২৮ তারিখ ঘুম ভাঙল সূর্যোদয়ের আগেই। চাতলাং ট্যুরিস্ট লজের দোতলা আর তিনতলার প্রায় সবকটা ঘর সংলগ্ন ব্যালকনিই পুবমুখো। গোটা আইজল শহরই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে, ফলে চোখ সামনে বাধা পায় না। সক্কাল সক্কাল সূর্যোদয় দেখার জন্য আদর্শ। সারাজীবনে এত অজস্রবার অজস্র পরিস্থিতিতে দেখেও সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত আমার কাছে কখনো পুরানো হয় না। ঘর লাগোয়া বারান্দা ও বাইরের কমন বারান্দা থেকে ঘুরেফিরে সূর্যকিরণের ছোঁয়ায় আইজল শহরের জেগে ওঠা দেখি। পাশের ঘরের মানুষজনও জেগে উঠেছেন। জিজ্ঞাসা করে জানি কাল রাতে ওঁরা স্রেফ এই রাস্তা ধরে বড়রাস্তায় গিয়ে খানিক এদিক ওদিক ঘুরে রাস্তার ধারের এক দোকান থেকে রাতের খাবার খেয়ে ফিরেছেন। ওঁদের গাড়ি বুক করা, এয়ারপোর্ট থেকেই নিয়েছেন। সে গাড়ির সারথি মোটামুটি খাবার জায়গাগুলো চেনেন। দারুণ স্বাদের পর্ককারি আর ল্যাম্বচপ খাইয়েছেন।
সকালের আলোয় জেগে উঠছে আইজল ন’টা নাগাদ তৈরী হয়ে রিসেপশানে এসে দেখি আজ একজন মধ্যবয়সী মহিলা বসে আছেন। তাঁকেই বললাম ভাল ইংরিজি জানা সারথিওলা ট্যাক্সি ডেকে দিতে। তা মিনিট পাঁচেকের ভেতরই এলেন ‘এডি’ ট্যাক্সি নিয়ে। পরিস্কার ইংরিজি, বলা বা বোঝায় সমস্যা নেই কোনও।এডি খুবই গপ্পে মানুষ। দ্রষ্টব্য বিষয়ে আমার একটা লিস্ট বানানো ছিল, সেইটে হাতে নিয়ে ঠিক হল প্রথমেই যাবো ডারলাং ভিউ পয়েন্ট। যেতে যেতেই এডি বলেন ডারলাংএর চেয়েও ভাল একটা পয়েন্ট আছে, সেখানেই আগে যাই আমরা। আমি বলি সে নাহয় গেলাম কিন্তু স্টেট মিউজিয়ামে দশটা বড়জোর এগারোটার মধ্যে পৌঁছাতে চাইছিলাম, ওখানে সময় লাগবে আমার। এডি খুব চিন্তিত মুখে বলেন আজ খোলা থাকার সম্ভাবনা আছে বলেই মনে হয়, আজ থেকেই অনেক সরকারি অফিস খুলছে তো, তবে পাহাড় পর্বতে ঠিক দুপুরে গেলে তেমন ভাল লাগবে না। তা অবশ্য ঠিক, আজ ভাল রোদ্দুর উঠেছে দুপুরে গেলে ছবি সুবিধের হবে না।
এডির ট্যাক্সি,ফোন নম্বর আশকথা পাশকথা বকবক করতে করতে প্রথম গেলাম সকঅরমুইতোয়াই শিখর (Sakawrhmuituai Peak। কি কঠিন নাম রে বাবা! শিখরের নীচে চওড়া ঘাসজমির একপাশে একটা ছোট ক্যাফে, এখনো খোলে নি,টেবল পেতে জিনিষপত্র বের করে লাগাচ্ছে মা আর মেয়ে। এদিকে আজ সকাল থেকে আমার নাক দিয়ে জল গড়াচ্ছে অকাতরে, একটু গরম কফি বা স্যুপ পেলে হয়। মিনিট দশেক লাগবে সবকিছু সাজিয়ে বানাতে। একপাশে পাহাড়ের গা বেয়ে পাকদন্ডী উঠে গেছে শিখরের দিকে। এডি বলেন এইটে হল মিজোরামের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। ভ্যাট যা খুশী একটা বলে দিলেই হল! ফংপুই, যেটা ব্লু মাউন্টেন নামেই বেশী পরিচিত, সেটাই মিজোরামের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। এডি একটু দমে গিয়ে বলেন হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আমার মনে ছিল না, এইটে হল আইজলের সর্বোচ্চ। আমি মনে মনে হাসি – আরেকটু চাপ দিলে হয়ত আইজল ছেড়ে এই পাহাড়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মানতেই রাজী হয়ে যাবেন।
Sakawrhmuituai Peak
ইতোমধ্যে আরো খানদুয়েক গাড়ি এসেছে। সে দুই গাড়ি থেকে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা নেমে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে পাকদন্ডী বরাবর চড়তে শুরু করেছে। ছোট্ট ক্যাফের মালকিন এক কাপ কফি আর একবাটি চিকেন ন্যুডল স্যুপ টেবলে দিয়ে ডাকেন আমাকে। এডির জন্য হাক্কা ন্যুডলস। আমি অবাক হয়ে বলি কফি আর স্যুপ দুটো কেন? একসাথে খাব কী করে? মহিলার কন্যেটি একগাল হেসে বলে তুমি তো স্যুপের কথা বলছিলে তোমার ড্রাইভারকে, আমি শুনলাম যে, তাই মাম্মাকে বানাতে বললাম। বোঝো কান্ড! আমি বলেছিলাম কফি বা স্যুপ যেটা তাড়াতাড়ি হয় দিতে বলো, এ দুটোই বানিয়ে এনেছে! এডি গদগদ হয়ে বলে দেখেছ এখানকার লোক কেমন অতিথিদের যত্ন করে! আর কোথাও পাবে এমন? তা বটে, আমি আর কথা বাড়াই না। সর্দিজ্বলা গলায় ঢকঢক করে দুটোই খাই একের পর এক। তা সত্যি বলবো, দিব্বি লাগল কিন্তু। গলাটাও বেশ আরাম পেল।
Eddie এই ক্যাফের মেনুটা একটা হোয়াইট বোর্ডে হাতে লেখা, চা কফি, স্যুপ ন্যুডলস ইত্যাদির সাথে আছে ফ্রায়েড রাইস আর মাংসের কিছু পদও। ফ্রায়েডরাইস তিনরকম, চিকেন, পর্ক আর UISA. উইসা হল ডগমিট, কুকুরের মাংস। বলছিলাম না এডি খুবই গপ্পে মানুষ, তা আসার পথেই আমি জানিয়েছিলাম সোচিয়ার (Sochiar) খেতে চাই। মিজোরাম আসছি শুনে স্বাতী বলে দিয়েছিল এটা খেতে। পর্ক গ্রেভিতে খিচুড়ি বানিয়ে তার উপরে ভাজা শুঁটকি ছড়িয়ে পরিবেশন করে। তা এডি খুবই চিন্তিত হয়ে বলেছিলেন খ্রীস্টমাসের পরের দিন, ২৬ তারিখ লাঞ্চে বিভিন্ন চার্চ থেকে এইটে খাওয়ায় জনগণকে। আজ তো ২৮, পাবার সম্ভাবনা প্রায় নেইই। জিগ্যেস করলাম কোনও রেস্টুর্যান্টে পাওয়া যাবে না? তা ২৯ তারিখ অবধি নাকি প্রায় সমস্ত মিজো রেস্টুর্যান্ট বন্ধ, বিশেষত যারা মিজো ঐতিহ্যবাহী রান্না করে তারা তো বটেই। সেই সূত্রেই এডি জানিয়েছিলেন পর্কের চেয়ে ডগমিটের স্বাদ বেশী।
আমি অবশ্য শুনে একটুও খুশী হই নি, কুকুরদের আমি খুবই ভালবাসি। এডি আগে প্রচুর শুয়োর খেতেন কিন্তু কুকুরের স্বাদ পাবার পর আর খুব একটা খান না। ছেড়েই দিয়েছেন বলা যায়। এখানে মেনুতে উইসা দেখে এডি আবার উৎসাহিত হয়ে উঠলেন আমাকে খাওয়ানোর জন্য। কড়া করে বারণ করতেই হল। কিন্তু তখন এবং পরেও উনি বারেবারেই বলতে লাগলেন যাদের পর্ক ভাল লাগে তাদের উইসাও খুবই ভাল লাগবে এ তিনি নিশ্চয় জানেন। সে সর্বভুক বুনু গেলে খেয়ে এসে রিপোর্ট দেবে নাহয়। যাই হোক খেয়েদেয়ে পরের গন্তব্য মিজোরাম স্টেট মিউজিয়াম। পাহাড় থেকে নেমে এসে গাড়ি চলেছে এঁকেবেঁকে শহরের মধ্যে দিয়ে। এর মধ্যে একটা রাস্তা যার দুইপাশে অধিকাংশই বসতবাড়ি। দেখি প্রায় প্রত্যেক বাড়ি থেকে মানুষজন বেরিয়ে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন দুই তিন রঙের গার্হস্থ্য আবর্জনার থলি নিয়ে। সরকারি গাড়ি আসছে রাস্তার ওইপ্রান্ত থেকে এক এক করে সংগ্রহ করতে করতে।
এখানে রাস্তায় কেউ একটা কুচো কাগজও ফেলে না। বাড়িই হোক কি দোকান রাস্তায় নোংরা ফেলা, নিজের অংশটুকু ঝাঁটিয়ে পাশে নোংরা ডাঁই করে রাখা এসব এখানে কেউই করে না। জিগ্যেস করলাম কেউ যদি নিতান্ত করেই তাহলে কী হয়? জরিমানা? শাস্তি? এডি অবাক হয়ে বললেন কেন করবে? করলে তো নিজেদের রাস্তা, শহরই নোংরা হবে। আমার চাপাচাপিতে বললেন নিয়ম হয়ত আছে উনি জানেন না, তবে এরকম কেউ করেই ফেললে আশেপাশের লোক ঠিকই তুলে নিয়ে থলিতে ভরে সরকারি গাড়িতে দিয়ে দেবে। শুনলাম অনেক এলাকায় নাকি এলাকাবাসীই রাস্তা ঝাঁট দিয়ে গরমের দিনে জল ঢেলে ধুয়ে পরিস্কার রাখেন। গুগলে দেখাচ্ছে দুদিন ছুটি থাকার পর আজ থেকে স্টেট মিউজিয়াম খোলা থাকবে। এডি যদিও বলছেন আজও সম্ভবত বন্ধই থাকবে, তবু সেই আইএলপি করানোর অভিজ্ঞতা মনে করে বললাম ওখানে গিয়েই দেখব।
সেখানে পৌঁছিয়ে দেখা গেল মিউজিয়াম বন্ধ। সে বন্ধ শুধু আজ বা এই সপ্তাহ নয়, ক্রীস্টমাস উপলক্ষেও নয়। মিউজিয়ামের সংস্কার হচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে, চলবে আরো প্রায় মাসখানেক। এডি ভেতরে গিয়ে জেনে এলেন ২৬শে জানুয়ারির আগে কাজ শেষ করার জোরদার চেষ্টা চলছে, আশা করা যায় ওইসময় নাগাদ আবার দর্শকদের জন্য খুলে দেওয়া হবে। অগত্যা! কি আর করা! হাইকিং স্টিক আনতে ভুলেছি কাজেই রেইক যাবো না ঠিক ছিল আগে থেকেই।তবে রেইক শিখর থেকে তোলা ছবি যা দেখেছি মিস করা উচিত নয় আসলে। আইজল থেকে দূরত্ব ২৯ কিলোমিটারের মত। রেইক শিখর মোটামুটি ১৫০০ মিটারের মত উঁচু। কিছু অংশ বেশ খাড়া কাজেই হাঁটুতে সমস্যা থাকলে বুঝেশুনে ওঠা ভাল। ওঠানামা এবং শিখরে খানিক সময় কাটানো মিলিয়ে ঘন্টা চার সাড়ে চার মত লাগে। যাক পরেরবার এলে অবশ্যই যাব। আইজল জেলায় তামদিল, রংদিল ইত্যাদি কয়েকটা সুন্দর সুন্দর লেকও আছে।
মিজো ভাষায় দিল বা ডিল অর্থ হ্রদ। আইজল শহর থেকে তামদিলের দূরত্ব ৮৫ কিলোমিটার, রঙদিল কমবেশী ১২২ কিলোমিটারের মত। প্রতিটায় গিয়ে ফিরতে আস্ত এক একটা দিন লাগবে। ট্যুরিস্ট লজ থেকে জেনেছিলাম রংদিলের দিকে রাস্তা চওড়া হচ্ছে ফলে দিনের দিন ফেরা প্রায় অসম্ভব। ঠিক আছে এও তোলা থাক পরেরবারের জন্য। যা বুঝছি আরেকবার খ্রীস্টমাস বাদ দিয়ে অন্য সময় আসতেই হবে। কথায় কথায় গিয়ে পৌঁছালাম চানমারি প্রেসবিটারিয়ান চার্চে। বাইরে থেকে দেখতে চমৎকার তবে ঢোকা গেল না, এমনকি চত্বরেও ঢোকা গেল না। বন্ধ আছে খুলবে আবার বিকেল সাড়ে চারটেয়। চার্চের বাইরেও রাস্তায় কাজ হচ্ছে এবড়ো খেবড়ো মাটি পাথরে ভরা। ২০১৪ সালে স্বর্ণজয়ন্তী পালন করেছে কাজেই প্রায় নতুন চার্চই বলা চলে। আইজল শহরে খুব পুরানো শতাব্দীপ্রাচীন কোন বাড়ি বা চার্চ আমি দেখতে পাই নি। প্রায় নতুন শহরই বলা চলে। এইবারে যাওয়া যাক ডারলাং ভিউ পয়েন্ট।
চানমারি প্রেসবিটারিয়ান চার্চ
ওব্বাবা সেখানেও পৌঁছে দেখি উন্নয়নের মহাযজ্ঞ চলছে। দর্শকদের ঢোকার পথ আটকানো এক মস্ত রোডরোলার দিয়ে। তবে পাশের ঢাল বেয়ে সিমেন্ট পাথর বালি ইত্যাদি নিয়ে লরি গিয়ে গিয়ে প্রায় মসৃণ রাস্তা করে ফেলেছে। এডি ভেতরে গিয়ে একজন পুলিশ আরেকজন প্রাইভেট সিকিউরিটি গার্ডকে ধরে আনেন। মিজোভাষায় বুঝিয়ে বলেন আমি উৎসবমুখর আইজল দেখতে এসেছি, প্রায় সবকিছুই বন্ধ বলে কিছুই দেখে উঠতে পারছি না। এমতাবস্থায় ওই পাশের ঢাল বেয়ে উঠে যদি উপর থেকে আইজলের অপরূপ শোভা দেখতে পাই তাহলে বড়ই খুশী হব। তা তাঁরা মানুষ ভাল, দিব্বি একগাল হেসে ইয়েস ইয়েস গো গো করে অনুমতি দিয়ে দিলেন। তো ওঠা গেল উপরে। ভিউ পয়েন্টে একটা দোতলা বাড়ি তৈরী হচ্ছে, শুনলাম সেটা সরকারি ট্যুরিস্ট লজ হবে দোতলার ঘরগুলি পুরো কাচের জানলা দেওয়া ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ। আহাহা পরেরবার এসে এখানে এক রাত্তির কাটাতেই হবে।
গুগল ম্যাপ অনুসরণ করে যে জায়গায় পৌঁছানো গেল সেখানে নিতান্ত ছোটখাট কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের দোকান আছে বটে তবে এরকম কোন হস্তশিল্প কেন্দ্র টেন্দ্র নেই। একে তাকে জিগ্যেস করেও খুব একটা সুবিধে হল না। কেউই প্রায় কিছু বলতে পারে না। বিস্তর সামনে বেঁকে ডাইনে মোচড় মেরে বাঁয়ের দিকে ঘুরে এক খোলা মাঠের পাশে পৌঁছে এক ট্যাক্সিওলার কাছে কিছুটা হদিশ পাওয়া গেল। লক ডাউনের আগে তিনি বিভিন্ন লোক নিয়ে গেছেন সেখানে। কিন্তু সে নির্দেশমত গিয়ে আবারো সব ভোঁ ভাঁ। কিস্যু নেই। আবারও আরেক ট্যাক্সিচালক সহায় হলেন, বললেন অমুক বাড়ি ও চত্বরে ছিলো বটে কিন্তু লক ডাউনের শুরুতেই সেই যে বন্ধ হয়ে গেল আর তো খোলে নি। এখন বোর্ডটাও নেই। এডি তাঁর দুই সরকারি চাকুরে বন্ধুকে ফোন করেও কিছু সুরাহা করতে পারলেন না। তাঁরা আবার নামই শোনেন নি। তা সে কেন্দ্র নেই যখন আর কি করা যাবে, আমার আর পাতায় তৈরী মস্তবড় মিজোহ্যাট কেনা হল না। ট্যুরিস্ট লজে ফেরত যাই।
সোচিয়েরও পাওয়া গেল না, এডি যে কটা রেস্ট্যুর্যান্টে নিয়ে গেলেন সবই হয় বন্ধ নয়ত ডিনার পাওয়া যাবে, আপাতত কিছু মিলবে না। এদিকে ট্যুরিস্ট লজ থেকে যে ম্যাপ আর গাইড নিয়েছিলাম সে সব কাল ফিরে ব্যাগ থেকে বের করে রাত্রে বসে দেখছিলাম, সকালে আর ব্যাগে ভরতে মনে নেই। ওতে কিছু রেস্ট্যুরেন্ট ছিল। অন্তত ফোন করে দেখা যেত। এবারের পুরো যাত্রাপথই বিবিধ ভুলে ভর্তি। এরপরে আর বিশেষ কিছু নেই, ট্যুরিস্ট লজে ফেরার আধঘন্টার মধ্যেই পাওয়ার অফ হয়ে গেল। সে গেল তো গেলই, রাত দশটার আগে এলো না। কোথায় যেন কি একটা ফেল করেছে সেসব সারাতে সারাতে রাত দশটা। তবে ব্যাক আপ ছিল, ঘরে একটা লাইট একটা পাখা আর বাথরুমে একটা লাইট জ্বলছিল। বাথরুমের আলো অবশ্য প্রথমে জ্বলছিল না। রিসেপশানে ফোন করে এমার্জেন্সি লাইট জাতীয় কিছু একটা দিতে অনুরোধ করাতে ওঁরা অবাক হয়ে বললেন একটা লাইট তো জ্বলার কথা। যাইহোক সে দশ মিনিটের মধ্যেই একজন এসে ব্যাক আপ লাইনের বাল্ব বদলে দিয়ে গেলেন।
পাশের ঘরের বাসিন্দারা ফেরত আসার পরে খানিক গল্প সল্প হল। ওঁরা আজ মূলত বাজার ঘুরেছেন আর সলোমনস টেম্পল। ওঁদের একজনের মেয়ে পুণেতে চাকরি নিয়ে গেছে সম্প্রতি। তিনি আমার থেকে জেনে নিলেন কোথায় কোথায় মাছ টাছ পাওয়া যায়। ফোন নাম্বারও নিলেন, আমাকেও দিলেন। তা সেসব এখনও অবধি আর ব্যবহার হয় নি, যেমন হয় আর কি। পরেরদিন ওঁদের ফ্লাইট দুপুর আর বিকেলে। আমার সকাল এগারোটায়, এডিকেই বলে দিয়েছি আটটা নাগাদ চলে আসতে। ২৯ সকালে বিমানবন্দর পৌঁছে গিয়েছিলাম পৌনে নটা নাগাদ। আইজল শহর থেকে লেং পুই বিমানবন্দরে যাবার রাস্তাটা ভারী সুন্দর। প্রমদারঞ্জন রায়ের ‘বনের খবর’এ যে লুসাই পাহাড়ের কথা আছে এ সেই লুসাই পাহাড়, চিরহরিৎ বৃক্ষের অরণ্যে ঢাকা সবুজে সবুজ পর্বতশ্রেণি উঠে গেছে ঢেউয়ের মত। তারই মধ্যে এক জায়পগায় রেল লাইনের কাজ চলছে পাহাড় ফাটিয়ে গাছপালা উপড়ে ফেলে দিয়ে সুড়ঙ্গ কেটে।
এডি বলেন সামনের বছর মিজোরামে ভোট আছে। তার আগে যদি শেষ নাও হয় ২৪ এর ভোটের আগে অবশ্যই হবে। তারপরে খানিকটা আক্ষেপের সুরে বলেন ভারতের মূল ভূখন্ডের সাথে রেলপথে যোগাযোগ হয়ে গেলে বাইরের সেটলার আসা অনেক বেড়ে যাবে, এখানকার শান্তি নষ্ট হয়ে যাবে। মূল ভূখন্ডের বাসিন্দা আমি এর উত্তরে কিছু বলে উঠতে পারি না। শান্তশিষ্ট নির্ঝঞ্ঝাট পুণেকে চোখের সামনে বদলে যেতে দেখেছি আমি। শুধু বলি আমি আবারও আসবো, তামদিল রঙদিল চাম্ফাই সব যাবো। এডি বলেন ওঁকে এক সপ্তাহ আগে ফোন করতে তাহলে উনি ফাঁকা রাখবেন।আজ ভাড়া নিলেন ১০০০/- টাকা, কাল নিয়েছিলেন ৩২০০/-টাকা। এখানে ট্যাক্সি বেশ দামী। এদিকে বিমানবন্দরে পৌঁছে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হল চল্লিশ মিনিট। লেং পুই খোলে সকাল সাড়ে নটায়। ততক্ষণ সবাই দরজার বাইরে দাঁড়ানো।
দরজা খুললে প্রথমে ইন্ডিগো আর এয়ার ইন্ডিয়ার কর্মীদের ঢুকিয়ে তারপর যাত্রীসাধারণকে ছাড়েন সুরক্ষাকর্মী। খুবই ছোট্ট বিমানবন্দর। এখানে হাতব্যাগের সিকিউরিটি চেক বেশ সহজ। মোটেই ক্যামেরা ট্যামেরা বের করতে হয় না, শুধু পার্সটা একবার খুলে দেখাতে হয়। আলতো উঁকি দিয়েই ‘হ্যাপী জার্নি’ বলে ছেড়ে দেন সুন্দরী তরুণী। ভেতরে একটা শাল মাফলার ব্যাগের দোকান একটা গয়নাগাঁটি, টুকটাক হস্তশিল্পসামগ্রীর দোকান আর একটা খাবার দোকান। সবকটিতেই বিক্রেতা মেয়েরা। বাজার দোকানেও অধিকাংশ বিক্রেতাই মহিলা। গেঁট দিয়ে বেরিয়ে প্লেনে ওঠার ব্যপারটা বেশ মজার। ছোট্ট হোটেলের পোর্টিকোর মত ছাউনি দেওয়া অংশে লাইন করে দাঁড়িয়ে টুকটুক করে হেঁটে গিয়ে উঠে পড়তে হয়। রানওয়ের চারিদিকও সবুজ পাহাড়ে ঘেরা, ছোট্ট মিষ্টিমত বিমানবন্দর লেং পুই।
শেষকথা
আইজল যাবার জন্য সড়কপথ নয় আকাশপথই শ্রেষ্ঠ। সস্তা এবং সময় সাশ্রয়ী। হাফলং থেকে আইজল যাওয়ার প্ল্যান করাটা আমার একেবারেই ঠিক হয় নি। মিজোরাম বেড়াতে গেলে খ্রীস্টমাসের সময় না যাওয়াই ভাল কারণ এই চার পাঁচদিন প্রায় গোটা রাজ্যই ছুটি কাটায়। যদিও আইজল শহরের আলোকসজ্জা বা উৎসবের আবহ সত্যিই চমৎকার। মিজোরাম যথেষ্ট বড় রাজ্য। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গার দূরত্বও যথেষ্ট আর রাস্তার অবস্থাও সর্বত্র ভাল নয়। অনেক জায়গায় রাস্তা চওড়া করা হচ্ছে। ফলে হাতে অন্তত এক সপ্তাহ নিয়ে না এলে বিশেষ কিছু দেখা হবে না। প্রকৃতি ঢেলে সাজিয়েছে মিজোরামকে, তাকে দেখার জন্য সময় নিয়ে আসতে হবে।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।