কাল্পনিক দুটো সমস্যার উত্তর চাওয়া হল আপনার কাছে।
সমস্যা ১ (চিত্র ১)
একটি চলন্ত ট্রলির ব্রেক খারাপ হয়ে গেছে এবং ট্রলিটি থামানো যাবে না। ট্রলিটি যে ট্র্যাকে আছে তা আর একটু পরেই দু’দিকে বিভক্ত হয়ে গেছে।
আপনি একটা লিভারের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। দুটো অপশন আছে। আপনি কিছুই নাও করতে পারেন এবং ট্রলিটি যে ট্রাকে আছে সেটিতেই চলতে দিতে পারেন। এর ফলে ট্রলিটি ৪ জন কর্মীকে পিষে দেবে।
অথবা, আপনি একটা লিভার টেনে ট্রলিটির গতিপথ বদলে, ট্রলিটিকে অন্য ট্র্যাকের দিকে ডাইভার্ট করে দিতে পারেন। এক্ষেত্রে ট্রলিটি দ্বিতীয় ট্র্যাকটিতে থাকা একজন শ্রমিককে মেরে ফেলবে।
আপনার সামনে অন্য আর কোনো বিকল্প নেই।
আপনি কি করতে চান?
সমস্যা ২ (চিত্র ২)
এখানে আগের সমস্যাটির একটা বিকল্প রয়েছে।
৫ জন কর্মী একটি ট্র্যাকের উপর কাজ করছে। ব্রেকহীন ট্রলিটি এই কর্মীদের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
আপনি এই ট্রাকের উপর একটি ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে আছেন।
এক্ষেত্রেও আপনার অপশন দুটি। আপনি কিছুই নাও করতে পারেন, ফলত ব্রেকহীন চলন্ত ট্রলিটি ওই ৫ জন মানুষকে মেরে ফেলবে।
অথবা আপনি ওই ওভারব্রিজের উপর দণ্ডায়মান একজন মানুষকে ঠেলে ফেলে দিতে পারেন ট্রাকের উপর। তাতে ওই ঠেলে ফেলে দেওয়া মানুষটি তো মারা যাবেই কিন্তু এই দুর্ঘটনার ফলে সতর্ক হয়ে গিয়ে ওই ৫ জন মানুষ বেঁচে যাবে। অর্থাৎ আপনি একটি মানুষকে খুন করতে পারেন কিন্তু সেই সঙ্গে ৫ জনকে বাঁচাতেও পারেন।
এই সুবিখ্যাত ট্রলি-ডিলেমা একটি নতুন মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষার প্রধান আধার।
প্রথমে দেখা যাক এই পরীক্ষার রেজাল্ট কী হয়েছিল।
উপরের দুটি পরিস্থিতির, প্রথমটিতে বেশিরভাগ মানুষ বলেছেন তারা লিভার টানবেন এবং ১ জন মানুষকে মরে যেতে দেবেন।
কিন্তু দ্বিতীয় পরীক্ষাটির ক্ষেত্রে সাথে বেশিরভাগ মানুষই একজনকে খুন করে ৫ জনকে বাঁচাতে চাননি।
অথচ ফলাফলের হিসেবে পাঁচ জনকে মেরে ফেলার চেয়ে একজনকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্তই ‘সঠিক’।
এখানে একটা কথা রাখি, কেন দ্বিতীয় পরীক্ষাটির ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষ, পাঁচ জনের পরিবর্তে এক জনকে মেরে ফেলতে দ্বিধাবোধ করেছে, তা আমরা সকলেই জানি। সুতরাংএ নিয়ে আর কথা বাড়াচ্ছি না।
যাই হোক, এই পরীক্ষাটি গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে কীভাবে আমরা অনুভূতিগুলিকে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপর প্রভাব ফেলতে দিই, এই পরীক্ষাটি সেই গভীরে গিয়ে আলো ফেলে ও অন্তর্তদন্ত করে। আমাদের জীবনে নেওয়া সবচেয়ে খারাপ, সবচেয়ে ক্ষতিকারক, বিপর্যয়মূলক সিদ্ধান্তগুলি প্রায়ই যুক্তির চেয়ে আবেগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এখানেও অনেকেই গাট ফিলিংসের কথা বলবেন। আবার আমার মতো অনেকেই আছেন, যারা হৃদয়-তাড়িত মূর্খতা নিয়ে গর্বও করে থাকেন। অনেকে আবার ভুল করে বসবেন এ কথা না বুঝেই, যে আবেগের বিপরীতে যা ক্রিয়াশীল, তাও আসলে আবেগই।
ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো, এই প্রাচীন ট্রলি-টেস্টটি একটু অন্যরকম ভাবে উপস্থাপন করেছে।
কীরকম? এমন সব মানুষকে এই মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়েছিল, যারা প্রত্যেকেই দ্বিতীয় আরেকটি ভাষা জানে, কিন্তু সেই ভাষায় খুব সড়গড় নয় বা ঐ ভাষায় তাদের ভোকাবুলারি লিমিটেড। পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের বলা হয়েছিল, এই দ্বিতীয় ভাষায় বাক্যগঠন করে সমস্যাটি ভাবতে ও তার উত্তর খুঁজতে।
এবারে কিন্তু দেখা গেল দ্বিতীয় ট্রলি-টেস্টেও বেশিরভাগ মানুষই একজনকে মেরে ফেলতে রাজি হল, পাঁচ জনের জীবনের পরিবর্তে!
এরপর শিকাগো ইউনিভার্সিটি খুনোখুনি রেখে আর একটা বিকল্প পরীক্ষা করেছিল, সেখানে অংশগ্রহণকারীদের ১৫ ডলার করে দিয়ে এমন কিছু বেট করতে দেওয়া হয়েছিল, যেখানে তাদের জেতার সম্ভাবনাই বেশি। দেখা গেল, অংশগ্রহণকারীদের দ্বিতীয় বা দুর্বল ভাষাটিতে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলে, তারা এই জুয়াতেও অনেক বেশি জিতছে।
এই বিষয়ে ইউনিভার্সিটির লিড রিসার্চার সায়ুরি হায়াকাওয়া (Sayuri Hayakawa) বলছেন যে, মাতৃভাষার সাথে আমাদের মধ্যে দৃঢ় সংবেদনশীল সংযোগ রয়েছে, কেননা এই ভাষা আমরা শিখি আমাদের সবচেয়ে প্রিয়জনদের থেকে, পরিবার থেকে।
যদি আমরা দুর্বল ভাষায় চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিই, তবে প্রথমেই যা বাদ যায়, তা হল আবেগ ও সেই আবেগ সম্বলিত স্মৃতি। ফলে সেই স্থান অধিকার করে যৌক্তিক চিন্তাভাবনা, যা পরিস্থিতিটিকে আরও ভালভাবে বিশ্লেষণ করে।
আর একটা কথা, সাহিত্য, বিশেষত কবিতার অনুবাদ প্রসঙ্গেও এই রিসার্চটি আমার অসম্ভব তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়। কেন? “Poetry is what gets lost in translation,” রবার্ট ফ্রস্টের এই বিখ্যাত মন্তব্যটিকে আজকাল অনেককেই আর ততখানি মান্যতা দেন না বা লঘু করে দেখেন। কিন্তু উপরের এই পরীক্ষাটির সূত্র ধরে বলা যায়, এই ক্ষেত্রেও দ্বিতীয় ভাষাটিতে আবেগ (যে আবেগ প্রথম ভাষার স্মৃতি ও সত্ত্বা অনুমোদিত ভোকাবুলির সঙ্গে নিবিড় সংযোগ রক্ষা করে চলে) হ্রাস পায় অথবা যৌক্তিক দৃঢ়তা বৃদ্ধি পায়। এই লস-কে অনেকেই ট্রান্সক্রিয়েশন বলে এড়িয়ে যেতে চান, কিন্তু আমার ধারণা এই সমস্যাটি আরও গভীরের, বিশেষত কবিতা অনুবাদের (দ্বিতীয় ভাষায় পঠনেও অনুবাদ প্রয়োজন হয়) ক্ষেত্রে। এই জন্যই শ্রেষ্ঠতম কবিতা প্রায়ই অনুবাদযোগ্য নয়।
যাই হোক বিতর্কিত বলেই “বিদেশী ভাষায় কথা বলার মতোন সাবধানে "এই প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বলি, কোনও কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়, যদি আপনার দ্বিতীয় বা তৃতীয় কোনো ভাষা জানা থাকে তবে সেই ভাষা ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত নিন।
পাদটীকা: একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় ছবি আর বর্ণনার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ছবিতে সাবজেক্টকে ট্রাকের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। কিন্তু যেহেতু উপরের পোস্টটি আমার মাতৃভাষায় লেখা, তাই আমার সম্প্রসারিত আবেগই হোক বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক, এই বেঁধে রাখার বিষয়টি আমার পছন্দ হয়নি। আবার ইন্টারনেটে ছবিও পাইনি আমার মনোমতো। তাই এ দিকটা আশা করি সবাই নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন।
দ্বিতীয় পরীক্ষা য় আমি নিজেও তো ঝাঁপ দিতে পারি লাইনে, তাহলেও তো 5জন সতর্ক হয়ে যাবে।
রমিত চ্যাটার্জি আপনি সম্ভবত সিদ্ধান্ত বলতে মরাল ডিসিশন ভেবেছেন। আশ্চর্য নয়। কিন্তু এই এক্সপেরিমেন্টটি মূলত লাভ-লোকসান জাতীয় সিদ্ধান্ত বিষয়ে। নিজে ঝাঁপ দেবার এই ভাবনাটিও সম্ভবত মাতৃ-ভাষাতেই ভাবা। ফলত নৈতিক, অনৈতিক বিষয়গুলির উপর জোর চলে আসছে, লাভ-লোকসানের কথা না ভেবে। কিন্তু পরীক্ষাটি সম্পূর্ণ হাইপোথেটিক্যাল। ওই দুটো অপশান ছাড়া আর কোনো অপশনই নেই। বাস্তবে এরকম একটা সমস্যার মুখোমুখি হওয়া যে কোনো সংবেদনশীল মানুষের পক্ষে এক চূড়ান্ত ট্রমাটিক শাস্তি। স্বভাবতই এমন এক কাল্পনিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েও আমরা আবেগ-বিযুক্ত ভাবে ভাবতে পারি না বা পারিনি। তাই অনেকেই ভেবেছেন, পাঁচজনকে বাঁচাতে নিজে ঝাঁপ দিলেও তো চলে! কিন্তু নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক থেকে সঠিক হলেও, লাভ-লোকসানের হিসেবে এই 'সিদ্ধান্ত' ঠিক নয়। কেন? নিজে ঝাঁপ দেওয়ার সিদ্ধান্তেও সেই পাঁচের পরিবর্তে একটা জীবন তো নষ্ট হচ্ছেই। উপরন্তু নিজের জীবন নষ্ট হচ্ছে, যা ব্যক্তিগত লাভ লোকসানের হিসেবে ক্ষতিরই। পুরো এক্সপেরিমেন্টটা একটা রিস্ক ম্যানেজমেন্ট টুল হিসেবেই দেখা উচিৎ। যেমন আপনি এখন যে চাকরিটা করছেন, সেটা করবেন নাকি রিস্ক নিয়ে নতুন শহরে, নতুন চাকরিতে, সামান্য বেশি বেতনে জয়েন করবেন। এই ধরণের সিদ্ধান্তের কথাই বলা হয়েছে এই লেখায়।
সুন্দর করে বোঝানোর জন্য ধন্যবাদ