কিছু না বলে ওয়েটার সামনের চেয়ার থেকে উঠে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল৷ এতক্ষণ ধরে হিসাবরক্ষক এ দিকটায় তাকিয়ে ছিল৷ ওয়েটার তার সামনে গিয়ে দাঁড়ানো মাত্র সে নিচু স্বরে তাকে কিছু নির্দেশ দিল।
তিয়াসা সেদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল এর পরে কী হতে পারে! তাকে অবাক করে দিয়ে অনুমতি না নিয়েই ওদিকে বসে থাকা লম্বা মহিলাটি নিজের চেয়ার থেকে উঠে এসে ওয়েটারের ছেড়ে দেওয়া চেয়ারে বসে পড়লো৷ তারপর জামার বুক পকেট থেকে টিস্যু বের করে বড় ফ্রেমের চশমা খুলে মুছতে থাকলো৷ তার কৌতুকময় চোখগুলি দেখাচ্ছিল বেশ ছোটো৷ চশমা যথাস্থানে ফিরে গেলে সে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল তিয়াসার দিকে। যেন তার ভিতরটা অবলোকন করতে পারছে সে৷
তিয়াসার কৌতুহলী চোখের আর উৎসুক আঙুল চিবানোর দিকে খানিকক্ষণ একভাবে তাকিয়ে থাকল সে।
এবার তাহলে গল্পটা আবার শুরু করা যাক। উত্তরের প্রত্যাশা না করেই সে শুরু করে দিল বলা –
সেদিন হাসপাতালে ধ্বংসযজ্ঞ হয়ে যাওয়ার পর সেখানকার সেই নার্স সিদ্ধান্ত নিল সেখান থেকে চলে যাবার। সেই আগুন থেকে পাঁচজন রোগীকে উদ্ধারের কৃতিত্ব হিসেবে উপযুক্ত সম্মান পেয়েছিল সে, কিন্তু কোনো কিছুই তাকে আর সেখানে থাকার উৎসাহ যোগালো না।সবাই ভাবল ছেলেটির মৃত্যু তাকে শোকে আচ্ছন্ন করে তুলেছে। তাই সে আর এখানে থাকতে চাইল না।
বেশ কয়েক মাস বাদে অবশ্য ভিন্ন এক রূপে দেখা গেল তাকে, অন্য এক শহরে৷ তাকে চেনাই যাচ্ছিল না। সব কিছুতেই পরিবর্তন৷ এক ঢাল কালো চুল ছিল তার। এখন চুলে সোনালি রঙ করা৷ নার্সের সাদা রঙের পোষাকের বদলে উজ্জ্বল ঝলমলে রঙের পোশাক তার গায়ে।
সবচেয়ে বড় চমকপ্রদ আকর্ষণ হলো তার নতুন পেশা৷ সে এখন স্ট্যান্টওম্যান বা নকল অভিনেত্রী ৷ দেখিয়ে বেড়াচ্ছে শারীরিক-কসরতের নানা কৌশল। অকুতোভয়ে করে যাচ্ছে ভয়ঙ্কর সব জটিল কাজগুলো৷ ফলে শীঘ্রই নামী পরিচালকেরা নায়িকার ড্যামি হিসেবে তার সঙ্গে কাজ করতে শুরু করল৷ তার সময় বের করাই এখন দুরূহ হয়ে পড়ছিল। নিশ্চিতভাবেই এটা তার আগের পেশার তুলনায় অনেক বেশি সফল পেশা। নাম যশ অর্থ সব কিছুই উপচে পড়ছিল তার। কাগজে কাগজে ইন্টারভিউ ছাপা হচ্ছিল। ভালোই চলছিল সবকিছু। কিন্তু হঠাৎ এমন কিছু ঘটলো যাতে সবটাই স্তব্ধ হয়ে গেল৷
মানে? কী হল তার? তিয়াসা অধীর আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল।
সেদিকে তাকিয়ে মহিলা উত্তর দিল, নতুন এক পরিচালক চাইছেন অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীর প্রেক্ষাপটে প্রেমের গল্প নিয়ে ছবি বানাতে। তাঁর সিনেমায় একেবারে নতুন নায়ক নায়িকা। প্রথম দৃশ্য শুরু হবে রুদ্ধশ্বাস করা এক ঘটনা দিয়ে। তিনি ডেকে পাঠালেন এই মেয়েটিকে। প্রচুর পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মেয়েটি রাজিও হয়ে গেল। যদিও কাজটা খুবই বিপজ্জনক। তবু মেয়েটি জানালো সে এইধরনের ঝুঁকির কাজ নিতেই পছন্দ করে। ফলে কাজ শুরু হল। প্রথম দফার কাজ নির্বিঘ্নেই শেষ হল।
এবারের কাজ ভয়ঙ্কর উঁচু জলপ্রপাত থেকে আরো দুজন স্ট্যান্টম্যানের সাথে এক রাবারের নৌকায় লাফ দিতে হবে৷ সব নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দৃশ্য চিত্রায়ন যথারীতি রেকর্ড করা হচ্ছে৷ এমন সময় কিভাবে যেন দড়ি ছিঁড়ে গেল৷ যাত্রীসহ নৌকাটি জলপ্রপাতের শেষটায় পাথরে আছড়ে পড়ল৷ এক জনও বাঁচল না। আশ্চর্যভাবে একমাত্র সেই অল্প আঘাত নিয়ে বেঁচে রইল৷
ঘটনার তদন্তে দেখা গেল এটি কোনো নিছক দুর্ঘটনা নয়৷ দড়ি আপনা-আপনি ছিঁড়ে যায়নি, আসলে সেটি কেটে ফেলা হয়েছে৷ কে করেছে সেটি রহস্যাবৃতই রইল। গোয়েন্দা ও পুলিশ সব খুঁটিয়ে দেখে রিপোর্ট দিল, এটা এক ত্রিভুজ প্রেমের গল্প ৷ দুই নারী এক পুরুষের সেই ছকে বাঁধা গল্প। পুরুষটি নতুন স্ট্যান্টওম্যানের প্রেমে মশগুল, অপর নারী তার প্রতি ঈর্ষান্বিত।
যদিও ইউনিটের সকলের জবানবন্দি অনুযায়ী, এই স্ট্যান্টওম্যান তাকে প্রত্যাখ্যান করছিল৷
তারপর, তিয়াসা তখন অধীর পরের ঘটনা শোনার জন্য।
তারপর সেই নারী দীর্ঘকালের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। বহু বছর বাদে সে আবার ফিরে এলো বেশ পরিবর্তন সঙ্গে করে৷ তার সোনালি চুল এখন লাল, খেলার পোশাকের পরিবর্তে অন্য রকম পোশাক এখন তার শরীরে৷ অনেকটা বেদুইনদের মত। একই সাথে ব্যবহারেরও পরিবর্তন। এখন সে সবসময় হাসিখুশি৷ আর রীতিমত তালিম নেওয়া নৃত্যপটিয়সী। তার এখনকার পেশাও চমকপ্রদ৷ সে এখন সার্কাসে যোগ দিয়েছে৷
মহিলা এই অবধি বলে চশমা খুলে মুছল। জল খেল। একটা স্মিত হাসি তার ঠোঁটের ডগায় মুহূর্তের জন্য খেলা করল। চশমা নিজের জায়গায় ফিরে গেলে আবার সে শুরু করল-
প্রথমে সে চাকরিতে সামান্য পদ পেয়েছিল। সার্কাসের পোশাকের দেখভাল, জন্তুগুলোর যত্ন নেওয়া, জোকারদের মেকআপ করতে সাহায্য করা এবং সারিবদ্ধ মেয়েদের পিছনের সারিতে নাচার কাজ ছিল তার। বেতনও ছিল খুব কম।
এই রুটিনের পরিবর্তন হতো না, যদি না নতুন আসা দু’জন জাদুকরের একজন সহকারীর প্রয়োজন পড়তো৷ মিস্টার কামু ও মিস কামনা নামের এই জাদুকররা নিজেদেরকে ভাই-বোন বলে পরিচয় দিতো৷ তারা এর আগে কোথায় কাজ করত বা কোথায় থাকত তা কেউ জানত না। তবে তাদের আচরণ ছিল বেশ সন্দেহজনক৷ পরস্পর হাত ধরতে, চুমু খেতেও তারা দ্বিধা করতো না৷ রটে যায় যে তারা প্রেমিক-প্রেমিকা, এবং অবৈধ সম্পর্কে জড়িত৷ অবশ্য তাদের কর্মযজ্ঞ শো’র বিশেষ আকর্ষণ হয়ে ওঠায় এ নিয়ে আর কথা বেশি উঠল না৷
এখানেই সেই নতুন মেয়েটির অংশগ্রহণ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলো৷ রিংয়ের খেলা দেখাবার পর সে এই দুই জাদুকরের সঙ্গে মঞ্চে প্রবেশ করত। সার্কাসের মাঝখানে জলপূর্ণ কাঁচের বাক্স রাখা হত, সহকারী ঝলমলে সাঁতারের পোশাক পরে তাতে ডুব দিত৷ তারপর জাদুকরেরা চকচকে লাল কাপড়ে ঢেকে তালা লাগিয়ে দিত বাক্সে। শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্তের সাথে চলত উচ্চস্বরে বাদ্যঝঙ্কার৷ যখন দর্শকদের উত্তেজনা চরমে উঠত তখনই কাপড়টা সরিয়ে ফেলে দেখানো হত বাক্স খালি, কিন্তু সেটা যথারীতি তালাবদ্ধ৷ একই সময় ড্রামের আওয়াজের সাথে পেছনের পর্দা সরে সেই সহকারী মঞ্চে প্রবেশ করত সম্পূর্ণ শুকনো অবস্থায়৷ দর্শকদের বাঁধ ভেঙ্গে যেত করতালি ও উচ্ছ্বাসে।
অবশ্য সার্কাসের আরেকটি খেলাও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সিংহের মুখের মধ্যে জীবন্ত মানুষের মুখ ঢুকিয়ে দেওয়ার খেলা।
কী অদ্ভুত তাই না? মানুষের জীবনের দাম কত কম! বাকিটা না শুনেই তিয়াসার প্রতিক্রিয়া শুনে সামনে বসা মহিলা তাকাল।
আচ্ছা নার্স মেয়েটির নাম কী তা তো বললেন না একবারও।
নামে কী বা আসে যায়! তবু যদি জানতে চান তবে বলি, তার নাম ধরা যাক বাসনা। অল্প হেসে মহিলা বলতে শুরু করল, কুড়িটি শো করার পর আচমকা জাদুকররা বাধ্য হল সার্কাস ছেড়ে চলে যেতে৷ ছাড়ার পেছনে ছিল কোন রহস্যময় কারণ৷
আসলে সেদিন শেষ শো-এর আগে কিছু একটা হয়েছিল৷ সেটা সঠিক জানা না গেলেও শো চলাকালীন যখন কাপড় দিয়ে ঢাকা পড়ে গেল বাক্স ,তখন দেখা গেল পর্দা সরিয়ে কেউ এল না৷ জাদুকররা বাদে সবাই অবাক হলেও স্থির হয়ে রইল। কিছুক্ষণ এভাবেই কেটে গেল। দর্শক এবার উত্তেজিত। তখন বাক্সটা আবারও একটা কাপড়ে মুড়ে দেওয়া হল। তবুও দর্শকের সামনে কেউ এলো না৷ যদি দর্শকেরা আগে থেকে কী হবে তা না জানতো তবে এটা বোঝা যেতো না৷ হট্টগোল শুরু হল৷ ফলে পুরো শো’র দফা রফা৷
তারপর? তিয়াসা জানতে চাইল।
তারপর! তারপর আর কী! শো শেষ হলে সবাই প্রাক্তন স্ট্যান্টওম্যান, যার নাম এখন বাসনা, তার খোঁজে বের হল, কিন্তু আশার গুড়ে বালি৷ তার অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ধরনে মনে হতে লাগল যেন ধরিত্রী তাকে গিলে ফেলেছে৷ ভাই-বোনকে প্রশ্ন করা হল কিন্তু তারা জানতোই না বাসনার কী ঘটেছে৷ তারা এর থেকে কোন দুর্ঘটনার আশঙ্কাকেও উড়িয়ে দিল৷ কারণ, বাক্সের নিচে যে ফাঁকা জায়গা রাখা থাকত দর্শকদের অলক্ষ্যে সেখান থেকেই তার উঠে আসার পথ। তারা শুধু আকারে ইঙ্গিতে বলল, কেউ সম্ভবত তার কাজে অসন্তুষ্ট ছিল। তাই তার এমনভাবে মঞ্চ থেকে পালিয়ে যাওয়া৷
পুলিশকে জানানো হয়নি? তিয়াসা উত্তেজিত গলায় জানতে চাইল।
না। রিংমাস্টার ভেবেছিল পুলিসকে জানাবে, কিন্তু জানালো না৷ তার আরেকটা কারণ ছিল- সেদিনই সিংহটা তার মুখের মধ্যে ঢোকানো মানুষটার মুন্ডু চিবিয়ে খেয়ে নিয়েছিল। সিংহের শরীর ও মন সেদিন কোনো কারণে বিগড়ে ছিল। বারবার চাবুক মারায় সে বিরক্ত হয়ে মঞ্চে এলেও খেলোয়ার মাথা ঢোকানো মাত্র সব রাগ তার উপর গিয়ে পড়ে। জনতা সেই দেখে ভয় পেয়ে চিৎকার করতে শুরু করেছিল। এতে সার্কাসের মালিকের দুঃশ্চিন্তা আরো বেড়ে গিয়েছিল।
এই অবস্থায় পুলিস এলে পুরো সার্কাস জুড়ে তল্লাশি চালাতো, হয়তো অনির্দিষ্টদকাল সার্কাস বন্ধ হয়ে যেত। সার্কাসের মালিক দুটো মানুষের পরিণতি মেনে নিলেও সার্কাস বন্ধ করার ক্ষতি মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। ফলে কোন অভিযোগ উঠলই না যাতে পুলিসের অনুসন্ধান দরকার পড়বে৷ অবশ্য দুই জাদুকরকে সার্কাস ছাড়তে বাধ্য করা হলো৷ তারপর সার্কাসের জনপ্রিয়তা কমলো কিনা বা সার্কাস বন্ধ হয়ে গেল কিনা আমার জানা নেই।
এই অবধি বলে মহিলা ‘আসি’- বলে উঠে গেল নিজের চেয়ারে।
বেশ রহস্যময়