আগের দুই কিস্তিতে লিখেছি ভাতের পাতে সুক্তো, শাক, চচ্চড়ির কথা, এবার আসি মেইন কোর্সে। সেখানে আমিষ বলতেই মাছে-ভাতে বাঙালি নামটির কথা মাথায় আসে সবচেয়ে আগে।
বরিশাল জেলার ফুল্লশ্রী গ্রামের বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলে বরিশালের বাঙালি রান্নাশৈলী উঠে এসেছে—
‘রান্ধি নিরামিষ ব্যঞ্জন হলো হরষিত।
মেস্যর ব্যঞ্জন রান্ধে হয়ে সচকিত
মৎস্য মাংস কুটিয়া থুইল ভাগ ভাগ।
রোহিত মৎস্য দিয়া রান্ধে কলকাতার আগ
মাগুর মৎস্য দিয়া রান্ধে গিমা গাচ গাচ
ঝাঁঝ কটু তৈলে রান্ধে খরসুল মাছ
ভিতরে মরিচ-গুঁড়া বাহিরে জড়ায় সূত।
তৈলে পাক করি রান্ধে চিঙড়ির মাথা
ভাজিল রোহিত আর চিতলের কোল।
কৈ মৎস্য দিয়া রান্ধে মরিচের ঝোল
ডুম ডুম করিয়া ছেঁচিয়া দিল টই।
ছাইল খসাইয়া রান্ধে বাইন মেস্যর কৈ...
বারমাসি বেগুনেতে শৌল-মেস্যর মাথা।...’
পোস্টকার্ডে চিত্রশিল্প। নন্দলাল বসু (ছবি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া)
ময়মনসিংহের দ্বিজ বংশীদাস, তাঁর মনসামঙ্গলে আছে—
‘নিরামিষ রান্ধে সব ঘৃতে সম্ভারিয়া।
মেস্যর ব্যঞ্জন রান্ধে তৈল পাক দিয়া
বড় বড় কই মৎস্য, ঘন ঘন আঞ্জি
জিরা লঙ্গ মাখিয়া তুলিল তৈলে ভাজি।
কাতলের কোল ভাজে, মাগুরের চাকি।
চিতলের কোল ভাজে রসবাস মাখি
ইলিশ তলিত করে, বাচা ও ভাঙ্গনা।
শউলের খণ্ড ভাজে আর শউল পোনা
বড় বড় ইচা মৎস্য করিল তলিত।
রিঠা পুঠা ভাজিলেক তৈলের সহিত
বেত আগ পলিয়া চুঁচরা মৎস্য দিয়া।
শক্ত ব্যঞ্জন রান্ধে আদা বাটিয়া
পাবদা মৎস্য দিয়া রান্ধে নালিতার ঝোল।
পুরান কুমড়া দিয়া রোহিতের কোল...
ধনিয়া সলুপা বাটি দারচিনি যত
মৃগমাংস ঘৃত দিয়া ভাজিলেক কত।’
বাঙালি মাছ ঠিক কবে থেকে খাওয়া শুরু করে, তার কোনো সঠিক দিনক্ষণ নেই। আগেই বলেছি প্রাকৃত পিঙ্গলে মৌরলা মাছের কথা। মাছ যে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম প্রাণী। পশ্চিমবাংলার চন্দ্রকেতুগড়ে একটি পোড়ামাটির ফলকে মাছের উৎকীর্ণ চিত্র পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, ফলকটি চতুর্থ শতকের। আবার বাংলাদেশের পাহাড়পুর ও ময়নামতীতে রয়েছে বিভিন্ন ফলকেই মাছ কোটার, ঝুড়িতে করে মাছ নিয়ে যাওয়ার ছবির নিদর্শন। মাছ যে বাঙালির অতি প্রাচীন এক খাদ্যাভ্যাস সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
বঙ্গে নাকি মুসলমানরাই মাছ বেশি খেত। ব্রাক্ষ্মণ আর বৌদ্ধধর্মানুসারীদের জন্য মাছ খাওয়ার সুযোগ ছিল না ধর্মীয় বিধিনিষেধের কারণে। তবে বাঙালি শাস্ত্রকারদের মধ্যে ভবদেব ভট্ট প্রমাণ করেছিলেন মাছের গুণাগুণ এবং সুফল। তাই বুঝি এত জনপ্রিয় হল মাছ। মঙ্গলকাব্যের ছত্রে ছত্রে বিবিধ মাছের উল্লেখ আর সেই মাছ দিয়ে নানান মশলা সহযোগে মাছ রান্নার কৌশল।
অতএব মধ্যযুগীয় বাঙালির হেঁশেল ছিল মৎস্য গন্ধে ভরপুর। বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যে মৎস্য ভোজনের এই বিপুল বর্ণনায় দেখলাম রুই, কাতলা, চিতল, মাগুর, চিংড়ি, পাবদা, শোল সব ধরনের মাছের নাম। ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যেও আছে খাড়কি, চিংড়ি, কচ্ছপের ডিম, ভেটকি সহ অসংখ্য মাছের কথা। এ ছাড়াও ছিল বাঙালির প্রিয় শুঁটকি মাছ। ষোড়শ শতকে বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্যেও দেখা গেল মাছ রান্নার বিভিন্ন বিবরণ আদার রসে রান্না করা কই মাছ কিংবা রুই মাছ দিয়ে কলতার আগা, ঝাঁঝালো সর্ষের তেলে খরসুন মাছ এইসব।
বাঙ্গালির মৎস্যবিলাসে ইলিশ বা শোলের স্থান সেযুগেও ছিল পাকা।
বিজয়গুপ্ত রচিত পদ্মপুরাণ বা মনসামঙ্গলে আছে লখিন্দর জন্মাবার আগে সনকার সাধ ভক্ষণে মাছ রান্নার বৈচিত্র্যের কথা।
‘চেঙ্গ মৎস্য দিয়া রান্ধে মিঠা আমের বৌল।
কলার মূল দিয়া রান্ধে পিপলিয়া শৌল।
কৈ মৎস্য দিয়া রান্ধে মরিচের ঝোল।
জিরামরিচে রান্ধে চিথলের কোল।
উপল মৎস্য আনিয়া তার কাঁটা করে দূর।
গোলমরিচে রান্ধে উপলের পুর।’
বিজয়গুপ্ত দক্ষিণ সাগরের কলা দিয়ে ইলিশের ঝোলের কথা বলেছেন—
‘আনিয়া ইলিশ মত্স্য
করিল ফালাফালা
তাহা দিয়ে রাঁধে ব্যঞ্জন
দক্ষিণসাগর কলা’
ঊনবিংশ শতকের কালিঘাট-চিত্র। ছবি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া।
এই দক্ষিণসাগর কলা যে কাঁচা কলা আর মাছ দিয়ে সেই ঝোলের কেমিস্ট্রি যে সর্বদাই জমে যায় তা বলাই বাহুল্য। অথবা দেখুন —
‘শৌল মৎস্য কাটিয়া করিল খান খান।
তাহা দিয়া রান্ধে ব্যঞ্জন আলু আর মান।
মাগুর মৎস্য আনিয়া কাটিয়া ফেলে ঝুরি।
তাহা দিয়া রান্ধে ব্যঞ্জন আদামাগুরী।’
আর মাছরান্নার অনুপানে যা অনুষঙ্গ তাঁরা ব্যবহার করতেন সে যুগে তাও বিচিত্র নয়।
এ ছাড়া গোসানীমঙ্গলের লৌকিক আখ্যানেও আছে গোসানী মা চণ্ডীকে স্মরণ করে রাজা কান্তেশ্বরের কাজিলীকুড়ার বিরাটদহে জাল ফেলে বিশাল শোলমাছ ধরার কথা। কখনও আবার গ্রাম বাংলায় ইলিশমাছ এসেছে ধাঁধা হয়ে—‘রূপোর পাতে মারে ঘা, পানির বুকে ফেলল পা।’
ময়মনসিংহ গীতিকায় মাছের রানি ইলিশের স্থান এক অমূল্য পণ্য হয়ে—‘সেই ইলিশের দাম হইল সোনায় একুশ ভরি মাছ ইলিশারে’।
দ্বাদশ শতকে পণ্ডিত জীমূতবাহন সর্বপ্রথম ইলিশ মাছের নাম উল্লেখ করেছেন। সেইসময় সর্বানন্দের টীকাসর্বস্ব গ্রন্থেও ‘ইল্লিষ’ শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর বলেন ‘পাঙ্গাস ইলিশ’। ১৮২২ সালে হ্যামিল্টন বুকানন বঙ্গোপসাগরের মাছ নিয়ে গবেষণার সময় ‘হিলসা’ শব্দটি জুড়ে দেন। হিলসা ও ইলীশা মিলেমিশে এক হয়ে যায়। ইল+ঈশ= ইলীশ অর্থাৎ জলের ঈশ্বর।
মনসামঙ্গলের পর ধর্মমঙ্গলের রচয়িতা রূপরাম চক্রবর্তীর লেখায় গৌড়যাত্রার পথে রাজা লাউসেন ভ্রষ্টা নারী নয়ানীর ছলনার উত্তর দিয়ে বলে—
‘শিশুকাল হৈতে আমি ধর্মের তপস্বী।
শুক্রবার দিনে মোর ধর্ম একাদশী।
শনিবারে পারণাতে ভক্ষ্য ভোজ্য খাই।
ধর্মের সেবক হয়্যা সুখ নাহি চাই।।’
এহেন খাদ্যরসিক বাঙালির সংসারে এলাহি উপবাসেরও আয়োজন ছিল তবে। মাছের সঙ্গে মাংস প্রসঙ্গ এসেই পড়ে বাঙালির পাতে। রেড মিটের সঙ্গে যেন আমাদের সম্পর্ক জন্মজন্মান্তরের। তার কাহিনি পরের কিস্তিতে।
একটা কোশ্নো ছিল। এই দুটো লাইন পরে কৌতূহল হলো :
শৌল মৎস্য কাটিয়া করিল খান খান।
তাহা দিয়া রান্ধে ব্যঞ্জন আলু আর মান।
যদি ধরে নি এখনকার আলুর কথাই বলা হচ্ছে , তাহলে এই বিজয়গুপ্ত বা দক্ষিনসাগর -এনাদের লেখার টাইম লাইন গুলো কিরকম ? ১৫ বা ১৬ শতকের আগে না পরে ? নাকি আলু বলতে অন্য কিছুকে বোঝানো হতো তখন ?
মানে আলু তো যদ্দুর জানি স্প্যানিশ রা প্রথম নিয়ে আসে সাউথ আমেরিকা থেকে ইউরোপে ১৫ শতকের শেষে । তারপর হয়তো ব্রিটিশ বা ফ্রেঞ্চ বা পর্তুগিজ দের হাত ধরে ভারতে আসে , তাতে আরো অন্তত 50-১০০ বছর লেগে যাওয়ার কথা, সেখানে চাষ বাস বা ব্যবসা র রুট ধরলে। এবার ভারতে আসার পর , সেটা চাষ -বাস হয়ে , সক্কলের পাতে পৌঁছতে পৌঁছতে আরো ৫০-১০০ বছর লাগতে পারে হয়তো , তাহলে টাইম লাইন প্রায় ১৭ বা ১৮ শতকে এসে যাচ্ছে . খুব বেশিদিন নয়।
যদিও এগুলো জাস্ট আন্দাজ করছি। কিন্তু তখনকার সময়ে একটা নতুন সবজি নিশ্চয় খুব তাড়াতাড়ি জনপ্রিয় হবেনা লজিস্টিকস দেখলে।
Amit, এ ক্ষেত্রে আলু কথার খুব সম্ভব অর্থ কচু , potato মনে হয় নয় । কারণ বাংলায় ব্রিটিশরা আলু প্রচলিত করে, তার মানে অন্তত আপনি যে সময়ের কথা বলছেন । লক্ষ্য করুন পর্তুগিজ রা আলু বলত না, যে কারণে পশ্চিম ভারতে বাটাটা ।
আলু বলতে কন্দ জাতীয় মূল বোঝানো হয়েছে মনে হয়। সেক্ষেত্রে এ আলু মেটে আলু, রাঙা আলু বা কচু কি অন্যকিছু তা জানা নেই। কারণ আলু বলতে আমরা যাকে বুঝি তা সত্যিই পরতুগীজ আমলেই এদেশে আসে।