স্যার আরেন্টি - বাঙালি ইন্টেলেকচুয়ালের বাবা ইন্টেলেকচুয়াল যেমতি লিখিয়াছিলেন, "এত বুড়ো কোনোকালে হব নাকো আমি / হাসি-তামাশারে যবে কব ছ্যাব্লামি", তেমতি আমি হাসি-তামাশার পালে এমতি ইন্টেলেকচুয়াল হাওয়া দিব।
পাবলিক ইন্টালেকচুয়ালদের প্রতি বাঙালির যুগপৎ শ্রদ্ধা আর সন্দেহ।
কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় গল্প করেছেন সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ কফি হাউজে উৎপল দত্ত টেবিলে বসে হ্যামলেট চরিত্রের ব্যাখ্যা করছেন। অবস্থাগতিকে অন্য টেবিল ফাঁকা না পাওয়ায় দেবশরণ নামের এক যুবকও বাধ্য হয়েছেন সে একই টেবিলে বসতে। এ বোধহয় পঞ্চাশের দশকের কথা। দেবশরণের ততদিনে ক্লেম-টু-ফেম হল তৎকালীন দুঁদে ইংরিজিনবিশ নিরঞ্জন মজুমদারের কান মুলে দেওয়া। নিরঞ্জন মজুমদার 'শীতে উপেক্ষিতা' নামে একটি বই লিখে কিছু নাম করেছিলেন। তারপরে একটি ধারাবাহিক উপন্যাসে হাত দেন, তার উপজীব্য হল বন্ধু পত্নীর সঙ্গে অবৈধ প্রেম। হঠাৎ দেবশরণের সামাজিক ঔচিত্য জেগে ওঠায়, কফি হাউজে ঢোকার মুখে নিরঞ্জন মজুমদারকে পাকড়াও করে কান মুলে দিয়ে বলেছিল, এসব আবার লিখতে দেখলে জুতিয়ে খাল খিঁচে নেব।
তো এ হেন দেবশরণ উৎপল দত্তর টেবিলে বসে শুনে যাচ্ছেন, উৎপল তাঁর সঙ্গীকে লরেন্স অলিভিয়ের অভিনীত হ্যামলেটে কীভাবে হ্যামলেট চরিত্রের ইন্টারপ্রিটেশন করেছিলেন। অলিভিয়েরে ইন্টারপ্রিটেশনে নাকি হ্যামলেটের একটা পিউরিট্যানিক স্ট্রিক ফুটে উঠেছিল। এসব হাই লেভেলের ইয়ে যখন চলছে, দেবশরণ বুড়ো আঙুল নাচিয়ে উৎপল দত্তকে বলেছিলেন যে, যে হ্যামলেটকে তার বাবা, তার মা, তার কাকা কেউ বুঝতে পারল তার সব তোমরা বুঝে বসে আছ!
উৎপল দত্তকে ঠিক পাবলিক ইন্টালেকচুয়াল বলা যাবে কিনা সেটা ভাববার কথা। উৎপল নিজে কী ভাবতেন জানিনা, কিন্তু অন্যত্র উৎপল অনন্যসাধারণ নট, নাট্য-প্রযোজক ও ভাল নাট্যকার হিসেবে পরিচিতি পেতেন, পাবলিক ইন্টালেকচুয়াল হিসেবে নয়। সত্যজিৎ রায়ও ক্রিয়েটিভ পার্সোনা হিসেবেই খ্যাতি পেতেন, যেমন পেয়েছেন। সেই সঙ্গে বুদ্ধিজীবীর তকমা পেতেন কিনা বলা শক্ত। আজ থেকে ধরুন বছর সত্তর-আশি আগে, বাংলায় বামপন্থী আন্দোলন গেঁড়ে বসা থেকে, ইন্টেলেকচুয়ালিজমের খুব বাই ওঠে। এসবই কলকাতা-কেন্দ্রিক ও কলকাতা পরিচালিত ব্যাপার-স্যাপার। এই বঙ্গে কলকাতার বাইরে বুদ্ধি ও পড়াশুনো চর্চার কেন্দ্র হিসেবে কিছু জায়গার খ্যাতি থাকলেও, তার কিছু আগে থেকেই কলকাতা মূলতঃ এ ধরণের কাজকর্মের ঘাঁটি হয়ে উঠেছিল। পশ্চিমবঙ্গে এই বুদ্ধিজীবী কালচার এমনই গুরুতর হয়ে উঠেছিল বিনয় ঘোষের এ নিয়ে একটি আখাম্বা প্রবন্ধসংকলনই আছে 'বাংলার বিদ্বৎসমাজ'। বেরিয়েছিল ১৯৭৩ সালে, বঙ্গসমাজের ইন্টেলেকচুয়াল ক্যাংলাপনার গনগনে দ্বিপ্রহরে। প্রবন্ধগুলো তার আগে লেখা। সেখানে রাশিয়ান ইন্টালিজেনসিয়ার বাংলা হিসেবে বাঙলা বুদ্ধিজীবী শব্দকে সনাক্ত করেছেন। এর কিছু আগে থেকে, ধরুন পঞ্চাশের দশক, কবি, সাহিত্যিক, নট-নাট্যকার, চিত্র-পরিচালক (শুধু আর্ট ফিলিমের পরিচালক, কমার্শিয়ালদের জায়গা নাই) - এনারাই সব বুদ্ধিজীবী হতেন। কিন্তু ধরুন একজন সফল ডাক্তার কি ইঞ্জিনিয়ার কিম্বা বিজ্ঞানী - এনারা কোনদিন বুদ্ধিজীবী হবেন না। সফল ব্যবসায়ী? ওরেব্বাবা, বুদ্ধিজীবী তো নয়ই, তার ওপর ব্যবসায় যদি লাভ হয়ে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই শ্রমিক শোষণ আর নয় দু-নম্বরী। অধিকাংশ সময়ে দুইই। নব্বইয়ের দশক থেকে অবশ্য টিভিতে চেঁচালেই বুদ্ধিজীবী তকমা পাওয়া যেত। অধুনা তো ইংরিজিতে যাকে সেলিব্রিটি বলে, বাংলায় তাকে বুদ্ধিজীবী বলা হয়। আর সেলিব্রিটি তাকেই বলা হবে যাকে অন্ততঃ দুমাসে একবার পঁয়েরো সেকেন্ডের জন্যে টিভিতে বাইট দিতে দেখা যায়।
বাঙালি ইন্টালেকচুয়ালের এই গরিমাময় অতীত নিয়ে আমরা খুবই গর্ববোধ করে থাকি। আমরা মানে জনগণ ও আনন্দবাজার। আমাদের উঠতি বয়েসেও দেখেছি শক্ত-শক্ত বইয়ের নাম বললে, কঠিন বিদেশী ছবি-টবির নাম বলতে পারলে সম্ভাবনাময় আঁতেল বলে নাম কেনা যেত। এমন কি সুনীল গাঙ্গুলিও বলেছেন দীপক মজুমদার সর্বদা নাকি খটোমটো নামের অপ্রচলিত বই হাতে করে ঘুরতেন। তখন থেকেই এই ছিল আঁতলামির অভিজ্ঞান। সেই বইয়ের বুকমার্ক হিসেবে কেউ যদি ফিল্ম সোসাইটির মেম্বারশিপ কার্ড ব্যবহার করতে পারেন, তো তিনি সর্বজনপূজ্য আঁতেল। আর সে ফিল্ম সোসাইটি যদি কুলীনস্য-কুলীন 'ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি" হয়, তাহলে আপনি আঁতেলচূড়ামণি। কারণ তদ্দিনে পাড়ায় পাড়ায় 'ফিল্ম সোসাইটি' গড়ে উঠেছে। আমাদের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও একটি ফিল্ম সোসাইটি ছিল। গান্ধী ভবন নামক একটি অন্ধকূপে মঙ্গলবার-মঙ্গলবার ছবি দেখান হত। বিদেশি ছবি বোঝা যেত, সাবটাইটেল থাকত বলে। বাংলা বা হিন্দি ছবি কিস্যু বোঝা যেতনা। একে তো দুর্বোধ্য 'আর্ট ফিল্ম'। তার ওপর সাবটাইটেল নেই। গান্ধী ভবনের অডিও সিস্টেম এমন যে নিজের কথা সাবটাইটেল পড়ে বুঝতে হয়। কাজেই বাংলা-হিন্দি কথা কোন বিজাতীয় ভাষায় বেরোত। এখানেই সত্যজিতের কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছিলাম। তার নাকি প্রিন্ট অনেকদিন হারিয়ে গেছিল। খুঁজে পাওয়ার পরে যাদবপুরে গান্ধী ভবনে স্ক্রিনিং হল। অডিও সিস্টেমের দৌলতে সে ছবি আমরা দেখেছিলাম 'ছবিতে-গল্প' হিসেবে।
আমাদের ছাত্রাবস্থায় খুব শক্ত বই পড়া পাবলিকের মুখোমুখি আসার সৌভাগ্য তেমন হয়নি। আমাদের নিজেদের দৌড় ছিল জেমস জয়েস, বিশেষতঃ ইউলিসিস, 'রাইজ অ্যান্ড ফল অফ দা থার্ড রাইখ' অব্দি। বাংলা বইয়ে কোন পয়েন্ট পাওয়া যেত না। তারপরে এল অনলাইনের যুগ। আগে দেখনদারি করতে একটা বই অন্ততঃ কাছে রাখতে হত। বিশ্ব ভার্চুয়াল হওয়ায় বইয়ের দেখনদারিও ভার্চুয়াল। এক গভীর আঁতেল - যে কথায় কথায় বই ও লেখকের নাম বলত - গোপনে পরে স্বীকার করেছিল, আমাদের সন্দেহকে সত্যি করে - তার অধিকাংশ নেম ড্রপিংই বইয়ের ব্লার্ব আর বিব্লিওগ্রাফি পড়ে।
সেই উঠতি বয়েসে আমরা পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল হিসেবে দু-চারজনের নাম শুনতাম। তবে এনাদের অভিমত-টত কোনদিন কাগজপত্রে দেখেছি বলে মনে নেই। যেভাবে বার্নার্ড শ বা বার্ট্রান্ড রাসেলের, বা অধুনা নোয়াম চমস্কির, পাবলিক ইন্টালেকচুয়াল হিসেবে প্রতিষ্ঠা, বাংলায় বোধহয় রবীন্দ্রনাথের পরে সে জায়গা কেউই নিতে পারেননি। ওপার বাংলায় পেয়েছি আহমদ ছফা প্রমুখদের। যদিও নোয়াম চমস্কিকে পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল বললে হয়ত উনি নিজেই চটে যাবেন। পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল সমাজের বিবেক। যদিও এই পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালের কনসেপ্ট এসেছে খুব সম্ভবত প্রাচীন রোমান সমাজ থেকে। অন্নদাশংকর রায় বেঁচে ছিলেন যখন, তখন উনি পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল ততটা নয়, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির বিবেক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন আমাদের মনে। আমাদের মানে জনগণের আর আনন্দবাজারের। পরে সেই শিরোপা পেয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ, ২৩৫-এর রোষ উদ্রেক করেও। সেখানেও আমাদের, মানে জনগণ ও আনন্দবাজারের ষড়যন্ত্র। এখন সেই পদের দাবীদার পার্ট-টাইম কবি, স্মার্ট গীতিকার, বেসুরো গাইয়ে ও প্রাক্তন কলমচি - আনন্দবাজারের - চন্দ্রিল ভট্টাচার্য। আমরা, মানে জনগণ ও আনন্দবাজার, এই দাবীর পেছনে মুঠো হাত তুলে দাঁড়িয়ে পড়েছি।
ব্যক্তিগতভাবে অরিজিনাল থিংকার সাধারণ বাঙালির মধ্যে অনেকদিন পাইনি। শুধু অরিজিনাল থিংকার হলেই হবে না, বিবেকবান ও আধুনিকও হতে হবে। নীরোদ সি চৌধুরী অরিজিনাল থিংকার ছিলেন না এ কথা কেউই বলবে না। কিন্তু মানসিকভাবে বাস করতেন ঊনবিংশ শতাব্দীর 'দা গ্রেট রাজ' জমানায়। চিন্তা ও মননের ব্যাপ্তি, মৌলিক চিন্তা, বিবেকের শাসন ও নিজের সময়েকে মেপে নেবার ক্ষমতা - এই নিয়ে কবে একজন বাঙালি আসবেন, তার অপেক্ষায় আছি। নস্ত্রাদামুস কি কিছু বলেছেন?
তবে এটাও ঠিক যে বাঙলার আদ্যন্ত মেরুকরণ ঘটা সমাজে পাবলিক ইন্টালেকচুয়ালরা যে ঠিক কী করবেন সে কথা ভেবে ওঠা শক্ত। টিভিতে চেঁচানো ছাড়া। তবে জমি খোলা আছে। তল্পিতল্পা নিয়ে বসে পড়লেই হল।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।