আমেরিকার যত জায়গায় উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের ব্যবস্থা আছে - জর্জিয়া এর অন্যতম প্রধান রাজ্য। তার মধ্যে প্রথম এসে ক্লার্কস্টন শহর হল অধিকাংশের প্রাথমিক থাকার জায়গা। রিসেটেলমেন্ট এজেন্সি থেকে লটারিতে নাম ওঠার পরও অনেক পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে পাশ করে তবে অনুমতি পায়। এদেশে আসার। ৯/১১ এর আগে এত কঠিন ছিল না নাকি। প্রায় ৪০টি দেশের মানুষ এবং ৬০ টিরও বেশি ভাষায় কথা বলে ক্লার্কস্টন। কত ধরণের পোশাক, কতরকমের কলতান - নানা মুখ, নানা বলিরেখার বিবিধের মাঝে মিলন এক জায়গায়। হারানোর যন্ত্রণার ছাপ। বড় ছোট সবাই।
আমরা উদ্বাস্তুদের অস্তিত্ব নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগি, আমি ‘আমরা’ই বলবো, কারণ যারা এরকম ভাবে আমি তাদের সমাজেরই অংশ, যারা ভাবি আমার ট্যাক্সের পয়সা “ওরা” ভোগ করছে, বছর বছর বাচ্চা জন্ম দিয়ে গোষ্ঠী বড় করছে - তারা খুব সুবিধাজনক ভাবে এই কথাটা ভুলে যাই, যে যারা বংশানুক্রমে, দশকের পর দশক ধরে জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে, কখনো জঙ্গলে, কখনো ভাঙা ডিঙি নৌকোয়, কখনো বে-আব্রু রিফিউজি ক্যাম্পে জীবন কাটিয়ে এসেছে, তাদের জীবন আর "আমাদের" জীবনে অনেক তফাত আছে। আমাদের আধুনিকতা, আমাদের সচেতনতা, আমাদের মূল্যবোধের অনেকটাই "ওদের" জন্য লাক্সারি, কারণ "ওরা" জানে যে কোন মুহূর্তে ওরা বা ওদের প্রিয়জন মরে যেতে পারে। ওদের মরে যাওয়ার মধ্যে রোমান্টিসিজম নেই, জীবনেও খুব কম।
“সর্বহারা” শব্দটি কত হাহাকার জড়িত করে তৈরি - সেটা দেশহারা মানুষ দেখলে কিছুটা বোধহয় বুঝতে পারি। কেউ কারো দয়া নিয়ে বাঁচতে চায় না। প্রতি মুহূর্তে দয়া নিতে বাধ্য হলে, দয়াকে অস্বীকার করতে হলে যে ট্রমা হয় তা আমাদের পক্ষে বোঝা অসম্ভব।
সবসময়ে নিরাপত্তার অভাব। অথচ আমার অরগানাইজেশনের মত ছোট বড় ২১টি অরগানাইজেশন কাজ করে। একজনের কষ্টের খবর পেলে সব অরগানাইজেশন ঝাঁপিয়ে পড়ি। কোন অস্বাভাবিক ঘটনা যে কোন অরগানাইজেশনের কানে এলেই আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের ঐ কেস নিয়ে কাজ করার অনুমতি আছে কিনা।
উদাহরণস্বরূপ আমার অরগানাইজেশন কোন ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স নিয়ে কাজ করতে পারবে না। “সেভার”, “ক্রিসক্রস” (নাম পাল্টে দিলাম) - ওরা কাজ করে। কোথাও ওদের অফিসের ঠিকানা পাবেন না। ওদের ফোন নম্বর জেনেরিক। কোন কেস ম্যানেজার বা অফিস কর্মীর কাছে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। কিন্তু কমিউনিটিতে সবাই ছায়ার মত ঘোরে। একটি খবর পেলেই প্রসেস শুরু হতে যায়। ক্লায়েন্টদের গোপনীয়তা যেন কোনভাবেই কম্প্রোমাইজড না হয় তার জন্যে ঐ অর্গানাইজেশনগুলির কর্মীরা নিজেদের লোকচক্ষুর আড়ালে রাখেন আশ্চর্য উপায়ে। কিন্তু ওঁদের ক্লায়েন্টরা বেশিরভাগই নিজে থেকে বাইরে এসে সাহায্য চাইতে পারেন না, তাই অদ্ভুতরকম দক্ষ নেটওয়ার্ক তৈরি রেখে ওঁরা পৌঁছে যান যেখানে দরকার।
আমার অরগানাইজেশনের প্রধান কাজ হল যারা এদেশে ০-৫ বছরের সময়সীমার মধ্যে আছে, তাদের নিয়ে। যেদিন আমেরিকার মাটিতে ৫ বছর পূর্ণ হবে - অনেক প্রকল্প ওদের জন্য বন্ধ। এর মানে, আমাদের লক্ষ্য হল ঐ ৫ বছরের সময়সীমার মধ্যে এদেশে স্বনির্ভর হতে সাহায্য করা।
আবার ৫ বছরের সীমা পেরোনোর পরও কাজ করার জন্য কয়েকটা প্রোগ্রাম আছে।
আমি যেমন রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত, সেরকম আমার সোমালিয়ান, নেপালি, ভুটান, ঘানা, ইরিত্রিয়ান, আফগানি, পাকিস্তানি ক্লায়েন্টও আছে। অনেক ভাষা জানি না - তবুও কথা বলি! সামনাসামনি, ভিডিও কল - সবই হয়, কোথাও মানুষে মানুষে একটা কমন ভাষা আছেই বোধহয়!
আমি যে কমিউনিটিতে কাজ করি - আমার গাড়ি কমিউনিটিতে ঢুকলেই খবর চলে যায় নানা ঘরে। কোর্ট ইয়ার্ডে বসি - খালি পার্কিং লটে বসি।
হাহা হিহি চলে। দু:খের কথাও চলে। অথচ কোন কমন ল্যাঙ্গুয়েজ নেই। সেই সমতা আনারই চেষ্টা আমাদের। একে অন্যের সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার স্বভাব/অভ্যাস/ বিশ্বাস তৈরি করা।
এই ১.৪ বর্গমাইলের ক্লার্কস্টন শহরের মধ্যে কত কিছু যে ঘটছে প্রতি মুহূর্তে - সদা ত্রস্ত পুলিশ থেকে ডাক্তার, সমাজসেবী, হেলথ প্রমোটার - সব্বাই। এ দেশ ব্যক্তি স্বাধীনতার দেশ। নানা ভাবে রোজ প্রমাণ করে যাচ্ছে।
আমার অভিজ্ঞতা এর কত ছোট ভগ্নাংশ - আমি নিজেও জানি না - আর সারাদিনের কত ঘটনার কত মিলি ভগ্নাংশ আমার কানে আসে - সেটাও জানি না।
আবার সবই যে সরল গল্প - সোজা রাস্তাই যে যায় - তা ও নয়। কমিউনিটিরই এক নেতা, অন্য একটি নন প্রফিটে কাজ করে, দোভাষী এবং অন্যান্য লিয়াজঁর কাজ। পুরো গোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র অফিস কাজে চাকুরিরত। ফর্মাল ফিটেড কেতাদুরস্ত, বুকে আমেরিকার পতাকাওয়ালা কলম। আমার কমিউনিটিতে ঢোকার খবর ওর ভাল লাগেনি।
আমার আগে এই কমিউনিটিতে কেউ মহিলামহলে প্রবেশ করেনি। কিছু মহিলা সোশাল ওয়ার্কার যদিও কাজ করে, কেউ কারো ভাষা বোঝে না। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে, আকার ইঙ্গিতে কাজ চলছিল।
আমি মেয়েদের/বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকে গেছি - অনেক পরিবারে পুরুষ সদস্যই সেটা পছন্দ করেনি। তার মধ্যে নানান রকম ইনসিকিউরিটি, ধর্ম ও সংস্কৃতির বাধা, অনেক কিছুই হয়তো আছে। আমাদের জাজমেন্টাল হলে চলে না।
তো, অল্প বয়সে বিয়ে, বেশি বাচ্চা - এইসব নিয়ে কথা হচ্ছিল।
ফোনালাপ
- আপু, হামিদার মেয়ের বিয়ে। দাওয়াত পাইস?
- না তো! হামিদা’র মেয়ে? ওর বিয়ে? হাই স্কুল তো শেষ হয়নি?
- আপু, ভাল দাম পাইসে।
- দাম পাইসে মানে???
- আপু, ওর মাইয়ারে বিয়ে করার জন্য ৬০ হাজার ডলার দিতেও রাজি আসে। মেয়েরে বাড়িতে রাখা মুশকিল হইতাসে। একটা ভাল ছেলে পাইসে। ২৯০০০ ডলার দিব আর বিয়ার পর হামিদা’র বাড়িও থাকব।
কী করব আমি এ খবর পেয়ে? আগেই বলেছি যে আমার কোন প্রশিক্ষণ নেই, অভিজ্ঞতা নেই।
অফিসে গিয়ে প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে সবাইকে বললাম। আমি ছাড়া সবাই শান্ত।
জামাইকান কলিগ বলল “ইউ ক্যান্ট ডু এনিথিং”
আমার বস্ ওকে থামিয়ে দিয়ে আমাকে বলল “ডোন্ট ক্রস ইওর বাউন্ডারি। বাট ইফ ইউ আর কমফর্টেবল দেন টক টু হামিদা অ্যান্ড হার ডটার।”
হামিদা আর আমি এক বয়সী।
হামিদার বাড়িতে খুশি উপচে পড়ছে। ওর বর এ দেশে এসেছে ৮ বছর আগে। হামিদা এসেছে সাত ছেলে আর একমাত্র মেয়েকে নিয়ে ২ বছর আগে।
এই ঘটনা ২০১৯ এর সেপ্টেম্বর ।
দূর দূর থেকে আত্মীয় চলে আসছে।
- হামিদা, তোমার মেয়ের ইচ্ছে আছে এই বিয়েতে?
- কী কন্ আপু! দেখেন না কী খুশি? লাল অপ্সরা হইয়া ঘুরতাসে।
- এত এত ওয়ার্কশপে নিয়ে যাই, এত ভাল ভাল কথা শুনে কী শিখলে তাহলে?
আপনাদের বোঝাতে পারব না - আমি কয়েক মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পারলাম কিছু অদৃশ্য ক্ষমতা মা-মেয়ে আর আমার চারদিকে ঘুরছে। কোন পুরুষ আমাদের সামনে ছিল না। কিন্তু ওদের প্রতাপ আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল।
হামিদার মেয়ে আর আমি। ওর ইংরেজি উচ্চারণ এদেশে জন্মানো টিনএজারদের মতই। দু বছর হল এসেছে।
- তুমি বিয়ে করতে চাইছ? তোমার ইচ্ছে আছে?
-হ্যাঁ।
- সত্যি বলছ?
- হ্যাঁ।
- তোমার কলেজ যেতে ইচ্ছে করবে না? চাকরি করতে চাও না? তুমি একবার পাশ করলেই তোমার চাকরি হবে। তোমাদের গোষ্ঠী থেকে তোমরা মোট আটজন হাইস্কুল শেষ করতে যাচ্ছ। এত ভাল ইংরেজি বলছ। এই কমিউনিটিতে তোমাদের দরকার।
- আমি কেন চাকরি করব? আমার সাত ভাই আছে। (এর মধ্যে ৪ টি ভাই কিন্তু ওর ছোট তো বটেই, দুজন আবার এলিমেন্টারিতে যায়।) আমার বাবা আছে। আমার বর হবে। আমি কেন চাকরি করব?
একজন ১৯ বছরের মেয়ে আমেরিকান ইংরেজি উচ্চারণে এবং বলিউড সুন্দরী নায়িকা কনের সাজে বসে আমাকে কথাগুলো বলছে।
কী করতে পারবেন আপনি? ঐ মুহূর্তে আমি প্রথম বুঝতে পারলাম “ট্রাই টু মেক আ বাউন্ডারি” বলতে কী বোঝায়। আমার জামাইকান রেফ্যুজি কলিগ যে ভাবলেশহীন সুরে বলেছিল “ইউ ক্যান্ট ডু এনিথিং” - বুঝলাম।
হঠাৎ হামিদার বর এসে ওর গালে ঠাস করে চড় মেরে বলল “তোর কি এখন এখানে গল্প করার সময়! কাল সকালে কাবিলনামা। কত মেহমান আইতাসে। যা বাইরে! চুলাত কী হইতাসে দেখ।
হামিদা আমার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে হেসে বলল “আপু খাইয়া যাইবা কিন্তু।”
ওর বর আমার সঙ্গে একদম স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে শুরু করল যেন এর আগের মুহূর্তর কোন অস্তিত্ব ছিল না।
কী করা উচিত ছিল আমার?
পুলিশকে ফোন করা?
ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স রেসকিউ টোল ফ্রি নম্বরে ফোন? অন্য অরগানাইজেশন এর সঙ্গে যোগাযোগ? আমি কোনটাই করলাম না।
সমাজে শিক্ষা-অশিক্ষা-কুশিক্ষা দূর করা কোন এক মুহূর্তের খেলা নয়। ঘেন্না, অশ্রদ্ধা, নিন্দামন্দ না করে প্রথমে ঘটনাক্রম ভেবে না নিলে হিতে বিপরীত।
আমি পুলিশ ডাকতে পারতাম। কী হতো এরপর? আমার কোন নিয়ন্ত্রণ থাকত কি? হামিদা আর ওর মেয়েকে মুহূর্তের মধ্য শেল্টারে কি নিয়ে যাবে? তার চেয়ে বড় কথা- ও কী চায় ?
ওরা এর বাইরে কখনো ভাবেনি। ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়। সবাই আবার সেটা মানতেও পারে না। মানার ক্ষমতাও থাকে না। সহজভাবে দেখলে মনে হয় - আমেরিকায় আসতে পেরেছে, হাইস্কুলে যাচ্ছে, ইংরেজি বলছে - প্রথম জেনারেশন শিক্ষার সন্ধান পেয়েছে। আমার মূল্যবোধে হামিদার পারিপার্শ্বিককে আমি বিচার করতে পারি না। তথাকথিত উন্নততর সমাজেও প্রথম প্রজন্মের আলোকপ্রাপ্তদের নানান পরিবর্তন, চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
আমার মা কাজ করতো সমাজকল্যাণ দপ্তরে, মা'র কাজের বড় অংশ ছিল ত্রিপুরার গ্রামে পাহাড়ে ফিল্ড ওয়ার্ক, মায়েদের, শিশুদের সুষ্ঠু জীবনের দিকে নজর রাখা। মা'র কাছে খুব কম হলেও শুনেছি কাজের চ্যালেঞ্জ, মেয়েদের ক্ষমতায়নে নানান রকম বাধা - তখন ভাবতাম, সরকারি লোকেদের কত ক্ষমতা, কেন কেউ কিছু করে না। আজ এত বছর পর দেখি প্রথম বিশ্বের শীর্ষে থাকা দেশটিতেও এত জায়গায় হাত পা বাঁধা।
আমাদের কাজ কথা বলে যাওয়া, বলে যাওয়া আর বলে যাওয়া। এই প্রজন্মে না হলে পরের প্রজন্মে হবে, ভবিষ্যত নাগরিকরা আরেকটু স্বাধীন, নিরাপদ জীবন চিনবে।
উদ্বাস্তুরা দেশ অ্যালট হওয়ার পর, আমেরিকায় এলে - নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে দেয় রিসেটলমেন্ট এজেন্সির কর্মী। একটা বাড়ি, রেফ্রিজারেটর ভরা খাবার, পরিবারের সদস্য সংখ্যার সঙ্গে বিচার করে বাড়ির আকার ঠিক হয়। যাদের মাথার ওপর কোন আবরণ ছিল না, কোন নিজের ঠিকানা ছিল না, জীবনের নিশ্চয়তা ছিল না - হঠাৎ এক সকালে যখন দেখে কিছু মানুষ আদর করে কথা বলছে, সম্মান পাচ্ছে - বাচ্চাদের আলাদা ঘর, পুরো বাড়ি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, বাথরুম, আলাদা রান্নাঘর - আর কিছু ভাবার কি দরকার আছে? কিন্তু উদ্বাস্তু জীবনের অতীত ভোলা সহজ না। ছিন্নমূল মানুষ যা হারায় তার মধ্যে একটা খুব বড় জিনিস - মানুষের প্রতি বিশ্বাস, নতুন কিছুকে ভরসা করার ক্ষমতা।
এখানে আসার এক মাসের মধ্যে পরিবারের অন্তত একজনকে রোজগার করার জন্য তৈরি করতে হয়। আর, সে দায়িত্ব থাকে রিসেটেলমেন্ট এজেন্সির ওপর এবং ঐ পরিবারের জন্য ভারপ্রাপ্ত কেস ম্যানেজারের ওপর।
প্রত্যেকের জন্যেই কোন এজেন্সি ঠিক থাকে, যে এজেন্সির মাধ্যমে কেউ আসেন, যদি পরিবারসহ হয় তাহলে পুরো পরিবারের, অথবা ব্যক্তির - প্রথম তিন মাস সব দায়িত্ব থাকে ঐ এজেন্সির। বাড়ি ভাড়া থেকে শুরু করে মেডিকেড, ফুড স্ট্যাম্প - মোট কথা এ দেশের অধিবাসী হিসেবে ন্যায্য অধিকার বুঝিয়ে দেওয়া।
আসল চ্যালেঞ্জ শুরু এরপর। এর পরের ধাপের কাজ হল আমাদের মত অর্গানাইজেশনের।
এসে তো পড়লো, বাড়ি পেল, নিরাপত্তা পেল - মেন্টেন করবে কী করে?
শুকনো বাথরুম নরক গুলজার। বন্ধ ঘরে পুরনো নতুন খাবারের বীভৎস গন্ধ। টয়লেট পেপার কেনার কথা ভাবতে পারে না। বড় বড় রান্নার বাসন বাথটাবে ধুচ্ছে। আশেপাশের জলাশয়ের ইকোসিস্টেম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কারণ কিচেন আর বাথরুমের পয়ঃপ্রণালী আলাদা, কোন জায়গার জল কোথায় যাবে সেগুলো প্ল্যানড।
সার্ভে করে বেরোল সব স্থানীয় গ্রসারি স্টোরে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় রান্নার তেল। সবচেয়ে কম বিক্রি হয় হাত ধোয়ার সাবান, ক্লিনার আর টয়লেট পেপার। আর রান্না করার পর বাসন ধোয়ার জল এবং ভাজাভুজির পর বাতিল অতিরিক্ত পুড়ে যাওয়া তেল সেই রান্নাঘরের নল দিয়ে জলাশয়ে যায়।
এইবার এই যে পরিণতি হচ্ছে - কী করা উচিত? শাপ শাপান্ত করে গালি দিয়ে টাইম পাস্ নাকি “নিজে বাঁচো অন্যকে বাঁচাও” ভাবা! সম্প্রতি করোনা আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে নিজে নিজের বাড়িতে সুরক্ষিত থাকাই যথেষ্ট নয়, এমন একটা সময় আসে যখন সারা পৃথিবীর সবকটি মানুষ সুরক্ষিত কিনা তার ওপর নির্ভর করে আমাদের সুরক্ষা। নিজেদের দেশ, সংস্কৃতি, দক্ষিণ এশিয়ার খোলামেলা প্রকৃতি ছেড়ে উথালপাথাল জীবন পেরিয়ে আমেরিকায় এসে পরদিনই আমেরিকার জীবনে মানিয়ে নেবে - "বেতসের মত সভ্য শিক্ষা" শেখেনি এরা।
কেউ আসতে চায় না। কেউ বেরোতে চায় না।
টোপ দিতে হয়। সেই টোপ হল উদাহরণ তৈরি করা। একটা উদাহরণ - একটা আদর্শ উদাহরণ যদি কমিউনিটির সামনে দাঁড় করানো যায় - পুরো প্রভাব ধরতে পারা যায়।
এমব্রেস নামে এক নন্ প্রফিট অর্গানাইজেশন - নানা রকম প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ করে। কিন্তু ক্লায়েন্ট কারা? শুধু সন্তানসম্ভবা। যে মুহূর্তে কোন সন্তানসম্ভবা ওদের কাছে পৌঁছায় - বাচ্চা জন্ম হওয়া পর্যন্ত সব দায়িত্ব ওদের। পুষ্টির নিয়ম মেনে নিয়মিত খাবার পৌঁছে যায়। কবে কোথায় কোন ডাক্তার, কী কী টেস্ট - এমব্রেসের ভলান্টিয়ার হাজির থাকে বাড়ির সামনে। বাচ্চা হওয়ার পর হাসপাতাল থেকে ছুটি পেলে ভলান্টিয়াররা দরকার মত বাড়ি এসে থাকে পর্যন্ত। সব কিন্তু নিখরচায়। কার সিট্, ডায়াপার - বেবি ক্রিব - যা কিছু শিশু ও নতুন মায়ের প্রয়োজন।
অনেকেই ভাবেন - একে তো খাওয়া-পরার অভাব নেই। এর উপরে বাচ্চা হবে বলে এত খাতির - তাহলে তো আরো ডজন ডজন বাচ্চা হবে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে - যেসব মা’রা এমব্রেসের সান্নিধ্যে এসেছে - ওদের পরিবারের সুস্থ পরিবার কল্পনার হার অনেক বেশি।
ঐ যে বললাম - টোপ! টোপ হল সব সুযোগ সুবিধা আর আরাম - আর লক্ষ্য কী? লক্ষ্য হল কমিউনিটিতে সুস্থ মেসেজ ছড়ানো।
কীভাবে হয়?
তোমার বাচ্চা হবে? দারুন খবর। সব করব আমরা। শর্ত একটাই। সপ্তাহে পাঁচ থেকে ছ’দিন রোজ চার ঘণ্টা ওদের ট্রেনিং সেন্টারে যেত হবে। অকারণ অনুপস্থিতি হলেই প্রোগ্রাম থেকে বাদ!
কে এই সুযোগ হাতছাড়া করবে? করে - এরপরও কেস আসে - যারা ভাবে ওদের বাড়ির মহিলাদের শিক্ষিত করে ফেলা হচ্ছে - তুলে নেয় নাম।
এই কারিকুলামে কত কী যে শেখানো হয়, ভিডিও দেখানো হয়। বেসিক ইংরেজি শেখানো হয়। বাচ্চার নার্সিং, মা’র নার্সিং, পরিষ্কার থাকা - ওয়াইপস ব্যবহার, টয়লেট সাফ রাখা - বাসন কোসন জীবাণুমুক্ত রাখা, ডিশওয়াশারের উপযোগিতা বোঝানো- শারীরিক বিশ্রামের কী গুরুত্ব তা উপলব্ধি করানো।
এইসব প্রোগ্রামে যে শুধু বেতনপ্রাপ্ত কর্মীরাই কাজ করেন তা না, ভলান্টিয়ারও অনেক আছেন। আমি মূলত ভলান্টিয়ার করি দোভাষী, অনুবাদক আর ট্র্যান্সপোর্টের জন্য। অনেকের কাছেই আমেরিকা একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক তথা স্বার্থপর দেশ - কিন্তু ভলান্টিয়ারিঙে যে কত অল্প বয়স থেকে উৎসাহ দেওয়া হয় তা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। তাতে অনেক সময় ইন্সেন্টিভ জড়িত থাকে, স্কুল কলেজ, কাজের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি অনেক কিছুতে সুবিধে হয়, কিন্তু একেবারে নিঃস্বার্থ স্বেচ্ছাসেবক, যাঁরা শুধু সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দিতেই আসেন, এমন মানুষও অনেক।
যাই হোক, প্রোগ্রাম প্রসঙ্গে মনে হলো, একটি হাইকিং গ্রুপ আছে আমাদের। রিফিউজিদের জন্যে হাইকিং গ্রুপ শুনে প্রথম প্রতিক্রিয়া অনেকের কাছে শুনেছি - এদেরকে হাইকিং করিয়ে কী হবে, ওটা তো বিনোদন মাত্র! কিন্তু ঐসব পরিবারের মহিলাদের জন্যে এই সামাজিকতা, মুক্তি, খোলা প্রকৃতির সান্নিধ্য কতটা বড় তা অনুভব করতে পারলেও লেখার ক্ষমতা আমার নেই। রোহিঙ্গা গোষ্ঠী থেকে তিনজন এই গ্রুপে যোগ দিয়েছেন আমার হাত ধরে, এটা মনে করে আমার গর্ব হয়। ওঁদের জন্যে পরিবারের দায়দায়িত্ব সরিয়ে রেখে শনিবার পুরো দিন একা একা বাইরে কাটানো একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা - স্বাধীনতার অচেনা ঘ্রাণ। REI আমাদের স্পনসর।
আমাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষা - প্রয়োজন, পরিস্থিতি আর প্রেক্ষিত বোঝা। নিজেদের প্রয়োজন বা প্রায়োরিটির ধারণা দিয়ে অন্যদের বিচার না করা। এই গল্পটা একটা ট্রেনিংয়ে শুনেছিলাম-
একটি সমাজসেবীর দল গেছে খুব গরিব এক দেশ পর্যবেক্ষণ করতে। যতটা কল্পনা করে গেছিল, বাস্তব তার চেয়েও ভয়ঙ্কর।
যাই হোক - বিজ্ঞজনের পর্যবেক্ষণে ঠিক হল যে ওঁরা একটি কমিউনিটি সেন্টার বানাবেন আর অনেক অনেক শৌচালয় তৈরি করে দেবেন। তাঁরা এই প্ল্যান নিয়ে গেলেন দলনেতার সঙ্গে কথা বলতে। দলনেতা শুনে অবাক! কে জানালো ওঁদের যে ওরা শৈচালয় আর কমিউনিটি সেন্টার চায়? প্রথমত ওরা বলল যে কিছুই চায় না। যেভাবে আছে ওরা ভাল আছে। অথচ চারদিকে বিষ্ঠা, নোংরা, অপুষ্টি, অস্বাস্থ্য ছড়িয়ে। আর যদি কিছু করতেই চাও তাহলে, ওরা চায় একটি ফুটবল মাঠ!
সমাজসেবী দল আকাশ থেকে পড়লো।
অনেক উদাহরণ আর উপকারিতা বুঝিয়ে ওদের রাজি করানো হল যে আগে শৌচালয় আর কমিউনিটি সেন্টারই হবে। প্রথমে তো স্বাস্হ্য আর পরিচ্ছন্ন জীবন। এরপর তো খেলা।
প্রজেক্ট শেষ করে সমাজসেবীর দল ফিরে এলেন। বাজেট মঞ্জুর হল। বেশ কিছু শৌচালয় আর ঝকঝকে কমিউনিটি সেন্টার তৈরি হল। তৈরি হওয়ার এক বছর পর সমাজসেবী দলের হেড অফিসের সব লোক গেলেন পর্যবেক্ষণে। যা দেখলেন - তাতে আবারও চোখ কপালে। শৌচালয় হয়ে গেছে গৃহপালিত পশু থাকার জায়গা। আর কমিউনিটি সেন্টার আমাদের ধাপা’র মাঠ।
আবার মিটিং। দলনেতাকে প্রশ্ন
- এত সুন্দর পরিষ্কার শৌচালয় কেন ব্যবহার করনি?
- জল বয়ে নিয়ে এতদূর কেন বয়ে আসবে? এর চাইতে তো জলের পাশে যাওয়াই কম পরিশ্রমের কাজ!
- আচ্ছা, কমিউনিটি সেন্টারের কী হল?
- কেন বদ্ধ জায়গায় বসব আমরা? আর এমন কী আলোচনা থাকে যে ভেতরে বসতে হবে? যখন যেখানে সমস্যা হয় - সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওখানেই সমাধান করা হয়।
হেড অফিসের বড়বাবুদের মাথায় হাত। মিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে গেছে। এ প্রজেক্ট ফেল হলে তো চলবে না। গ্র্যান্টর তো চেয়ে আছে ফলাফলের দিকে!
আবার আলোচনা। এবার ঠিক হল যে - যা গেছে তো গেছে। ঠিক আছে, একটা বেসিক ফুটবল মাঠই হোক।
কমিউনিটি সেন্টারের পাশেই ফুটবল মাঠ হল।
মাঠ হবার ৬ মাস পরের রিপোর্ট :-
* রোজ ফুটবল খেলা হয়।
* কমিউনিটি সেন্টার রোজ সন্ধ্যায় শিক্ষামূলক ক্লাস হয়।
* নির্দিষ্ট দিনে কমিউনিটি মিটিং হয়।
* গবাদিপশুরা আগের জীবনযাত্রায় ফিরে গেছে। শৌচালয় যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে।
* শৌচালয়ের কাছাকাছি জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। জলের কাছে আর শৌচালয় তৈরি হয়নি।
~~~
স্বপন, লালচাঁন দাদা আর মদন - একটি দু কামরার আ্যাপার্টমেন্ট শেয়ার করে।
রমাদানের সময় প্রচুর ডোনেশন আসে। বিরাট বিরাট বাক্স - ৭০/৮০ পাউন্ড ওজন। ভেতরে সব শুকনো খাবার। সাংঘাতিক ভাল মানের খাবার। খেজুর যে এত বড় বড় সাইজের হতে পারে - ঐ বাক্সেই প্রথম দেখলাম। কী সুন্দর গন্ধের মশলা। আরো কত শৌখিন খাবার। কত কিছু নতুন দেখছি। আমাদের কাছে শুধু ক্লায়েন্ট লিস্ট চাওয়া হয়। আমার তত্ত্বাবধানে ৯১টি পরিবার।
প্রতি পরিবারের সদস্যসংখ্যা কত এবং তাদের বয়স কত - সব রেকর্ড থাকে। এখানে কোন ধর্মভিত্তিক বণ্টন হয় না। অন্তত আমায় কেউ নির্দেশ দেয়নি।
তো, ঐ স্বপন আর বন্ধুরা। আমি মদন আর লালচাঁনকে আগে থেকেই জানি। স্বপনের নাম শুনেছি, কখনো দেখিনি। আমাদের কোন টার্গেট কিছু থাকে না যে এত সংখ্যক ক্লায়েন্ট থাকতে হবে। কিন্তু যত বেশি মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় ডোনেশন/ গ্রান্ট এসবের ক্ষেত্রে সুবিধা। স্বপনের ফাইল আমি বানাইনি। স্বপনও কখনো আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়নি। আবার আমি যতবারই মদনদের বাড়ির কাছে গেছি- দেখা হয়নি।
২০১৯ রমাদান
সেদিন ইদ।
মদনরা চারজন প্রাপ্তবয়স্ক। হিসেব মত পরিবার পিছু একটি বাক্স। সদস্যসংখ্যা বেশি হলে বাক্স বাড়তে পারে। আর বয়েস হিসেবে খাবারের ধরনও আলাদা। কিন্তু কেউ যদি একা হয়, তবুও আমি পুরো বাক্স অ্যালোকেট করি। মদনরা চারজন একসঙ্গে থাকলেও চারজনের আলাদা আলাদা ফাইল। তাই আমি চারজনের জন্য চার বাক্স হিসেব করি। একটু পক্ষপাতিত্ব মনে হতে পারে। কিন্তু সবার জন্যই করি। যাই হোক। মদনের দরজায় নক্ করলাম।
- বাইরে আসবে? বড় বড় চারটে বাক্স ঘরে ঢাকাতে হবে। গাড়ি থেকে নামাতে হবে।
- আসছি দিদি। স্বপন! বাহিরে এসো একবার! দিদির গাড়ি থেকে বাক্স নামাতে হবে।
- ইদ মুবারক দিদি।
আমি গাড়ির ট্রাঙ্ক খুলছিলাম। না তাকিয়েই উত্তর দিলাম “ইদ মুবারক”!
ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলাম ধবধবে সাদা পোশাক ও টুপি পরা অল্পবয়সী এক ছেলে। বাক্স ধরতে এসেছে। আমি আর কথা বললাম না। এই ডিস্ট্রিবিউশন আমার জন্য, আমার গাড়ির জন্য খুব পরিশ্রমের। কয়েকটা স্টক পয়েন্ট ঠিক করা হয়। এরপর ক্লায়েন্টদের ঐ ঠিকানা শেয়ার করা হয় যাতে নিজেরা তুলে নেয়। আমার বাকি সহকর্মীদের ক্লায়েন্টরা অডি, বিএমডাব্লু, মার্সেডিজ চড়ে যায় ডোনেশন নিতে (ঐ আরেক মজার গল্প, পরে বলব)। আর আমার সদ্য এদেশে আসা অভাগা ক্লায়েন্টদের প্রায় কারো গাড়ি নেই। যাদের আছে, খুব মেজাজও আছে সঙ্গে। যাদের গাড়ি নেই, তাদের অনেক অনুনয় বিনয় করতে হয় গাড়ির সার্ভিস পেতে হলে। আমার ভাল লাগে না কাউকে এমন অপ্রস্তুত করতে। আমি এত পারি না।
হয়তো কখনো কঠিন হয়ে বলি বটে “আমি পারব না। অফিসে এসে নিয়ে যেতে হবে/ অফিসে এসে জমা দিয়ে যাও।”
কিন্তু যখন উত্তর আসে “ঠিকই তো। আপা কতবার আইব। আমারার জন্য খাটতে খাটতে আপুর চেহারা শুকাইয়া যাইতাসে।”
এসব শুনলে আবার বাউন্ডারি ভেঙে যায়।
সেই আমিই নানা কসরত করে টেনেটুনে একেকদিন তিন/চারবার করে যাতায়াত করি। আবার কখনো পিক্ আপ ট্রাক মালিক ভলান্টিয়ার পাই। ওরা এগিয়ে আসে।
বাক্স নামানো শেষ ।
মদন- দিদি, একটু গরিবের ঘরে পা রাখার মন করবেন কি?
- কী সব বল! আরো কত জায়গায় যেতে হবে জানো তো।
- দিদির কত কষ্ট! আমার পা যদি না ভাঙ্গিত, আমি যেতি পারতাম সাহায্য করতি।
মদনের গাড়ি আছে। এদেশে এসেছে এক বছর। কিন্ত আমার সঙ্গে পরিচয় হয় ওর আ্যাক্সিডেন্টের পর। কাজের জায়গায় আ্যাক্সিডেন্ট। কোম্পানি সব খরচ দিচ্ছে আর ইনস্যুরেন্স তো আছেই। সঙ্গে মাইনেও পাচ্ছে। একা। অল্প বয়স। বাংলাদেশে মা-বাবা- ভাই-বোন।
- ঠিক আছে। আমি পাশের আ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে যাব। আমি রহমার বরকে বলে রেখেছি। ওরা তৈরি থাকবে। আচ্ছা স্বপনকে যে ডাকলে, দেখলাম না তো? আর সাদা পোশাক পরা, ও কে?
- দিদি, ও-ই তো স্বপন।
আমি থতমত খেয়ে সামলে নিই নিজেকে। এরমধ্যেই স্বপন একটি সুন্দর থালায় নানারকম রান্না করা খাবার, এক বাটি ফিরনি সহ গাড়ির সামনে হাজির।
আবারও বলল - “ইদ মুবারক - আমি স্বপন ইসলাম।”
একটু অবাক হলাম - বাংলাদেশ থেকে মুসলিম রিফিউজি এখানে আগে কখনো দেখিনি। অ্যাসাইলিরা সাধারণত আমেরিকায় আসেন না।
আমিও বললাম “ইদ মুবারক”। ওখানে দাঁড়িয়ে খেলাম কিছুটা।
মাশাল্লা! মা লক্ষ্মীর মত মুখ
একটি ওয়ার্কশপ করছি। ১৩ জন মহিলা - দুজন নতুন। জাইনা আর আনোয়ার। মায়ানমার থেকে এসেছে। আপাদমস্তক ঢাকা। শুধু চোখ দেখা যায়। আনোয়ারের আট সন্তান। বড় ছেলে ২১। আনোয়ারের বয়েস ৩৮। তার মানে ১৬ বছরে প্রথম সন্তান। দুই জোড়া যমজ বাচ্চা সহ মোট আট সন্তানকে নিয়ে চলে এসেছে। স্বামী নেই। কেন নেই জানতে চাইনি। আনোয়ার একটু তাড়াতাড়ি কথা বললে কিচ্ছু বুঝতে পারি না।
হঠাৎ খেয়াল করলাম আনোয়ার পাশের কাউকে কী যেন বলছে। আমি ভাবলাম ওর কোন অসুবিধে হচ্ছে কিনা। জানতে চাইলাম “কোনো সমস্যা”?
- নায় গো বুবু। আফনের চেয়ারার লগে মাশাল্লাহ! এক্কেরে মা লক্ষ্মীর মুখ!
আমি কী বলব!
- তুমি তো রোহিঙ্গা?
- হয়। তবে আমার ছাওয়াল সময়ে দ্যাশের আইলের মাটিত্ যে লক্ষ্মী পুজা হইত - আফনের মুখের মত।
এমন শক্ লাগে একেকটা সিচুয়েশনে। আমি আজো জানতে চাইনি ওর দেশ কী। আমার কাছে ওর ফাইল। তাতে লেখা, অরিজিন- মায়ানমার।
বাংলা ভাষার অসংখ্য ডায়ালেক্ট, এর সঙ্গে বার্মিজ, মালয়েশিয়ান আর উর্দুর মিশ্রণে রোহিঙ্গারা কথা বলে। ইতে আলিবাবা। ইতে উগ্গা মরত ফুয়া।
এ হল আলিবাবা। ও একজন ছেলে।
ইবায় মর্জিনা। ইবা উগ্গা মাইয়ালা ফুয়া।
এ হল মর্জিনা। ও একজন মেয়ে। যদিও আমাকে লক্ষ্মীর সঙ্গে তুলনা করার কোন কারণ নেই। কিন্তু একটু ভাল ব্যবহার, গুরুত্ব পাওয়া - কোথাও একটা ভাল লাগার অনুভূতি এনে দেয়। আমরা যারা ধর্মভীরু, সবসময়েই তুলনা করি ভগবানের সঙ্গে। কে জানে ওর কোন্ ছোটবেলায় কোন্ পরিবেশে লক্ষ্মীপুজোর স্বাদ পেয়েছিল?
এমনিতেই এত কষ্টের কথা শুনতে থাকি, আর ইচ্ছে করে না জানতে। কোন্ ঘা কে জাগিয়ে তুলব কে জানে!
অন্য স্বপন
লালচাঁনদের বাড়ি থেকে খবর এল স্বপন ট্রাক ড্রাইভারের পরীক্ষা দিতে চায়, তার জন্যে কাগজপত্র নিয়ে কিছু সাহায্য লাগবে। ওদের সঙ্গে আমার খুব বেশি কাজ থাকে না, আগেই বলেছিলাম, ওরা সবাই বেশ চটপটে, মোটামুটি শিক্ষিত ও স্বনির্ভর। বাড়ির বাইরে গিয়ে ফোন করতো গলায় তুলসী মালা, কপালে চন্দনের তিলক কাটা পরিপাটি একটি ছেলে বেরুলো - "আপনের কথা তো অনেক শুনেছি দিদি, আসতে আজ্ঞা হোক"।
আমি বললাম, না না, ঠিক আছে, ঢুকবো না। স্বপন কোথায়?
- আজ্ঞে দিদি আমার নামই স্বপন।
- ওহ, তোমার নামও স্বপন? কবে এলে?
এ কথা সেকথার পর স্বপন জানালো ঐ স্বপনও হিন্দু ছিল, হিন্দু ধর্মের মহান ঐতিহ্য নিয়ে ও কিছু জানে না, মাথা খারাপ হয়ে গেছে, তাই নিজেকে মুসলমান ভাবে।
আমি ওসব শুনতে চাই না, আমার শোনার কথাও না, কৌতূহল হলেও চেপে রাখি।
এই স্বপনের বাড়ি বাংলাদেশ, ছোট চাষবাষ আছে। আবার ওর নিকটাত্মীয় আছে আগরতলার কাছে আমতলিতে। অনেকবার আগরতলা গেছে, আমরা আগরতলার লোক শুনে উচ্ছ্বসিত। ভারতের রেশন কার্ডও আছে ওর! কথায় কথায় জানতে পারি প্রথম বিশ্বের কোন দেশে আসার জন্যে ও গত সাত আট বছর বিভিন্ন দেশের রিফিউজি ক্যাম্পে কাটিয়েছে। নিজেকে রিফিউজি প্রমাণ করার জন্যে বাংলাদেশের নাগরিকত্বের সব নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলেছে। রিফিউজি ক্যাম্পগুলিতে অন্য দেশের, অন্য ভাষার আশ্রিতরা অকথ্য অত্যাচার করেছে, দশ বছর মা বাবা ভাই বোন কাউকে চোখে দেখেনি। এবার এত কিছুর পর আমেরিকা এসেছে, এবার দেশে টাকা পাঠাবে, সবার মুখে হাসি ফুটবে। কমিউনিটি কলেজে ভর্তি হবার প্ল্যান - সব খোঁজ খবর নেওয়া হয়ে গেছে। ভালো দর্জির কাজ জানে, আমি কি কিছু ব্যবস্থা করে দিতে পারি? কণ্ঠীধারী বৈষ্ণব, চিকেন ফ্যাক্টরিতে কী করে কাজ করে! কাজের পাশাপাশি ট্রাক ড্রাইভারের ট্রেনিং নেবে, সব খোঁজ খবর নেওয়া হয়ে গেছে, ফ্লোরিডা যেতে হবে পরীক্ষা দেওয়ার জন্যে।
আমি ভাবি এই ছোটখাটো নিরীহ দেখতে ছেলেটা এমন দানবের মত ট্রাক চালিয়ে আমেরিকার এপ্রান্ত ওপ্রান্ত করবে? এদিকে আমি জেনে গেছি ও ঠিক ছিন্নমূল উদ্বাস্তু নয়, ওর পরিবার নিরাপদেই আছে। ওর বিপদ ছিল দারিদ্র। আমার কী করা উচিত? একটু ভালো জীবনের আশায়, বাড়ির লোকজনকে ভালো রাখার আশায় এত বছর ধরে প্রাণের মায়া ছেড়ে অজানা দেশে অচেনা মানুষের লাথি ঝাঁটা খেয়ে যে বেড়িয়েছে, তাকে নিয়ে আমি কী ভাববো?
আমি কিছুই ভাবি না, কিছুই করি না, ওর কেসটার জন্যে যাদের কাছে গ্রান্ট আছে তাদের ফরোয়ার্ড করে দিই, পরের ফুড ডিস্ট্রিবিউশন ড্রাইভ আর রুম হিটার ডোনেশনের লিস্টে ওর নাম লিখে রাখি, টেলারিংয়ের কাজের খোঁজ করার জন্যে কলিগকে বলি। এর বাইরে কিছু জানা আমার কাজ নয়।
ফুটবল মাঠের গল্পটা ঠিক বুঝলাম না।
অসাধারন
ফুটবল মাঠ - To understand the need
বাচ্চারা কোন কাজ করতে না চাইলে যেমন নানা trick করি আমরা - patient কথা না শুনলে যেমন ডাক্তাররা নানারকম উপায় ভাবেন - ঠিক সেরকমই এই ধরণের কাজগুলি। দরকার যে আছে - সেটা আমরা যারা বুঝতে পারি তাদেরই তো নানা কৌশল বার করতে হয়। ছোট বাচ্চারা / বড়রাও যখন জেদ করে , তখন অনেক সময়ই আমরা মেনে নিয়ে থাকি । কখন মানতে পারি? যখন এর consequences গুলি ক্যালকুলেট করি।
ওকে! তুমি বন্ধুদের সাথে পার্টি করবে! তাহলে এর আগে এই এই কাজগুলো শেষ কর।
চকলেট না পেলে হোমওয়ার্ক করবে না ।
ডায়াবেটিক রুগীকে সুগারফ্রী মিষ্টি । ইত্যাদি।
অনেক সময়ই আমরা সবাই এমন কিছু আবদারে মেনে নিই যার সাথে হয়তো আসল উদ্দেশ্যের কোন যোগাযোগ নেই সরাসরি। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য অন্যদিকে আপোস করা।
আমি তো তোমাকে বুঝলাম। এবার তুমিও আমাকে বোঝ!
ফুটবল মাঠ পেয়ে খেলায় এমন আনন্দ পেল যে পাশাপাশি বাকী disciplinary work গুলোকেও মেনে নিতে থাকল।
আমরা যখন কোন একটা মতামত মানতে চাইনা , জেদ করি - কেউ একজনকেও যদি সমর্থক পাই- মাথাটা হাল্কা হয় না! তখন অন্যান্য যুক্তিগুলিকে শোনার জন্য নিজেকে তৈরী করা সোজা হয়।
জানিনা , বোঝাতে পারলাম কিনা @স্বাতী রায় ।
আমরা যারা একটা ডিসিপ্লিনের মধ্যে বড় হয়েছি, স্বনির্ভর হওয়া ছাড়া আর কোনো অপশন খোলাই ছিল না, তাদের কাছে এই জীবন এতই দূরের যে একে বোঝা খুবই কঠিন। যেটুকু চেষ্টা করি সেখানে দেখছি সমবেদনার বদলে করুণা চলে আসছে - empathy-র বদলে pity। অন্য মানুষটির যতটা সম্ভ্রম প্রাপ্য ততখানি দিতে পারছি না মনে হয়। মানুষটাকে ওপর থেকে দেখে দুঃখ পাচ্ছি। তার সাথে এক প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানোর ক্ষমতা আমার নেই। এটা আত্মসমালোচনা। যে পরিবেশে বড় হয়েছি তার প্রভাবমুক্ত হওয়া তো সোজা না।
এই জায়্গাটা খুব ভালো লাগলো - "যাই হোক, প্রোগ্রাম প্রসঙ্গে মনে হলো, একটি হাইকিং গ্রুপ আছে আমাদের। রিফিউজিদের জন্যে হাইকিং গ্রুপ শুনে প্রথম প্রতিক্রিয়া অনেকের কাছে শুনেছি - এদেরকে হাইকিং করিয়ে কী হবে, ওটা তো বিনোদন মাত্র! কিন্তু ঐসব পরিবারের মহিলাদের জন্যে এই সামাজিকতা, মুক্তি, খোলা প্রকৃতির সান্নিধ্য কতটা বড় তা অনুভব করতে পারলেও লেখার ক্ষমতা আমার নেই। রোহিঙ্গা গোষ্ঠী থেকে তিনজন এই গ্রুপে যোগ দিয়েছেন আমার হাত ধরে, এটা মনে করে আমার গর্ব হয়। ওঁদের জন্যে পরিবারের দায়দায়িত্ব সরিয়ে রেখে শনিবার পুরো দিন একা একা বাইরে কাটানো একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা - স্বাধীনতার অচেনা ঘ্রাণ। REI আমাদের স্পনসর।"
দুই-তিন প্রজন্ম পরে যদি মুক্তি আসে সেটাও অনেক বড় পাওয়া।
পড়লাম, যথারীতি প্রতিটি পর্বে খুব ভালো ডকুমেন্টেশন হচ্ছে। অনেক কথাই ভিড় করে আসছে, তবে তার মধ্যে অনেক কিছুই অবান্তর। হু ভালো লিখেছে, লেভেল গ্রাউন্ডে আসতে পারার অক্ষমতা নিয়ে।
হাইকিং গ্রুপের প্রোগ্রাম টা আমারো খুব ভালো লাগলো। যে যুদ্ধগুলো ঐ মেয়েরা করছেন সেগুলো এতই অসম যে এক একটা আপাততুচ্ছ ব্যাপারও হয়ত কোথাও গিয়ে কোন জানলা খুলে দেবে। দুই বা তিন প্রজন্ম পরে কী হবে সেটা খুবই দূরের কথা, অনেক ক্ষেত্রে হয়ত কিছুই হবেনা কিন্তু আপাতত ঐ এক একটা দিনের মুক্তিই অনেক।
অসাধারণ লাগছে এই সিরিজটা। লেখা চলুক।
আমরা যারা হয়তো কিছুটা প্রিভিলেজড ইমিগ্র্যান্ট অন্য দেশে বেশির ভাগই হয়তো নিজের ইচ্ছায়, এইভাবে নতুন দেশে শুরুর স্ট্রাগল যাদের হয়তো এতটা দেখিনি , তাদের মধ্যেও রক্ষণশীলতা বা টিপিক্যাল ফিউডাল বা রিগ্রেসিভ মাইন্ডসেট যেভাবে পরতে পরতে ঢুকে আছে , সেটা যেতে যে কত জেনারেশন লাগবে কেও জানেনা। বরং তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত দের মধ্যেও উল্টোটাই বেশি দেখেছি যে সেই সব রক্ষনশীলতাকে নিজেদের মহান সভ্যতার কালচার বাঁচিয়ে রাখার নাম করে গ্লোরিফাই করতে।
তথাকথিত আলোকপ্রাপ্তদের মধ্যে কেউ যদি সুকন্যাদির সামনে বৌকে চড় মারতো তাহলে সুকন্যাদি চুপ করে সেটা দেখত না। ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সে রিপোর্ট করা হত কিনা জানি না। সেটা যে পরিস্থিতি বিশেষে মেয়েরা এখনো পেরে ওঠে না তা অস্বীকার করার জায়গাই নেই। কিন্তু লোকটিকে অন্তত বলা হত যে কাজটি অন্যায় হয়েছে। মহিলাটিকে তার অধিকার সম্পর্কে সজাগ করার চেষ্টা হলে সে হয়ত কিছুটা বুঝত। এই ডায়লগটুকুর পরিসর তৈরী করার জন্য ঐ তথাকথিত আলোটির ভূমিকা আছে। স্কুল এডুকেশনের বিকল্প এখ্নও কিছু তৈরী হয়েছে বলে তো মনে হয় না।
সুকন্যাদি, একটা কথা জানার ছিল। এই পরিবারগুলোর বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো নিশ্চয়ই বাধ্যতামূলক? হামিদার মেয়ের কি আঠারো পেরিয়ে গেছে বলে কিছু করা গেল না?
স্কুল এডুকেশনের বিকল্প কিছু যে নেই এখনো সেতো ১০০-%। কিন্তু সেটা থাকতেও সোশ্যাল এসিমিলেশন হোক বা মিনিমাম জেন্ডার ইকুয়ালিটি এসব আসতে যে এখনো অনেকটা রাস্তা পেরোতে বাকি। যতই আনডিজাইরড হোক , নিজেদের কালচার ধরে রাখার নামে জোর করে ফ্যামিলি র অন্যদের ওপর অনেক কিছু চাপিয়ে দেওয়া আর অন্য কালচারের প্রতি এন্টিপ্যাথী এখনো অনেক ক্ষেত্রেই ডোমিন্যান্ট রোল প্লে করে। স্বাভাবিক ভাবেই সব জায়গার আলোকপ্রাপ্তদের মধ্যে তার রেশিও অনেক কম। কিন্তু আছে। সেটাই জাস্ট বলা।
এই লেখাটার জন্য অপেক্ষায় থাকি
অসাধারণ৷ আমি একজনকে জানি। এল এ থাকে। যে ভাবে হোক নাগরিকত্ব৷ চাই। বাড়িতে টাকা পাঠায়। বাকিতে চলে কোনো রকমে। সে অবশ্য শিক্ষিত ছেলে। কত কষ্ট করে থাকে। এই লেখাটির তুলনা নেই। ধর্ম কত তুচ্ছ, মানুষ কত বিদ্বেষহীন, তা বলেছেন লেখক নানা অনুষঙ্ । মাশাল্লা, মা লক্ষ্মীর মতো মুখ। পুরোহিত হিন্দু ধর্ম নিয়ে বললে, মন্তব্য আসে ইনসাল্লা, খুব ভালো অনুষ্ঠান হয়েছে। অসাধার।
থ্যাঙ্ক ইউ @সুকন্যা। হ্যাঁ নিশ্চয়ই বোঝাতে পেরেছেন।
যদিও আমার ধারণা অনেকেই নিজের পাওয়াটা হয়ে গেলে আর অন্যের কথা শোনে না। ক্রমাগত বলে যেতেই হয় সেটা অবশ্যই। তবু বলে গেলেও শোনে না এমন উদাহরণ তো চারপাশে অনেক।
এই যেমন ধরুন না,হামিদার হবু জামাইটি। বিয়েতে ২৯০০০ ডলার দেয় যে সে নিশ্চয় কিছুদিন আগেই আমেরিকা এসেছে। এদেশের কালচার চিনেছে ,কখনও সখনওকি কানে আসে নি যে বৌ বাচ্চার গায়ে হাত তুলতে নেই? বা হামিদার বাবার, সেও আট বছর ধরে আমেরিকার মাটিতে ঘষটাচ্ছে তো। তার সামনে তার মেয়ের গায়ে হাত তুললেও সে কিছু খারাপ বুঝছে না। এরা দুজনেই আমেরিকার সুবিধাটা নিচ্ছে, অন্যসব কিছুর থেকে মুখ ফিরিয়েই থাকছে। অবশ্যই প্রয়োজন,পরিস্থিতি আর প্রেক্ষিত বোঝা দরকার , এদের প্রয়োজন কি কোনদিন নিজে থেকে বদলাবে ?
আমি তোমার দুটো কথা মেনে নিলে তুমিও আমার দুটো কথা মেনে নেবে আমার ধারণা এটাও আলোকপ্রাপ্ত সমাজের দৃষ্টি ভঙ্গী। আমার দেশীয় জীবনের গণ্ডিতে আমি অনেক লোক দেখেছি যারা এর পরোয়া করে না। পাওয়াটাকে নিজের প্রাপ্য হিসেবেই নেয়,দেওয়াটা কে নয়। তাই কেমন ভয় হয়!
@hu- আমার চেনা গণ্ডীর মধ্যে কেউ যদি একজন আরেকজনকে চড় মারে আমার সামনে - কি জানি- কিছু বলব কি না । সামনে থেকে সরে যাব হয়তো। এখানে আমার কষ্ট হচ্ছিল যে ও চড় খেল আমার জন্য। আমি একটা বেশী কথা বললে হামিদার শাস্তি বাড়তে থাকবে। আমার ওপর গত রাগ হবে ওর বরের - সব হিসেব মেটাবে হামিদার ওপর। আমার ওদের সাথে কাজও বন্ধ হয়ে যেতে পারে । ক্লায়েনেট যদি না চায় - আমরা জোর করে কিছু করতে পারব না। নিয়ম নেই। ব্যক্তি স্বাধীনতার যন্ত্রণাও অনেক। সবাই বুঝতে পারছি যে ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু - ঐ - process মেনে - rubric follow করেই চলতে হবে।
হ্যাঁ - স্কুল যাওয়া বাধ্যতামূলক তো বটেই , অগ্রিম অনুমতি না নিয়ে তিন দিনের বেশী বাচ্চাকে স্কুলে/ অনলাইনে না দেখা গেলে পুলিশ ও কোর্ট - এমনকি কাষ্টডি পর্যন্ত চলে যেতে পারে। এনিয়েও আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা আছে। দিনের পর দিন ক্লায়েন্টের সাথে কোর্টে হাজিরা দিতে হয়েছে - ওর হাইস্কুলে পড়া ছেলে স্কুল যাচ্ছিল না । সে আরেক গল্প।
এই বাচ্চা'র স্কুল বন্ধ করা - হাইস্কুল পর্যন্ত - এটা কিন্তু সব্বার জন্য - ধনী গরীব অন্য্ classes of ইমিগ্রান্টস/নন ইমিগ্রান্টস /citizens- রেগার্ডলেস অফ any আইডেন্টিটি - বাচ্চা আছে মানে স্কুল যেতে হবে। আর স্কুল বন্ধ করা যাবে না বিনা কারণে। আমার বেশ ক'জন চেনা বন্ধু ছোট বাচ্চা নিয়ে স্কুল চলাকালীন নিজের দেশে গেছিল ছুটি কাটাতে - অনুমতি নিয়ে - কিন্তু বাচ্চার নাম কেটে নেয়া হয়েছে স্কুল থেকে । কারণ ১০ দিনের বেশী স্কুল কামাই। ঐ সিট ওরা নষ্ট করবে না। একটা সিটের পেছনে অনেক হিসেব আর টাকা । ফ্রী তে পড়ার সুযোগ দিচ্ছে - আবার সিট ধরে রাখা - হবে না। ছুটি কাটাতে এই দেশে ফিরে এসে আবার নতুন করে ভর্তি। হয়তো একই ক্লাসে জায়গা পাবে- নাও পেতে পারে। ঐ নির্দিষ্ট স্কুলে যায়গা না থাকলে পাশের স্কুলে যাবে। ক্লাসে ছাত্রসংখ্যার অনুপাত বেড়ে গেলে নতুন সেকশনের কথাও ভেবে নেবে। কিন্তু স্কুলে বাচ্চাদের যেতেই হবে ১২ ক্লাস পর্যন্ত।
তবে স্কুল যাওয়া বাধ্যতামূলক হল ১২ ক্লাস পর্যন্ত। এরপর সরকার আর জোর করতে পারে না।
হামিদার মেয়ে স্বেচ্ছায় বিয়ে করছে। এবং ও সত্যিই খুশী । আমি ক'দিন আগে scatter girl সিনেমা দেখতে দেখতে হামিদার মেয়ের কথা ভাবছিলাম। তফাত কোথায় - need/ক্ষিদে/চাহিদা -
হামিদার মেয়ের চৌদ্দ পুরুষ যা অনুসরণ করে এসেছে - ঐ মেয়ে এর বাইরে কিছু ভেবে উঠতে পারছে না। ওর নিজের ভেতরে চাহিদা সৃষ্টি না হলে কি করা যাবে? ও সবসময় আহ্ল্লাদ পেয়ে এসেছে একমাত্র মেয়ে হিসেবে। প্যাম্পার্ড- স্কুলে দু বছর পড়েছে ঠিকই - Take home is ZERO -সেটাও আবার আমার আপনার দৃষ্টিতে ZERO - ওর পরিবেশ - ওর মানসিক বিকাশ - কে কণ্ট্রোল করবে? শুধু সময় আর সময়ের অপেক্ষা - চারদিকে এমন পরিবেশ তৈরী করা - যাতে ভাল/মন্দ বিচার করতে পারে।
মাটিতে বীজ পোঁতার মত। বড় গাছ আর ভাল ফুল/ফল/কাঠ চাইলে তো সেইমত পরিবেশ তৈরী করতে হবে! এরপরও আমরা ১০০% সফল হবার কথা ভাবতে পারিনা - সব করার পরও বীজ থেকে অঙ্কুর না ও বেরুতে পারে- চারাগাছ কোন পশু খেতে নিতে পারে। বেশী/কন জল/পুষ্টিতেও গাছ মরে যেতে পারে। আবার গাছ বড় হল - কিন্তু ফল/ফুল কিছুই হল না - মোটকথা anything can happen- আমরা কি করতে পারি? আমাদের control এ একটাই কাজ -
নিষ্ঠা আর সততার সাথে কাজ করে যাও - ফল কি হবে সেটা সময় বলবে -
সেই ঘুরেফিরে ভগবত গীতা।
কর্তব্যানীতি মে পার্থ নিশ্চিতং মতমুত্তমম্।।
অনেক সময় ওয়ার্কশপ করে মেয়েদের স্বনির্ভর করার চেষ্টা করতে গিয়েও কষ্ট হয়। মনে হয় আরো যণ্ত্রণা ঢুকিয়ে দিচ্ছি। স্বপ্ন দেখাচ্ছি কিন্তু পুরো পারছি কই? একবুক স্বপ্ন নিয়ে ঘরে যাচ্ছে ঠিকই - কিন্তু ঘরে ঢুকলেই তো অন্য গল্প। এতে তো যণ্ত্রণা আরো বাড়ে।
কি করলে যে ঠিক - রহস্য। :)
"আমি তোমার দুটো কথা মেনে নিলে তুমিও আমার দুটো কথা মেনে নেবে আমার ধারণা এটাও আলোকপ্রাপ্ত সমাজের দৃষ্টি ভঙ্গী।"
স্বাতীদির এই মন্তব্য প্রসঙ্গে, 'আলোকপ্রাপ্ত' র সংজ্ঞা কী? কাদের বলব? যে কম্যুনিটিদের সঙ্গে আমাকে নিত্য কাজ করতে হ্য, তাঁদের প্রথাগত শিক্ষা বেশিরভাগেরই শূন্য, কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গির তেমন অভাব দেখিনি। এমনকি কথা শোনার জন্য তাঁদের কথা শোনার পূর্বশর্তও আরোপ করতে দেখিনি। তবে অবশ্য, সব কথা কি আর শোনেন কেউ, সেও না, আবার কেউ শোনেন কেউ না। পুরো সমাজ হিসেবে জেনেরালাইজ করা যায় কিনা সেনিয়ে আমার ধন্দ আছে।
@পাই, ওই জন্যেই আমার ধারণা বলেছিলাম। আমার দেখা অবশ্য খুবই ছোট। সেখানে আরও দেখেছি সামাজিক আর দশটা ব্যাপারে খুব লজিক্যাল হয়েও বাড়ির মেয়েদের ব্যাপারে লোকে কত insensitive হয় ।
তবে তুমি একদম ঠিক বলেছ সমাজকে কখনোই জেনেরালাইজ করা যায় না। এত অজস্র প্যারামিটার যে কোন মডেল ই দাঁড়ায় না!
আর আমার কথাটা নিজের দুঃখের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। সুকন্যার লেখাটা অসম্ভব চিন্তার উস্কানি দেওয়া হচ্ছে। ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নেই।
গুরুর পাতায় আগের মতো রেগুলার আসা হয়ে উঠে না| কিন্তু সম্প্রতিক কয়েকটি লেখা অসাধারন লেগেছে। সুকন্যার এই লেখাটি তার অন্যতম। এতো সাবলীল ভাষা যেন চোখের সামনে সব চরিত্র ভেসে উঠে। নবনীতা দেবসেন এর লেখনীর সাথে খুব মিল পাই|
মনে হয় যেন কথক ঠাকুর গল্পের বুননে ছবি এঁকে চলেছেন| গল্পের সাথে সাথে মন দুঃখী হয়ে উঠে চোখ ভিজে আসে আবার কারো মুখে হাসি ফুটে উঠলে তার আনন্দও মন ছুঁয়ে যায়|
সুকন্যা
ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি তুমি মানুষের জন্য আরো অনেক কাজ করতে পারো ।.অনেক এর মুখে যেন হাসি ফোটাতে পারো.. এই লেখার আরো কিস্তির অপেক্ষায় রইলাম
আমি শান্তনুবাবুর সাথে গলা মেলালাম।
রিপোর্টাজ ধাঁচের এই ধারাবাহিক একেবারে অনন্য। প্রতি কেস স্টাডি বিস্ময় আর অভিজ্ঞতার প্রকাশ।
সাংবাদিক জীবনে অনেক শরণার্থী শিবির ঘুরেছি, খুব কাছ থেকে দেশহীন মানুষের মর্মবেদনা বোঝার চেষ্টা করেছি, কিন্তু এত ভেতর থেকে দেখা কখনোই সম্ভব হতো না যদি না এই জীবন্ত দলিল না পড়তাম!
হামিদার মেয়ের বিয়ে অদৃশ্য সমাজটিকে হাতেনাতে চিনিয়ে দিচ্ছে...
এত ভিতর থেকে নিজের কাজকে কখনো দেখিনি। অপরাধবোধ হচ্ছে।