আধুনিক যুগের অখন্ড ভারতের ইতিহাস, অর্থাৎ আজকের দিনের ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ – এইগুলো তুলনামূলক মাত্র কিছুদিন আগে বলে আমাদের সবার মনেই কমবেশী দাগ কাটা আছে বা আমরা সেই সবের ইতিহাস বেশী মনে রাখতে পারি। কিন্তু যদি প্রশ্ন রাখি আজ থেকে হাজার বছর বা দেড় হাজার বছর আগের ‘বৃহত্তর ভারত’ বিষয়ে আমাদের কতটা কি ধারণা আছে – তাহলে দেখা যাবে আমাদের অনেককেই বেশ ভাবতে হচ্ছে এবং মাথা চুলকাতে হচ্ছে। যাঁরা এই সব নিয়ে পড়াশুনা করেন তাঁদের কথা হচ্ছে না – তাঁরা আমার থেকে বেশি জানবেন – কথা হচ্ছে আম জনতার। তো সেই হিসাবে দেখা গেলে ‘বৃহত্তর ভারত’ সম্পর্কে গড়পড়তা জনতার ধারণা বেশ ঝাপসা।
কিন্তু এটা তো ইতিহাসের ক্লাস নয় বা রাজাদের সাম্রাজ্য বিস্তার ব্যখ্যা করার জায়গা নয়। লিখতে বসেছি ভারতের বাইরের কিছু প্রাচীন প্রাচীন হিন্দু মন্দির এবং তাদের আর্কিটেকচার নিয়ে। তার আগেই একটু ব্যাকগ্রাউন্ড বলে নেওয়া আর কি। আজকের দিনে আমরা অনেক কিছু নিয়ে হা-হুতাশ করি – আগে সব ভালো ছিল, এখন সব বখে গেছে, আগে আমরা কি উন্নত ছিলাম অমুক আর তমুক এসে আমাদের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। এই সব কথায় অনেক সময় যুক্তি থাকে, বেশীর ভাগ সময়েই থাকে অবেগ। তবে তথ্য এবং ইতিহাস নিয়ে নেড়ে ঘেঁটে দেখলে দেখবেন আমাদের গর্ব করার কিন্তু কম জিনিস ছিল না। একসময় আমাদের ভারতীয় সভ্যতা যে কি শিখরে উঠেছিল তা এই সব মন্দির, স্থাপত্য দেখলে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে জানান দেয়। তাই বলি কি গর্ব করুন অবশ্যই – কিন্তু কি নিয়ে গর্ব করছেন সেটার ব্যাপারে একটু খোঁজ খবর রাখুন, আর আমরা ভালো মানে বাকিরা খারাপ বা বেদে সব আছে, এমন অযৌক্তিক সরলীকরণ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন।
এটা আমরা সবাই জানি বা ইতিহাস পড়ে দেখেছি যে প্রাচীন কালে সাম্রাজ্য, রাজত্ব, রাজা ইত্যাদি অ্যাডমিনিষ্ট্রেটিভ জিনিসগুলো হাত ধরাধরি করে চলত ধর্মের সাথে – তা সে প্রাচীন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টধর্ম বা পরের দিকে ইসলাম – যাই হোক না কেন। তাই মন্দিরের গল্প করতে গেলে রাজার গল্পও চলে আসবে – কারণ তাঁরাই ছিলেন সেই সব বানাবার প্রধান পৃষ্ঠপোষক।
ভারতের বাইরে হিন্দু মন্দিরের সবচেয়ে প্রাচীন উপস্থিতি টের পাওয়া যায় আজকের দিনের ভিয়েতনামে, খৃষ্ট পূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত – সূর্্য দেবতা, শিব এবং বিষ্ণুকে নিবেদিত। আমি উপরে যে ‘বৃহত্তর ভারত’ এর উল্লেখ করেছি তা একসময় বিস্তৃত ছিল আজকের দিনের মায়নামার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, কাম্বোডিয়া, লাওস এবং ভিয়েতনাম জুড়ে। সংস্কৃতে লেখা পাথরে খোদাই পাওয়া গেছে ভিয়েতনামে খৃষ্টীয় দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শতাব্দীতে ভিয়েতনামে বা চতুর্থ এবং পঞ্চম শতাব্দীতে কাম্বোডিয়াতে। সেই সময় থেকে শুরু হয়ে দেখা গেছে প্রায় ১৪শ শাতাব্দী অবধি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সব দেশে স্থানীয় প্রভাব যুক্ত হিন্দু মন্দির তৈরী হয়েছে। অনেকসময় হিন্দু এবং বৌদ্ধধর্ম পুরোপুরি আলাদা না থেকে জন্ম দিয়েছে এক মিশ্র ঐতিহ্য এই দেশগুলিতে এবং মন্দিরে এই সব ছাপ রয়ে গেছে। পরের দিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মূলত বৌদ্ধ ধর্ম থেকে যায় কেবল মাত্র মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশীয়া ছাড়া – এই দুই দেশে ইসলাম ধর্মে এসে বৌদ্ধধর্মকে প্রতিস্থাপন করেছিল।
আজকে কাম্বোডিয়ার গল্প – কাম্বোডিয়া বলতেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে আঙ্কোরভাট মন্দিরের কথা – যা ভগবান বিষ্ণুর জন্য বানানো – এবং ভারতের বাইরে সবচেয়ে বড় হিন্দু স্থাপত্য এই আজকের দিনেও। সেই আঙ্কোরভাটের গল্প অন্য দিন – আজকে আঙ্কোরভাট থেকে অল্প দূরে সেই হারিয়ে যাওয়া শহর ‘আঙ্কোর-থোম’ নিয়ে দুই চার কথা হয়ে যাক।
আসলে এই আঙ্কোরভাট বা আঙ্কোরথোম সবই একটি চত্ত্বরের অংশ যা ছিল এককালে খেমের সাম্রাজ্যের রাজধানী শহর ‘আঙ্কোর’ – এই শহরকে আগে ‘যশোধরাপুর’ ও বলা হত। আঙ্কোর কিন্তু আমাদের সংস্কৃত শব্দ ‘নগর’ এর অপভ্রাংশ। আমাদের যেমন গুপ্ত যুগে ভারত উন্নতির চরম শিখরে উঠেছিল, ঠিক তেমনি কাম্বোডিয়া উন্নতির শিখরে উঠেছিল এই ‘খেমের’ সাম্রাজ্য কালে যা প্রায় ৯ম থেকে ১৪শ শতাব্দী পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। খেমের হিন্দু রাজা দ্বিতীয় জয়বর্মণ এর সময় থেকে আঙ্কোর স্বর্ণযুগের সূচনা – উনি নিজেকে সারা পৃথিবীর সম্রাট, ভগবান প্রেরিত ইত্যাদি ঘোষণা করে সিংহাসনে চড়ে বসেন।
পুরানো দিনের আঙ্কোর শহর আজকের কাম্বোডিয়ার সিয়াম রীপ শহরের কাছে অবস্থিত – কথিত আছে এই এলাকা জুড়ে নাকি প্রায় হাজারের বেশী মন্দির আছে। বেশীর ভাগই ভগ্নপ্রায় – কিছু কিছু মন্দির পুনর্নিমাণ-এর কাজে হাত দেওয়া হয়েছে – কিন্তু সে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। একবার ঘুরলে বুঝতে পারবেন সে কি বিশাল জটিল কাজ হবে সব কিছু রিষ্টোর করা। তবে ইউনেস্কো যবে থেকে আঙ্কোরভাট এবং আঙ্কোরথোম-কে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের আখ্যা দিয়েছে তবে থেকে কিছু কিছু আন্তর্জাতিক সাহায্য আসতে শুরু করেছে। আজকের দিনে কাম্বোডিয়ায় এই দুই স্থাপত্য দেখতে সবচেয়ে বেশী পর্যটক আসেন – বছরে প্রায় ২০ লক্ষ!
এবার আঙ্কোরথোম নিয়ে কিছু বলা যাক – যারা বেশী জানতে উৎসাহী তাঁরা উইকি পেজ বা ইন্টারনেট দেখে নেবেন প্লীজ। এখানে সব লিখতে গেলে হাত ব্যাথা হয়ে যাবে – আমার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে যদি কারো মনে কিছুমাত্র ইন্টারেষ্ট জাগানো যায় – একবার ইন্টারেষ্ট জেগে গেলে বাকিটা আপনারা নিজেরাই খুঁজে নিতে পারবেন। আঙ্কোরথোম এর অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘মহৎ শহর’ – এটাই খেমের সাম্রাজ্যের শেষ এবং সব থেকে বেশী দিন স্থায়ী রাজধানী ছিল। রাজা সপ্তম জয়বর্মণ দ্বাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে আঙ্কোরথোম এর পত্তন করেন।
প্রায় ৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই শহর – অনেক কিছু স্থাপত্য এবং মন্দির আছে এই চত্ত্বরে। এই সব স্থাপত্য দেখলে বুঝতেই পারবেন এগুলো ভারতের উত্তর এবং দক্ষিণের মন্দির/স্থাপত্য থেকে অনুপ্রাণিত। কিন্তু এমন উদাহরণ পাবেন না যেখানে ভারতের কোন এক মন্দির পুরোপুরি অনুকরণ করে এরা অন্য একটা মন্দির বানিয়েছে। ভারত থেকে অনপ্রাণিত হয়েছে – কিন্তু মিশিয়েছে স্থানীয় সংস্কৃতি এবং আপন মনের মাধুরী। আর এই আঙ্কোরথোম-এর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ মনে হয় রাজা সপ্তম জয়বর্মণের কুলদেব/দেবীর মন্দির ‘বায়ন’ – একেবারে শহরের মধ্যভাগে এই মন্দির অবস্থিত – আশে পাশে আছে আরো অনেক কিছু, ‘বিজয়গাথা চত্ত্বর’ সহ অনেক স্থাপত্য।
ইতিহাস তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে ‘বায়ন’ মন্দিরের পূর্বনাম ছিল ‘জয়গিরি’, মানে বিজয় পর্বত। প্রথমে হিন্দু মন্দির থাকলেও রাজা জয়বর্মণের মৃত্যুর পর এখানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব বেড়ে যায় এবং মন্দিরের অনেক কিছু স্থাপত্য এবং ভাষ্কর্যের পরিবর্তন হয়। তারো পরে ফরাসীরা এখানে উপনিবেশ বানায় এবং বৌদ্ধ ধর্মে ‘বেনিয়ান ট্রী’-র গুরুত্ব বিচার ইত্যাদি করে মন্দিরের নাম চালু করে ‘বায়ন’ বলে।
এখন যদিও অনেক কিছু ভেঙে চুড়ে গেছে – তবুও দেখলে বুঝতে পারবেন কি অপূর্ব ছিল এক সময়ে এই মন্দির। একদম বাইরের দিকের দেওয়ালে আঙ্কোরের সেই সময়ের রোজকার জীবন এবং তাদের ইতিহাস খোদিত আছে। দক্ষিণ দিকের দেওয়ালে চিত্রিত আছে সব খেমের সৈন্য বাহিনী – তাদের সাথে সংগীতকার, ঘোড়ায় চড়া বাহিনী, হাতির ইত্যাদি ইত্যাদি। পূর্বদিকের গ্যালারীতে আছে খেমের গার্হস্থ্য জীবনের ছবি – ইত্যাদি ইত্যাদি
মন্দিরের ভিতরের দিকের স্থাপত্যে বর্ণিত আছে নানা পৌরাণিক কাহিনী – বেশীর ভাগই হিন্দু পুরাণের। হিন্দু ধর্মের ত্রিমূর্তি – ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এরা খোদিত আছে অনেক – আর আছে রাবণ থেকে সীতার ছবি – প্রচুর নৃত্যরত অপ্সরা ইত্যাদি। সমুদ্র মন্থনের গল্পও খোদাই করা আছে। মন্দিরের মাঝের দিকে, কিন্তু একধাপ উপরে আছে সবচেয়ে ইন্টারেষ্টিং অনেক গুলি স্তম্ভের মত। এক একটা স্তূপ/স্তম্ভ প্রায় তিন থেকে চারটি করে বিশাল আকারের হাস্যরত মুখের স্থাপত্য। এগুলোকে নাকি ‘লোকেশ্বর’-এর মুখ বলা হয় (চাইনীজ বুদ্ধধর্ম প্রভাবিত) – এক সময় নাকি বায়ন মন্দিরে এমন স্তম্ভের সংখ্যা ছিল ৪৯টি – কিন্তু এখন বেঁচে আছে মাত্র ৩৭টি – সব মিলিয়ে মুখের সংখ্যা প্রায় ২০০ এর কাছাকাছি।
আবার আঙ্কোরথোম-এর কথায় ফিরে আসা যাক – শুধু বায়ান মন্দিরই তো নয়, আরো অনেক মন্দির আছে এই চত্ত্বরে যেমন আগে বলেছি। জানামতে আঙ্কোরথোম-শহরে সবচেয়ে শেষ মন্দিরটি নির্মিত হয় ১২৯৫ সালে ‘মঙ্গলার্থ’ নামে। তার পর থেকে বারে বারে মন্দির সারানো বা মডিফাই করা হয়েছে, কিন্তু নতুন কিছু নির্মিত হয় নি। এত সুন্দর শহর পরিত্যক্ত হয় ১৬০৯ সালে এবং অনেক দিন থাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে।
সমস্ত বড় বড় নাম করা প্রাচীন শহরের মতই এই আঙ্কোরথোম-ও নির্মিত হয়েছিল সিয়াম-রীপ নদীর কিনারায়। শহরটি ঘেরা ছিল প্রায় ২৪ ফুট উঁচু দেওয়াল দিয়ে এবং এক এক দিকের দেওয়ালের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৩ কিলোমিটার করে। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম দিকের দেওয়ালের মধ্যস্থলের প্রবেশদ্বারের থেকে রাস্তা ছিল যারা গিয়ে মিলত শহরের মাঝে বায়ান মন্দিরে। পূর্ব দিকের প্রবেশদ্বারের থেকে ৫০০ মিটার দূরে ছিল ‘বিজয় দ্বার’ – এখান থেকে রাস্তা পূর্ব-দ্বারের সমান্তরালে গিয়ে মিশেছে ‘বিজয় প্রাঙ্গণে’ এবং রাজপ্রাসাদে।
শহরের প্রবেশ দ্বারের কাছে অনেক মুখের স্থাপত্য আছে – কিন্তু এগুলো কি বা কে বা কেন, এই নিয়ে নানা মতামত আছে। অনেকে বলে এরা একসাথে বানানো হয় নি – বরং পরে নির্মিত হয়েছে কালক্রমে, কেউ বলে এগুলো রাজার নিজের প্রতিবিম্ব, কেউ বলে এগুলো বোধিস্তত্ত্ব-কে প্রতিনিধিত্ব করে, কেউ বলে এগুলো রাজার রক্ষক – কেউ আবার বলে এগুলো সব কিছু মিলেমিশে গেছে, কোন একটা স্পেশাল উপলক্ষ্যে বানানো নয়। আবার কিছু পৌরাণিক চরিত্র বা উপকথার আখ্যানও দেখা যায় এখানে।
আজকের দিনে এই শহরে মূলত ঢোকা হয় দক্ষিণ দিকের প্রবেশ দ্বার দিয়ে – তবে উত্তর দিকের গেটে কিছু বেশ কিছু মূর্তি এখনো টিকে আছে। গেলে ওদিকটাও ঘুরে নেবেন। এত সুন্দর শহর পরিত্যক্ত হয় ১৬০৯ সালে এবং অনেক দিন থাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে। অদ্ভূত এক অনুভূতি হয় এই সব দেখতে দেখতে – ঢুবে যাই যেন অনেক দিন আগেকার এক কর্মমুখর প্রাণবন্ত শহরের কোলাহলে।
যেতে হবে ....
শিবাংশুদা, এটা পুরো আপনার ফিল্ড। আমার তো মনে হয় ভিয়েনতাম, কাম্বোডিয়া, ইন্দোনেশীয়া এই দেশ গুলো ঘুরে এসে আপনার অবিলম্বে এটা বই লিখে ফেলা উচিত। বাংলায় তেমন বই বিরল - আপনার বিষয়গত ফান্ডার জন্য (এবং ইন্টারেষ্টের জন্য) আপনি অনেক কিছু কানেক্ট করতে পারবেন খুব সহজে - একটা সময়কাল জুড়ে, নানা দেশে - লোকধর্মের বিবর্তন। যেটা আমার মত পাবলিক পারবে না চট করে