আমাদের বিয়ে হবার আগে দিশা যখন করুণাকর রকমের অল্প বেতনে একটা ক্ষয়িষ্ণু স্কুলে শিক্ষকতা করতেন তখন তিনি মন খারাপ হলে বা কোনো কারণে রাগ করলে ঢাকার ইস্টার্ন প্লাজা নামের মার্কেটে স্বর্ণের গহনা বানাতে যেতেন। ‘স্বর্ণের গহনা’ কথাটিতে যে ভারভারিক্কি আছে দিশার ঐসব গহনা অমন নয়। হয়তো একটা লকেট, অথবা আংটি, অথবা টিকলি – এমনসব হালকা-পাতলা ধরনের সস্তার জিনিস। তখন স্বর্ণের ভরি ৬,৬০০ টাকা (৫৬৬ টাকা/গ্রাম), এক হাজার টাকায় দু’আনা ওজনের একটা লকেট হয়ে যেতো। দিশার গহনাগুলো ঠিক একবারে বানানো হতো না। প্রথমে আইটেম, ডিজাইন, ওজন ইত্যাদি ঠিক করে খুব অল্প কিছু টাকা আগাম দেয়া হতো। তারপর হাতে যখন যেমন টাকা জমত সেটা ঐ অর্ডারের হিসাবে জমা দেয়া চলতো। কয়েক মাস পরে সর্বশেষ বাজার দর অনুযায়ী পুরো মূল্য পরিশোধ হলে গহনাটি নিয়ে আসা হতো। এভাবে কোনো গহনার পুরো মূল্য পরিশোধ হতে দেড়-দুই বছরও লেগে গেছে। ঠিক কাছাকাছি প্রক্রিয়ায় দিশা ঢাকার নিউ মার্কেটের একটা ভালো বইয়ের দোকান থেকে দামী বইগুলো কিনতেন – দোকানটি এখন আর নেই। আমাদের বিয়ের পরে প্রথম প্রথম আমাদের দু’জনের মধ্যে ঝগড়া হলেই দিশা গহনার দোকানে চলে যেতেন। সেসব গহনার মূল্য আমাকে কখনো পরিশোধ করতে হয়নি। এই গহনাগুলোর সিংহভাগ দিশা নানা উপলক্ষে বিভিন্ন জনকে উপহার দিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশের অনেকে উপহার হিসেবে স্বর্ণ পেতে ভালোবাসেন – তা যত টিঙটিঙে হোক।
গহনার জন্য দিশা সাধারণত ইস্টার্ন প্লাজার ‘অনিন্দ্যা’ বা ‘রূপবতী’ বা ‘নিউ স্বর্ণালী’-এর মত অপেক্ষাকৃত ছোটো, দরিদ্র দোকানগুলোতে যেতেন, এবং একইসাথে একাধিক দোকানে কোনো না কোনো অর্ডার চালাতেন। ‘আফ্রোদিতি’, ‘সামিন’, ‘স্বজন’, বা ‘প্লাটিনাম ওয়ার্ল্ড’-এর মত বড়, ধনী দোকানগুলো যারা কেউ দোকানে ঢুকলে তাঁর অ্যাপিয়ারেন্স দেখে তাঁর সামর্থ্য মেপে ঠিক করেন কতটুকু কম বা বেশি দুর্ব্যবহার করবেন, সেসব দোকানে দিশা যেতেন না। একদিন একটা বিশেষ উপলক্ষে একটু ভালো মানের গহনা একটা গহনা প্রয়োজন ছিল, তাই আমি আর দিশা অমন একটা ধনী দোকানে গিয়েছিলাম। আমাদের দু’জনের চেহারা সুরত দেখে দোকানের বিক্রয়কর্মীরা ভাবলেন, যেহেতু এরা কিছু কিনবে না তাই এদের সাথে যা খুশি আচরণ করা যায়। যেহেতু আমাদের ‘ঠ্যাকা’ ছিল তাই আমরা চরম অপমান সহ্য করে প্রয়োজনীয় বাছাবাছি করে গহনাটি কিনলাম। আমরা যখন মূল্য পরিশোধ করছিলাম তখন বিক্রয়কর্মীরা মোটামুটি বিস্মিত হয়ে গেলেন। একজন বিক্রয়কর্মী হতবিহ্বল অবস্থা কাটিয়ে নিতান্ত অনিচ্ছায় বললেন, ঠান্ডা কিছু আনাই? আমি ঠান্ডা স্বরে বললাম, না, আমরা বরং যাই, আমাদের একটু তাড়া আছে।
গহনার যে দোকান থেকে জীবনে একবারও স্বর্ণের গহনা কিনেছি তার প্রত্যেকটি থেকে মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের শুরু পর্যন্ত ‘হালখাতা’র নিমন্ত্রণলিপি আসতো। বাংলাদেশে স্বর্ণের দোকানের অ্যাকাউন্টিং সিস্টেম অত্যন্ত নিখুঁত এবং ডাটাবেস অত্যন্ত শক্তিশালী। এক দোকান ভেঙে একাধিক দোকান হলে তার প্রতিটি অংশীদারের কাছ থেকে হালখাতার নিমন্ত্রণলিপি আসতো। যেমন, ‘স্বর্ণালী’ ভেঙে যখন ‘নিউ স্বর্ণালী’ গঠিত হল তখন দুটো থেকেই নিমন্ত্রণলিপি আসতো। আবার এক দোকানের কোনো দক্ষ কর্মী অন্য দোকানে যোগ দেবার সময় যদি আগের দোকানের ডাটাবেস নিয়ে আসতে পারতেন তাহলে নতুন দোকানের পক্ষ থেকে ঐ ডাটাবেসে নাম-ঠিকানা থাকা সবাই হালখাতার নিমন্ত্রণলিপি পেতেন। এভাবে একেবারে অপরিচিত কিছু দোকান থেকে কয়েক বার হালখাতার নিমন্ত্রণলিপি পেয়েছি।
নববর্ষের দিনে সম্ভব হলে দিশা ‘অনিন্দ্যা’ বা ‘রূপবতী’ বা ‘নিউ স্বর্ণালী’-এর হিসেবের খাতায় থাকা বাকি বকেয়া সমুদয় মিটিয়ে দিতেন। বকেয়া মেটানো হোক বা না হোক আমাদেরকে আসতে দেখলে এই দোকানের মালিক-বিক্রয়কর্মীরা খুশি হতেন। তাঁরা আমাদেরকে যথাসাধ্য আপ্যায়ন করতেন। দুই-তিন বার কী করে যেন হালখাতার দিনেই আমাদের কেনাকাটা করার প্রয়োজন হয়েছিল। ঐ কয়েকবার তাঁরা বিপুল আনন্দিত হয়েছিলেন। অবশ্য বকেয়া মেটানোর বা কেনাকাটার ব্যাপার না থাকলে আমরা পারতপক্ষে হালখাতার দিনে এসব দোকানে যেতাম না। সেক্ষেত্রে কিছু দিন পরে দোকানে গেলে, হালখাতাতে কেন আসিনি সেই প্রশ্ন তাঁরা করতেন। তাঁদের এই আন্তরিকতা আমাদের ভালো লাগতো।
২০০৪ সালে ঢাকার পান্থপথে বসুন্ধরা সিটি নামের বিশাল শপিং কমপ্লেক্সটি চালু হবার আগে পর্যন্ত হাতিরপুলের ইস্টার্ন প্লাজা মার্কেটটি বেশ জমজমাট ছিল। গোড়াতে বসুন্ধরা ঠিক জমে উঠতে পারেনি। একবার একটি ছোট অগ্নিকাণ্ড আর ২০০৯ সালে একটি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা মার্কেটটির জমে ওঠাকে কিছুটা বাধাগ্রস্থ করে। অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে যেহেতু কোনো ইন্ডাস্ট্রিতে বৃহৎ বিনিয়োগের ঘটনা ঘটতে শুরু করলে কুলুঙ্গি বাজার (niche market) ছাড়া বাকি বাজারের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক বিনিয়োগগুলোকে সাধারণত লোকসান গুনে গুটিয়ে ফেলতে হয় তাই বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স বা যমুনা ফিউচার পার্কের মত বিশাল বিনিয়োগগুলোর সামনে ইস্টার্ন প্লাজা বা মিরপুর রোডের ধানমণ্ডি অংশের মার্কেটগুলোর মত অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র বিনিয়োগগুলো মার খেতে থাকে। এই মার্কেটগুলো ক্রমে তাদের জৌলুস এবং ক্রেতাগোষ্ঠী হারাতে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় ইস্টার্ন প্লাজার অপেক্ষাকৃত দরিদ্র স্বর্ণের দোকানগুলো তাদের অনেক বছরের পুরনো ক্রেতাদের হারাতে থাকে। দিনের পর দিন যায় এসব দোকানের কোনো কোনোটিতে সারা দিনে এত নগণ্য পরিমাণে বিক্রয় হতে থাকে যে তাদের পরিচালনা ব্যয় সঙ্কুলান করা পর্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে।
যেহেতু অন্য সব কেনাকাটার জন্য দিশাকে বসুন্ধরা যেতে হতো তাই কেবল স্বর্ণের জন্য তিনি ইস্টার্ন প্লাজায় যাওয়া প্রায় বন্ধ করে দেন। বসুন্ধরার অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক দোকান ‘স্বর্ণবীথি’র সাথে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। অবশ্য এর মধ্যে আরেকটি ঘটনা ঘটে। স্বর্ণের মূল্য নিয়মিতভাবে বাড়তে বাড়তে এতোটাই বেড়ে যায় যে সেটা আর আমাদের নাগালের মধ্যে থাকে না। ফলে আমার সাথে দিশার যত বড়ো ঝগড়াই হোক না কেন তাঁর পক্ষে আর গহনার দোকানে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। দীর্ঘ দিনের অদর্শনের কারণে হোক, অথবা ব্যবসায়ের মন্দার কারণে হোক স্বর্ণের দোকানগুলো থেকে হালখাতার নিমন্ত্রণ আসার সংখ্যা এক সময় কমতে থাকে। ২০২০-এর করোনা অতিমারীর আগে পর্যন্ত বায়তুল মোকাররমের জুয়েলারী মার্কেট আর বসুন্ধরা সিটির দোকানগুলো থেকে অল্প কিছু নিমন্ত্রণলিপি এসেছে, ইস্টার্ন প্লাজা থেকে প্রায় কিছুই আসেনি। ইস্টার্ন প্লাজা থেকে নিমন্ত্রণলিপি না আসলেও হালখাতার আগে তাঁদের কারো সাথে দেখা হয়ে গেলে মুখে মুখে নিমন্ত্রণ জানাতেন। আমরা অবশ্য লজ্জায় আর সেসব নিমন্ত্রণে যাইনি। আমাদের প্রথম লজ্জা – আমরা আর স্বর্ণের গহনা কিনতে পারছিলাম না। আমাদের দ্বিতীয় লজ্জা – বিক্রিবাটা কমে যাওয়ায় দোকানগুলোর হতশ্রী দশা হওয়ায় পুরোনো ক্রেতাদের সামনে দোকানের মালিক-বিক্রয়কর্মীগণ একটু বিব্রত হতেন। কয়েক বছর আগে এক হালখাতার দিন শেষ সন্ধ্যায় ‘রূপবতী’তে গিয়ে দেখি তাঁদের আয়োজনের সিকিভাগও ফুরোয়নি। অর্থাৎ, নিমন্ত্রিত অতিথিদের বেশির ভাগ জন আসেননি। আমাদেরকে আপ্যায়ন করার পরে তাঁরা খুব জোরাজুরি করছিলেন আমরা যেন আমাদের বাসার লোকজনদের জন্য খাবার নিয়ে যাই। বিষয়টি উভয়পক্ষের জন্যই বিব্রতকর।
এখনো চৈত্র মাস আসলে আমি আর দিশা স্বর্ণের দোকান থেকে হালখাতার নিমন্ত্রণ নিয়ে কথা বলি, স্মৃতিচারণ করি, নিজেদের সামর্থ্য কমে যাওয়া নিয়ে যতটা মন খারাপ হয়, ইস্টার্ন প্লাজার পুরোনো দোকানগুলোর কথা ভেবে তারচেয়ে ঢের বেশি মন খারাপ হয়। যে প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করেছিলাম সেটা দিয়ে শেষ করি। কর্মজীবনের শুরুর ঐ ক্ষয়িষ্ণু স্কুলে সদ্য স্নাতক দিশার বেতন তখনকার বাজারমূল্য অনুযায়ী যত গ্রাম স্বর্ণের দামের সমান ছিলো, তার প্রায় দুই যুগ পরে একাধিক বিষয়ে স্নাতকোত্তর করা, নানা রকমের পেশাদার ট্রেনিং করা, এবং দীর্ঘ কর্মাভিজ্ঞতা সম্পন্ন দিশা যে বর্ধিষ্ণু স্কুলটিতে শিক্ষকতা করেন সেখানে তাঁর বেতন ঠিক ঐ তত গ্রাম স্বর্ণের দামের সমান। স্বর্ণের দাম কি অস্বাভাবিক রকমে বেড়ে গেছে নাকি দেশে শিক্ষকতার বেতন অস্বাভাবিক রকমে কমে গেছে বুঝতে পারছি না। এখানে দিশার মত শিক্ষকদের লজ্জা পাওয়া উচিত নাকি অন্য কারো লজ্জা পাওয়া উচিত কিনা সেটাও বুঝতে পারছি না।
রাষ্ট্রীয় এবং নানা প্রকারের বাণিজ্যিক উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশে এখন বাংলা নববর্ষ বিশাল এক উৎসবে পরিণত হয়েছে। সেটা নিয়ে আমাদের দু’জনের মধ্যে আনন্দ যেমন আছে তেমন হালখাতা উদযাপনের কথা ভেবে তেমন সামান্য হলেও লজ্জাও আছে।
এসব ব্যক্তিগত বিষয় থাক, সবাইকে ১৪৩০ নববর্ষের শুভেচ্ছা। অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।