এই গল্পের বেশ কিছু দিক আমার চোখে পড়েছে, যেমন,

এক, স্থানীয় মেক্সিকান মৃত্যু পরবর্তী জীবন-সংক্রান্ত বিশ্বাস, আর ক্যাথলিক বিশ্বাস এই উপন্যাসে মিলে মিশে গেছে। লেখকের হাতে এই মিশ্রণ কেমন রূপ নিয়েছে, তা দেখা বেশ উপভোগ্য।

দুই, এখানকার কোনো চরিত্রই জীবন-মৃত্যুর মধ্যে কোনো একদিকে স্থির হয়ে বাস করে না। আমাদের কথক হুয়ান প্রেসিয়াদোর সঙ্গে বহু মৃত চরিত্রের সাক্ষাৎ তো হয়ই, তার সাথে আমরা দেখি, আরও অনেক চরিত্রই শহর বেঁচে থাকার সময়ও মৃত চরিত্রদের দেখা পায়, তাদের সাথে কথা বলে। শুধু তাই নয়, পেদ্রো পারামো বা সুসানা সান হুয়ান কাহিনীর অনেক জায়গাতেই এতটাই নিষ্ক্রিয়, এতটাই নিস্পৃহ, যে মনে হয় তারা একই সাথে মৃত এবং জীবিত। এইভাবে জীবন ও মৃত্যুর superposition -এ বাস করা চরিত্রেরা জীবন ও মৃত্যুর ভিতরের স্পষ্ট সীমারেখাকে আরও অস্পষ্ট করে তোলে। তাহলে, এখানে মানুষ জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে দুইভাবে বাস করে- মৃতরা জীবন্ত হয়ে এসে দেখা দেয় বারংবার- আর মানুষ জীবন্মৃত অবস্থায় জড়বৎ বাস করতে থাকে।

তিন, গৃহযুদ্ধ অনেক সময় ক্ষমতাবানেরা হাইজ্যাক করে নেয়। তারপর তা দিশা হারায় অনেক জায়গায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর পটভূমি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের “চিলেকোঠার সেপাই”-এ কীভাবে বর্ণিত হয়েছিল, তা মনে পড়ে যায়। ইতিহাসেও আমরা এই ঘটনা দেখেছি অনেকবার। এখানে সেই সত্যি, স্বাভাবিক ঘটনার প্রকাশ ঘটে লাতিন আমেরিকান জাদু বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে। ব্যাপারটা কাব্যিক বইকী! সূক্ষ দাগের irony!

চার, এই কোমালা গঞ্জ আর পেদ্রো পারামো যেন একই জিনিসের দুই রূপ। তার প্রতাপ, স্বাস্থ্যই শহরের স্বাস্থ্য। পেদ্রোর মারা যাওয়াই তার গঞ্জের মারা যাওয়া।

পাঁচ, এই গঞ্জের ক্যাথলিক পাদ্রী ফাদার রেন্তেরিয়ার মধ্যে দিয়ে ঔপন্যাসিক অনেক কিছুই বলেছেন। পাঠকদের দার্শনিক প্রশ্নের সামনে ফেলেছেন। তিনি বহু মানুষের শেষকৃত্য করেন না, কারণ তারা টাকা দিতে অক্ষম। কঠিন পরিস্থিতিতে আত্মহত্যা করা নারীকে তিনি মরণোত্তর ক্ষমা করেন না, কিন্তু অতিলম্পট ধর্ষককে তিনি ক্ষমা করেন গীর্জার জন্য মোহরের থলির বিনিময়ে। শেষে, তিনি জীবিত অবস্থায় অন্য পাদ্রীর কাছে ক্ষমা চাইলে সেই পাদ্রী তাঁকে absolution দেননা। কারণ তাঁর নিজের পাপই ক্ষমার অযোগ্য। তিনি নিজে অত্যাচারী, লোভী নন, কিন্তু তাও তাঁর এবং গীর্জার সাহায্যেই পেদ্রো পারামোর মত কেউ অত ভূমি ও ক্ষমতার অধিকারী হয়। শেষে তিনি গৃহযুদ্ধে লড়তে যান। গঞ্জে আর কারও ধর্মীয় শেষকৃত্য হয়না। সমস্ত মৃত আত্মা বিনা শেষকৃত্যে অতৃপ্ত থাকে, স্থান ও কালকে প্রভাবিত করতে থাকে বারংবার… (ক্রমশ)