যারা শিরোনাম দেখে ভাবছেন অন্য অনেক অনেক কিছুর মত রবীন্দ্রনাথ, ফার্মা'র শেষ উপপাদ্য নিয়েও কিছু বলে গেছেন তারা এই পোস্টটি পড়লে হতাশ হবেন! আমি আসলে ভাবছিলাম এই ব্লগের নাম ফার্মা'র শেষ উপপাদ্য রাখলে হত কিনা। (যাঁরা ফার্মা'র শেষ উপপাদ্য সম্পর্কে জানেন না তাঁরা এখান থেকে পড়ে নিতে পারেন Wiki link )। যাঁরা এ পর্যন্ত পড়ে ভাবছেন আমি নাম্বার থিওরি নিয়ে কিছু লেখার চিন্তা করছি তাদেরও আশ্বস্ত করা যেতেই পারে এই বলে যে ওদিকে আমার বিশেষ মতি নেই। আসলে এই যে ফার্মা সাহেব ১৬৩৭ সালে একটা বইয়ের মার্জিনে লিখে গেলেন একটা উপপাদ্যের প্রস্তাবনা, এও বলে গেলেন যে তাঁর কাছে এর প্রমাণ আছে আর ৩৫৮ বছর ধরে গণিতজ্ঞরা তার সমাধান বের করতে মাথা কুটে মরলেন এটা কিন্তু একটা অনন্য সাধারণ ব্যাপার। মানে লোকে তো এটা সাহেবের ভীমরতি (যদিও ১৬৩৭ এ সাহেবের বয়স ৩০) বা ভুল ধারণা ভেবে অনেক আগেই ছেড়ে দিতে পারত এই উপপাদ্য প্রমাণের চেষ্টা। কিন্তু এই ৩৫৮ বছর ধরে (শেষমেশ ১৯৯৪ তে এর সমাধান বেরোয়) কেউ না কেউ এই প্রমাণের চেষ্টায় মাথা ঘামিয়েই গেছেন। আমি আসলে ভাবছিলাম আমি যদি এই ব্লগে বিভিন্ন দাবী লিখে বলে যাই যে "হুঁ হুঁ বাবা, আমার কাছে এর প্রমাণ আছে কিন্তু এখানে জায়গা কম বলে দিলাম না", তাহলে কি অন্তত ১০ বছর ধরেও লোকে তা প্রমাণ বা অপ্রমাণের চেষ্টা করবে? আমি জানি সে সম্ভাবনা প্রায় নেই। তার একটা কারণ নিশ্চয়ই এটা যে আমি যা যা নিয়ে লিখতে পারি তার কোন উপপাদ্যসুলভ নিশ্চিত প্রমাণ নেই। তাছাড়া, এই সব দাবী মৃত্যু'র পরে আবিষ্কার হলে তবেই এরকম সম্ভব। জীবিত অবস্থায় লেখা বেরোলেই লোকে গলায় গামছা দেবে -- কই, করুন দেখি প্রমাণ! রবীন্দ্রনাথের ধান ভানতে, ফার্মা'র গীত গাওয়ার একটাই কারণ। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে দুচার কথা লিখব, কিন্তু একটা একাডেমিক প্রবন্ধ যে ধরণের প্রমাণ দাবী করে তা দেব না। হয়ত প্রমাণ নেই, অথবা আছে কিন্তু বললাম না (ফার্মা স্টাইল!)।
রবীন্দ্রনাথের গান বেদনা প্রবণ যা আমাকে বা আমার মত অনেক বাঙ্গালিকেই মুগ্ধ করে। এই বেদনা কিন্তু বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা নয়। এর মধ্যে আত্ননিবেদন, নিঃস্ব হওয়ার আকুতি এবং উত্তরণ আছে অর্থাৎ, এই যন্ত্রণা আস্তিক, সে কোন মহাপ্রাণের সাথে মিলনে বিশ্বাস রাখে। সেখানেই এই গানগুলি ট্র্যান্সেন্ড করে। এসব কথা নতুন নয়। অনেকে অনেকভাবে, অনেক নতুন আঙ্গিকে এসব কথা বলেছেন বা না বললেও উপলব্ধি করেছেন। কিন্তু এই আস্তিক দুঃখবোধের প্রতি আমাদের (মানে বাঙ্গালিদের) যে আকর্ষণ, এটা যে খুব সাধারণ মানব চরিত্রের বৈশিষ্ট এমন তো নয়! সব সংস্কৃতি যে এই আস্তিক বেদনার সমঝদার এমনটা মোটেই নয় (সে যতই আমরা রবীন্দ্রনাথ কে বিশ্বকবি ভাবি না কেন এবং যতই তিনি নোবেল পেয়ে থাকুন না কেন!) কিছুদিন আগে আমি শঙ্খ ঘোষের ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো এবং রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক বইটা পড়ছিলাম। সেখানেও শঙ্খ দেখাচ্ছেন, বুদ্ধিজীবি সমাজে সমাদর পেলেও, ইউরোপ এবং চিনে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এর দর্শন সাধারণ ভাবে প্রত্যাখাতই হচ্ছে এবং তাঁকে লোকে প্রত্যাখান করছে প্রাচ্যের মিস্টিক কবি হিসেবে। ইউরোপে প্রত্যাখ্যান আসছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সভ্যতার মনন থেকে আর চিনে তা আসছে মাও সে তুং এর নেতৃত্বাধীন কম্যুনিস্টদের থেকে। শঙ্খ বাবু লিখছেন, “ছিঁড়ে যাচ্ছিলেন, কেননা এই ভারততত্ত্ব প্রচার তেমন কোন গরিমা পায়নি যতোটা হয়ত প্রত্যাশা ছিল তাঁর, যতটা হয়ত ধারণা ছিল আমাদের। বিদেশে যখনই গেছেন তখনই তিনি উজাড়-করা সন্মান পেয়েছেন সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই সন্মাননা কি নবীন কোন মনীষাকে ততটাই উদবেজিত করছিল সে-দেশে? ভবিষ্যতের তরুণদলকে জাগ্রত করছিল তেমনভাবে? আমাদের অনেকসময়ে জানতেও দেওয়া হয়নি প্রাচী-প্রতীচীর বিরূপ প্রতিক্রিয়াগুলি, জানলে ভালোই হতো হয়তো। কিন্তু আমরা না জানলেও রবীন্দ্রনাথ জানতেন সেই নিস্ফলতার আঘাত, যে-আঘাত যে-প্রত্যাখান কখনো কখনো তাঁকে বিষণ্ণ করে দিয়েছে” (পৃঃ ২১, ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ, শঙ্খ ঘোষ, দে’জ পাবলিশিং)। আমরা কিন্তু মোটের ওপর আচ্ছন্নই রইলাম রবীন্দ্রনাথে। সমাজ পাল্টালো আমূল, বিশ্বযুদ্ধ হল, মন্বন্তর হল, নকশাল আন্দোলন হল, তবু আমরা, কি আশ্চর্য, মোটের ওপর রাবীন্দ্রিকই রইলাম।
কিন্তু এই যে আমরা রবীন্দ্রনাথে আচ্ছন্ন রইলাম এটা কি আমাদের কোন বিশেষ জাতিগত মনবৈশিষ্ট্যের কারণে নাকি রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রায় ঐশ্বরিক প্রতিভায় আমাদের জাতির মননই পালটে দিয়েছিলেন গত শতাব্দীর গোড়ায়? শিল্পে দুঃখ উদযাপনের সাথে কি আমাদের নিবিড় যোগ আছে কোন? আর সেটাই আমাদের রবীন্দ্র আচ্ছন্নতার কারণ? এই উত্তর পাওয়ার প্রয়াসে আমি ভাবছিলাম যে বাংলাতে আর কোন কোন কবি আছে যাদের কবিতা মূলতঃ এক ধরণের গভীর বিষণ্ণতার খেলা। আমার সীমিত অভিজ্ঞতায় দুজনের কথা মনে হল -- জীবনানন্দ আর ভাস্কর চক্রবর্তী। দুজনের লেখাতেই একটা গভীর যন্ত্রণার অভিঘাত পাওয়া যায়।কিন্তু সেই যন্ত্রণা মূলতঃ ইউরোপীয়, সেখানে যন্ত্রণা আসছে বিচ্ছিন্নতা থেকে, ব্যক্তিকেন্দ্রিক সভ্যতার বিষাদ থেকে। সেখানে যন্ত্রণা নাস্তিক বেদনা , রবীন্দ্রনাথের মত যন্ত্রণার প্রক্রিয়া কোথাও উত্তরণ ঘটায় না। কারণ তার পেছনে সেরকম কোন বিশ্বাস নেই।
কিন্তু আমরা নাস্তিক যন্ত্রণার কাছে যাব না আস্তিক যন্ত্রণার কাছে, তা তো সমাজের অন্য পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত।আধুনিক সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে এই কিছুতে বিশ্বাস ক্ষয়ে গেছে ক্রমশ, আমরাও আস্তে আস্তে সাংস্কৃতিক ভাবে ইউরোপের কাছে চলে গেছি। সেই অবস্থায় জীবনানন্দকে আপন করে নেওয়া আশ্চর্যের না, আশ্চর্যের হল রবীন্দ্রনাথ এর থেকে যাওয়া। তাহলে আমরা রাবীন্দ্রিক রয়ে গেলাম কি করে? নাকি আমরা আর রাবীন্দ্রিক নেই? পুরোটাই পুরনো প্রজন্মের অভ্যাস?
আমার ধারণা ভোগের প্রতি মোহ এবং তৎপরবর্তী মোহভঙ্গ জীবনানন্দীয় যন্ত্রণায় পৌঁছে দেয়, কিন্তু খুব ভোগের প্রবাহে যায়নি যে সমাজ সে হয়ত রাবীন্দ্রিক থাকে। তার কোথাও বিশ্বাস থাকে। শিক্ষিত বাঙালি সমাজ কিন্তু বিশ্বাসের প্রবাহেই থেকেছে বহুদিন, পশ্চিমের সমনাধিকারের ধারণায়, স্বাধীনতার ধারণায় আর তারও পরে সমাজবদলের ধারণায়। বিশ্বাসভঙ্গের সূচনা তো নব্বই দশকের গোড়ার দিকে -- বার্লিনের পাঁচিল ভেঙ্গে দেশে যখন অবাধ ভোগ আর মোটা মাইনের চাকরির ব্যবস্থা হল। কিন্তু নব্বইতে যারা যৌবন গেছে যাদের ভোগের স্বাদ পেলেও বিশ্বাসকে পুরোটা ছাড়তে পারে নি আর সেই পিছুটানের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ রয়ে গেছেন। কিন্তু নব্বইতে জন্মেছে যে শিশু, সেও এখন যৌবনের দোরগোড়ায়। তাই মনে হচ্ছে, আস্তিক যন্ত্রণার দিন শেষ হয়ে আসছে। গোটা পৃথিবী আস্তে আস্তে নাস্তিকতার দিকে এগোচ্ছে। এখন সংস্কৃতি শাসন করছে মধ্য-চল্লিশের লোকজন যাদের জন্ম আস্তিক পৃথিবীতে। তাই এখনও পুরোটা বোঝা যাবে না নাস্তিক সংস্কৃতি'র বিকাশ।
কিন্তু আমার মনে হয় আধুনিক প্রজন্মের কাছে (যারা ১৯৯৫ বা তারো পরে জন্মেছে) হয়ত রবীন্দ্রনাথের আবেদন বিলীয়মান। নাকি যৌবনে রবীন্দ্রনাথের আবেদন সব সময় কম থাকে (সুনীল পাপোষে লুটিয়েছিলেন রবীন্দ্র রচনাবলী) আর বয়স হলে তা ফিরে আসে? কারণ সেই ১৯৩০ এর দশক থেকে বার বারই কবিরা রবীন্দ্রনাথ কে অস্বীকার করেছেন আর বয়সকালে তাঁর কাছেই ফিরেছেন। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, এই ফেরা না ফেরার খেলা শেষ হল বোধহয়। তখনো নাস্তিক আর আস্তিক পৃথিবীর লড়াই ছিল, লেনিনগ্রাদ ছিল, ভিয়েতনাম ছিল। এখন শুধু অপর্যাপ্ত ভোগের "বীভৎস মজা" (এবং হয়ত তার কিছুটা প্রতিরোধও, কিন্তু সেটা খুব ব্যক্তিগত পরিসরে, সামাজিক মূল্যবোধের স্তরে নয়)। আস্তিক যন্ত্রণার দিন শেষ হয়ে এল বোধহয়। যদিও এসবই অলস মনের conjecture (এর বাংলা কোনটাই লাগসই মনে হল না), প্রমাণ যে আছেই তাও বলতে পারছি না। ফার্মা হওয়া এত সহজ নয়!
আধুনিক প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে, এর প্রধান কারণ বোধহয় অতিব্যবহার দুষ্টতা।
নইলে রোদ্দুর রায়ের এতো ফ্যান হয় কী করে?