(১) আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ প্রথম পড়ি এমন এক ধূসর সময়ে, চাইলেও যার স্মৃতি ভোলা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।
মনে পড়ে, সিডনি ল্যুমেটের ‘টুয়েলভ অ্যাংরি ম্যান’ দেখার পরে এমন অভিভূত হয়ে যাই, যে সিদ্ধান্ত নেই সেরা কিছু সিনেমা না দেখেই রেখে দিতে হবে; অপঠিত রেখে দিতে হবে সেরা কিছু বইও, যাতে করে ভবিষ্যতে নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে হলে উপাদানের কমতি না পড়ে। ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ আমি তাই ফেলে রেখেছিলাম কোনো দুঃসময়ের জন্য।
তারও আগে বারবার পড়েও ইলিয়াসের ছোটগল্পের প্রতি মুগ্ধতা আমার কিছুতেই যায় না। বইয়ের দোকানে চোখের ভুরুর গিট্টু হয়ে, দাওয়াত খেতে গিয়ে উৎসবে মেতে, অফিস ফেরতা রিকশাওয়ালার শার্ট থেকে ভেসে আসা গন্ধের মাঝে ইলিয়াস নড়াচড়া করেন তার গোটা জগৎ নিয়ে। ‘বলবো না, নড়বো না, করবো না, সেলফি তুলবো কেবল’ সিনড্রোমে ভুগতে থাকা প্রজন্মের একজন হয়ে অনলাইনের ব্যক্তিগত চিলেকোঠায় ওসমানের মতো স্বমেহন করে নিরুপদ্রব জীবন কাটানো এই আমার দরজায়ও হাড্ডি খিজির হয়ে ইলিয়াস অবিরত হাঁক মারেন।
আমি তাই ইলিয়াসকে জিইয়ে রাখি শেষ না করে। বইয়ের পাতা উল্টাই, এমনকি কিন্ডলের পর্দায়ও পিডিএফ নিয়ে নাড়াচাড়া করি। কিন্তু লোকটার বাকি রচনাবলী একাধিকবার পড়া হয়ে গেলেও ‘খোয়াবনামা’ আমি পড়ি না। এক জাদুকরের থলের শেষ যাদুটাও বেরিয়ে যাবে, সে আশঙ্কায় ‘খোয়াবনামা’য় তাই ধূলো জমে অবিরাম।
তারপর এসে পড়ে সেইদিন, যখন কোনো পহেলা জুলাইয়ের রাতে ঢাকার গুলশানের বিলাসী কোনো রেস্তোরাঁয় অস্ত্র হাতে প্রবেশ করে একদল মানুষ, যখন সবকিছু ভেঙেচুরে যায়।
আমার সেই শহর, চারশো বছরের উত্তরাধিকার নিয়ে যার রাস্তায় পানি জমে যায় সামান্য বৃষ্টিতে; সেই শহর, করিনিস্থিয়ান থামের ওপরে দাঁড়ানো পগোজ স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে যাকে নিয়ে কবিতা পড়েছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত আর আজ যেখানে তিষ্ঠানো যায় না মাইকের চিৎকারে; সেই শহর যেখানে ইন্দুবালা বাইজী নাচতো গভীর রাতের নবাববাড়িতে আর আজ সেখানে রুপসী রাজকন্যরা ঘুরে বেড়ায় উড়ে বেড়ায় রিকশায় আর ফুচকা অথবা চায়ের কাপে; পামুকের ইস্তানবুলের চাইতেও মিস্টিক সেই ঢাকা শহর সেই পহেলা জুলাইতে চোখের পলকে ধ্বসে যায় আমার সামনে।
মানুষ মাত্রেই পলায়নপর। আমি তাই পলায়নপর হয়ে ডুবে যাই সাদার মাঝে কালো অক্ষরে, ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ য়।
(২) স্বপ্নের মতোই, ছুঁয়েও যেন ছোঁয়া যায় না ‘খোয়াবনামা’ র মূল ঘটনাস্রোতকে।
সেই কবে গোরা সেপাইয়ের গুলি খেয়ে ফকির মজনু শাহের দলের মুনসি বয়তুল্লাহ কাৎলাহার বিলের উত্তরের পাকুড় গাছে চড়ে বসলো, তমিজের বাপ যতই ঘাড়ের রগ টানটান করে খোঁজ করুক, সন্ধান তার মেলে না। গন্ধ শোঁকা এড়াতে পারে না কুলসুমও, তমিজের সৎ মা সে, চেরাগ আলি ফকিরের নাতনি, আজও তার গলায় কোনো অব্যাখ্যনীয় উপায়ে নেমে আসে ওই গতাসু গাতকের স্বর। তমিজ চরিত্রটা আবার ঘরের খোয়াবে বিভোর। মাঝির ছেলে সে, কিন্তু কৃষক হবার স্বপ্নে সে চাষ করে হুরমুতুল্লাহর জমিতে, আর বিয়ে করতে চায় সেই বুড়োর ঘ্যাগওয়ালা মেয়ে ফুলজানকে। ফুলজানের অবশ্য আগেও একবার বিয়ে হয়েছে। তার সেই ভূতপূর্ব স্বামী কেরামত এখন হাট-বাজারে গান গায়, আর কুলসুমের কাছ থেকে হাত করতে চায় চেরাগ আলি ফকিরের রেখে যাওয়া ওই ছেঁড়াফাড়া বই, যাতে লেখা আছে বিবিধ খোয়াবের অর্থ। সেই কেরামত আলিকে দিয়ে গান লেখাতে চায় ইসমাইল। স্থানীয় রাজনীতিতে ইসমাইল সক্রিয় মুখ, পাকিস্তান নামে নতুন একটি রাষ্ট্র কায়েমের স্বপ্ন দেখছে এই শিক্ষিত তরুণ। এলাকার অন্যান্য বিত্তবান যারা; সেই কালাম মাঝি, শরাফত মণ্ডল আর মুকুন্দ সাহার রাজনীতি অবশ্য আরও সংকুচিত, তারা চায় এলাকার জমি, বিশেষ করে কাৎলাহার বিল, দখল করতে। উপন্যাস ‘খোয়াবনামা’, এগিয়ে গেছে এদের নিয়েই।
লক্ষ করি, কী আশ্চর্যভাবে মানুষের মুখে মুখে গল্প হয়ে ওঠে পুরাণ। পাকিস্তান আর ভারত রাষ্ট্রের জন্ম নিয়ে ইতিহাস নয়, উপন্যাস পড়ছি বলে নিজেকে স্মরণ করাই বারবার; তবু দেখি, এমনকি ইতিহাসেও এর চেয়ে বিশ্বস্ত চিত্র পাই না কোথাও।
পূর্ব বাংলার শিক্ষিত মুসলমান তরুণদের একটা অংশ যে পাকিস্তান আন্দোলন দ্বারা তাড়িত হয়েছিল, সেই বয়ান উন্মোচনের পাশাপাশি হতদরিদ্র কৃষকদের তেভাগা আন্দোলনের কথাও এসেছে উপন্যাসে। পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি এ অঞ্চলটার অন্ত্যজ মানুষদের যে সমর্থন, সেটা তাদের রাজনীতির জ্ঞান থেকে উৎসারিত নয়; তারা বরং নতুন একটা রাষ্ট্র চেয়েছে হিন্দু জমিদার কি জোতদারদের দৌরাত্ম্য আর উন্নাসিকতার প্রতি বিতৃষ্ণা থেকেই। ধর্মানুভূতির সুড়সুড়িও তাদের চেনা হয়ে ওঠেনি ১৯৪৬ এর আগে; সে ব্যাপারে তাদের উসকে দিয়েছিলো এদিকে মুসলিম লীগ আর ওদিকে কংগ্রেসের নেতাকর্মীরা।
‘খোয়াবনামা’ আমাদের শোনায় ইতিহাসের মূল বয়ানের সাথে ব্যক্তির ক্ষুদ্র স্বপ্নের আখ্যান, ‘খোয়াবনামা’ আমাদের দেখায় চশমা আঁটা সমাজতাত্ত্বিক কি ইতিহাসবেত্তার ম্যাক্রোপলিটিক্সের বিপরীতে ধূলিকণার মতো তুচ্ছ মানুষের জীবনযাপনের ক্লেদের মাইক্রোপলিটিক্স।
৩) কিন্তু প্রতিটি মহৎ উপন্যাসের মতোই, কাহিনি বা বয়ানের বাইরেও 'খোয়াবনামা'র একটা নিজস্ব জগৎ আছে। আর ইলিয়াসের সেই জগৎ এক অনন্য অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড় করায় পাঠককে।
পাঠকের সামনে অবিশেষণসম্ভব, অভূতপূর্ব এক পৃথিবী সৃষ্টি করেন ইলিয়াস। সেখানে রোদের সঙ্গে রোদ হয়ে মিশে কাৎলাহার বিলের বেবাক মাছের হিম শরীরে ওম দিয়ে যায় মুনসি, সেথায় ঘুমের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে তমিজের বাপ গভীর রাতে জাল টেনে তুলতে থাকে গ্রামের পর গ্রাম, সেখানে মাগী মানুষের মতো জমির গায়ে নাঙ্গলের চোদন দেয় তমিজ, পাকুড়গাছ হেঁটে বেড়ায় বিলের উত্তর সিথান বরাবর।
পড়তে পড়তে মনে হয়ঃ ওই জখম হওয়া চাঁদের গতর থেকে ঠিকরে আসা আলো, বিরাট বিপুল কাৎলাহারের জল, পোড়াদহ মেলার একশো বছরের পুরোনো ঘ্রাণ, মুনসির হাতের পাণ্টির প্রতি কৃষকের অগাধ বিশ্বাস; এরা সবাই মিলে যেন আমাদের চিরচেনা পৃথিবীর অন্য একটা মাত্রা উপস্থাপন করে। এ যুগের ক্রিস নোলানের বহু আগেই আমাদের চারপাশের জগতকে স্বপ্নের মতো একটা মাত্রা দিয়ে উপস্থাপন করে ইলিয়াস আমাদের নিয়ে যান স্বপ্নের ভেতরে আরেক স্বপ্নে। ঘুমের মাঝে হেঁটে বেড়ানো তমিজের বাপের মতোই, ইলিয়াসের ইনসেপশনে ঢুকে আমরা দেখতে পাই বস্তুগত দুনিয়ার ভেতরে নানা রকম খোয়াবে ভরপুর আরেক দুনিয়া।
শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে তাই ইলিয়াসের জগৎটাকে পুরো বোঝা যায় না, তাকে বুঝতে হয় হৃদয় দিয়ে, ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলদ্ধি করে। সেই জগতের এক স্তরে যেমন রয়েছে লৌকিক মানুষ, তাদের স্বার্থপরতা, তাদের রিপুচর্চা, তাদের রাজনীতি; অন্য স্তরে রয়েছে অলৌকিকে লোকবিশ্বাস, ব্যাখ্যাতীত ইতিহাস, সর্ববিস্তারী প্রকৃতি। কোনো সীমানা না মেনে পরস্পরের মাঝে মিশে যাওয়া ওই দুই ভিন্ন স্তরকে একত্রে অনুধাবন করতে না পারলে ‘খোয়াবনামা’র পাতায় ডুব মারায় অভিজ্ঞতাটাও হয়ে থাকে অপূর্ণ। উৎসুক যে পাঠক কাজটা করে উঠতে পারে, সে তখন বুঝে যায়, যে সৎ মা কুলসুমের সাথে তমিজের সঙ্গমটাও প্রকৃতপক্ষে স্বপ্নের দুনিয়া আর বস্তুগত জগতের মিলেমিশে যাওয়ার এক প্রতীকী অবতারণা।
বস্তুজগতের সমান্তরালে চোখে-না-দেখা ওই জগতের সহাবস্থান ছাড়াও উদ্দিষ্ট উপন্যাসে আরেকটা ব্যাপার দখল করে অনেকটুকু জমিঃ মিথ, বা পুরাণ।
অতীতের গণসংগ্রামের প্রেরণা কীভাবে ছায়াপাত করে বর্তমানের দুনিয়ায়, ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসে জনতার জেগে ওঠার দৃশ্যে এক দুর্দান্ত প্রতিভামন্ডিত অনুচ্ছেদে সেটার বর্ণনা দিয়েছিলেন ইলিয়াস। কিন্তু ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসে তাকে দেখা যায় আরও উচ্চাভিলাষী, তিনি এখানে রহস্যভেদ করছেন কীভাবে অতীতের সংগ্রামের ইতিহাস সঞ্চারিত হয় একটি অঞ্চলের লোকবিশ্বাসে, আর এক পর্যায়ে তা পরিণত হয় পুরাণে।
স্থানীয় মানুষের হয়ে অত্যাচারী কোনো শাসক কি প্রভুর বিরুদ্ধে লড়াই করে যে বড় নামগুলো; কালক্রমে তারা সেই অঞ্চলে জন্ম দেয় অলৌকিক সব গল্পের। ধর্মবিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ওসব আঞ্চলিক পুরাণে কেউ মহাশক্তিমান মানে ভবানী পাঠককে, কারো কাছে নমস্য হয় ফকির মজনু শাহের সেনাপতি। আবহমান বাংলার প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই তৈরি হয়েছে এমন মিথ, স্থানীয় জীবনাচরণে যাদের প্রভাব সীমাহীন। তবে, বহু ক্ষেত্রেই, যাদের কেন্দ্র করে মিথগুলো গড়ে ওঠে, সেই বিদ্রোহী চরিত্রগুলোর প্রতিবাদমুখর কর্মকান্ডকে অস্বীকার করে এক শ্রেণির লোকে প্রচার করে কেবল অতিরঞ্জিত অলৌকিক গালগল্পকেই। কারণটা সহজেই বোধগম্য: এরা চায় অতীতের বিপ্লব কিংবা প্রতিবাদের ইতিহাস মানুষের মনে যেন কোনো ইন্ধন তৈরি না করে, এরা চায় সাধারণ মানুষের মনে ধর্মের ভয় জিইয়ে রেখে নিজেদের শোষণ প্রক্রিয়া জারি রাখতে।
গণমানুষের তৈরি মিথের বিপরীতেও তাই তৈরি হয় পাল্টা মিথ, অন্য কারো স্বার্থে। মধ্যযুগের ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে যেমন অন্ত্যজ মানুষের দেবী মনসার ব্যক্তিগত বেদনার ইতিহাসটা চেপে গিয়ে তার বিপরীতে প্রচার করা হয় সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষ চাঁদ সওদাগরের বিদ্রোহের ইতিহাস; ঠিক সেভাবেই ‘খোয়াবনামা’য় বৈকুণ্ঠ গিরির বিশ্বাস করা ভবানী পাঠকের কিংবদন্তী অস্বীকার করে জমিদার নায়েব চক্রবর্তী গল্প শোনায় মা দূর্গা আর মহাদেবের। কার বয়ানটা তবে বিশ্বাস্য? ইংরেজ দখলদারদের অনুচর হয়ে থাকা জমিদারের নায়েবের, না ভবানী পাঠক আর মজনু শাহের বিদ্রোহে অংশ নেওয়া ওই ভূমিলগ্ন হয়ে থাকা মানুষদের?
পাঠকের এই প্রশ্নের উত্তরে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস অবশ্য উপন্যাসের প্রথম বাক্যেই একটা ইঙ্গিত দিয়ে রাখেন:
“ পায়ের পাতা কাদায় একটু খানি গেঁথে যেখানে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গলার রগ টানটান করে যতটা পারে উঁচুতে তাকিয়ে গাড় ছাই রঙ্গের মেঘ তাড়াতে তমিজের বাপ কালো কুচকুচে হাত দুটো নাড়ছিলো, ওই জায়গাটা ভালো করে খেয়াল করা দরকার।...”
মাটি সংলগ্ন মানুষের প্রতিনিধি তমিজের বাপ যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে খুঁজে দেখছে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত লোকবিশ্বাস, ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসের পাঠককে যে বিবেচনা করতে হবে সেই অবস্থানটাই, তা কি আর ভেঙে বলার দরকার আছে এরপর?
৪) কিন্তু এই যে রাজনীতির বিবাদ, কিংবা সমাজে বিদ্যমান শ্রেণিদ্বন্দ্বের বয়ান; কোথাও কি সেটা ইলিয়াসের উপন্যাসকে করে তোলে রাজনীতির হাতিয়ার? অন্যভাবে বললে, এই উপন্যাস কি কোনো পক্ষের বিপরীতে দাঁড় করায় অন্য কোনো পক্ষকে?
না, কোনভাবেই না।
একের বিপরীতে অন্য কাউকে দাঁড় করানো যে আমাদের শেষ পর্যন্ত ঠেলে দেয় ২০১৬ সালের পহেলা জুলাইয়ের ঢাকা শহরে, ইলিয়াসের মতো সর্বদ্রষ্টা লেখক তা জানতেন। তিনি কেবল করেছেন সেই কাজটিই, যা করতে পারেন সৎ এবং মহৎ সাহিত্যিকেরাঃ ভাষাহীনকে ভাষা দেওয়া। কালাম মাঝি হোক, কি শরাফত মণ্ডল; কম্যুনিস্ট পার্টির ছোকরারা হোক কিংবা মুসলিম লীগের চ্যালারা; ইলিয়াস ব্যাক্তির ওপর কোনো সত্য আরোপ করেননি। তিনি কেবল সমষ্টির মাঝে ব্যক্তির আকাঙ্খার সাথে সমাজের বৈষম্যের পার্থক্যটাই এঁকে গেছেন। লেখার টেবিলকে ইলিয়াস পল্টনের ময়দান করে তোলেননি। ফলে, উদ্দিষ্ট এই উপন্যাস প্রকৃতপক্ষে বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের এন্টি-থিসিস; এমন কথা যে ইদানিং শুনতে পাই, সাহিত্যের পাঠক হিসেবে তখন আহত না হয়ে আর উপায় থাকে না।
অন্যদিকে, পাঠক সত্যিকার অর্থেই পূর্ববঙ্গের সামগ্রিক জীবনের দেখা পায় ইলিয়াসের এই উপন্যাসে। ইলিয়াস যা-ই বর্ণনা করেন, তাই হয়ে যায় পূর্ব বাংলা। চরিত্রেরা উথাপিত হয় তাদের চিন্তা, আচার, সংস্কার-এর সবটুকু ক্ষুদ্রতা নিয়ে। কাদার গন্ধ, জমির জন্য মায়া, শোল মাছের খলবল আর এক একটা আঞ্চলিক সংলাপে পাঠকের চোখে উত্থিত হয় গোটা জনপদটাই।
বলাই বাহুল্য, রাজনীতি ছাড়া জীবনের সামগ্রিকতা তুলে আনা যায় না যেহেতু, ‘খোয়াবনামা’তেও তাই রাজনীতি আছে। সত্যি বলতে, জনজীবনের অভিজ্ঞতা শুষে নিয়ে ইতিহাস সম্পর্কে যে ইলিয়াস উপলদ্ধিতে পৌঁছেছিলেন, সেটাকে ব্যক্ত করতে রাজনীতির পট সৃষ্টি না করে তার উপায়ও ছিলো না। কিন্তু এক ধারার রাজনীতিক বা লেখকেরা যে ক্রমাগত ইলিয়াসকে একটি নির্দিষ্ট মতবাদের পক্ষের বলে প্রচার করছেন, ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ কখনোই সেই দলগত রাজনীতির ওঠেনি।
‘খোয়াবনামা’র রাজনীতি তাই তুচ্ছ মানুষের স্বপ্নভঙ্গের রাজনীতি। ‘খোয়াবনামা’র রাজনীতি তাই, একদা অখণ্ড কাৎলাহার বিলকে ভারতবর্ষের মতোই টুকরো টুকরো হতে দেখার রাজনীতি।
৫) সতীনাথ ভাদুড়ীর মতোই, ইলিয়াসের প্রায় প্রত্যেকটা রচনাই আগাগোড়া রাজনীতি সচেতন। এমন আরো লেখকও আছেন নিশ্চয়ই, কিন্তু তবু যে ভাদুড়ীজীর কথা সুনির্দিষ্ট করে বলা, তার কারণ মানুষটার হাতে বাংলা উপন্যাসের আঙ্গিকের একটা রুপবদল। উপন্যাসের ইউরোপিয়ান ঘরানা থেকে বেরিয়ে এসে সতীনাথ যে জন্ম দিলেন ‘ঢোঁড়াই-চরিত মানস’ এর মতো ওরকম এক ম্যাগনাম ওপাস, আঙ্গিকের অমন উদ্ভাবনের উদাহরণ বাংলা সাহিত্যে আর কোথায়?
ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’র ক্ষেত্রেও এই কথা খাটে। উপন্যাসের আঙ্গিককে ভাঙবার নামে যত উদ্ভট পরীক্ষা দেখি সচরাচর, তার থেকে নিজেকে সযতনে বাঁচিয়ে ইলিয়াস ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছেন উপন্যাসের অতি চেনা সেই ঘরানাই, কিন্তু আমাদের চেনা ঘরানার সাথে তবু এই উপন্যাসের ছাঁচ মিলতেই চায় না। বরং যত ভেতরে ঢোকা যায় উপন্যাসের, আবিষ্কার করি, কাৎলাহার বিলের ওপর রাজত্ব করা মুনসির মতোই, ইলিয়াস এক অভূতপূর্ব শেকল গলায় বেঁধে পাঠককে আটকে রাখছেন। সেই শেকলটি একই সাথে লৌকিক আর অলৌকিক উপাদানে গড়া, সেই শেকল একই সাথে ব্যক্তির নিগ্রহ আর ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ দিয়ে গড়া।
মনে পড়ছে, ইলিয়াসের প্রভূত প্রশংসা করেও সুনীল গাঙ্গুলি বলেছিলেন, ইলিয়াসের দ্বিতীয় উপন্যাসটি, অর্থাৎ এই খোয়াবনামা, কিছুটা দীর্ঘ ও নীরস। বড় লেখকরাও অনেক সময়ই ঠিক বলেন না, জেনে গেছি।
মিলান কুন্ডেরা যা বলেছিলেন গ্যাবো মার্কেজের শত বর্ষের নিঃসঙ্গতা নিয়ে, আমি কেবল সেই কথাটি খানিক বদলে বলি, ‘খোয়াবনামা’ একটা জারজ উপন্যাস। বাংলা ভাষায় এমনধারা উপন্যাসের সন্ধান পাওয়া যায় না আর, এর কোনো বংশ পরিচয় নেই।