সমস্ত মূলধারার মার্কিন মিডিয়াতে তারা রাশিয়া এবং পুতিনকে ইউক্রেন আক্রমণ ও দখলের জন্য ক্ষুধার্ত ভিলেন হিসাবে চিত্রিত করেছে। এবং ভারত ও আমেরিকার বেশিরভাগ মানুষ এই সুরেই সুর মেলাচ্ছে কোনোরকম ভাবনাচিন্তা না করেই।
বাজারে মাস্ক মিলবে কোটি কোটি। কিন্তু থিংকিং ক্যাপ আজকাল আর পাওয়া যায়না একেবারেই।
কোনো সন্দেহ নেই যে ভ্লাদিমির পুতিন স্বৈরাচারী শাসক হয়ে উঠেছে সেই চেচনিয়ার দমনপীড়নের পর থেকেই। কোনো সন্দেহ নেই গণতন্ত্র ও ভিন্নমতের প্রতি পুতিনের সহনশীলতা জিরো। এবং তার শাসনামল বড় ধরনের যুদ্ধ ও সহিংসতার একটি নতুন পরিবেশ তৈরি করেছে। আমরা কেউ এই আগ্রাসনের পক্ষে নই।
কিন্তু হিপোক্রিসিটা অন্য জায়গায়। হিপোক্রিসি হলো এই ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বড় বড় মিডিয়ার ভণ্ডামি। এই মিডিয়া -- নিউ ইয়র্ক টাইমস, সিএনএন, ফক্স -- ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস এবং কার্যত সারা বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যা করে এসেছে, তার বিরুদ্ধে একটা কথাও বলেনি, বরং সেই বীভৎস আগ্রাসন ও গণহত্যাকে সমর্থন করে এসেছে প্রকাশ্য বা প্রচ্ছন্নভাবে। এবং তার স্যাটেলাইট সমর্থন পেয়েছে ভারতীয় মিডিয়ার কাছ থেকে।
মোটামুটি ব্যাপারটা হলো, মার্কিন আগ্রাসন হলো "কমিউনিজম এবং সন্ত্রাসবাদের শৃঙ্খল থেকে অন্যান্য দেশের মানুষকে মুক্ত করার জন্য ধর্মযুদ্ধ।" মগজধোলাইটা আমরা সহজেই দেখতে পাই একটু চোখ খুলে রাখলেই। অন্যদিকে রাশিয়া, চীন এবং অন্যান্য পরাশক্তিগুলি যা করে তা হল "আক্রমণ" এবং "দখল করা।" আর, দুশো তিনশো বছর ধরে ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় দেশগুলো ভারত, বাংলা ও সারা পৃথিবীকে যে চুষে ছিবড়ে করে খেয়েছে, তার কথা তো আর কেউ বলেই না।
কারণ, ওই যেমন আমার এক ছাত্রী আজ জানালেন, "স্যার, পুরোনো ইম্পিরিয়ালিজমের কথা ভেবে নতুন এক্সপ্যানশনিজমকে সাপোর্ট করা যায়না।" অলরাইট, খুব ভালো কথা। কিন্তু পুরোনো ইতিহাসের রক্তের দাগ, ক্ষতচিহ্ন কি এই জীবনে ভুলে যাওয়া যাবে? ভিয়েতনামে এখনো এজেন্ট অরেঞ্জের কারণে বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম নিচ্ছে। তাদের মায়েরা কি ভুলতে পারবে সে বীভৎস অত্যাচার?
আমি অনেক বছর ধরে খুব কাছ থেকে দেখেছি বেশিরভাগ আমেরিকান এই মগজধোলাই খেলাটা বুঝতেই পারে না, এবং সেই অজ্ঞানতা ও অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে সমস্ত বড় মিডিয়া হাউসগুলি মার্কিন প্রশাসনের পক্ষে নিরলস প্রচার, ভয়ভীতি এবং পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবেদন তৈরি করে। আমরা রিপাবলিকান এবং ডেমোক্রেটিক প্রশাসনের পিছন থেকে পুতুলনাচ নাচানো যুদ্ধ কর্পোরেশনগুলোর এই খেলা সারাজীবন ধরে দেখে আসছি। মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স অবিশ্বাস্যভাবে শক্তিশালী, এবং মার্কিন রাজনীতিবিদদের তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস নেই। সে বুশ বলুন, ক্লিনটন বলুন, ওবামা বলুন, আজকের বাইডেন বলুন। ট্রাম্পের কথা তো ছেড়েই দিলাম। ও লোকটার কথা যত কম বলা যায়, ততই ভালো।
বেশিরভাগ আমেরিকান জানে না কিভাবে সামরিক শিল্প কমপ্লেক্স এবং তাদের বোয়িং, রকওয়েল, আই বি এম, জেনারেল ইলেকট্রিক, অ্যাপল, সান মাইক্রোসিস্টেম, আজকের গুগল, মাইক্রোসফ্ট, হাজার আর্মস ফ্যাক্টরি, ন্যাশনাল রাইফেল এসোসিয়েশন, তারপর প্রাইভেট প্রিজন ইন্ডাস্ট্রি যাদের স্টক শেয়ার মার্কেটে কেনাবেচা হয়, এবং তাদের বিশাল বিশাল ব্যাঙ্ক, শেয়ার মার্কেট ও কর্পোরেট মিডিয়া একসাথে যুদ্ধু যুদ্ধু খেলা খেলে, এবং আমাদের টুপি পরিয়ে ট্রিলিয়ন ডলার প্রফিট করে।
আমরা কতিপয় মূর্খ যারা এই আমেরিকান-ব্রিটিশ আগ্রাসী রাজনীতির সমালোচনা করি তাদের হয় যে কোনো অর্থপূর্ণ আলোচনা থেকে বাদ দেওয়া হয়, অথবা যদি তাদের কন্ট্রোল করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে তবে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। উদাহরণ -- নোম চমস্কি, হাওয়ার্ড জিন, কর্নেল ওয়েস্ট, এমি গুডম্যান, তারপর জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ জাতীয় সাম্প্রতিক উদাহরণ থেকে যে কেউ শিখতে পারে। আমাদের দেশে পরিবেশবিদ বন্দনা শিবা।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের ওয়েপন্স অফ মাস ডেস্ট্রাকশনের জালি কাহিনী ভুলে যাইনি এখনো আমরা -- যে বুলশিট বুশ সরকার ইরাকে একতরফাভাবে গণহত্যা চালানোর জন্য ব্যবহার করেছিল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কার্যত সমগ্র বিশ্বের প্রতিবাদের বিরুদ্ধে লক্ষ মানুষ হত্যা করেছিল৷ কত আর বলবো? বাংলাদেশের গণহত্যা ও গণধর্ষণ -- সে ঘাতক কিসিঞ্জার এখনো বেঁচে আছে।
আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ থেকে এরকম আরও অনেক উদাহরণ উদ্ধৃত করতে পারি। সেই আমেরিকা ও তাদের রামনাম!
কথা হলো, শুনছে কে?
_____
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।