় উজাড় করে নিজের অতি সামান্য সম্বল থেকে ভালোবেসে কী করে অন্যকে বিলিয়ে দিতে পারে - তা দেখে আমি যে কী অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম তা বোঝানো কঠিন।
আমাদের আরেকজন বন্ধু হয়েছিল রোহিনী। অল্পবয়সী, কৃষক মেয়ে; খুনের অভিযোগে বন্দী। অসম্ভব পরিশ্রমী - বাগানের মাটি কুপিয়ে, ওয়ার্ড্রেসের কাপড় কেচে, মেটিনের হুকুম খেটেও ওর ক্লান্তি নেই। ও খালি আমাদের কাজ করে দিতে চাইতো - কাপড় কাচা, বাসন মাজা, সেল পরিষ্কার, হাত পা মালিশ করে দেওয়া! এই মেয়েরা কখনো কোন স্কুল কলেজে পড়াশুনো করা মানুষকে নিজের কাজ নিজে করতে দেখেনি, তাই চেনাশুনো হয়ে যাওয়ার পর আমাদের কয়লা ভাঙতে, বা বাসন মাজতে বা সেল ঝাড়ু দিতে দেখে ওরা খুব অস্বস্তিতে পড়ে যেত। আমরা বুঝিয়ে বললাম যে পড়াশুনো শিখেছি বলে নিজের কাজ নিজে করতে হবে না, এমন কোন নিয়ম কোথাও নেই। আস্তে আস্তে এই জিনিসটা পরিস্কার হয়ে যাওয়ার পর আমাদের সবার সঙ্গেই খুব সুন্দর চেনাশুনো হয়ে গেল।
রোহিনী বলেছিল ওর অনেকদিনের লুকনো ইচ্ছে লেখাপড়া শেখার। কল্পনা দুপুরের কাজকর্ম শেষ করে রোহিনীকে হিন্দি অক্ষর পরিচয় শুরু করলো।
কিন্তু এতে এমন একটা হিতে বিপরীত হলো যেটা আমরা কল্পনা করতে পারিনি।