ওঁদের হাতে সরল পাটিগণিতের অদৃশ্য বই। ১৮টি লোকসভা। একটি লোকসভায় ৭টি করে আসন। ১৮ গুণ ৭, সমান সমান ১২৬।
২০১৯ লোকসভা ভোটের এই হিসেব দেখিয়ে দিচ্ছেন আব্বাস সিদ্দিকির সেকুলার ফ্রন্টের অনুগামীরা।
২৪ জানুয়ারি মুসলিম ধর্মগুরু আব্বাস সিদ্দিকি হিজলি মাঠে সভা করতে আসেন। তিনি কয়েকদিন আগে একটি মঞ্চ তৈরি করেছেন। নাম "পিছিয়ে পড়া মানুষের যৌথ মঞ্চ"। উদ্দেশ্য সংসদীয় রাজনীতিতে কিছুটা ক্ষমতা দখল। এই মঞ্চে আরও যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের কেউ দলিত রাজনীতি, কেউ আদিবাসীদের পরিচিতির রাজনীতির সাথে যুক্ত।
অশোকনগর পুরসভার ১৫ নং ওয়ার্ড পার করলেই শ্মশান। তারপর হিজলি গ্রাম। জিরাট রোড পেরোলে বাইগাছি। সামনে ভুরকুণ্ডা পঞ্চায়েত। ওপাশে শ্রীকৃষ্ণপুর, নূরপুর অঞ্চল। অশোকনগর পুরসভার ২২ নং ওয়ার্ডে কিছু আদিবাসী মানুষ বাস করেন। বাকি অঞ্চলগুলিতে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যাই প্রধান। এমন একটি অঞ্চলে গত ২৪ জানুয়ারির সভাটি কয়েকটি প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গেল। প্রায় সাত থেকে আট হাজার মানুষ এই সভায় হাজির ছিলেন। এর আগে মহিষপুকুর, আওয়ালসিদ্ধিতে আব্বাস সভা করেছেন। কিন্তু এটাই ছিল যৌথমঞ্চের প্রথম সভা।
২৪ জানুয়ারির সভায় মুসলিম সমাজের তরুণ অংশের উপস্থিতি ছিল মুখ্য। অনেকেই ভোটার নন, মাদ্রাসা ছাত্র। 'এই সভার উদ্দেশ্য কী?' জমায়েতের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজনকে প্রশ্ন করতে একবাক্যে জবাব এল -' ভাইজান আসবে।' একজন অগ্রবর্তীর কাছ থেকে আরেকটু স্পষ্ট উত্তর - "আমরা সবাই ভাইজানের ডাকে এসেছি।' 'আমরা বলতে?' 'দলিত, আদিবাসী আর হিন্দুরা আমাদের সঙ্গে আসছে। আমরা সবাই।'
কেন আসছে তারা? এখানে কত শতাংশ হিন্দু? এর কোন স্পষ্ট উত্তর অবশ্য এল না৷ বরং তৃণমূল সরকারের দুর্নীতি, সুযোগ সুবিধা না পাওয়ার জন্য ক্ষোভ রয়েছে। তাই এবার বদল চাই। বলছিলেন এম ডি কুতুবউদ্দিন। নিবাস শ্রীকৃষ্ণপুর। রেডিমেড কাপড়ের ব্যবসা। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ব্যবসা করেন, তাঁর মনে হয়েছে সবাই ভাইজানকে চাইছে।
'আব্বাসকে চাইছে মানে ভোটে জেতাতে চাইছে বলছেন?' উত্তর এল - 'হ্যাঁ'। যুক্তমঞ্চ প্রার্থী দেবে। উপস্থিত জনসংখ্যার কতিপয় আদিবাসী, যাদের সভায় নিয়ে এসেছেন আদিবাসীদের পরিচিতির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।
চর্মচক্ষে কয়েকজন দলিত নেতা ছাড়া ব্যাপক অংশের দলিত মানুষের উপস্থিতি অবশ্য সভায় চোখে পড়েনি। তাহলে তারা কোন পাটিগণিত মেনে বলছে আব্বাস সিদ্দিকির প্রার্থী জিতবে? দলিতের বড় অংশ বর্তমানে বিজেপির ভোটার, আর আদিবাসী ভোটারের সংখ্যা পরিসংখ্যানেও কম। তাহলে কীভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হবেন আব্বাস?
জিজ্ঞেস করলাম - 'বর্তমানে দেশের প্রধান বিপদ কারা?' তার জবাব, তৃণমূল, বিজেপি। দুজনের মধ্যে কে বেশি বিপদজনক? বিশেষত মুসলিম সমাজের পক্ষে? এবার সে জবাব দিল - বিজেপি। জানতে চাইলাম - ফ্রন্ট প্রার্থী দিলে তো তৃণমূল থেকে মুসলিম ভোটের একটা অংশ কাটবে। তাতে সুবিধা হবে বিজেপির।
কুতুবউদ্দিনের জবাব - তৃণমূল জিতবে না। বিজেপিও না৷ তাহলে কারা জিতবে? কুতুবউদ্দিনের প্রত্যয়ী জবাব - 'আমরা।'
কিন্তু কী ভাবে? ভোটের পাটিগণিতে তো সম্ভব নয়। প্রশ্ন করলাম, আপনারা কত শতাংশ? কুতুবউদ্দিনের জবাব, ৪৫% মুসলিম ভোটার আছে, তার সঙ্গে হিন্দু ভোট, দলিত ভোটও পাব। তাকে কিঞ্চিৎ নিরাশ করে বললাম, ৪৫% মুসলিম ভোট তো কোনও সরকারি পরিসংখ্যানে নেই। তাহলে? দৃঢ় প্রত্যুত্তর এল - সরকারি হিসেব ভুল। সারা রাজ্যে দু-একটা জেলা ছাড়া এত শতাংশ মুসলিম ভোটার নেই তো?
এবার কুতুবউদ্দিন নীরব। বিজেপি ক্ষমতায় এলে কি মুসলিম জনগোষ্ঠীর সমস্যা বাড়বে? রাজ্যের সমস্যা কি বাড়বে না কমবে? প্রতিপ্রশ্ন উড়ে এল আমার দিকে - ‘বিজেপি ক্ষমতায় আসবে কে বলল?'
টিভি-কাগজে বিজেপির প্রভাব, নানা প্রচার দেখে এমন আশঙ্কা হয় জানানো গেল। এবার কুতুব আর একা নয়, অন্যদের স্বরও প্রত্যয়ী লাগল - ‘বিজেপি তো ক্ষমতায় এসে গেছে।’ বললাম - কীভাবে? '২০১৯ এর লোকসভায় বিজেপি ১৮ টা সিট পেয়েছে।প্রতিটা লোকসভার আন্ডারে ৭ টা বিধানসভা। ১২৬ টা সিট বিজেপি পেয়েই আছে।'
দিল্লিতে লোকসভায় আপ একটিও সিট পায়নি। বিধানসভা আপের রমরমা। বিধানসভায় তো লোকাল ইস্যুর প্রভাব বেশি থাকে। তাহলে?এর উত্তর না দিয়ে সমস্বরে শোনা গেল -"আপনারা আর তৃণমূল প্রচার করছে, ভাইজান প্রার্থী দিলে বিজেপির সুবিধা। আমরা সারা রাজ্যে ২ নম্বর হব।"
বেড়াবেড়ি অঞ্চল থেকে এসেছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব নূর বক্স মণ্ডল। আবার দিঘরা থেকে বছর বিশের আমিনুল মোল্লা। এই জমায়েতের উদ্দেশ্য তাঁদের কাছে স্পষ্ট। তাঁরা মনে করেন ভাইজান বঙ্গ রাজনীতিতে নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠবে। অশোকনগর বিধানসভায় জয়ের ব্যাপারে তাঁদের মুখের কথায়, শরীরের ভাষায় আত্মবিশ্বাস স্পষ্ট। কিন্তু ভোটের গতিতত্ত্বের কোন নিয়মে এমন ঘটবে, তা তাঁরা জানেন না। বিজেপি ক্ষমতায় এলে তাঁদের সমূহ বিপদ। সুতরাং কী করণীয় তাঁদের? এই প্রশ্নের মুখে তাঁদের অসহায় জবাব - 'বিজেপি তো ক্ষমতায় এসে গেছে।' কেন এই সভায় যোগদান - বারবার এই প্রশ্নে যে জবাব এসেছে অনেকটা পরস্পরবিরোধী। যেমন
তৃণমূল চোর, দুর্নীতি করেছে। তাই তারা মঞ্চ গঠন করেছে।
মঞ্চে সবাই আছে।
'বিজেপির প্রচার তৃণমূল মুসলিম তোষণ করে, আব্বাস বলছেন মুসলিমরা বঞ্চিত। তাহলে কোনটা সত্যি? '
এমন প্রশ্নে ঠিক মত জবাব মেলেনি। কারও জবাব ছিল - 'বঞ্চিত না, তবে আমরা ক্ষমতা দখল করব।' এম. ডি. আমিনুল আরও একধাপ এগিয়ে - ' সব আসনে আমরাই এগিয়ে থাকব। আমাদের নিয়েই বিধানসভা তৈরি করতে হবে। আমরাই বিজেপিকে ঠেকাবো?'
কিন্তু কীভাবে?
উত্তর আসে, ‘সে ভাইজান ঠিক করবে। সবাই ভাইজানের সঙ্গে আসছে।’
আমফানে ঘর ভেঙেছে বাইগাছি মৌজার নিমাই মুণ্ডার। পুরসভায় গিয়েও টাকা পাননি। কোনও সুবিধা পাচ্ছেন না। মঞ্চ থেকে অভিযোগ করলেন তিনি। মঞ্চ থেকে নামার পর তিনিও জানালেন এই ফ্রন্ট তাঁদের অবস্থা পরিবর্তন করবে। ভাইজানের নেতৃত্বে লড়াই হবে। তাঁকে বলা গেল - এতে তো ভোট কাটাকাটি হবে। বিজেপির সুবিধা। তাহলে?'
নিমাই মুণ্ডার জবাব- 'সে তো বিজেপি পার্টির ব্যাপার।'
একই কথার পৌনঃপুনিকতা, ব্যাণ্ডওয়াগন এফেক্ট মানুষের মধ্যে কতটা কাজ করে - নানা জনের উত্তরে মধ্যে খুঁজে পাচ্ছিলাম। গঙ্গাসাগর এক্সপ্রেসে যেতে যেতে আলাপ হল মধুপুরবাসী অনিল কুমারের সাথে। কলকাতায় কোনও ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিতে কাজ করতেন। লকডাউনে কাজ কমেছে। বাড়ি ফিরে যাবেন। ব্যবসা করবেন। তাঁর আসল বাড়ি উত্তর প্রদেশ। কথায় কথায় উঠে এল কৃষিবিলের প্রসঙ্গ। তিনি কৃষিবিল পড়েননি। কিন্তু মোদীজি যখন কৃষিবিল এনেছেন ভালোই হবে। কর্পোরেট কোম্পানির সাথে কৃষকের চুক্তিতে কৃষক কি পারবে টিকে থাকতে? এম এস পি তুলে দিলে কি খোলা বাজার দাম দেবে কৃষকদের? ২০১৬ তে আদানি গোষ্ঠীর কাশ্মীরের আপেল চাষির থেকে আপেল কেনার প্রসঙ্গটি তোলা গেল। খোলা বাজারের ব্যাপারিরা হঠে গেলে রাজ করবে কর্পোরেট। তখন ২১ টাকার আপেল ৬ টাকা কেজিতে চাষি বিক্রি করতে বাধ্য হবে। এসব প্রসঙ্গের কোনও উত্তর অবশ্য মোদী বিশ্বাসী অনিল কুমারের কাছে নেই। লকডাউনে মোদী অনেক কাজ করেছেন। ঘর দিয়েছেন। রামমন্দির করেছেন। থামিয়ে জানতে চাই, অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান তো বিক্রি হয়েছে। পাশ থেকে জবাব দিলেন সহযাত্রী এ কে বিশ্বাস। নদিয়ার বাসিন্দা। সরকার যখন বিক্রি করছে তখন নিশ্চয়ই ভালই হবে। কী ভালো বা কেন ভালো তা অবশ্য বিশ্বাসবাবুরও অজানা৷ তাঁর যুক্তি, তৃণমূল চোর। কিছু করেনি। নদিয়ার সবাই বিজেপি হয়ে গেছে।
জানতে চাইলাম, চোর তৃণমূল নেতাদের বিজেপি যেভাবে দলে টানছে, তাতে বিজেপি ক্ষমতায় এলে এরা তো বেশি চুরি করবে। একে বিশ্বাসের বিশ্বাসজাল একটু নড়ে গেল যেন। জবাব এল, নিশ্চয়ই কিছু ভেবেই বিজেপি দলে নিয়েছে।
কয়েকদিন আগে অমিতাভ গুপ্তের একটা লেখায় - ইনফর্মেশন কাসকেড বিষয়ে আলোচনা পড়ছিলাম। ১৯৬৯ নাগাদ জার্নাল অব পার্সোনালিটি অ্যান্ড সোশাল সাইকোলজিতে একটি পর্যবেক্ষণ প্রকাশিত হয়েছিল। স্ট্যানলি মিলগ্রাম, লেনার্ড বিকম্যান আর লরেন্স যৌথভাবে একটা পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। নিউইয়র্কের শীতল বিকেলে কিছু মানুষকে একটা অদ্ভুত কাজ করতে বলে হয়েছিল। মিনিট খানেক আকাশের দিকে তাকানো। যখন জনা পনের মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়েছিলেন, অন্য লোকজনও কারণ ছাড়াই সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। ভিড় জমে গিয়েছিল।
সবাই বলছে - অতএব এটাই ঘটবে। এই বিশ্বাস থেকে সদ্য দল গড়ে তোলা কোন মুসলিম ধর্মগুরুর অনুগামীরা বলতে পারেন, তাঁরাই ক্ষমতায় আসবেন। অথচ বহু সংখ্যক ইসলাম ধর্মাবলম্বী জানেন, বিপদটা কোথায়? বিজেপিকে তাড়াতে নয়, আসলে আব্বাস তাঁদের পায়ের তলায় শক্ত মাটি দেবেন।
কথা হচ্ছিল মাদ্রাসা শিক্ষক মোতালেবের সাথে। তাঁর সাফ কথা, বিজেপির বিপদ তিনি জানেন৷ যে বিজেপিকে রুখবে তাকেই ভোট দেবেন। দরকার হলে প্রথমে তৃণমূলকে ভোট দেবেন। সিপিএম যদি এটা করতে পারে, তবে সিপিএমকে ভোট দিতে তাঁর অসুবিধা নেই।
বিজেপি জানে ব্যাণ্ডওয়াগন এফেক্ট কীভাবে কাজ করে। তাই তারা নিরন্তর প্রচার চালায়। ধর্মগুরু আব্বাস ইয়েলদের পরীক্ষাটির বিষয়ে কতটা তাত্ত্বিক ভাবে অবগত তা অজানা৷ কিন্তু ব্যবহারিক জীবনের শিক্ষায় তিনি বা তাঁরা জানেন, কিছু মানুষকে দিয়ে অকারণ আকাশে তাকানোর মতো, প্রচার করালে ভক্তরাও ভাবতে শুরু করবে - 'নিশ্চয়ই কিছু একটা হবে।'
এই পৌনঃপুনিক প্রচারে আব্বাস বা দিলীপ ঘোষ মানুষের মনোভূমিকে অধিকার করে চলেন।
'আমরাই জিতব!'
কেন? কীভাবে?
এসবের উত্তরহীন বিশ্বাসে ভর করে তাঁরা এগোতে থাকেন৷ নাকি পিছোতে? গতি ও বিধি তাঁদের কোন দিক পানে, কতটা নিয়ে যায়, তা দেখার জন্য আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করে থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
প্রথমশ্রেণির ভাগানো।