কে আমি? এই প্রশ্ন কি শুধু দার্শনিকের? জীবনের নানা পরিসরে যারা সক্রিয়, এই জিজ্ঞাসা কি তাদেরও নয়? নিছক অভ্যাসে দশকের পর দশক পেরিয়ে যাই হয়তো। কিন্তু কোনো এক সাম্প্রতিকে খটকা লাগে: এই যে বর্তমান আমাদের, সাফল্যে-ব্যর্থতায় আনন্দে-বিষাদে আর্তিতে-নৈরাশ্যে আলো-অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে কিংবা ভেসে যেতে যেতে কোনো তাৎপর্যে কি পৌঁছে দিচ্ছে? যাকে প্রাপ্তি ভাবছি তা আসলে তিক্ত অপ্রাপ্তি নয়তো? যা আমাদের ব্যক্তিগত ও যৌথ অতীত, তার ছায়াতপ থেকে এই বর্তমান কতটা দূরে যেতে পেরেছে? আসন্ন ভবিষ্যতে কোন অভিঘাত নিয়ে আসবে এই চলাচল? আর কত শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে পড়বে অস্তিত্বের সংবিদ।
যেহেতু অস্তিত্ব নিছক একক নয়, সামূহিক – ‘কে আমি’ থেকে পৌঁছে যাই ‘কে আমরা’: এই জিজ্ঞাসায়। পারিবারিক পরিচয়েও নিহিত রয়েছে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরম্পরা, রয়েছে বৌদ্ধিক ঐতিহ্যের আলো-ছায়া, রয়েছে চিৎপ্রকর্ষ অর্জনের দীর্ঘ ইতিহাস। এতে কত অজস্র উচ্চাবচতা, কত নতুন সূচনাবিন্দু। এসব ভাবতে গিয়ে দেখি, জাতিসত্তার বিচিত্র হয়ে ওঠায় ‘আমি’ ও ‘আমরা’-র অভিজ্ঞান অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত। ভাষাই জাতির পরিচায়ক, ধর্ম কখনই নয়। কেননা রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা বাধ্যবাধকতায় ব্যাপক ধর্মান্তরীকরণ ঘটতে পারে। বাঙালি জাতির বড় অংশ বিভিন্ন সময় আধিপত্যবাদী শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে ব্যবহারিক স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার জন্য। কখনও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে, কখনও খ্রিস্টধর্ম। ক্রমশ পরবর্তী প্রজন্মকে ধর্মীয় বিভাজন স্বতঃসিদ্ধ হয়ে পড়াতে ঘৃণা-বিদ্বেরষ-আক্রোশ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা বাঙালি জাতি হওয়ার বদলে ‘হিন্দু’ হয়েছি প্রাণপণে, হয়েছি ‘মুসলমান’ এবং নিজেদের দেশের মাটিকে টুকরো টুকরো করেছি আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের চক্রান্তের শিকার হয়ে।
এই প্রতিবেদন যখন লিখছি, সেসময় ভারতীয় উপমহাদেশে বাঙালি বসতিগুলিতে উৎকট হিন্দু ও মুসলমানের আস্ফালন মাত্রাছাড়া হয়ে পড়েছে। এদের মধ্যে বাঙালি কোথায়? এমনকী নববর্ষ উৎসবও ‘মুসলমান’দের জন্য একদিন আগে পালিত হচ্ছে। ঢাকায় মঙ্গল শোভাযাত্রা এবং সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উৎসবের আয়োজন স্পর্শকাতর মুসলমানেরা ‘হিন্দুয়ানির ছোঁয়া’ দেখতে পেয়ে মারমুখী হচ্ছেন। তাঁদের তীব্র ধর্মান্ধতায় বাঙালিত্ব ডুবে যাচ্ছে। একবারও বিবেচনা করছেন না, বাংলাদেশের জন্ম কেন হয়েছিল? দ্বিজাতিতত্ত্ব ও দেশভাগের প্রগল্ভ মিথ্যার তাৎপর্য অনুভব না করে এঁরা কার্যত পুনঃপাকিস্তানীকরণের পথে হাঁটছেন। ভুবন জোড়া বাঙালি জাতির ঐক্য পুনঃস্থাপনের কথা না ভেবে এঁরা শানিত অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন হিন্দু হিন্দুস্তানীভূত ভারতের উগ্র সন্ত্রাসপরায়ণ মৌলবাদীদের হাতে। এঁরা অন্তরে-বাহিরে অন্ধ না হলে এই খবরটুকু রাখতেন, গুজরাটি-হিন্দি আগ্রাসনের দীর্ঘমেয়াদি চক্রান্তের ধারক রাষ্ট্রশক্তির কাছে বাংলাভাষী মাত্রই অনুপ্রবেশকারী, পরিত্যাজ্য ও পীড়নযোগ্য। আসামের বাঙালিকে এরাই ‘রাষ্ট্রীয় নাগরিকপঞ্জি’-র মুষলপ্রহারে ধ্বংস করতে চাইছে। হয় অসমিয়া জাতির অংশ হওয়ার নিয়তি মেনে নাও, নয়তো উচ্ছন্নে যাও।
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে বাঙালির জন্য। এমনকী, পশ্চিমবঙ্গেও বাংলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে রাজ্য সরকারের অনুমোদন পায় না। বরং হিন্দিভাষীদের তোষণ করতে ব্যস্ত শাসকেরা। বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা হিন্দিভাষী বিহারকে ভেট দিয়েছিল কংগ্রেসি সরকার। ফলে বিহার দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ফলে ঝাড়খণ্ড রাজ্যে বহু প্রজন্ম ধরে বসবাসকারী বাঙালিরা ভাষিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। ওড়িশা-আন্দামান-উত্তরপ্রদেশ-উত্তরাখণ্ড-দিল্লি প্রভৃতি রাজ্যেও বাঙালিরা অত্যাচারিত। যাঁরা হিন্দু-মুসলমান ছাড়া অন্য কিছু দেখতে পান না, চাঁদের শ্যাওলা ধরা পাথরের মতো মনে বাঙালি জাতির ঐক্য তো অর্থহীন মনে হবেই। তাহলে একুশে ফেব্রুয়ারি কেন উদযাপিত হয় প্রতিবছর? বাংলাদেশে যদি সবাই মুসলমান এবং খণ্ডিত ভারতে সবাই হিন্দু হয়ে যান – বাঙালি জাতির জন্য বরাদ্দ কি তবে শ্মশান ও কবরস্থান? তাই এই ক্ষমতার প্রশ্নটা করুন: আমি কে? আমরা কারা? একবার অন্তত লক্ষ করতে শিখুন, একদিকে নতুন হিন্দুস্তানে উগ্র হিন্দুত্ববাদ এবং অন্যদিকে বাংলাদেশে ইসলামি পুনরুত্থান জয়ী হলে পরাজিত হয় কারা?
অবশ্যই বাঙালি জাতি। কেননা গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো নব্য বিশ্বায়ন ও আধুনিকোত্তরবাদের ফসল অন্তর্জাল (ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ-ইন্সটাগ্রাম-টুইটার) দিয়ে বাঙালির ঘরে ঘরে, শিশু থেকে বুড়ো অবধি, কদর্যতম লোভ-লালসা-ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিয়েছে। বাংলা বই কেউ পড়ে না, বাংলা গান কেউ শোনে না, বাঙালির খাদ্যাভ্যাস ও সাংস্কৃতিক অভ্যাস কেউ মানে না। হাঁসজারু ও বকচ্ছপ কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়াদের কোলাহলমুখর ভিড়ে কোথাও বাঙালিয়ানা নেই। দেশের সমস্ত সম্পদ বিক্রি হয়ে গেলেও এদের কিছু যায় আসে না। জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছাড়িয়ে মহাকাশে চলে গেলেও এদের একমাত্র স্লোগান: “কত রবি জ্বলে রে / কে বা আঁখি মেলে রে।” তাই দানব-পিশাচদের দাপট সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গেলেও এরা রবীন্দ্রনাথ-দেশবন্ধু-জীবনানন্দ-নেতাজি-সুভাষ কিংবা কাজী আবদুল ওদুদ-নজরুল ইসলাম-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কথা স্মরণ করে না। এদের কাছে কে পৌঁছে দেবে যামিনী রায়-রামকিঙ্কর-জয়নাল আবেদিন-ওয়ালীউল্লাহ-শামসুর-ইলিয়াস-হাসান আজিজুলদের বাঙালিয়ানা? তবে কি অন্ধতাই চিরসত্য, যেহেতু অন্ধের কী বা দিন কী বা রাত্রি। আমরা কারা, ভাষা কাকে বলে, সংস্কৃতি কাকে বলে, জীবন কাকে বলে আদৌ কি বুঝতে চেয়েছি কখনও?