গ্রুচো মার্ক্স (১৮৯০-১৯৭৭) কে আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই। হলিউড কাঁপানো এই কৌতুকাভিনেতার বিচরণ-কাল ছিল মোটামুটি ভাবে গত শতাব্দীর কুড়ির দশক থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত। বিচিত্র-ভাবে ছাঁটা গোঁফ, টিকালো নাক, ঠোঁটে বৃহৎ চুরুট, গোল চশমা ও তার ভিতর দিয়ে গোল দুটি চোখ এই নিয়ে অদ্ভুত-সদৃশ ভাবভঙ্গীতে মাতিয়ে রাখতেন দর্শকদের। হার্পো, চিকো, জেপ্পো ও গুম্মো মার্ক্স, এইসব ভাইদের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন ইনি। এই ভাইদের সাথে জুটি বেধে কমেডি ছবি করতেন, মার্ক্স ব্রাদার্স নামে খ্যাত হয়েছিলেন। এদের অভিনয় তাৎক্ষনিক পরিস্থিতি ও ক্রম-পরিণত প্লট, ভাঁড়ামো ও হাস্যরস, রোমান্স ও সমবেদনার এক আশ্চর্য সংমিশ্রণ। চ্যাপলিন বা কিটনের মত আদ্যন্ত স্ল্যাপ্সটিক না হলেও, দেহের অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে অদ্ভুত সদৃশ মুখের ব্যবহারে গ্রুচো ছিলেন স্বকীয়। সুকুমার রায়ের আঁকা একটি পোট্রেটের মধ্যে গ্রুচো মার্ক্সের ছোঁয়া দেখতে পান সত্যজিৎ রায়(১৯২১-১৯৯২)। তখন ১৯৫৭ সাল, জলসাঘরের শুটিং মাঝপথে বন্ধ। তপন সিনহার(১৯২৪-২০০৯) ‘কাবুলিওয়ালা’(১৯৫৭-)র জন্য ছবি বিশ্বাস(১৯০০-১৯৬২) গেছেন বার্লিনে। ফ্যান্টাসি, অদ্ভুতরস, কমেডি ইত্যাদিতে অভিরুচি ও সহজাত দখল, সত্যজিৎ যে বাপ-ঠাকুরদার দৌলতে বংশানুক্রমে পেয়েছিলেন সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বস্তুত প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালি’(১৯৫৪)-তেই এর ঝলক আমরা দেখতে পেয়েছি। অপু, দুর্গা, ইন্দির ঠাকরুন, সর্বজয়া ও হরিহরের সঙ্গে আরেকজনকে মনের মণিকোঠায় চিরকালের জন্য স্থান দিয়েছি আমরা – তিনি প্রসন্ন মাস্টার।
‘তুলসী চক্রবর্তী(১৮৯৯-১৯৬১) – সত্যজিৎ রায়’ যুগলবন্দীর প্রথম দ্যুতি এখানেই, কিন্তু ক্ষণিক। জঙ্গল থেকে উনুন জ্বালানোর গাছের ডাল নিয়ে ফেরার সময় সর্বজয়া দেখতে পায় অপু ঘুমিয়ে আছে! সর্বজয়া বলে, “একি! অপু, উঠবিনে? ও, অপু, পাঠশালায় যাবি নি?...”। এরপরেই সেই বিখ্যাত দৃশ্য যেখানে দুর্গা এসে ছেঁড়া চাদরের ফাঁক দিয়ে অপুর একচোখ টেনে খোলে, আমরা ‘পথের পাঁচালি’-র কাল্ট অপুকে প্রথম দেখতে পাই! উন্মুক্ত পৃথিবীর রূপক নিয়ে পাঠশালা ও অপু শুরু থেকেই সংবদ্ধ! ‘পথের পাঁচালি’ উপন্যাসে ও ছবিতে প্রসন্ন মাস্টারের প্রথম উপস্থিতি সৈন্ধব লবণ দাঁড়িতে মাপার দৃশ্য দিয়ে। ছবিতে তুলসী চক্রবর্তীকে আমরা দেখতে পাই ধুতি-খালিগা-পৈতে সমেত সেই আর্কিটাইপ পোশাকে। হাই তুলতে তুলতে বলছেন, “এই সেই জনস্থান-মধ্যবর্তী প্রস্রবণ-গিরি। ইহার শিখরদেশে আকাশপথে সতত-সমীর-সঞ্চরমাণ-জলধর-পটল সংযোগে নিরন্তর…”। স্লেটে ফনের কাটাকুটি খেলা, বড় লাঠি হাতে রাজকৃষ্ণ স্যানালের আগমন, তাঁর কথাবার্তা শুনে অপুর হেসে ফেলা এবং তাতে ‘ওকি, অপূর্ব হাসছ যে? এটা কি নাট্যশালা?’ গুরুমশাইয়ের রেগে ওঠা, ছবির মত সবটাই উপন্যাসে আছে। বেত্রাঘাতের কথাও উপন্যাসে আছে, ‘ছেলেদের শুধু পা খোঁড়া এবং চোখ কানা না হয়, এইটুকু মাত্র নজর রাখিয়া তিনি যত ইচ্ছে বেত চালাইতে পারেন ’, অভিভাবকরা একথা বলে দিয়েছিলেন গুরুমশাইকে! ছবিতে আমরা প্রসন্ন মাস্টারকে বড় বড় চোখ করে বেত্রাঘাত করতে দেখি, “হাত পাত, হাত পাত, হাত পাত বলছি…”। চমকপ্রদ হল গুরুমশাইয়ের ম্যানারিজমের ব্যাপারটা। এতো বিভূতিভূষণ লিখে যাননি। আদ্যন্ত শহুরে সত্যজিৎ স্বভাবতই পাঠশালার বর্ণনা থেকে পাঠশালা পর্বের সংলাপগুলি অধিকাংশই নিয়েছিলেন উপন্যাস থেকে, কিন্তু গোটা মেজাজের উপযোগী অভিনেতা নির্বাচন ছিল সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই সত্যজিৎ বাজিমাত করেছিলেন, জহুরি জহর চিনেছিলেন!
সত্যজিৎ ‘পথের পাঁচালি’-র সময়ই লেন্সে চোখ রেখে বুঝেছিলেন তাঁর গ্রুচো মার্ক্সকে পেয়ে গেছেন! বুঝতে পেরেছিলেন অসামান্য ক্ষমতা সম্পন্ন এই অভিনেতা অপেক্ষা করছেন পূর্ণ-দৈর্ঘ্যের একটি সঠিক সুযোগের জন্য। তুলসী চক্রবর্তী জন্মগ্রহণ করেন অবিভক্ত বাংলার গোয়ারি নামে একটি ছোট গ্রামে। তাঁর বাবা রেলে চাকরি করতেন এবং পরিবারটিকে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল। কলকাতায় থাকতেন মামা প্রসাদ চক্রবর্তীর কাছে। প্রসাদ চক্রবর্তী কাজ করতেন স্টার থিয়েটারে, ছিলেন তবলা ও হারমোনিয়াম বাদক। ব্রাহ্মণ পরিবারের কড়া অনুশাসন থেকে পালিয়ে তুলসী চক্রবর্তী তৎকালীন বার্মার (বর্তমান মায়ানমার) একটি ভ্রাম্যমাণ সার্কাসের দলে যোগ দেন। সেখানে নানারকম শারীরিক কসরতের খেলা দেখাতেন। অচিরেই তাঁর অদ্ভুত রকমের মুখাবয়ব ও দেহাবয়ব যা একই সঙ্গে জোকার ও জাদুকরের প্রতি-কল্প হতে পারে, তাই তাঁকে চলচ্চিত্র জগতে নিয়ে আসে। চার্লি চ্যাপলিনের ছবির সাথেও পরিচিত ছিলেন। চার্লির ছোট গোঁফটি যেমন ভবঘুরে থেকে হিটলার সর্বত্রগামী, তুলসীর ক্ষেত্রে সেই জায়গাটা নিয়েছিল তাঁর বড় গোল দুটি চোখ! সমস্ত রকমের পরিস্থিতিতে সমস্ত রকমের আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে ঐ চোখদুটির কোনো জুড়ি ছিল না।
‘পথের পাঁচালি’-র সময়ই তিনি প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা ছিলেন, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ মূল চরিত্রে নয়, মূলত একদিনের বা একরোজের কাজে কোনো পার্শ্ব কমিক-চরিত্রে কাজ করতেন। সত্যজিৎ রায়ের কাজে তিনি বিশেষ প্রীত হয়েছিলেন, কখনই মনে হয় নি সত্যজিৎ একজন নবাগত পরিচালক। এযাবৎ অভিনয়ের নামে তাঁকে যা দেওয়া হত তা কতকগুলি বিচ্ছিন্ন সংলাপের বেশি কিছু ছিল না, সত্যজিৎই প্রথম যথোপযুক্ত সংলাপের সঙ্গে তাঁর অস্বাভাবিক মুখাবয়ব ও চেহারাটাকে চুটিয়ে ব্যবহার করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সহজাত প্রতিভা তো ছিলই তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল মুখাবয়ব ও দেহাবয়বকে ব্যবহার করার সত্যজিতীয় পরিশীলন। এই ব্যাপারটারই অভাব ছিল তৎকালীন অন্য পরিচালকদের মধ্যে। আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য যে তুলসী চক্রবর্তী, জহর রায় বা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাপের অভিনেতাকে তাদের যোগ্য চরিত্র দেওয়ার মত ছবি এ দেশে বিশেষ হয় নি। ‘পরশ পাথর’ একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। শোনা যায় ‘পথের পাঁচালি’-র সময়ই তুলসী চক্রবর্তী বড় রোলের আর্জি জানান সত্যজিতের কাছে। মাঝখানে একটি ছবির ব্যবধান ও খানিক অখণ্ড অবসর, ব্যাস। ‘পরশ পাথর’-এর স্ক্রিপ্টের পাশেই পরে থাকতে দেখা যায় গ্রুচো মার্ক্সের একখণ্ড ছবি যার সঙ্গে পরেশ চন্দ্র দত্তর চেহারায় মিল আছে।
সত্যজিৎ যখন জানান বড় রোল নয়, আগামী ছবির নায়ক তিনি, তুলসী চক্রবর্তী আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন। আরও শোনা যায়, সত্যজিৎ পরেশ চন্দ্র দত্তের জন্য যে অর্থ অফার করেছিলেন তা নিতে তিনি রাজি হন নি। বক্তব্য ছিল, মানিকবাবুর কাছ থেকে অত টাকা নিয়েছেন এটা যদি একবার ইন্ড্রাস্টিতে রটে যায়, তাহলে এরপর আর তিনি কোনো কাজ পাবেন না! দুর্ভাগ্যের এই যে, নায়ক হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশের চার বছরের মাথায় তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। সাঙ্ঘাতিক অর্থাভাবে বিড়ম্বিত হয় শেষ জীবন। অর্থের অভাবে টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়া থেকে কাজের শেষে হেঁটে হাওড়ার শিবপুরে নিজের বাড়িতে ফিরতেন প্রায়শই! সত্যজিৎ রায় একবার মন্তব্য করেছিলেন তুলসী চক্রবর্তীর জন্ম যদি আমেরিকায় হত তাহলে তাঁর অস্কার বাঁধা ছিল।
একদিকে উপেন্দ্রকিশোর-সুকুমারের উত্তরাধিকার ও সেই সূত্রে পরশুরামের(১৮৮০-১৯৬০) অদ্ভুত-রসের গল্পের প্রতি আকর্ষণ এবং অন্যদিকে গ্রুচো মার্ক্স-চ্যাপলিন-কিটনের ছবির থেকে পাওয়া কমেডি চলচ্চিত্রের বোধ, এই ছিল সত্যজিতের সম্বল। তাছাড়া পারিবারিক জীবনকে প্রাধান্য দেওয়া ছিল সত্যজিতের ছবির একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ‘পরশ পাথর’-এও এ ব্যাপারটার নিবিড় চিত্রণ আমরা দেখতে পাই। তাঁর ছবিতে খুব কম চরিত্রই পাওয়া যাবে যারা পারিবারিক পরিসর থেকে বিচ্ছিন্ন। সম্ভবত সত্যজিতের ব্যক্তিজীবন এর পিছনে একটা বড় কারণ। আজীবন পরিবার সংবদ্ধ ছিলেন। পরশুরাম বা রাজশেখর বসুর সঙ্গে সত্যজিতের পারিবারিক যোগাযোগ ছিল। রাজশেখর বসুর দাদা গিরীন্দ্রশেখর বসু ছিলেন তাঁদের পারিবারিক ডাক্তার। এই গিরীন্দ্রশেখর বসুর সঙ্গে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের দীর্ঘ পত্রালাপ হয়েছিল ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন তত্ত্বের প্রাচ্যীয় রূপ নিয়ে। রাশভারী কেমিস্ট রাজশেখর বসুর ‘পরশ পাথর’ নামের দশ পাতার গল্পের চলচ্চিত্ররূপটি কিন্তু একেবারেই গল্পানুসারী নয়। আসুন এই ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখা যাক।
পরশুরামের পরেশ দত্ত উকিল, সত্যজিতের ব্যাঙ্কের কেরানি। পরশুরাম লিখছেন, ‘পরেশবাবু মধ্যবিত্ত মধ্যবয়স্ক লোক, পৈতৃক বাড়িতে থাকেন, ওকালতি করেন। রোজগার বেশী নয়, কোনও রকমে সংসারযাত্রা নির্বাহ হয়। আদালত থেকে বাড়ি ফেরার পথে একটি পাথরের নুড়ি কুড়িয়ে পেলেন। জিনিসটা কি তিনি চিনতে পারেন নি, একটু নতুন রকম পাথর দেখে রাস্তার এক পাশ থেকে তুলে নিয়ে পকেটে পুরলেন।’। ছবির সূচনা পর্বে উপর থেকে টিল্ট-ডাউন শটে আমরা দেখি সাদা কালো জেব্রা ক্রসিং-এর উপর দিয়ে রাস্তা পেরোচ্ছে অসংখ্য মানুষ, পুলিশ হাত নাড়ছে, বাস-গাড়ি-সাইকেল-ট্রাম চলে যাচ্ছে। আর অফ-ভয়েসে আমরা শুনতে পাই কিঞ্চিত কৌতুক-মেশানো দরদী একটা গলা – “ডালহাউসি স্কোয়ার, কলকাতার স্নায়ু-কেন্দ্র, ডালহাউসি স্কোয়ার! এখন বিকেল পাঁচটা, সবে আপিস ভেঙেছে, কর্মক্লিষ্ট কেরানীকুল ক্লান্ত পদক্ষেপে গৃহাভিমুখে যাত্রা করছে। বাঙলার কেরানি এরা, আহা, এদের দুর্ভাগ্য নিয়ে অনেক কাহিনী রচিত হয়েছে। আমাদের বর্তমান কাহিনীও এদেরই একজনকে নিয়ে, এর নাম শ্রী পরেশ চন্দ্র দত্ত।”। এরপরই আপিসের লিফটের বোতাম চাপতে দেখা যায় অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী অর্থাৎ পরেশ দত্তকে। গল্পের কাল যদি ধরে নেওয়া হয় দেশ স্বাধীন হওয়ার দশ বছরের মধ্যে তাহলে বাঙ্গালীর হাঁড়ির সঙ্গে তার বারমাস্যার সঙ্গে অর্থাৎ গড় বাঙ্গালীর প্রতিভূ হিসেবে উকিলের চাইতে সওদাগরি আপিসের কেরানী বা ব্যাঙ্কের কেরানিই যে অনেক বেশী মানানসই সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। জমিদার আমলে সেরেস্তায় হিসেব-নিকেশ যারা রাখত তাদের একপ্রকার কেরানিই বলা চলে কিন্তু করণিক ব্যাপারটা পেশা হিসেবে ব্যাপকভাবে উদ্ভূত হয় ঔপনিবেশিক ভারতেই এবং কলোনাইজারদের প্রয়োজনেই। কাজেই কেরানি-বাঙ্গালীর একটা ইতিহাস আছে, কেরানি ও বাঙালি যতটা সমার্থক, উকিল ও বাঙালি ততটা নয়। দশ পাতার গল্পটি পড়লেই বোঝা যায় এ গল্পে পরেশ দত্ত উকিল না কেরানি সেটার কোনও মূল্যই নেই, প্রধান হল তিনি গরীব । কিন্তু সিনেমা যেহেতু একটি ফিজিক্যাল মিডিয়াম, গল্পের কল্পনার পরেশ দত্তকে যেহেতু বাস্তবে রক্তমাংসে আসতে হবে, তাই সিনেমার পরেশ দত্তের দায় আছে গড় বাঙ্গালীর প্রতিভূ হয়ে ওঠার । না হলে ‘অলীক-বাস্তবতা’ এরকম একটি উদ্ভট ব্যাপারের কোনো আবেদন থাকবে না জন-মানসে। সেই জন্যই সত্যজিৎকৃত এই পরিবর্তন।
লিফটের বোতাম চাপার পরপরই আমরা দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারছি, “তিপ্পান্ন বছর বয়সে ছাঁটাইয়ের নোটিস দেখতে হল”- পরেশবাবু তাঁর সহকর্মীকে জানান। পরশুরামের লেখা ‘মধ্যবয়স্ক’-তে সত্যজিতের স্বস্তি নেই, সঠিক বয়সটাও জানানো প্রয়োজন। প্রথম দর্শনেই ছাপোষা কেরানির যে প্রতিমূর্তি তৈরি হয় তাতে আরও দুর্দশার সঞ্চার করে দ্বিতীয় তথ্যটি, অর্থাৎ ছাঁটাইয়ের নোটিস! এরপরই সেই পৃথিবী বিখ্যাত হাঁটার দৃশ্য। লং শটে আমরা পরেশ চন্দ্র দত্ত ওরফে তুলসী চক্রবর্তীকে দেখতে পাই পড়ন্ত বিকেলে রাজভবনের সামনে দিয়ে অফিসের পরে দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরছেন, ছাতাটি ভাঁজ করা অবস্থায় কাঁধের উপর ধরা এবং মেঘের গর্জন শুনে চমকে চমকে উপর দিকে তাকাচ্ছেন মাঝে মাঝে। একে স্ল্যাপসটিকই বলতে হবে এবং বাংলা ছবিতে অতি উৎকৃষ্ট স্ল্যাপসটিক কমেডির সম্ভবত এটি একমাত্র উদাহরণ। তথাপি চ্যাপলিন বা কিটন গোত্রের স্ল্যাপসটিক এ নয়। চ্যাপলিন ‘কমেডির রাজা’ ম্যাক সেনেটের ‘কিস্টোন স্টুডিও’তে যোগদানের পর স্ল্যাপস্টিক কমেডির উপযোগী শারীরিক দক্ষতা রপ্ত করেছিলেন, প্রায় স্প্রিঙের মত বানিয়ে ফেলেছিলেন শরীরটাকে। কিন্তু ‘পরশ পাথর’-এর সময় তুলসী চক্রবর্তীর বয়স আটান্ন, এই বয়সে সার্কাসে শেখা কসরতের কিছুই অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। প্রকৃতপক্ষে এই স্ল্যাপসটিক তুলসীর সহজাত। অদ্ভুত মুখভঙ্গির সঙ্গে বেঢপ শরীর এবং হাঁটাচলার অনুনগামী বৈশিষ্ট্য! কৃতিত্ব সম্পূর্ণত তুলসীর! সত্যজিৎ উচ্চ-স্তরের জহুরির কাজ করেছেন অবশ্যই। বৃষ্টি ভেজা শেষ বিকেলে কার্জন পার্কের মোড়ে পুনরায় সাদা-কালো জেব্রার উপর দিয়ে রাস্তা পেরতে দেখি পরেশ দত্তকে। এই সাদা-কালোকে মোটিফের মত ব্যবহার করেছেন পরিচালক। একথায় পরে আসব। বৃষ্টির মধ্যে বেসমেন্টে পাথরটিকে পড়ে থাকতে দেখি আমরা।
পরশুরাম লিখছেন, ‘বাড়ি এসে তাঁর অফিস-ঘরের তালা খোলবার জন্য পকেট থেকে চাবি বার করে দেখলেন তার রং হলদে।…হয়ত চাবিটা কোনও দিন হারিয়েছিল, গৃহিণী তাঁকে না জানিয়েই চাবিওয়ালা ডেকে এই পিতলের চাবিটা করিয়েছেন, এতদিন পরেশবাবুর নজরে পড়ে নি ।…বেশ গোলগাল চকচকে নুড়ি, কাল সকালে তাঁর ছোট খোকাকে দেবেন, সে গুলি খেলবে। পরেশবাবু তাঁর টেবিলের দেরাজ টেনে পাথরটি রাখলেন।…কি আশ্চর্য! ছুরি আর কাঁচি হলদে হয়ে গেল।‘। এরপর চাকর হরিয়াকে ডেকে হাত ঘড়ি আনিয়ে তাতে পাথর ঠেকিয়ে বকলেস ও স্প্রিং সোনা হয়ে যাওয়ার বর্ণনা আছে। সত্যজিৎ পরশ পাথর আবিষ্কারের এই পর্বটিকে সাজিয়েছেন ভিন্ন ভাবে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত যে পাড়ায় পরেশ দত্ত থাকেন, একটা লং শটে বাড়ির গলিতে তাঁকে আমরা দেখতে পাই। কেরানি হিসেবে পরেশবাবুর অবস্থা ও দিনের শেষে বাড়ি ফিরে স্ত্রী গিরিবালার সাথে তাঁর কথোপকথন আমাদের মনে করিয়ে দেয় – ‘দেবতারা ঔপনিবেশিক ভারতে এসে দেখেনঃ ‘অফিসের কেরানিরা ঝিমাতে ঝিমাতে অফিস হইতে প্রত্যাগমন করিতেছে। তাহাদের মুখগুলি সমস্ত দিন খেটে শুকিয়ে গিয়েছে।…সমস্ত দিন সাহেবের ঝাঁটা লাথি খান, তৎপরে প্রত্যাগমনের সুখ…পত্নীদের গঞ্জনা…।…’’-দেবগণের মর্তে আগমন’ (লেখক দুর্গাচরন রায়, ১৮৮৯)।
গলি থেকে শুরু করে গৃহের অন্দরমহলের দৃশ্যগুলি সর্বতোভাবে আমাদের মনে করিয়ে দেয় ফরাসী চিত্র-গ্রাহক হেনরি কার্টিয়ের-ব্রেঁস(১৯০৮-২০০৪)-র স্থির চিত্রগুলির প্রতি সত্যজিতের অনুরাগের কথা। ব্রেঁসর ক্যান্ডিড ফটোগ্রাফির স্পষ্ট প্রভাব দেখতে পাওয়া যায় নিস্তেজ বিজলীবাতিতে ভেসে থাকা কর্দমাক্ত গলির চিত্রণে। এখানে দাঁড়িয়েই উল্টো দিকের বাড়ির বাচ্চা ছেলে পল্টুকে পরেশবাবু নতুন মার্বেলটি দেয়, বিনিময়ে শুনে নেয় ‘দ্রিঘাংচু’ গল্পে ব্যবহৃত সুকুমার রায়ের ছড়া! ‘হলদে সবুজ ওরাং ওটাং’ স্বভাবতই পরশুরামে নেই। বাপের প্রতি সত্যজিতের এই নিবেদন ছবির অদ্ভুতরসকে করেছে আরো ঘনীভূত, কারণ পরশ পাথরের মেজাজের সাথে সুকুমারের ননসেন্সের রসগত মিল আছে। পরবর্তী পর্ব আমাদের জানা, এই পল্টুই শিশুসুলভ চপলতায় পরেশবাবুর কাছে উদাঘাটন করবে পাথরের রহস্য। পরশুরাম বর্ণিত পকেটের চাবির রং হলদে হয়ে যাওয়ার তথ্য সাহিত্যের বিচারে যথোপযুক্ত, কিন্তু এর মধ্যে নাটকীয়তা না থাকায় সত্যজিৎ এই পল্টুকে নিয়ে এসেছেন। আরেকটি কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হল পরশুরামের পরেশ দত্ত সম্ভবত নিঃসন্তান নন, কিন্তু গোটা গল্পে এর একটিই ইঙ্গিত আছে, ‘কাল সকালে তাঁর ছোট খোকাকে দেবেন, সে গুলি খেলবে’! আর কোনো উল্লেখ নেই। সত্যজিৎ প্রকারন্তের পরেশ দত্তকে নিঃসন্তান দেখিয়ে ঐ ছোট খোকাটিকে স্থান দিয়েছেন উল্টো দিকের বাড়িতে। এতে করে দৈন্য-দুর্দশার বাস্তবতার মধ্যে জোড়াল ভাবে নিয়ে আসা গেছে অপূর্ণ বাৎসল্যের রস এবং পরশ পাথর আবিষ্কারের মুহূর্তটিকে করে তোলা গেছে যথাযথভাবে নাটকীয়। মজার ব্যাপার হল পাথরটির অভাবনীয় ক্ষমতা প্রকাশ হতেই পরেশবাবুর বাৎসল্যকে দমন করেছে প্রবল লোভ। সে এখন তাঁর অতি প্রিয় পল্টুকে যেভাবে হোক পটিয়ে-ঠকিয়ে ঐ পাথরটি চায়। শুরুর বারো-তেরো মিনিটে চিত্রনাট্যের এই বুনন আমাদের দেখিয়ে দেয় ফ্যান্টাসি-ধর্মী গল্প থেকে ঠিক কতটা ও কিভাবে সরলে তা চলচ্চিত্রের বাস্তবতা ও সীমাবদ্ধতাকে মেনে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।
অতঃপর সুপুরিকাটার যন্ত্রের ও পেপার-ওয়েটের সোনা হয়ে যাওয়া এবং তাই দেখে হতভম্ব পরেশবাবুর হাসতে হাসতে কেঁদে ফেরার সেই বিখ্যাত দৃশ্য। মালিকের পরশ পাথর আবিষ্কারের দৃশ্যে চাকর ভজারুপী (হরিয়ার বদলে) জহর রায়ের চায়ের কাপপ্লেট হাতে কাঁপতে কাঁপতে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলার অসাধারণ অভিনয় এতে বাড়তি হাস্যরস যোগ করেছে। চমকপ্রদ ব্যাপার হল এই পর্বে উল্টে পরশুরামে আমরা পাই নাটকীয় উপাদান! তিনি লিখছেন, ‘তিনি হাত জোড় করে কপালে বার বার ঠেকাতে ঠেকাতে বললেন, জয় মা কালী, এত দয়া কেন মা?...স্বপ্ন দেখছি না তো? পরেশবাবু তাঁর বাঁ হাতে একটি প্রচণ্ড চিমটি কাটলেন, তবু ঘুম ভাঙল না…তাঁর মাথা ঘুরতে লাগল, বুক ধড়ফড় করতে লাগল। শকুন্তলার মতন তিনি বুকে হাত দিয়ে বললেন, হৃদয় শান্ত হও; এখনই যদি ফেল কর তবে এই দেবতার দান কুবেরের ঐশ্বর্য ভোগ করবে কে? পরেশবাবু শুনেছিলেন, এক ভদ্রলোক লটারির চার লাখ টাকা পেয়েছেন শুনে আহ্লাদে এমন লাফ মেরেছিলেন যে কড়িকাঠে লেগে তাঁর মাথা ফেটে গিয়েছিল। পরেশবাবু নিজের মাথা দু হাত দিয়ে চেপে রাখলেন পাছে লাফ দিয়ে ফেলেন।’। অনবদ্য, পরশুরাম! যেকোনো গড়-মেধার পরিচালক হলে কেরি-ক্যাচার করার এত সুযোগ হাতছাড়া করতেন কিনা সন্দেহ! কিন্তু সাহিত্যে বা নাটকে যা চলে চলচ্চিত্রে তা সবসময় কেন অধিকাংশ সময়ই চলে না। ‘নায়ক’-এর অরিন্দমের ভাষায় “একটু বাড়িয়েছ দশ গুণ বেড়ে যাবে”। উপরে উদ্ধৃত অংশে যে স্ল্যাপস্টিক এলিমেন্ট আছে তাতে চ্যাপলিন কিটনের কোনো বঙ্গীয় সংস্করণ পেলেও ঝুঁকি নেওয়া যেত, নচেৎ ও রাস্তায় একেবারেই নয়। সাহিত্যে লিখে দেওয়া যত সহজ চলচ্চিত্রে করে ফেলা ততটাই কঠিন। চলচ্চিত্রে বিষয়টা সম্পূর্ণত ভাঁড়ামোয় পর্যবসিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে প্রবল। এব্যাপারটা আমাদের দেশে সত্যজিৎ রায়ের থেকে ভালো আর কেউ বুঝতেন না। এর কারণ শুধুমাত্র এই নয় যে সিনে-টেকনিক বা সিনে-প্রকরণবিদ্যার উপর তাঁর দখল ছিল ঈর্ষণীয়, এর সঙ্গে এটাও সত্যি যে তাঁর আঠাশটি পূর্ণ-দৈর্ঘ্যের ছবির মধ্যে কমবেশি বাইশটিই অন্যের লেখা সাহিত্য থেকে করা! ফলত তুলসীর সহজাত অভিনয় ক্ষমতা ও মৌখিক-দৈহিক বৈশিষ্ট্যকে ব্যবহার করে যতটুকু করা যায় তাই করেছিলেন সত্যজিৎ, যেটা বলা হয়েছে এই স্তবকের শুরুতে।
পত্নী গিরিবালাকে পরশুরামের পরেশ দত্ত দোতলায় নিয়ে গিয়ে ‘একটু একটু করে সইয়ে সইয়ে’ বলেন তাঁর মহা সৌভাগ্যের কথা এবং ‘তেত্রিশ কোটি দেবতার দিব্য দিয়ে বললেন, খবরদার, যেন জানাজানি না হয়।’। সত্যজিতের পরেশ দত্তর বাড়িতে দোতলা নেই। ফলে তাঁকে চাকর ভজার কান বাঁচিয়ে ঘরে দোর দিয়ে স্ত্রীকে পুরো ব্যাপারটা বলতে হয়। গিরিবালা বোঝায় এতো চোরাই মাল নয়, লটারির টাকা যারা পায় তাদের কি হাজতবাস হয়? লোভ ও লোভ নামক পাপের দরুন আসন্ন বিপদের কথা ভেবে সত্যজিতের পরেশ দত্ত পাথরটা গঙ্গায় বিসর্জন দেবেন বলেই ভাবেন। কিন্তু গিরিবালার কাশীবাসের চিরকেলে বৈরাগ্য যে অচিরেই পরেশ দত্তকে উচ্চতর বাসনার দিকে ঠেলে দেবে, এই বৈপরীত্যে আমাদের কোনো সন্দেহ থাকে না। পরশুরামের পরেশ দত্ত বিস্ময়ে হতবাক হয়েছেন কিন্তু কখনো এক মুহূর্তের জন্যও ভাবেন নি যে পাথরটির সদ্ব্যবহার করবেন না। উকিলের ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা কি কেরানির থেকে বেশী?
সোনার সুপুরি কাটার যন্ত্র, সোনার পানের দানি যা কিনা ‘বাবার বাবার বাবার বাবা’-র আমলেও দুষ্প্রাপ্য ছিল, নলিনী সেট রোডের সত্যিকারের সোনার দোকানে সেই সব বিক্রি করা সত্যজিতের মস্তিষ্ক-প্রসূত, পরশুরামে নেই। সত্যজিতের পরেশ দত্তর কেরানি হওয়ার দরুনই সম্ভবত বিস্ময়-বোধ, পরিতুষ্টি ও পাপ-বোধ সবই পরশুরামের থেকে বেশী। ফলত সত্যজিৎকে দেখাতে হয়েছে স্বর্ণকারের দোকান থেকে মোটা টাকা পকেটস্থ করে পরেশবাবু জীবনে প্রথম বারের জন্য ট্যাক্সিতে চড়লেন। লোহার কংক্রিটের একটি বিশাল বাড়ির ধাঁচা দেখে পরেশবাবু বুঝতে পারলেন কি কেলেঙ্কারি রকমের অর্থের ও ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার সম্ভাবনা এখন তাঁর! এ যেন স্বপ্ন-বাসর, তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখ নিয়েই তিনি দেখছেন রাজভবন ও স্ট্যাচু নামক ঔপনিবেশিক কলকাতার দুটি স্মারককে। সেনার সম্বর্ধনা দেওয়া ও ‘এ গ্রেট সন অফ ইন্ডিয়া’ লেখা স্ট্যাচুর উপর দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ার স্বপ্নদুটিও একান্তভাবে সত্যজিৎ-কৃত, পরশুরামে নেই। পরশুরামে আছে, ‘এক জায়গায় রাশি রাশি মরচে পড়া মোটরভাঙ্গা লোহার টুকরো পড়ে আছে। জিজ্ঞাসা করলেন, কত দর? লোহার মালিক অতি নির্লোভ, বললে, জঞ্জাল তুলে নিয়ে যান বাবু, গাড়ি ভাড়াটা দিতে পারবো না।’। এই দৃশ্যকে চলচ্চিত্রায়িত করেছেন পরিচালক। পরেশ দত্ত সারি সারি পরে থাকা পরিত্যক্ত লোহা-লক্কড়ের মধ্যে দিয়ে স্তম্ভিত-ভাবে সন্তর্পণে পা ফেলে চলেছেন যেন চারপাশে সারি সারি সোনা পরে আছে! ফ্যান্টাসির মধ্যে বিস্ময়-উদ্রেককারী একটা ভাব নিয়ে আসা এ ছবির বৈশিষ্ট্য। আমরা দেখতে পাই জঞ্জাল থেকে তুলে আনা মিউটিনির দুটি গোলা ট্যাক্সিতে পরেশ দত্তর মাথার পিছনে রাখা রয়েছে।
বালিগঞ্জে বাড়ি করা ও প্রিয়তোষ হেনরি বিশ্বাস নামে একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সেক্রেটারি রাখা গল্প ও ছবি উভয়েই আছে। ইতিমধ্যে আমরা পরেশবাবুকে দেখেছি গান্ধীটুপি (শোনা যায় এই সাদা গান্ধীটুপি যেহেতু কংগ্রেসি ঘরানার রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল তাই সেন্সর নাকি টুপিটাকে কালো রঙের দেখাতে বলেছিল!) পরে সভাসমিতিতে সোনার মেডেল বিতরণ করছেন, এর কোনো উল্লেখ পরশুরামে নেই। পরশুরাম লিখছেন, ‘পরেশবাবু মনে করেন, তিনি পরশ পাথর ছাড়া আর একটি রত্ন পেয়েছেন-এই প্রিয়তোষ ছোকরা।’। পরশুরামে প্রিয়তোষের ব্যাপারে যেটা প্রকাশ পেয়েছে সেটা ঝুঁকিহীন আস্থা যেহেতু ধন-দৌলত, সোনার-উৎস এসব ব্যাপারে প্রিয়তোষের কোনো উৎসাহই নেই। সে সারাদিন বিনা-প্রশ্নে কাজ করে, রাতে ঘুমোয় ও বাকি সময় চা-সিগারেট খায় আর হিন্দোলাকে প্রেমপত্র লেখে! পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে পরশুরামের পরেশবাবু একবারই তাঁর প্রিয় খোকার কথা বলেন। শেষাবধি গিরিবালার ‘সব সোনা গঙ্গায় ফেলে দিয়ে কাশীবাস করবে চল’ এবং পরেশ বাবুর প্রিয়তোষকে যৌতুক দেওয়ার প্রশ্নে আমাদের মনে হয় তাহলে ঐ খোকা সম্ভবত উল্টো দিকের বাড়ির কোনো ছেলেই হবে, আপন সন্তান নয়। অন্যদিকে সত্যজিতের পরেশবাবু ‘প্রিয়তোষ’ বলে না ডেকে স্নেহভরে ‘প্রিয়তোষ হেনরি বিশ্বাস’ বলে ডাকে। কিন্তু নিঃসন্তান পরেশের সন্তানবৎ স্নেহ শুধু নয়, এর আরেকটি কারণ হল তা না হলে প্রিয়তোষের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান আইডেন্টিটিটা চলচ্চিত্রকারের পক্ষে প্রকাশ করা মুশকিল! সাহিত্যে স্বভাবতই এইভাবে ডাকার দায় নেই।
বিদেশ থেকে সুন্দরী মহিলাদের পাঠানো প্রেমপত্র ও মেম-সেক্রেটারি রেখে সেগুলির উত্তরে গিরিবালার বিখ্যাত ‘ড্যাম’ লিখে পাঠানোর এই অংশটি সত্যজিৎ সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে দিয়েছেন। এক, এতে অতি-নাটকের ঝুঁকি আছে, দুই, গিরিবালা-পরেশের সত্যজিৎ-কৃত দাম্পত্য-রসায়ন আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি পরশ পাথর আবিষ্কার পর্বে। চাকরির কি হতে চলেছে এই নিয়ে গিরিবালা কিঞ্চিৎ উষ্মা প্রকাশ করেন, পরেশবাবু উঠে গিয়ে দেওয়ালে ঝোলানো তাঁদের যৌবনে তোলা ছবির দিকে তাকান, পাশে ঝোলানো দেখেন ‘শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে’। এই রস বা রসায়নেরই সম্প্রসারণে পরে আমরা দেখতে পাই, পরেশবাবু ঘরে আসার সময় শুনতে পান স্ত্রী গান গাইছেন ‘কেন মন সঁপে ছিলাম তারে…’, সদ্য বানানো একটি সোনার হার হাতে নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে খুনসুটি করে তিনিও গান ধরেন ‘আমি দেব না দেব না মালা…’।
পরশুরামে উল্লেখ আছে, ‘ব্রিটেন ফ্রান্স আমেরিকা রাশিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রের ভারতস্থ দূতরা পরেশবাবুর উপর করা সুনজর রাখেন, তাঁকে বার বার ডিনারের নিমন্ত্রণ করেন। পরেশবাবু চুপচাপ খেয়ে যান, মাঝে মাঝে ইয়েস-নো বললেন, কিন্তু তাঁর পেটের কথা কেউ বের করতে পারে না, শ্যাম্পেন খাইয়েও নয়।’। সত্যজিৎ এইটুকু থেকেই পেয়েছিলেন ককটেল পার্টির আইডিয়াটা। শুরু থেকে গল্প যে ভাবে সাজিয়েছিলেন তাতে এই নাটকীয়তার প্রয়োজন ছিল, না হলে ছবিটিকে একটা যৌক্তিক সমাপ্তির দিকে নিয়ে যাওয়া মুশকিল হত। ককটেল পার্টিতে সত্যজিৎ একত্র করেছিলেন সে সময়ের প্রায় সমস্ত স্টলওয়ার্ট অভিনেতাদের - কমল মিত্র, পাহাড়ি স্যান্যাল, ছবি বিশ্বাস, জহর গাঙ্গুলি, নিতিশ মুখার্জি, গঙ্গাপদ বসু, পদ্মাদেবী! ককটেল পার্টির অভিজাত আবহ তৈরি করার জন্য এইসব ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতি প্রয়োজন ছিল। অর্থ শুধু করতে জানলে হয় না, চলনে বলনে অর্থের গরিমাও প্রকাশ করতে জানতে হয়। পরেশ দত্ত শুরু থেকেই এই পার্টিতে বেমানান, ৩৬ নম্বর ছাতুময়রা লেনের গন্ধ তাঁর গা থেকে যায়নি যেন এখনও! অর্থের উৎস অজানা, হঠাৎ প্রচুর টাকা করেছেন ও করে চলেছেন, কিন্তু কোনোরকম ভ্রষ্টাচার ছাড়া! নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে এর থেকে যথার্থ সুখের অবস্থা আর কি হতে পারে! এখানেই সাদা-কালোর মোটিফকে ব্যবহৃত হতে দেখি অভিনব ভাবে। ছবির শুরুর রাস্তার জেব্রা-ক্রসিঙের সাদা-কালো যা ছিল নিম্ন-আটপৌরে জীবনের প্রতীক, ক্রমে ক্রমে পরশপাথরের ছোঁয়ায় কালো ধাতুর সাদা(সোনা) হয়ে যাওয়া কালো টাকা সাদা হওয়ার রূপকল্পে উপনীত। অভিজাতদের আভিজাত্যকে ম্লান করে দিয়ে কালো নগ্নিকা প্রস্তর-মূর্তি এক অর্থে বললে নিম্নবিত্তের ছাইচাপা ঔদ্ধত্যে পরিশেষে সাদা হয়ে গেল! অথচ গোটা ব্যাপারটাই পরিবেশিত হয়েছে হিউমারের আড়ালে।
পরশুরামের পরেশবাবু পরশ পাথর নিয়ে কোনো বিপদেই পড়েন নি, ফলে তাঁকে পুলিশের হাতেও পড়তে হয় না। সোনার দামের ক্রম-অধোগতি, টাকা ডলার ইত্যাদির দাম তলানিতে গিয়ে ঠেকা ও তৎসংক্রান্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানাপ্রকার অভূতপূর্ব সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়া এবং বৈভবে ঘেন্না ধরে যাওয়া হেতু তিনি একসময় ঠিক করেন প্রিয়তোষকে পাথরের রহস্য জানিয়ে দিয়ে সেই কাশীবাসিই হবেন। কিন্তু সত্যজিতের পরেশবাবু ককটেল পার্টির নেশা কেটে যেতেই পরের দিন বুঝতে পারেন একটা বড় বিপদে পড়তে চলেছেন। তড়িঘড়ি প্রিয়তোষকে পাথরের ব্যাপারটা জানিয়ে দিয়ে সস্ত্রীক চম্পট দেওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। এরই মাঝে আমরা দেখেছি সত্যজিতের উদ্ভাবনী ক্ষমতা। ছবির শুরুতে পল্টুর মুখ দিয়ে ‘দ্রিঘাংচু’-র ছড়ার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে না রাখলে কাচালুকে (গঙ্গাপদ বসু অভিনীত) পরেশবাবুর বলা সংস্কৃত মন্ত্রের (‘হলদে সবুজ ওরাং ওটাং…’) ব্যাপারটা প্রায়োগিক দিক থেকে ভাঁড়ামো ও কষ্ট-কল্পিত মনে হত। পরশুরামের গল্পে ছড়িয়ে থাকা অভূতপূর্ব পরিস্থিতির বর্ণনাকে অতঃপর টুকরো টুকরো দৃশ্যে প্রকাশিত হতে দেখি ছবিতে। সেই সব দৃশ্যের ফাঁকে অফ-ভয়েজে শুরুর সেই দরদী-কৌতুকপূর্ণ গলা আবার ফিরে এসেছে, “৪ঠা অঘ্রান, ১৩৬৬ সন। কলকাতার ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন।…সোনা অপর্যাপ্ত হবে অতএব সোনার মূল্য আর থাকবে না, এই বিভীষিকা জনসাধারণকে উদ্ভ্রান্ত করে তুলেছিল। সঞ্চিত সোনা বিক্রি করার মরশুম লেগে গিয়েছিল স্বর্ণকারের দোকানে দোকানে। যারা অপেক্ষাকৃত বিত্তশালী তাদের উত্তেজনার কারণ ছিল শেয়ার-বাজারের অবস্থা।”। এই গল্প এই ছবি হিউমারের মোড়কে গরীর মানুষের ধারণাতীত অন্তর্ঘাতের গল্প, যা উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় পরশ পাথরের মতই একটা অলৌকিক ব্যাপার যেন!
সাদা-কালো মোটিফের সর্বশেষ ব্যবহার থানার দৃশ্যে। পরেশবাবুর টাকা ওড়ানোর কোনো প্রকার বদ খেয়াল নেই এবং তিনি কোনো প্রকার নেশাও করেন না, একথা স্মরণ করাতেই থানার ওসি মন্তব্য করেন “মদ? ড্রিংকিং?”। অর্থাৎ ইঙ্গিত থাকে সে দিনের ককটেল পার্টিতে এই ওসি ছিলেন! এরপরেই প্রিয়তোষ ছোকরা পাথরটা হজম করে ফেলে এবং থানার টেবিলে রাখা সাদা(সোনা) বল গুলি পুনরায় কালো(লোহা) বলে পরিণত হয়! পরশুরামে থাকা হিন্দোলা পর্ব এখানে অনেকটা সংবাদের মত। প্রিয়তোষের একতরফা টেলিফোন-কথোপকথনে হিন্দোলা পর্ব আমাদের কাছে সংক্ষেপে বুদ্ধিদীপ্তভাবে পরিবেশিত। হিন্দোলার বাপের লোভ ছিল স্বর্ণগর্ভা প্রিয়তোষে, হিন্দোলারও তাই! পাথর হজম করার কারণ পরশুরাম লিখেছেন তৃপ্ত প্রেমের ফলে প্রিয়তোষের হজম ক্ষমতা বেড়ে যাওয়া! অনবদ্য এই হিউমার সত্যজিৎ পরিহার করেছেন হিন্দোলার বাপের পর্বটি পরিহার করার জন্য। সম্ভবত ছবির দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির কথা ভেবে ও পূর্বেই প্লটের পরিবর্তন করার জন্য এটি তিনি পরিহার করেছিলেন। প্রকারন্তরে ছবির মেজাজের উপযোগী দুটি নতুন চরিত্র নির্মাণ করেছিলেন! মনি শ্রীমানি অভিনীত ‘অ্যামেজিং’ ডাক্তার নন্দী ও পুলিশ ইন্সপেক্টারের চরিত্রে অতুলনীয় হরিধন মুখার্জি।
গ্রুচো মার্ক্স বা চ্যাপলিন-কিটনের কথা সত্যজিৎ অনুষঙ্গে এলেও, ‘পরশ পাথর’-এর সঙ্গে বরং অনেক বেশী তুলনীয় ফরাসি চলচ্চিত্রকার Jacques Tati (১৯০৭-১৯৮২)-র সিচুয়েশনাল কমেডি ছবিগুলি (Monsieur Hulot's Holiday (১৯৫৩), My Uncle (১৯৫৮) ইত্যাদি)। আটপৌরে জীবনে ফ্যান্টাসির উপাদান নিয়ে আসা, মিলান শহর জুড়ে মানুষের উড়ে বেরানো ভিক্টরিও ডিসিকার ‘মিরাকেল ইন মিলান’-এ আমরা দেখেছি । কিন্তু ‘পরশ পাথর’-এ ফ্যান্টাসি বাইরে থেকে আরোপিত নয়, অ্যালকেমিকে স্থান দেওয়া হয়েছে সামাজিক বাস্তবতার মধ্যে সত্যজিতের চিরাচরিত রিয়েলিস্ট স্টাইলকে অবলম্বন করেই। তথাপি ‘পথের পাঁচালি’, ‘অপরাজিত’-র পরিচালকের কাছ থেকে এই ছবি কলকাতার দর্শকের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল । ‘পথের পাঁচালি’ বিপুল সাফল্য পেয়েছিল। ‘অপরাজিত’ একেবারেই চলেনি। ভেনিস থেকে পুরস্কার জিতে আসার পরে সত্যজিৎ ছবিটি রি-রিলিজ করেন, কিন্তু তাতেও চলেনি। ‘পরশ পাথর’ তৈরি হয়েছিল সেই অভাব মিটবে এই আশায়। কিন্তু আশা পূর্ণ হয়েছিল একথা বলা যাবে না, ‘পরশ পাথর’ মোটামুটি চলেছিল।