মাছধরা ও পুলিশ
কোন এক রবিবার বেলা ৩টে
- দিদি, আমারে তো পুলিশ ধরসে।
- My God - কী করেছ?
- কিসুই তো না! ছাওয়ালগুলিরে লইয়া মাস (মাছ) ধরতে আইসলাম।
- মাছ ধরতে এসেছ, আর শুধু শুধু পুলিশ ধরল?
- হয়। কথাও বুঝিনা। কিতা জানি কয়।
লাইসেন্স নাই বলে।
- সর্বনাশ! তোমার ড্রাইভার লাইসেন্স নেই? এক্সপায়ার্ড?
- না না । গাড়ির আসে। কিতা কয় মাসের বলে নাই। কথা কইবা নি পুলিশের লগে।
বললাম - “এখন থাক। টিকিট তো দেবেই। নিয়ে নাও। পরে দেখছি।”
পরে শুনলাম ৬ সিটের গাড়িতে ৯ জন বসেছে । আর খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম যে মাছ ধরার লাইসেন্স নেই! বছরে ১৫ থেকে ২৫ ডলার লাগে মাছ ধরার জন্য - “Your purchase supports the conservation of Georgia's aquatic resources”.
ঐ বেচারাও জানত না - কিন্তু ও আরো অনেক অপরাধ করেছে। বেশি সংখ্যায় গাড়িতে লোক, তার মাঝে গাড়ির সামনের সিটে বিয়ার। ৬ মাসের জন্য লাইসেন্স সাসপেন্ড। সাহায্য চাইতে এসেছিল। কিন্তু এতে আমাদের কিছুই করার নেই, আইন না জানা আইন ভাঙার যুক্তি হতে পারে না। এখানে লিগ্যাল সাপোর্ট দেওয়ার পরিকাঠামো বা পলিসি কোনটাই আমাদের নেই। কিন্তু আমি তো জানি, আইন জানার জন্যে যে প্রাথমিক জ্ঞান প্রয়োজন, তা ওর নেই, আশাও করা যায় না - কিন্তু আমার হাত বাঁধা।
হাসপাতাল ও ভিডিও কল
- আপু, আমার আনএমপ্লয়মেন্ট ফাইল করতে লাগব।
যখন তখন ভিডিও কল। দিন নেই রাত নেই। ইংরেজি লিখতে পড়তে পারেনা তো। না আছে নিজেদের স্ক্রিপ্ট। নিরক্ষর। তাই সম্বল অডিও মেসেজ/ কল। সেফ হল ভিডিও। তা একটু তো ভাবতে পারে? নাকে নল, হাসপাতালের বিছানা, সকাল ৭টা।
ঘাবড়ে গেলাম।
- কী হল?
- অপারেশন হইসে। গুলি লাগসে পায়ে। পুলিশ আইন্যা ভর্তি করসে।
মাগো মা - একেকটা এমন situation- ভয়ে গা গুলিয়ে ওঠে।
প্রশ্ন করতেও বুক কাঁপে।
অনেক পুরুষ ক্লায়েন্টের কাছেও আমার ফোন নম্বর। নানা সমস্যা। আমার ফোনে বিশদ বর্ণনা দিয়ে ভিডিও, অডিও নানা ছবি হুড়মুড় করে ঢোকে সারাদিন। চামড়ার রোগ, আ্যালার্জি, অপারেশন, ফাটা মাথা স্টেপলর এর পিন দিয়ে লাগানো, শরীরের নানা জায়গার ছবি, ফোঁড়া, কাটা -
কী বলব? সেটাও জানিনা। আপু, দিদি, সিস্টার - এই মায়াভরা ডাকগুলিকে অসম্মানও তো করতে পারিনা।
শিয়াল যতই নীল বর্ণ ধারণ করুক না কেন হুক্কাহুয়া তো এড়াতে পারেনা। আমার ক্ষেত্রে এটা ১০০ ভাগ প্রযোজ্য ।
পুলিশ ও আমি
পুলিশের সাথে আমার এক অন্য দুনিয়ার সম্পর্ক। কি দেশে আর কি বিদেশে । আগরতলা, কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই, নাগপুর - সবজায়গায় নানাকারণে পুলিশের সাথে সংলাপ, ঝামেলা এবং সখ্যতা - সে কত গল্প মনে পড়ে।
- ২০১১ সাল। ভোটের রেজাল্টের পর মিনুর বরকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। এরমধ্যে মিনু কাঁদতে কাঁদতে ফোন। “বৌদি আমার বরকে বাঁচাও! কাউকে বস্তিতে না পেয়ে মিথ্যে কেস্ দিয়ে বরকে তুলে নিয়ে গেছে।” ভাঙা পা নিয়ে ওয়াকারে ভর দিয়ে কয়েকমাস বয়েসের সোহাগকে মা বাবার কাছে রেখে বেরিয়ে পড়লাম। থানায় ঢুকলাম। সবাই ব্যস্ত।
অনেক কষ্টে মিনুর বরের খোঁজ পেলাম। মিনু থানার মাটিতে লুটাচ্ছে - আমি ওয়াকারে দাঁড়ানো। হঠাৎ দেখলাম মিনুর বর। কোমরে দড়ি। তিনজন পুলিশ ধরে বড়বাবুর ঘরে নিয়ে যাচ্ছে।
আপনাদের বলে বোঝাতে পারব না - কী অসহায় , ক্ষোভ, লজ্জা ওর বরের চোখে। হাঁটতে পারছে না ওর বর। মিনু কাঁদছে আর বলছে “ বৌদি গো, চার ঘন্টা ধরে তো মেরেছে। আর মারলে তো মরে যাবে। এখনো আমার চোখের সামনে বর বৌ এর সেই দৃষ্টিবিনিময় জ্বলজ্বল করে। থানায় এবার আমিও প্রায় চিৎকার করছি ।
ওসিকে জিগ্যেস করলাম “ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওকে! “
ওসি - “বড়বাবুর ঘরে। কিচ্ছু হবে না। কয়েকটা প্রশ্ন করবে। ছেড়ে দেবে।”
এর মধ্যেই আ উ করে ভীষণ যন্ত্রণা আর গোঙানির আওয়াজ বড় বাবুর ঘর থেকে।
আমি তো হতবাক। কী হল? পাশে ড্রাইভার বলল “ বৌদি, আবার মারছে। “ মিনু অজ্ঞান হয়ে পাশে পড়ে গেল।
আমি একে তো অনেক ব্যাপারেই ভোঁতা। না জেনে বুঝে ঝাঁপ দিয়ে ফেলি। এরপর এসব ঘটনার সামনাসামনি হলে কি করা উচিৎ তা ও জানিনা।
ওসি সহ যত পুলিশ ছিল সবাইকে ডাকছি আর জানতে চাইছি যে কী হচ্ছে এসব! ওসি একটু অপ্রস্তুত । হঠাৎ করে মাথায় এল কোথায় যেন শুনেছি যে পুলিশ স্টেশনে/লক-আপে গায়ে হাত তোলা নিষেধ। সেই জ্ঞানের বক্তৃতা শুরু করলাম। পাশে ড্রাইভার বলল “ ও বোঝা যায় না। জয়েন্টে জয়েন্টে কাপড়ের ব্যান্ড বাঁধা থাকে। দাগ হয় না। প্রমাণ থাকে না” -
এসব অনেক কথা। আমার এখনকার গল্প তো অন্য। কিন্তু - না, সব কোথায় একটা এক সুতোয় বাঁধা।
এখানের ক্লায়েন্ট পুলিশের গুলি খেয়ে হাসপাতাল থেকে ভিডিও কল আর ঐদিনের যাদবপুর থানা - মিলেমিশে একাকার।
মিনুর বরের জন্য বসে আছি। একটা সময় পর সেদিন থানায় এক ধোপদুরস্ত নেতাকে দেখলাম । সে কী উত্তেজনা। বিজয়ী দলের নেতা। স্বাধীন আর কালিমাহীন সরকার গঠনের জ্বালাময়ী বক্তৃতা। এই লোক এল মিনুর বরের মত এক পোকার সম্পর্কে অভিযোগ লিখতে? মিনুর বর নাকি বিরোধী পক্ষের অসামাজিক দলের লোক। কোথায় রানি রাসমনি আর কোথায় …।
পুরো ব্যাপারটা দেখে যা বুঝলাম যে কাউকে না পেয়ে মিনুর বর হল “বলি কা বকরা” - চরম কিছু প্ল্যান সাজানো হয়েছে। মিডিয়া আসবে।
এদিকে মিনুর বরকে প্রথমে যখন খুঁজতে গেছি বস্তিতে - নানা দিক থেকে নানা কথা শুনে যে প্লট দাঁড়ালো সেটা হল -
মিনু আর ওর পরিবার ভাত খাচ্ছিল। হঠাৎ একজন ওর বরকে ডেকে বাইরে নিয়ে গেল। এবার পুলিশের জিপ থেকে এক বালতি ভর্তি বোমা এনে মিনুর ঘরের পাশে পুকুর পাড়ে ডোবানো হল। এরপর মিনুর বরকে বলা হল ঐ ডোবানো বালতিকে তুলতে। যেই হাত দিয়ে ঐ বালতি জল থেকে তুললো ওর বর - সাথে সাথে খচাখচ ছবি আর প্রমাণ তৈরি হল যে পরাজয়ী দল কি কি প্রাণঘাতী প্ল্যান করে রেখেছে আর বিজয়ী দল মুহূর্তের মধ্যে সব ধরে ফেলছে।
এত পুলিশের মাঝে এক পুলিশের চোখে দেখলাম কষ্ট। আমি ততক্ষণে বুঝে গেছি মিনুর বরের রক্ষা নেই। ঐ পুলিশ কিন্তু ইশারায় অনেক সাহায্য করছে। কখনো কখনো পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় টোটকা দিয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ কী মাথায় এল আমার - বলে উঠলাম “এবারের মত ছেড়ে দিন। আমি বিকেলের মধ্যে ওদের অনেক দুরে ওদের গ্রামে পাঠিয়ে দেব।” এখন ভাবি - কেন বললাম ঐ কথা? কে জানে! নেতাকে
একটু নরম মনে হল।
এর মধ্যে মিনু বলে উঠল “আমার বর কোন দোষ করেনি। অন্য দল টাকা দিয়ে বস্তির লোকদের কিনে নিয়েছে । আমার বরকে বলেছিল ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে বিজয়ী দলে নাম লেখাতে। আমার বরের টাকাও নেই আর ও নিজের দলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। তাই এখন ধরিয়ে দিচ্ছে। আমরা কেন গ্রামে যাব? অনেক কষ্ট করে এখানে রোজগার করি। গ্রামে তো ঘরে ছাউনিও নেই”
ব্যস! নেতা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন “হলো তো! শুনলেন তো! এরপরও কিছু করার কথা বলবেন?”
গটগট করে বেরিয়ে গেল পুরো দল। খালি ঘরে বোকা আমি দাঁড়িয়ে আর মিনু স্থির হয়ে মাটিতে বসে।
আমি হায়হায় করছি - মিনুকে বকছি - কেন এমন বলতে গেলে মিনু?
ঠান্ডা গলায় মিনু উত্তর দিল “আমাদের কেন যেতে হবে? আমার বর কোন দোষ করেনি।”
মিনুর বর গারদে ঢুকল। আমাকে বলা হল আজ রাতটাই নাকি রাখবে। এতটা সময় থানায় থেকে সত্যি মিথ্যে ধরতে খুব সুবিধে হচ্ছিল। বুঝে গেলাম এই মিথ্যেকেও। অসহায় আমি বাড়ি চলে এলাম। ফোন নম্বর রেখে এলাম থানায়। বেশ রাতে একটি ফোন এল।সেই পুলিশ - যিনি নানাভাব সাহায্য করার চেষ্টা করছিলেন। - “থানা থেকে বলছি। আপনার মিনু আর ওর বর সব সত্যি কথা বলছে। একটা মিথ্যে কেস সাজানো হয়েছে । আমাদের ওপর প্রচুর টার্গেট। এত অসামাজিক কাজ আসলে হচ্ছেই না । জোর করে লোক খুঁজে খুঁজে ঘটনা বানানো হচ্ছে। আপনাকে দেখে আমার খুব খারাপ লেগেছে । আপনি ওদের বিশ্বাস করেছেন এবং আপনার বিশ্বাসই ঠিক । যদি ওদের বাঁচাতে চান তাহলে একজন উকিল ধরিয়ে দিন! আমায় ক্ষমা করবেন। আমি কিচ্ছু করতে পারলাম না।”
ক্ষমতার লড়াই আর মিনুর আত্মসম্মান - এই আত্মসম্মানকে মর্যাদা দিতে গিয়ে ৫ বছর মিনুর বরের কেস চালিয়েছি আমি আর সায়ন।
বিনা কারণে দুবছর জেলে ছিল মিনুর বর। তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে মিনু দিন কাটায়। ওর সংসারের সিংহভাগ খরচ চালাই আমরা। পাঁচ বছর পর বেলে ছাড়া পায় ওর বর।
কী দোষ ছিল ওদের? গরিব! অশিক্ষিত? পরিযায়ী? উদ্বাস্তু ????
আমার কী দোষ ছিল? আমি তো কাড়িকাড়ি টাকার উপর গড়াগড়ি খাই না? কিন্তু ঐ পরিবারকে মাঝপথে ছাড়তেও তো পারলাম না! মধ্যবিত্তর জ্বালা!
এদেশে এসেও পার পেলাম না । ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে।
হাতকড়া পরে ভিডিও কল। কী কাণ্ড - আমাকেই কেন? পুলিশের গুলি খেয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আমাকেই ফোন করতে হল??? কী করেছে তা তো জানিই না - উল্টে এবার না পুলিশ ভাবে আমি ওর দলের সদস্য!
আবার খবরের খোঁজ। যা জানলাম সেই মিনুর বরের ঘটনার সাথে কত মিল। এক সাদা আমেরিকান ঐ ছেলেকে প্রায়ই রিফিউজি বলে গালি দেয় ওর দোকানে গেলে। একদিন ওকে বানিয়ে বানিয়ে চোর বানায়।
ঝামেলা হয়। পুলিশ আসে। সাদা আমেরিকানকেও ধরে। কিন্তু আমার ক্লায়েন্টের কথা হল - আমি দোষ করিনি। আমাকে ধরবে কেন? ব্যস - পায়ে গুলি।
মিনুর গল্প অপ্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে! আমার কাছে সব একাকার। অস্তিত্বের লড়াই- বেঁচে থাকার সংগ্রাম। রিফিউজি নিয়ে লেখা শুরু - আমি তো এখন দেখি সমাজের সব স্তর এই শব্দের সাথে নানাভাবে জড়িত।
কে কিভাবে রিফিউজি হল - কে বা কারা বানালো? রিফিউজি শব্দের সৃষ্টি কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হয়েছিল? এই শব্দ আর একে ঘিরে নানারকম কর্মসংস্থান বানিয়ে কত লোকের রোজগার হচ্ছে? কত লোক অন্যায় সুযোগ নিচ্ছে! আইনের ফাঁকফোকর বুঝে নকল রিফিউজি হয়ে যাচ্ছে -
আমার চোখের সামনে যত লোক দেখি - আমার তো মনে হয় সবাই কম বেশি উদ্বাস্তু! টাকা, পড়াশোনা আর স্বচ্ছল পরিবারের ছায়া থাকলে হয়ে যাই প্রবাসী! হাঃ!
টাকা না থাকলে অন্যায়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে বাস্তুহারা হলে - রিফিউজি —- অসাধারণ ক্লাসিফিকেশন।
বিদেশে এসে যুদ্ধ করে টিকে গেলে NRI - আর যে অতি কষ্ট করছে টিকে যাওয়ার জন্য - তার দিকে নাক সিঁটকে সমালোচনা- বিদেশে থাকার এত লোভ!” - নিজে সহজে রাস্তা করতে পেরেছে বলে অন্যদের সংগ্রাম/ ইচ্ছে / স্বপ্ন ছোট করার অধিকার অর্জন করে নেয়।
স্টিমুলাস চেক - কী সব কথা! বাড়ি বসে বসে গরিব লোককে খোলামকুচির মত টাকা দিয়ে ওদের কাজ করার মানসিকতা সরকার নষ্ট করে দিয়েছে! আমার চেনা বেশ কিছু অতি স্বচ্ছল পরিবার সেই নিয়মের ফাঁকে দিয়ে স্টিমুলাস চেকগুলো পেল! এক গুজরাটি পরিবার যার বেশ কিছু বাড়ি আর ব্যবসা - দশ হাজারের ডলারের বেশি স্টিমুলাস চেক পেয়ে নানা জায়গা ঘুরে এল। আর আমার সাথে কথা হলেই শুধু বলবে যে কাজ করার জন্য লোক পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার আনএম্প্লয়মেন্ট বেনিফিট আর স্টিমুলাস দিয়ে শ্রমিকদের অলস বানিয়ে দিয়েছে। অনেক বাঙালি তো লজ্জায় বলতেও পারে না যে স্টিমুলাস পেয়েছে। যে মুখে সমাজ সংস্কার আর দাতব্যের এত গল্প - সোসাইটিতে নাক উঁচু স্টেটাস - ওদের কথাবার্তা শুনে মনে হয় দয়ার দান যারা নেয় তারা খুবই নিম্নমানের মানুষ । কিন্তু নিজের ভাগ কেউ ছাড়েনা।
হ্যাঁ - নিজের ভাগ ছাড়ার তো কথা ও না। কিন্তু অন্য কেউ ভাগ নিচ্ছে সেটা যদি হজম না হয় - তবে তো সমস্যা ।
নির্লিপ্ত থাকা - এর চাইতে কৃত্রিম আর কিছু হয় না। যে যেখানে যে কাজই করুক - ভালবেসে করুক আর জোর করে করুক - নির্লিপ্ত কি করে থাকা যায় - আর কেন? অন্যায় দেখলে অনেকেই পাশ কাটিয়ে চলে যাই - আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় নির্লিপ্ত - আসলে কি তাই? নির্লিপ্ত থেকে কি কোন কাজ করা যায়? আর প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে তার পূর্ব পদক্ষেপ জড়িত।
আমি রিফিউজি কমিউনিটির সাথে কাজের কথা লিখতে গিয়ে অনেক নিজের কথা নিজের অনুভুতির কথা লিখি। আমার অনুভূতি, আমার জীবনের নানা ঘটনা, স্মৃতি - কোথাও না কোথাও এখনকার এই কাজের সাথে জুড়ে যায়। তখন তো বোধও কম ছিল, অভিজ্ঞতা নেই, চারপাশে মানুষ যা করে তার অনেক প্রভাব পড়ে।
আমি যেখানে জন্মেছি, বড় হয়েছি - আমার বোন বা আমার চেনাজানা গণ্ডীতে অনেকেই জিজ্ঞেস করে “ তুই এগুলি দেখলি কীভাবে? এত বাংলার ডায়লেক্ট কি করে বুঝিস? একই বাড়ি বা একই জায়গায় তো আমরাও বড় হয়েছি। কই, এমন কিছু তো দেখিনি?”
সত্যিই তো আমি কি করে বুঝি এত ডায়লেক্ট - আমি প্রতি মুহূর্ত দগ্ধ হই যখন এমন কিছু ঘটনা মনে পরে যেখানে ক্ষমতা বা প্রতিপত্তি খাটিয়েছি। আমাদের রাজ্যে উপজাতি আছেন প্রচুর। আমার ছোট বেলায় রিক্সা চালক, দিনমজুর , বাজারে সব্জি বিক্রি - এসব কাজেই তাঁদের বেশি দেখতাম। এখন ভাবি - কত সংগ্রাম করেছে - নিজের মত করে জঙ্গলে পাহাড়ে শান্তিতে ছিল। চালাক, আধুনিক পরিযায়ীরা এসে পড়াশুনো, টাকা, ক্ষমতায়, নিজের যোগ্যতায় এগিয়ে গিয়ে রাজ্যের সিংহভাগ নিয়ে থাকতে শুরু করল ঠিকই - পাশাপাশি নিজের পাশে ওদেরও জায়গা তৈরি করতে, এগিয়ে নিয়ে যেতে আরো সাহায্য করতে পারত।
উপজাতি রিক্সাচালক দেখে রিক্সা নেওয়া – কারণ, ওরা “বোকা” -বাংলা ভাষাটা ঠিক বোঝেনা, দরদাম করতে জানেনা - বাঙালি রিক্সা ৫ টাকা নিলে উপজাতি রিক্সাওয়ালা ৩ টাকাতেও রাজি হয়ে যেত। ঐ ২ টাকায় স্বপন কুমারের বই, লটকন্, হজমি, আচার, বড়ই - সব করেছি।
আমাকে এখন এই স্মৃতিগুলি কষ্ট দেয়। ২০১৫ তে গিয়ে আমি পাগলের মত কিছু মুখকে খুঁজেছি । একটু ক্ষমা চাওয়া- একটু যদি নিজেকে কাজে লাগাতে পারি।
কলকাতায় যে মহিলা মাছ কেটে দিতেন - দুই হাত জলে জলে সাদা- সবাই দরদাম করত - আমিও করতাম - এখন মনে হয় - কেন??? কেন করলাম আমি? হ্যাঁ, আমিও ধনী ছিলাম না - এখনও নই - হয়তো ঐ মাছ কাটার মহিলা অনেক স্বচ্ছল ছিলেন - উনি সুবিধে মত ঐ জীবিকাকেই বেছে নিয়েছেন। শ্রমের মর্যাদা হিসেবে ওটা উনার প্রাপ্য । কেন আমরা এত স্টিরিওটাইপড?
এখন হয়তো অনেক পাল্টে গেছে - অনেক বছর যেতে পারিনা - সেই আমার মত করে আমার বিলাসী লড়াই করছি -
এখানে আমি যখন দেখি- কোন দরদাম নেই, যে যা করছে - মিনিমাম ওয়েজ এর স্কেল মেপে ঠিক সেই ন্যায্য পাওনাটা পাচ্ছে, সারাক্ষণই “এই বুঝি ঠেক গেলাম” এই অস্থির ধুকপুকানি নেই - নিজের ছোটবেলার দেখা কিছু ঘটনার জন্য খুব মন কেমন করে।
আমরা যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম, মালিক দিদা একদিন আমার বাবাকে বসেছিল যে বাজার থেকে কামলা নিয়ে আসতে । আমি বুঝেছিলাম “কামলা” মানে কোন “তরকারি” ।
আমার পরীক্ষা শেষ। আমিও বাবার সঙ্গে বাজারে গেলাম, বাবা বাজার করল। এরপর কাদের সঙ্গে কথা বলল। রিক্সা করে বাড়ি চলে এলাম । খুব কৌতূহল । বাড়ি গিয়ে “কামলা” তরকারি দেখব।
কিন্তু দিদার হাতে বাবা কিছু দিলই না - উল্টে বলল “কামলা আইতাসে।”
যাই হোক্ - সেই কামলা তো এল! আমি তো স্তব্ধ - তরকারির বদলে মানুষ??
বাবা ডেকে বলল “মাসিমা, কামলা আইসে।” - আমরা বাড়ি আসার প্রায় ১ ঘন্টা পর এসেছিল। এখন বুঝি, ওকে হেঁটে আস্তে হয়েছিল। আমাদের ঐ মালিক দিদা কামলা দেখে মোটেই খুশি হয়নি - বাবাকে ডেকে বললেন
“কিতা আনলা - গায়ে তো জোরই নাই। এই বুড়া কামলারে দিয়া কি হইব। আমার টাকাডি জলে যাইব।”
আমি কত্ত ছোট - ক্লাস ওয়ান কি টু হবে - এখনও আমার গাল গরম হয়ে যায় মনে পড়লে। আমি, আমার বোন, পাশের বাড়ির কুট্টু, ভুতু, টিনা - সবাই উত্তেজিত ছিলাম কামলা দেখব বলে। আমাদের সামনে নিজের ঐরকম evaluation কেমন লেগেছিল কামলার? জানিনা।
মালিক দিদা অর্ধেক টাকায় রফা করেছিল। বাবু টাকা আলাদা করে দিয়েছিল। কামলার কাজ ছিল সারা বাড়ি, পুকুরের চারপাশের আগাছা পরিষ্কার করা। আমি আর আমার চার সঙ্গী - যারা সবাই আমার চাইতে ছোট - আমরাও আমাদের ছোট ছোট হাতে কামলার সঙ্গে কাজ করেছিলাম কিছুক্ষণ।
অনেক কথা ভুলে যাই। কিছু কিছু কথা সপাং সপাং করে আঘাত দেয়।
একদিক দিয়ে ভাবতে গেলে - ঐ মালিক দিদা তো ঠিক। টাকা দিয়ে কাজ করাবেন - বুঝে শুনেই তো নেবেন। কিন্তু অপেক্ষাকৃত দুর্বল মানুষের কি কোন জায়গা নেই? নিজের কাছেও গুলিয়ে যায়। কী এর সমাধান? জেনেশুনে যাচাই করে, বিচার করেই যে কোন সার্ভিস কেনা বেচা করা হয় এবং উচিৎ। একই জিনিস নানা ব্র্যান্ড মার্কেটিং-এর দৌড়ে টিকে থাকছে যার যার জায়গায়। কিন্তু মানুষের মার্কেটিং ….সেটাও জরুরী। কিন্তু এভাবে?
এখানের যত রিফিউজি পরিবার আমি জানি - আমায় যদি বলা হয় একটা গরিব পরিবারকে আলাদা করে দেখাতে - আমি পারব না। আমাদের দেশের হিসেবে এরা কেউ গরিবই না। এত সিকিউরিটি কোত্থাও পাবে কি না জানিনা।
SSN আছে, কাজ করার পার্মিশন আছে, গ্রিনকার্ড পেয়ে যায় ১/২ বছরের মধ্যে - সরকারি সুযোগ - স্বাস্থ্য, খাবার - বিনে পয়সায় স্কুল -
নানারকম ভাতা - কী চাই আর আপাতদৃষ্টিতে?
গরিব শব্দটা আপেক্ষিক । তেমন ধনী , ভাল, খারাপ - সবগুলোই - নির্ভর করছে অন্য একটি মাপের উপর।
বেঁচে থাকার জন্য যা যা মিনিমাম দরকার - সেসব সব তৈরি থাকলে সংগ্রাম তো অনেক সহজ হওয়া উচিত।
শীততাপনিয়ন্ত্রিত বাড়ি, আসবাবপত্র, পরিবার চালানোর জন্য রোজগারের ব্যবস্থা করে দেওয়া, কাজ শেখানো, নানা রকম ট্রেনিং - কত ব্যবস্থা । এরপরও ক্লার্কস্টন শহর খুসি না ।
এই অখুসির প্রধান কারণ হল অশিক্ষা। শর্টকাট পদ্ধতিতে টাকা রোজগার, আইনের ফাঁক খুঁজে অসদ্ব্যবহার।
এই যে এত এত টাকা পেল স্টিমুলাস চেক - কিচ্ছু পাওয়া যাবে না। পরের মাসে আবার বাড়ি ভাড়া চেয়ে আবেদন। ইউটিলিটি বিলের জন্য আবেদন। আমি এক মহিলার কুড়িহাজার ডলার পর্যন্ত বাড়ি ভাড়ার আ্যাপ্লিকেশন মঞ্জুর করতে হয়েছে। রিফিউজি হিসেবে এ দেশে এসেছিল। এখন সিটিজেন। চোদ্দহাজার ডলার স্টিমুলাস পেয়েছে! এরপরও কুড়িহাজার???
আমার কুর্দিশ কলিগের নেটওয়ার্ক তাকে এই টাকা পাইয়ে দিয়েছে!