এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন

    Anamitra Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৭ অক্টোবর ২০২২ | ১২৩০ বার পঠিত
  • চেনা মানুষ মরে গেলে আমাদের একটা অংশ তার সঙ্গে মরে যায়। একসাথে কাটানো যে সমস্ত দিনরাত, সেসব স্মৃতির উপর যে রঙের আলো, তা অন্য কাউকে বুঝিয়ে উঠতে পারা যায় না কিছুতেই। অন্যদের সাথে সেসব গল্প আমরা ভাগ করে নিই, কিন্তু সে তো শুধু গল্পটুকুই; আলোচ্য ঘটনার দিন হাওয়া কতটা শুষ্ক ছিল কতটা ভিজে, সেই হাওয়ায় অনেক ছোটবেলায় হারিয়ে ফেলা কোনও বিকেলের বিস্মৃত গন্ধ ছিল কিনা, এইসব বলে ওঠা যায় না। তাই মনে হয় কথা শেষ হচ্ছে না কিছুতেই! কত কী যেন বলার মতো আটকা পড়ে থাকছে ভিতরেই। কিন্তু গল্প না ফুরোলেও সময় ফুরিয়ে আসে। সামনের মানুষটি বলে ওঠে, "এবার আসি!" 

    - "হ্যাঁ, এসো আবার।" 
    হাসিমুখে তাকে বলে ফেলার সময়ই আমরা বুঝতে পারি যেন একটা জলাজমি চাপা পড়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরে। তার উপরে হু হু করে বহুতল উঠে যাবে শীঘ্রই। এতগুলো বছরের বর্ষার কচুপাতায় জমে থাকা জল, নেউলের দৌড়, ইঁদুরের ডাক; --- এসবের আর কোনও সাক্ষী থাকবে না। জীবিতের শোক যে মৃত বহন করে না সে তো আমরা বহুকাল আগেই জেনেছি! জীবিতের ভেতরে মরে যাওয়া এই ছোট্ট অংশটিকেও জীবিত একাই বহন করে চলে আজীবন। এইভাবেই আমাদের বুকের ওপরের পাথরটার ওজন বাড়তে থাকে ক্রমশ। তারপর একদিন সেই পাথরের ভারে আমাদের হৃদপিন্ড 

    স্তব্ধ

    হয়ে

    যায়।  

    এই লেখাটার প্রথম কিস্তি লেখার সময় বেবিদা-র কথা মনে পড়ছিল খুব। খালি মনে হচ্ছিল ওকে তো এই লেখাটা পড়ানো হবে না। প্রদীপদাকে (চৌধুরী) যেমন ওর জন্যে লেখা অবিচ্যুয়ারিটা আমি পড়াতে চেয়েছিলাম। বলতে চেয়েছিলাম, "দেখো, ফারলিংঘেত্তির সেই লাইনটা আমি  কিরকম অবলীলায় ব্যবহার করে দিয়েছি এখানে! আমার কিন্তু মনে ছিল সেই চিঠিটার কথা। হয়তো গত দেড় বছর আড্ডা হয়নি আমাদের, কিন্তু হলে আবার সেখান থেকেই শুরু হতে পারতো। হয়তো চোখটা কিছুটা ঠিক হয়ে যেত ততদিনে তোমার।" ঠিক এরকমই; কোনও এক শীতের সকালে আবার গলায় মাফলার পেঁচিয়ে অজিত দা-র (রায়) সঙ্গে ধানবাদ এলাকায় ঘুরে বেড়াতে চেয়েছিলাম আমি। ওর স্ত্রী তো অসুস্থ ছিলেন বেশ কিছুদিন; ভেবেছিলাম সব ঠিক হয়ে গেলে তারপর যাব। একাই যেতাম। ততদিনে সুফিটাও হয়তো বড় হয়ে যেত কিছুটা। আমার একা কখনও কোথাও যাওয়া হয়নি সেভাবে আসলে। এসব অনেক কিছু ভাবছিলাম লিখতে লিখতে। আমি অনেকটা সময় ধরে লিখি একবার লিখতে শুরু করলে। আর এইসব চিন্তার সঙ্গে সেদিন মাথায় আসছিল যাদবপুর থানার মোড়ে বেবিদা-কে চকিতে ঘোল খাইয়ে দিয়ে আমার আর সোমতীর্থ-র ব্যান্ডেলে কেটে পড়ার ঘটনা। ২০০৯ সাল সম্ভবত। কিন্তু এ তো গেল শুধু তারিখ আর ঘটনার কথা। এর সাথে আমার মাথার ভেতর যে জোয়ার-ভাঁটা তার অনুবাদ করি কীকরে? হয়তো ডেভিড গিলমোরের মতো গিটার বাজাতে পারলে বাজিয়ে শোনানো যেত যে প্রশান্ত মহাসাগরের প্রশান্তি শুধু উপরিতলে। থির জলের দেওয়ালের নিচে সেখানেও এক ব্যাকুল প্রবাহ।

    আজ অন্য কিছু লিখতে চেয়েছিলাম। অন্য ঘটনার কথা। কিন্তু আপাতত সেটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। লেখা নিজের অভিমুখ নিজেই বেছে নিয়েছে। এটা মূলত মৃত মানুষদের নিয়ে একটা লেখা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ফলত। তা হোক। জিম জারমুশ-এর 'ডেড ম্যান' আমার খুব প্রিয় একটা সিনেমা। মানে, জনি ডেপ-এর 'ডেড ম্যান'-এর কথা বলছি আরকী। সেই অদ্রীশ দা (বিশ্বাস)যবে আত্মহত্যা করল তারপর থেকেই গাঙ্গুলীপুকুরের ফ্লাইওভারটা পেরোনোর সময় আমার ওর কথা মনে পড়তো অবধারিতভাবে। "এখানে মৌ থাকে। অদ্রীশও থাকে"--- লেখা ছিল দরজার ওপর নেমপ্লেটে। তাই না? ২০০৪ সালে পরিচয়। বছরদুয়েকের খুবই গলাগলি আড্ডা-র সম্পর্ক। তারপর একদিন একটা নিরীহ গন্ডার নিয়ে ইয়ার্কি মারার কারণে প্রচন্ড ক্ষেপে গিয়ে লোকটি কথাই বন্ধ করে দিল আমার সঙ্গে। সে ভালো করেছিল, তাতে কিছু এসেও যায়নি সেভাবে। কিন্তু একটা মানুষ, অত ভালো সম্পর্ক, হঠাৎ ঝুলে পড়ল একদিন জানার পরে তার পুরোনো পাড়া দিয়ে যাওয়ার সময় তার কথা মনে পড়ে যাওয়াই কী স্বাভাবিক নয়? 

    - "স্যার, যোধপুর পার্কের ভিতর দিয়ে যাব, না ঢাকা কালীবাড়ি থেকে ইউ টার্ন মারব?"
    রানা মাহাতো জিজ্ঞেস করলো কথাটা। রানা ওলা-ইউবার চালায় কলকাতা শহরে। আদিবাড়ি ঝাড়খণ্ডে কোথাও। রানা হলো সেইসব ড্রাইভারদের একজন যারা কাস্টমারকে ফোন করে "কোথায় যাবেন" জিজ্ঞেস করে। সিস্টেমে ড্রপ লোকেশন দেখালেও জিজ্ঞেস করে। কারণ রানা বা ওর মতো অনেকেই আসলে ইংরিজি হরফের সঙ্গে ততটাও পরিচিত নয়। তাই জিজ্ঞেস করে কনফার্ম হয়ে নেয়, আর আমরা ভাবি নির্ঘাত যাওয়ার ইচ্ছা নেই বলে। 
    - "বস, তুমি একটা ওষুধের দোকান দেখে সাইড করো আগে। প্রচন্ড মাথা ধরেছে। ওষুধ কিনবো।"
    গাড়িতে "কমফোর্টেবলি নাম্ব" চলছে। ফ্রেটবোর্ডে খেলে বেড়াচ্ছে ঈশ্বরের আঙুল। আমিই চালিয়েছি গানটা। রানার গাড়ির স্টিরিওটা ভালো। আর একটু এগোলেই যাদবপুর থানার মোড়, সেই যেখানে বহুবছর আগে বেবিদাকে একা ফেলে পালিয়েছিলাম আমরা। খানিকক্ষণ আগে ডানদিকে অদ্রীশদার সেই পুরোনো বাড়ির পাড়াটা পেরিয়েছি। ঐসব ভুলভাল ভাবতে ভাবতেই মাথাটা ধরিয়ে ফেলেছি তারপর। এমনিও সকাল দশটায় বেরিয়েছিলাম, এখন সন্ধে সাড়ে সাতটা বাজে প্রায়।

    - "স্যার, কী নামে বিল হবে?"
     বিলিং কাউন্টারের ছেলেটি জিজ্ঞেস করলো। ক্রেডিট কার্ড আর ওষুধ হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছি। কোন দোকানে ঢুকেছি খেয়াল করিনি। ফ্রাঙ্ক রস কিংবা অ্যাপোলো হবে। আমি তখন ভাবছিলাম গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ার সময় এই যে পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে নাকি ঘাড় ভেঙে যায় মরে যাওয়ার আগের মুহূর্তে এটা কি শুধুমাত্রই শারীরিক প্রতিক্রিয়া? মানুষের মাথাটা কী ভাবে তখন? আদৌ কিছু ভাবার অবস্থায় থাকে কি? অথবা মাথার একপাশে ঝিনঝিন-চিনচিন অনুভূতি নিয়ে কিংবা বুকে অসহ্য ব্যথা নিয়ে যেসব মানুষেরা একা একা বিছানায় শুয়ে পড়েছিল শেষবারের মতো, ঠিক কী ভেবেছিল তারা? "ও কিছু না, ঠিক হয়ে যাবে?" পার হয়ে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে ধরা পড়েছিল কি যে এবারেরটা আর ঠিক হওয়ার নয়? এরকমই এক অনন্তযাত্রা-র অপেক্ষায় বসে রয়েছি আমরা প্রত্যেকেই মনে হয়। একদিন খুব সামান্য কারণে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে হবে, আর সেইদিন আর ঠিক হয়ে ওঠা হবে না আমাদের। এইসব ভাবছিলাম।

    - "স্যার, নামটা?"
    ছেলেটি আবারও জিজ্ঞেস করল। কপালের ভেতর থেকে থরের হাতুড়িটা করোটি ফাটিয়ে আসগার্ডের দিকে ছুটে যাবে মনে হচ্ছে যন্ত্রণার চোটে। আমি দেখছি কাঠের নৌকোয় জনি ডেপ ভেসে যাচ্ছে স্থির জলের উপর দিয়ে। তার চোখদুটো বোঁজা। ডেড ম্যান। এক্ষুনি জল চেয়ে ওষুধটা খাওয়া দরকার আমার। আধবোঁজা প্রায় অন্ধকার নেমে আসা চোখে ক্রেডিট কার্ডটা এগিয়ে দিতে দিতে বললাম, "উইলিয়াম ব্লেক! ডু ইউ নো মাই পোয়েট্রি?"   

    (ক্রমশঃ। আবারও, সম্ভবতঃ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৭ অক্টোবর ২০২২ | ১২৩০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Sanjib Chakraborty | ০৭ অক্টোবর ২০২২ ২১:৩৫512608
  • এক কথায় অপূর্ব
  • Anamitra Roy | ১০ অক্টোবর ২০২২ ২০:৪৮512689
  • ধন্যবাদ
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন