সুদীপ বসুর ‘ছায়াবাণীর চারপাশে’ গল্পগ্রন্থের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে জাদু ও ফ্যান্টাসি। জীবনকে গভীরভাবে দেখাতে হলে অনেক সময় তাকে অতিরঞ্জিত করে দেখতে হয়। ঠিক এই কাজটিই করেছেন সুদীপ। জীবনের এক বর্ণময়, আড়ম্বরপূর্ণ ছবি উঠে আসে এই বইতে। প্রতিটি লাইনে প্রায় তিনি চমকে দিতে থাকেন। চেনা জীবন ক্রমশ যেন অচেনা হয়ে যেতে থাকে। আর অপরিচয়ের মধ্য দিয়েই তার সঙ্গে যেন আর গভীরভাবে পরিচয় ঘটতে থাকে আমাদের। আর এই যে চেনা–অচেনার খেলা আগাগোড়া চলতে থাকে, তার মধ্য দিয়েই জীবনের আকর্ষণ যেন আরও তীব্রতর হয়ে উঠতে থাকে পাঠকের কাছে।
বিয়ন্ড থিওরা। এমএফ হুসেন। অ্যাক্রিলিক অন ক্যানভাস। ১৯৯৪
এক মায়াবী, লিরিক্যাল গদ্যে আগাগোড়া বইটি লিখেছেন সুদীপ। কিন্তু সেই রঙিন মোড়কের আড়ালে রয়েছে এক হিংস্র ও নিষ্ঠুর জীবনের ছবি। ‘ছত্রিশ বছর পর হঠাৎ’ গল্পে রয়েছে এক ডাহা মিথ্যেবাদী ঠাকুরদার কথা। তাঁর গল্পগুলি যেন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ডমরুধরকে মনে করিয়ে দিতে পারে। আশ্চর্য মানুষ ছিলেন এই ঠাকুরদা। রাতে শুতে যাওয়ার আগে আবহাওয়ার পূর্বাভাস লিখে রাখতেন। বলতেন, সাজের জন্য নয়, মেয়েরা লিপস্টিক লাগায় কান্না চেপে রাখতে। বোঝাই যায়, এই মানুষটির জীবনযাপন এবং জীবনদর্শন ছিল একদম মৌলিক। কিন্তু রূপকথার এই মানুষটির একদিন আচমকাই প্রস্থান ঘটে, তার বদলে এসে উপস্থিত হন ঘোর বাস্তববাদী এক ঠাকুরদা। নিঃসঙ্গ, পলাতক, মিথ্যেবাদী, নকল ঠাকুরদা ফিরে যান এমন এক দুনিয়ায় যা রয়েছে আমাদের স্বপ্নে, জাদু, কল্পনা ও ফ্যান্টাসির পরিসরে।
‘বালিমানুষের বউ’ গল্পটিও মানুষের হারিয়ে যাওয়ার আখ্যান। বালিমানুষ এসেই মুঠো মুঠো বালি ছিটিয়ে দিত সবার চোখে। বালিমানুষের সঙ্গেই একদিন চলে গেছিল ছোটোমাসি। তারপর থেকে সে যখনই ফোন করত, বলত, পরশুদিন আসবে। কিন্তু আসত না। ছোটোমাসি নিয়ে গিয়েছিল রানির ওড়না। সেই রানি একদিন ওড়নার শোকে পালিয়ে যায়। নদীর ঢেউ হয়ে যায় সে। রানি আর ফিরে আসে না, শুধু তার ওড়না একদিন আবার ফিরে আসে। অদ্ভুত সব মানুষ, আশ্চর্য সব ঘটনার মধ্য দিয়ে জীবনটা যেন বিস্ময়বোধের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। মানুষ হারিয়ে যায়, থেকে যায় তার ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি, টুকরো টুকরো স্মৃতি।
‘নদী ও হত্যাকারী’ গল্পটির বিষয়, নারী–পুরুষের রহস্যময় সম্পর্ক। গল্পের শুরুতেই ছেলেটি ও মেয়েটির মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে যায়। ছেলেটি ফিরে পেতে চায় মেয়েটিকে, কিন্তু মেয়েটি কোনো সাড়া দেয় না। এরপর মেয়েটি মরিয়া হয়ে ওঠে, আর ছেলেটি ক্রমেই হয়ে উঠতে থাকে মেয়েটির হত্যাকারী। ছেলেটির মনে হয়, সে যেন এক আশ্চর্য অমীমাংসিত খেলায় জড়িয়ে পড়েছিল। ছেলেটি সেই হত্যার দায় থেকে শেষপর্যন্ত রেহাই পায় না। বিচ্ছেদ, দুঃস্বপ্ন, আতঙ্ক, হত্যা, রক্তপাত, হিংসা যেন আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে এই কাহিনিকে। ছেলেটি বারবার মুখোমুখি হয় তার অতীতের, যাকে সে সান্ত্বনা দেয়, ‘কাঁদে না কাঁদে না ছিঃ। কাঁদলে তো অন্ধকার বাড়ে।’
‘হ্যামলিন হ্যামলিন’ আর-একটি চমৎকার গল্প, যার বিষয়ও নারী–পুরুষের সম্পর্ক। হ্যামলিনের মেয়র সেখানকার জাতীয় অপেরার এক নর্তকীকে চুরি করে এনে বন্দি করে রেখেছিলেন। মেয়েটির নাচ ও গান বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এই অবদমনের ফলে তার মধ্যে অন্য একটি শক্তি জন্ম নিয়েছিল ধীরে ধীরে। সে ভবিষ্যৎ বলতে পারত। মানুষের শরীরের দিকে সরাসরি তাকালে সে তার মৃত্যুর তারিখ পর্যন্ত নাকি দেখতে পেত এবং তা পিছিয়ে দিতে পারত ইচ্ছে করলে। মেয়র তাকে বিশ্বাস করেছিলেন। আর মেয়েটি স্বাধীনতা হারিয়ে মেয়রের ওপর প্রতিশোধ নিয়েছিল অদ্ভুতভাবে। হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালাকে নিয়ে বলা তার ভবিষ্যৎবাণী মিথ্যে হয়ে গেল। পাশাপাশি এটা হ্যামলিন শহরেরও গল্প। বাঁশিওয়ালার সংগীতে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল এই শহর, চেয়েছিল সুস্থভাবে বাঁচতে। কিন্তু শেষপর্যন্ত এক অসুস্থ, বিকৃত স্থিতাবস্থার দিকে ঠেলে দেওয়া হয় তাকে। এভাবেই একটি প্রাচীন লোককাহিনিকে ভেঙেচুরে একটি আধুনিক রূপকথা বিবৃত করেন লেখক।
‘মা ও তার রুপোলি বন্ধুরা’ গল্পেও এসেছে নারী–পুরুষের সম্পর্কের কথা। স্বামীর সংসারে এসে নিত্য অপমানিত হতে হয়েছে মা–কে। মা তাই গভীর অভিমান থেকেই ঠিক করে মাছ হয়ে যাবে। মা হারিয়ে যায় একদিন এবং স্ত্রী মাছ হয়ে গিয়েছে এই বিশ্বাস থেকে বাবা স্থানীয় পুকুরটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। কিন্তু স্বার্থান্ধ প্রশাসনের কাছে ব্যক্তিমানুষের লড়াই শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকে না। বাবা অবশেষে ভবিতব্যকে মেনে নেয় এবং ছেলেকে বলে, ‘অনুবাদ করতে করতেই মানুষ একদিন বড়ো হয়।’ বাবা হয়তো ‘অনুবাদ’ শব্দটির মধ্য দিয়ে জীবনে যে নিত্য রূপান্তর ঘটে চলেছে, তাকেই বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু এই গল্পেও মুখ্য হয়ে উঠেছে নারী–পুরুষের একে অপরকে হারিয়ে ফেলার এবং কাল্পনিক বিশ্বাসের জোরে খুঁজে চলার কাহিনি।
‘গয়নার গল্প’–তেও হারিয়ে যাওয়া শিরিনকে আকস্মিকভাবে খুঁজে পায় বিনু। সত্যি–মিথ্যের সীমারেখা ভেঙে যায় এই গল্পে। স্মৃতির আড়াল থেকে যেন জ্যান্ত হয়ে ওঠে মানুষগুলো, জীবন্ত হয়ে ওঠে অতীত, অনুভব করা যায় তার উত্তাপ। ‘আকাশলীনা’ গল্পে হার্টের অসুখ নিয়েও গান চালিয়ে যায় লীনা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয় লীনার। কিন্তু তারপরও রূপমের সঙ্গে তার দেখাসাক্ষাৎ চলতে থাকে আকাশে, তারাদের জগতে, সেখানেও তৈরি হয় বাস্তব জগতের মতোই সম্পর্কের টানাপোড়ন। ‘নীনার দুনিয়া’ গল্পে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় নীনা রজতকে বিয়ে করে সে গরিব আর রোগা বলে। সুস্বাস্থ্যে ভরা গোলগাল মধ্যবিত্ত জীবনের বদলে সে চেয়েছিল উত্তেজনায় ভরপুর অনিশ্চয়তা। সৌন্দর্য দেখলে ক্ষুধার্ত ও বিহ্বল হয়ে উঠত নীনা। কিন্তু সন্তান জন্মানোর পর সন্তানের প্রতি ক্রমেই হিংস্র হয়ে উঠতে থাকে নীনা। তার জীবনের আনন্দকেই যেন কেড়ে নিতে চায় এই সন্তান, তাকে আটকে রাখতে চায় একটা স্থির ও নিশ্চিত জীবনের পরিধিতে। নীনার হাত থেকে সন্তানকে বাঁচাতে রজত ঝাঁপ দেয় অনিশ্চয়তায়, সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে যায়, চার বছর ধরে ছুটতে থাকে, ততোদিনে নীনার স্বভাব ও প্রবণতাগুলি সংক্রামিত হয়েছে তাঁর মধ্যেও।
‘শবনম’ গল্পের নায়ক ঈশান জানে, ‘টিকে থাকাটা তো আর সবসময় বেঁচে থাকা নয়।’ তার জীবনে আসে এক রহস্যময় নারী, শবনম। ঈশানের জীবনে তার আসার কথা নয়, অথচ সে আসে। আর হঠাৎ একদিন ঈশানের জীবন থেকে হারিয়েও যায়। আবার ন–বছর পর তাদের দেখা হয়, আর একটা প্রতীকী ঘটনায় তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে এই গল্প। শবনম জোর করেই ঈশানের কাছ থেকে আদায় করে নেয় একটা উপহার আর সেটা হল একটা বাঁশি। শবনম আবার হারিয়ে যায় কিন্তু ঈশানের জীবনে থেকে যায় তার অলটার–ইগো রূপকথার গল্প থেকে উঠে আসা রাজকুমার উইলিয়ম, যার কাছে এই রহস্যময় নারী এবং তার মধুর প্রেমের স্বীকারোক্তি করে ঈশান। শবনম বাঁশি অর্থাৎ জীবনের সংগীত বা প্রাণশক্তি নিয়ে যায় ঈশানের কাছ থেকে, ঈশানকে নিঃসঙ্গ করে দিয়ে যায়।
‘মনসিজবাবুর ডুবসাঁতার’ গল্পে রয়েছে এক আশ্চর্য মানুষ মনসিজবাবুর কথা। এই অদ্ভুত মানুষটি মাসের প্রত্যেক দ্বিতীয় শনিবার সন্ধেবেলা কিছু না কিছু সাজতেন। সরীসৃপের মতো বুকের ওপর ভর দিয়ে দেয়াল বেয়ে চলেন তিনি। গল্পের শেষে এই মনসিজবাবুও হারিয়ে যান। সাঁতার কাটতে নেমে একটা ফরসা মেয়েলি হাত জলের ভেতর টেনে নেয় তাঁকে। আবার সেই নারী–পুরুষের সম্পর্ক, হারিয়ে যাওয়া মানুষ, বিচ্ছেদ–বেদনার গল্প। সারাজীবন প্রিয় নারীকে হারানোর বেদনা নিজের ভিতরে বহন করেছেন মনসিজ, যার পরিণাম তার ওই আত্মহত্যা, যাকে এক আশ্চর্য রূপকথার আদলে পরিবেশন করেছেন সুদীপ।
‘মনোময়ের নতুন চাকরি’ গল্পে বেকার মনোময়ের স্ত্রী অপর্ণা গায়ে আগুন দিয়ে সংসার থেকে পালাতে চেয়েও পারে না। গল্পের শেষে নতুন চাকরি খুঁজতে গিয়ে মনোময় নিজেই হারিয়ে যায়। মনোময় এবং অপর্ণা পরস্পরকে ভালোবাসে, নিজেদের সংসারকে আসলে বাঁচাতেই চায়, কিন্তু অস্তিত্বরক্ষার লড়াইয়ে বারবার হেরে গিয়ে তারা একে অপরের থেকে পালাতে চায়, যার উৎসে থাকে একে অপরের কাছে অবলম্বন না হয়ে উঠতে পারার শোক ও যন্ত্রণা। ‘কালো ম্যাজিকের এক রাত’ গল্পে আবার সত্য ও মিথ্যার দেওয়াল ভেঙে যায়, অবিনাশের বাড়ি গিয়ে অবিনাশকে কোথাও খুঁজে পায় না সুপ্রিয়, অথচ অবিনাশ যে আছে, এটাই সুপ্রিয়কে বিশ্বাস করাতে চায় অবিনাশের স্ত্রী পরি, তাদের দারিদ্র্য ও অভাবের কথা ভেবে আপস করতে বলে একটা মিথ্যার সঙ্গে। গল্পের শেষে অবশ্য সুপ্রিয়র মনে হয়, তার নিজেরই কোনো অস্তিত্ব নেই। লেখক দেখাতে চান, সুপ্রিয় থাকলে অবিনাশ নেই। কিন্তু অবিনাশ আছে, এটা মেনে নিলে, সুপ্রিয় নেই, কখনও অবিনাশের বাড়িতে আসেনি, এটাকেই ধরে নিতে হবে। এভাবেই জীবনের এক গভীর সত্যকে যেন স্পর্শ করতে চান লেখক। সত্য থাকলে মিথ্যাকে মেনে নিতে হয়। কিন্তু সত্য না থাকলে মিথ্যার আর সত্য হয়ে উঠতে কোনো বাধা থাকে না।
‘ছায়াবাণীর চারপাশে’ গল্পে আকস্মিক এক ঘটনায় বাবার জীবনের অন্ধকার দিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে সন্তানদের কাছে। বাবা কিন্তু মরিয়া চেষ্টা করে যায় সন্তানদের চোখে নিজের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি বজায় রাখতে। এই টানাপোড়েন জীবনের এক মর্মান্তিক অসংতিকেই তুলে ধরে আমাদের চোখে। এই গল্পেও বাবা–মায়ের সম্পর্ককে এক ভিন্ন মাত্রা দিতে চেয়েছেন সুদীপ। ‘সাবান ও গয়নার গল্প’য় এক মধ্যবিত্ত কথকের জীবন আচমকা জড়িয়ে যায় এক কিশোর পালিশওয়ালার জীবনের সঙ্গে। এই গল্পে আশ্চর্য সব ঘ্টনা ঘটে। তরঙ্গ নামের সেই কিশোর অসুখে পড়ে এবং তার শরীরে ময়ূরের রোম ও পেখম গজিয়ে ওঠে। তরঙ্গের দিদি মৃণালিনী তারার রাতে আতরের গন্ধ পায়। তরঙ্গের বাবাকে পেয়ে বসে নানারকম সাবানের গন্ধ। কথক জড়িয়ে যেতে থাকে তরঙ্গের দিদি ও বোন, এই দুই নারীর সঙ্গে। ক্রমে কথকের জীবনেও সংক্রামিত হয় অস্বাভাবিকতা, স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টায় সে মরিয়া হয়ে ওঠে।
‘সাড়ে তিনটের বাস’ গল্পে আনিসের জীবনে হঠাৎ এসে হাজির হয় এক অস্বাভাবিক নারী। এই নারীর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে নাম বদলে যেতে থাকে। একসময় আনিস বুঝতে পারে, মেয়েটির জীবনের অস্বাভাবিকতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সাড়ে তিনটের বাস, কারণ আনিসকে দেখার জন্য তার কামনা তীব্র হয়ে উঠলেও, তার প্রস্থান যেন বাধ্যতামূলক এবং সেই বাধ্যতা জড়িয়ে আছে সাড়ে তিনটের বাসে ফেরার মধ্যে। আনিস কথায় কথায় একদিন মেয়েটিকে দেরি করিয়ে দেয় এবং তারপরই মেয়েটি স্বাভাবিক হয়ে যায়। ‘সার্কাসের আলোয়’ গল্পে আবার এসেছে মা ও বাবার সম্পর্কের টানাপোড়েন, অতীতের একটি ঘটনা, সার্কাসের ক্লাউন বাবার সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের ট্র্যাজিক দৃশ্য, বাবাকে ফিরিয়ে আনার জন্য মায়ের ব্যর্থ প্রয়াস ও কান্না এবং মাঝেমাঝে অনিয়মিতভাবে মুখবন্ধ খামে টাকা পৌঁছনোর স্মৃতি।
সুদীপের গল্পগুলির মূল বিষয়, মানবিক সম্পর্ক। কত সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ট্র্যাজেডিতে ভরা মানুষের জীবন! তারা একে অপরকে কী তীব্রভাবেই না ভালোবাসে! আবার তারাই বহন করে চলে একে অপরকে হারানোর তীব্র বিচ্ছেদ–বেদনা। কখনও মনে হয়, গোটা বই জুড়ে যেন একটাই গল্প বারবার, নানা ভাবে, লিখে গিয়েছেন সুদীপ। প্রতিটি গল্পই যেন নারী–পুরুষের সম্পর্কের গল্প, তাদের বিচ্ছেদ বা সংঘাতের গল্প, যার পরিণামে কেউ না কেউ হারিয়ে যায়, কেউ না কেউ অদ্ভুতভাবে আবার ফিরেও আসে। কী বিচিত্র এই সম্পর্ক, কত নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে এই সম্পর্ককে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন সুদীপ! সুদীপের গল্পগুলির বিষয়, এক তুচ্ছ, মামুলি জীবন। কিন্তু জীবনকে দেখার এক আশ্চর্য শক্তি আছে তাঁর। বিস্ময়কর তাঁর কল্পনাশক্তি। চমৎকারিত্বে ভরা তাঁর উদ্ভাবনীশক্তি। তিনি নতুন নতুন ভাবে যেন একই জীবনকে, তার গতানুগতিকতাকে আবিষ্কার করেন। চেনা মানুষগুলোকে এবং তাদের মামুলি জীবনগুলোকে উদ্ভাবন করেন। তাঁর লেখার গুণে আমাদের চেনা দৃশ্যগুলো রঙিন, বর্ণময় ও আড়ম্বরপূর্ণ হয়ে ওঠে।
আমরা তখন এক মায়াবী জগতের ভিতর নিমজ্জিত হই। সেই জগতের দিকে তাকিয়ে চমকে চমকে উঠি। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। ছোটা ছোটো মোচড়ে এই গল্পগুলির ভিতর বারবার নানা চোরাটান, ঘূর্ণি ও অভিঘাত তৈরি হতে থাকে। স্বাভাবিক জীবন, মানুষ ও জগৎ ক্রমেই যেন আরও বেশি করে অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। জাদু ও ফ্যান্টাসির নিরন্তর প্রয়োগে লেখক সচেতনভাবেই এই অস্বাভাবিকতাকে তৈরি করেন, যাতে মামুলি জীবন ও মানুষগুলো সেই অস্বাভাবিকতার জেরেই আরও বেশি করে তাদের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ে স্পষ্ট ও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে আমাদের চোখে, গতানুগতিকতা ও দৈনন্দিনতার সাধারণত্বে ও একঘেয়েমিতে হারিয়ে না যায়।
সুদীপ কখনও সরলরৈখিক বা একমাত্রিক গল্প বলতে চাননি। জীবনের খুব সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম জায়গাগুলিকে তিনি স্পর্শ করতে চেয়েছেন। যা অবাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্য নয়, সাহিত্যে অনেক সময় তাকে বাস্তবতার মোড়কে বিশ্বাসযোগ্যভাবে পরিবেশন করা হয়। সুদীপ ঠিক এর বিপরীত কৌশল ব্যবহার করতে চেয়েছেন। তিনি মোটেই গতানুগতিক গল্প লিখতে চাননি। তিনি প্রামাণ্য জীবনকে অবাস্তবতার মোড়কে পরিবেশন করে গিয়েছেন। সেই অবাস্তবতার আড়াল থেকে কখনো-কখনো জীবন তার তুচ্ছতা আর সংকীর্ণতা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে।
দক্ষতার সঙ্গে বারবার তিনি তাকে আড়াল করতে চেয়েছেন, কিন্তু জীবনের বিশ্বস্ততাকে কোথাও ক্ষুণ্ণ হতে দেননি। কল্পনার বিস্তার দিয়ে তিনি জীবনের প্রামাণ্যতা এবং তুচ্ছতাকে অতিরঞ্জিত করতে চেয়েছেন, তার সূক্ষ্মতাগুলির ওপর আলো ফেলতে চেয়েছেন। কখনও হয়তো রোমান্টিকতার বাহুল্য তাঁর গদ্যভাষার টানটান, ঋজু ভাবটিকে কিছুটা হালকা করে দিয়েছে, টলিয়ে দিয়েছে তার বুনোট ভারসাম্য। যা হতে পারত অ্যাবসার্ড বা জাদু বাস্তবতার চমৎকার দৃষ্টান্ত, তা কোথাও কোথাও হয়ে উঠেছে নিছক আধুনিক একটি রূপকথা। সুদীপ কখনও ভুলতে দেন না, তিনি মূলত একজন কবি! তবু চেনা পথের বাইরে যাওয়ার যে মৌলিক দুঃসাহস তিনি দেখিয়েছেন, তার জন্যই এই বই নিঃসন্দেহে বিশিষ্টতা অর্জন করেছে বলা যায়।
খুব ইন্টারেস্টিং কিছু লাগল না। বাংলাতে এত বেশি আটপৌরে জীবনের গল্প... :)
পড়ার আগ্রহ তৈরি হল। ' সার্কাসের আলোয়' গল্পটি পড়তে ইচ্ছে করছে, বিশেষ করে। এক্ষুণি পড়তে পারলে বেশ হ'ত। কারণ, মজার ব্যাপার হল , আমার একটি ফীচারধর্মী লেখার নাম ছিল, 'সার্কাসের আলো' (এই সময় , ২০১৩); নামটি ব্যবহার করে অতি সম্প্রতি একটি গল্প লিখলাম-