মেঘ-রোদ্দুরের ঘোমটা টেনে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা ভুটান পাহাড়ের আকুতির আকাঙ্ক্ষায় যেন তাদের ছোঁওয়া যায়। বর্ষার উদ্দাম উন্মত্ততায় খরস্রোতা তোর্সা আজও তাঁদের বহির্বিশ্ব থেকে নির্বাসিত করে রাখে। জঙ্গল-পাহাড়ের নিঃসীম আস্কারাতেই তাঁদের নিত্য বেঁচে থাকা। আদতে তাঁরা বঙ্গীয়, তবু বাঙালি নহেন। যদিও তাঁরা ‘প্রাচীন আদিবাসী জনজাতি’, তবু বহুজাতিক সহাবস্থানের বাধ্যবাধকতায় তাঁদের জাতিসত্তা চরম বিপন্নতায় আক্রান্ত। তাঁরা সংখ্যায় আজ সাকুল্যে দুহাজারের কিছু কম। আলোছায়াময় জঙ্গলের আবডালে তাঁরা আদিম হয়েও যেন সর্বহারা। সব হারানোর মাঝেও তবু তো টিমটিম করে টিকে থাকা! ক্ষয়িষ্ণু জাতিসত্তাকে আগলে রাখতে রাখতে কোনমতে বেঁচে থাকা!
পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে তোর্সা নদীর পশ্চিম প্রান্তে পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলার মাদারিহাট শহর থেকে পঁচিশ কিলোমিটার উত্তরে জল-জঙ্গল-নদী পেরিয়ে ভুটান পাহাড়ের গা ঘেঁসে ভারতের ‘আদিম উপজাতি’-র তকমা পাওয়া টোটো আদিবাসী জনজাতিদের ছোট্ট জনপদ ‘টোটোপাড়া’। মাদারিহাট থেকে উত্তরের দিকে পথ চলতে চলতে জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের লঙ্কাপাড়া রেঞ্জের বুক চিরে এগিয়ে যেতে যেতে তোর্সাসহ আরও কয়েকটি পাহাড়ি নদীর নুড়ি-পাথর বিছানো রুপোলি বিছানা পার হয়ে তবে পৌঁছতে হয় পাহাড়-জঙ্গল আবৃত টোটোপাড়ায়। যেন সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে তাঁদের বসতবাড়ি! নদী বিছানা জলে ভরে গেলে টোটোপাড়ায় যাতায়াত করার জন্য আজও অন্তহীন অপেক্ষা ছাড়া কোন বিকল্প পথ খোলা নেই। এই টোটোপাড়া আদতে টোটো আদিবাসীদের মাতৃভূমি হলেও বর্তমান এখানে টোটোদের সঙ্গে বাঙালি রাজবংশী, নেপালি, মুসলমান, তামাং, বিহারী মানুষদের গরিষ্ঠ সহাবস্থান। টোটোরা ইন্দো-ভুটানি আদিম জনজাতি এবং আদতে মঙ্গলীয় উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত। টোটোরা হিন্দু ধর্মীয় হলেও, তাঁদের পূজিত দেবতা ভিন্ন। টোটোদের ধর্মীয় আচারও সাধারণ হিন্দুদের থেকে আলাদা। প্রতি বছর জুলাই মাসে পূজিত দেবতার মন্দিরে টোটোদের ধর্মীয় উৎসব ‘মাঙ্কা’ জাতিগত প্রথা মেনে উদযাপিত হয়। হালফিলে বহির্জগতের ছোঁওয়ায় বছরের বাকি দিনগুলিতে আধুনিক পোশাক পরিধান করলেও, উৎসবের দিনগুলিতে টোটোরা তাঁদের নিজস্ব চিরাচরিত পোশাকেই আনন্দে মেতে ওঠেন। টোটো জনজাতির নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি আছে। সেইসঙ্গে পায়ে পায়ে জড়িয়ে রয়েছে বিপুল সমস্যা ও বিপন্নতার কণ্টকময় জাল।
টোটোপাড়ায় সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং একটি উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়াও মিশনারি সংস্থার দ্বারা পরিচালিত একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও আছে। এইসব বিদ্যালয়ে বাংলা ও ইংরাজি মাধ্যমে পঠনপাঠন হয়ে থাকে। টোটো মানুষদের মধ্যে কথিত ভাষা হিসেবে ‘টোটো ভাষা’র প্রচলন থাকলেও, এতদিন পর্যন্ত এই ভাষার কোন লিপিই ছিল না। বছর পাঁচেক আগে স্থানীয় ধুনিরাম টোটোর নিরলস উদ্যোগে এবং অস্ট্রেলিয় স্বজন টবি অ্যান্ডারসনের সহৃদয় সহায়তায় টোটো ভাষার লিপি প্রস্তুত করা সম্ভব হয়েছে। যার ফলস্বরূপ, চারেক দুয়েক আগে টোটো মানুষজনদের উদ্যোগে ‘চিত্তরঞ্জন টোটো মেমোরিয়াল এডুকেশন সেন্টার’ নামক একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে, যেখানে কেবলমাত্র টোটো ভাষার মাধ্যমেই পঠনপাঠনের ব্যবস্থা করা গেছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও খোলা হয়েছে টোটোপাড়ায়।
টোটো উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষজনের সঙ্গে ভুটানের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। প্রতি মঙ্গলবার টোটোপাড়ায় হাট বসে। দোকানিরা পসরা সাজিয়ে সার সার দিয়ে বসে পড়েন টোটোপাড়ার গৌরবহীন হাটে। অনতিদূরের ভুটান থেকেও ক্রেতারা হাটে আসেন। রোজগারের হাতছানিতে টোটোরাও নিত্যদিন ছুটে যান ভুটানে। কেউ যান এলাচ ছাড়ানোর কাজে, কেউ বা সুপারি ছাড়ানোর কাজে, কেউ কেউ আবার অন্যান্য দিনমজুরের কাজের খোঁজে। ভুটান থেকে দিনে মাথাপিছু ৩০০ টাকার মতো আয় হয়। এই পরিপূরক নির্ভরশীলতার মাধ্যমেই নিবিড় সখ্য গড়ে উঠেছে টোটো আদিবাসী জনজাতি এবং সংলগ্ন ভুটানি মানুষজনের মধ্যে।
ভারতবর্ষের অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মতো টোটোরা কিন্তু ততটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি তাঁদের জনগোষ্ঠীকে। প্রাপ্য সরকারি সুযোগ সুবিধা আদায়ের ক্ষেত্রেও টোটোরা বেশ পিছিয়ে। টোটোপাড়ায় একটি সরকারি হাসপাতাল এবং একটি গ্রামীণ ব্যাংকের শাখা রয়েছে। বর্তমানে প্রায় দুহাজারের কাছাকাছি তপশিলি উপজাতিভুক্ত টোটোদের মধ্যে মাত্র ১৫/১৬ জন পুরুষ এবং একজন মহিলা সরকারি চাকুরে। তাঁদের নিজভূমে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মানুষদের মিশ্র সংস্কৃতির দাপটে তাঁরা অটুট রাখতে পারেনি তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতিকেও। বহির্জগতের জমকালো আবেদনের ছোঁয়ায় টোটোরা তাঁদের চিরাচরিত পোশাক পরিত্যাগেও প্রায় বাধ্য হয়েছে। টোটোপাড়ায় গেলে এখন রীতিমতো খুঁজে নিতে হয় টোটোদের নিজস্ব চিরাচরিত গুটিকয়েক ঘরবাড়ি। বাংলা এবং নেপালি ভাষার প্রবল আধিপত্যে টোটোপাড়ার পথেঘাটে, হাটেবাজারে, অলিতেগলিতে এখন অনর্গল বাংলা এবং নেপালি কথাই বেশি শোনা যায়। বিশ্বায়নের সূর্যালোকের প্রবল বিচ্ছুরণে টোটোদের চিরাচরিত জাতিসত্তা আজ প্রকৃত অর্থেই চরম সংকটে।
টোটোরা ১৯৫৬ সালে ভারত সরকার প্রদত্ত ‘তপশিলি উপজাতি’র এবং ১৯৭৫ সালে ‘আদিম উপজাতি’র তকমা পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু এতদিনে তাঁদের হারাতে হয়েছে অনেক কিছুই ... ব্যবহারিক জীবনে তাঁদের আদিবাসী জাতিসত্তা, তাঁদের নিজস্ব পোশাক পরিচ্ছদ, তাঁদের চিরাচরিত বাড়ির গড়ন, তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি। টোটোপাড়ায় এই সবই এখন লুপ্তপ্রায়। টোটো ভাষার লিপি আবিষ্কারের ফলস্বরূপ বিশ্বায়নের এই মধ্য গগনেও তাঁদের ভাষাটা এখনও টিমটিম করে টিকে আছে। টোটোপাড়া বাজারের দোরগোড়ায় জগন বিহারীর চায়ের দোকানের কাঠের বেঞ্চে বসে বিড়িতে সুখটান দিতে দিতে ক্রমশ হারিয়ে ফেলা টোটো জাতিসত্তা নিয়ে হাহুতাশের স্রোতে ইদানিং আর তেমন বন্যার প্লাবন আসে না! টোটোরা চালিয়ে যাচ্ছে প্রবল লড়াই... অন্তরে, বাহিরে। এমনকি এই করোনা উন্মত্ত পৃথিবীতে কোনমতে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদেও। পর্যাপ্ত না হলেও, ‘কার্যত লক ডাউনের’ দিনগুলিতে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার মতো সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত খাবার মিলছে রেশন দোকানের মাধ্যমে।
অশীতিপর সুদাম টোটো দাওয়ায় বসে ভেজা মনে তা দেন। তাঁর কাঁচা বাঁশের মতো ছিপছিপে শরীরে আজ ব্যাধি এসে বাসা বেঁধেছে। শ্রাবণের মেঘের মতো কালো কুচকুচে চুলে ধরেছে পাক। তাঁর জীর্ণ পর্ণকুটিরের একচিলতে জানালা দিয়ে দিগন্তব্যাপী অন্তর্দৃষ্টি মেলে নাগাড়ে স্মৃতিরোমন্থন করা সুদাম টোটো যেন টোটোপাড়ার ‘অতীত ভেজা কাক’। স্মৃতিকাতরতায় ন্যুব্জ সুদাম, টোটোদের কথা বলে চলেন। অনর্গল বলতে থাকেন তাঁদের মাঙ্কা উৎসবের স্বপ্নমধুর দিনগুলির কথা, রাতগুলির কথা। বলতে বলতে বৃদ্ধের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কেঁপে ওঠে গলার স্বর। চোখের কোণে কী যেন চিকচিক করে জ্বলে! অজান্তেই যৌবনের মাঙ্কা উৎসবের কলরবে কখন যেন সুদাম টোটো হারিয়ে ফেলেন নিজেকে। চামেলি টোটোর কথা মনে পড়ে। সুদামের অশীতিপর শরীর-মনে হঠাৎ যেন যৌবন চলকে ওঠে উৎসব-আবহের স্বপ্নতরণী বেয়ে। জীবনভর তিনি যেন মনের মণিকোঠায় আগলে রেখে আসছেন সেই বর্ষণমুখর উচ্ছল রাতের ধিকি ধিকি আঁচটা। তোর্সা নদীর ওপারে গা ছমছমে জঙ্গলে যেদিন চামেলির নরম হাতটা তিনি বুকে চেপে ধরেছিলেন। বর্ষার উন্মত্ততার স্পর্ধায় তোর্সাও সেদিন উত্তেজনায় ফুঁসছিল। সেই রাতে আর ঘরে ফেরা হয়নি সুদাম আর চামেলি টোটোর। সমস্ত রাত জেগে দুজনে আগলে রেখেছিলেন দুজনকে... যেন “পালকে পালক লাগে, আজ দিন আগুনে কাটুক”। বৃষ্টির লাগামহীন উচ্ছ্বাস আর উদ্দাম কলতানকে সাক্ষী রেখে সব কথা বলা হয়ে গিয়েছিল অজানা নীরব ভাষায়! কথা নিয়ে কথা দিয়েছিলন চামেলিও। তারপর ৩৭-টা বছর ধরে অগণিত বৃষ্টিস্নাত ‘সঘন গহন রাত্রি’ পার হয়ে গেছে। প্রতীক্ষার অন্তহীন প্রহর জাগিয়ে রেখে আজ শীতঘুম এসে বার্ধক্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সুদামকে। ধিকি ধিকি একাকিত্বের আঁচ ইদানিং যেন স্থবির করে ফেলেছে অশীতিপর সুদাম টোটোর সকল স্নায়ুতন্ত্রগুলো। তবু মাঙ্কা উৎসব এলে সুদাম টোটো শিয়রের জানালা খুলে রাখেন। রাতভর বৃষ্টির এলোমেলো কলতানে যেন কিছুতেই আর ঘোর কাটে না। গোটা রাত সুদাম টোটো জানালায় চোখ মেলে কার চোখে যেন চোখ রাখেন। খরস্রোতা তোর্সা পাড়ের জঙ্গল সারা রাতভর ঢুঁড়ে ফেলে। মিষ্টি সুরেলা স্বরের প্রতিধ্বনিতে যেন আপ্লুত হয়ে পড়ে। দুচোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে এসে মিশে যায় বৃষ্টি মুখর তোর্সার উন্মাদনার খরস্রোতে। নাহ, “কেউ কথা রাখেনি, কেউ কথা রাখে না”!
অসাধারণ লেখা। অনেকবার পড়লুম, আবারও পড়ব। কিন্তু কিছু যদি না মনে করেন তাহলে একটা মন্তব্য করব। রাগ করবেন না প্লীজ।
আপনার লেখার এই ছোট্ট অংশটা উদ্ধৃত করছি। "এই টোটোপাড়া আদতে টোটো আদিবাসীদের মাতৃভূমি হলেও বর্তমান এখানে টোটোদের সঙ্গে বাঙালী রাজবংশী, নেপালি, মুসলমান, তামাং বিহারী মানুষদের গরিষ্ঠ সহাবস্থান। "
এই মুসলমান কারা? এদের কি অন্য কোন identity নেই? ধর্মীয় পরিচয় ছাড়া আর পরিচয়ই নেই এদের? সময়টা খুব খারাপ চলছে। আমার মনে হয় এখন একদল মানুষ চাইছে মানুষকে শুধুমাত্র তার ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে বেধে রাখতে। আমরা কি সেই ফাঁদে পা দেব?
এই বিলুপ্ত প্রায় আদিবাসী গোষ্ঠীকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
আরও গবেষণা হোক, রক্ষা হোক সব জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি
#P2BI
মাননীয় শেখর নাথ মুখোপাধ্যায় মহাশয়,
আপনি যথার্থই বলেছেন। অন্যদের ক্ষেত্রে ধর্মীয় পরিচিতি না দিলেও,মুসলমানদের ক্ষেত্রে তা বলা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা মোটেও সমীচীন নয়। এই বিষয়ে আমার আরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন ছিল।
আপনার মূল্যবান মতামতের জন্য অকুণ্ঠ ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন। শুভকামনা অফুরান।
ধন্যবাদান্তে
ডঃ দেবর্ষি ভট্টাচার্য
মাননীয় বিপ্লব রহমান মহাশয়
আপনার মূল্যবান মতামতের জন্য অকুণ্ঠ ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন। শুভকামনা অফুরান।
ধন্যবাদান্তে
ডঃ দেবর্ষি ভট্টাচার্য