বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে গারো পাহাড়ের কোলে নেত্রকোনা জেলার বিরিশিরির সীমান্ত আদিবাসী গ্রাম সুসং দূর্গাপুরে হাজং জনজাতির মানুষ মেতে উঠেছেন ঐহিত্যবাহী ‘প্যাঁক খেলা’ উৎসবে। নারী-পুরুষ-শিশু সকলেই একে অপরকে পলি-কাদা মাখিয়ে খুশীতে মাতোয়ারা।
হাত ধরাধরি করে গোল হয়ে নেচে-গেয়ে অনাবিল আনন্দ, হাসি, তামাশায় সকলে বিভোর। কাদা মেখে কিম্ভুতকিমাকার একেকজন। হাসি আর কণ্ঠস্বর দিয়েই চিনে নিতে হয় পরস্পরকে।
‘প্যাঁক খেলা’ শেষে কাদা মেখেই নরম কাদায় বপন শুরু হয় ধান। এমনই সরল-সুন্দর-ঐতিহ্যময় হাজাং আদিবাসী জীবন।
‘হা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে, টিলা বা পাহাড়। এক সময় পাহাড়ি অঞ্চলে তাদের বসবাস ছিল বলে তাদের নামকরণ হয় ‘হাজং’। এ দেশের শেরপুর, রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী হাজংদের বাস। এছাড়া গাজীপুর ও টাঙ্গাইলের ভাওয়াল গড়ে এবং সুনামগঞ্জে অল্প কয়েক পরিবার হাজং বাস করেন। নেত্রকোনার কলমাকান্দা ও দুর্গাপুরে আনুমানিক সাড়ে আট হাজার হাজং পরিবার আছেন।
হাজংদের রয়েছে ঐতিহ্যবাহী নিজস্ব ভাষা, রীতিনীতি, সংস্কৃতি, বয়ন, পোশাক-পরিচ্ছদ। শান্তিকামী হাজাংরা অধিকাংশই পেশায় কৃষিজীবী, ধর্মান্তারিত হয়ে খ্রিষ্টান।
হাজংদের ‘প্যাঁক খেলার’ মতো কক্সবাজার-পটুয়াখালির রাখাইনদের রয়েছে আরেক ঐতিহ্যবাহী পানি-খেলা উৎসব-- সাংগ্রেং। পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমারাও পানি খেলার আয়োজন করেন, তারা একে বলেন-- সাংগ্রেই পোয়ে। সেটি অবশ্য বর্ষ বিদায় ও বর্ষ বরণের ভিন্ন এক উৎসব। আর বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলে বসবাসকারি গারো বা মান্দি জাতিগোষ্ঠীর রয়েছে বীজ বপনের উৎসব ‘রঞ্চুগালা’ ও নবান্ন উৎসব ‘ওয়ানগালা’। আর চাকমাদের বর্ষ বরণ ও বর্ষ বিদায় উৎসবের নাম ‘বিঝু’। ত্রিপুরারা তাদের চৈত্র সংক্রান্তির উৎসবকে বলেন ‘বৈসুক’। সাঁওতাল আদিবাসীর রয়েছে নবান্ন উৎসব ‘সোহরাই বাহা’ ও বৃক্ষ বন্দনা ‘কারাম’ উৎসবের ঐতিহ্য। তবে সে সব ভিন্ন প্রসঙ্গ।
ছোট্ট জনজাতি হাজংদের রয়েছে হাজং বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, টংক আন্দোলন এবং ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস। ১৯৪৬-৫০ সালের টংক আন্দোলনের শহীদ রাশমনি হাজং এখনো হাজংদের কাছে দেবীর সমান। ওই বিদ্রোহের নেত্রী কুমুদিনী হাজং এখনো জীবন্ত কিংবদন্তি। জমিদারদের অন্যায্য খাজনা আদায়ের বিরুদ্ধে সেই সময় রাজ সেনার বিরুদ্ধে তিনি কৃষকদের বিরত্বপূর্ণ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন।
টংক ছিল সে সময় ফসলের মাধ্যমে জমিদারদের খাজনা প্রদানের একটি শোষণমূলক প্রথা। নিখিল ভারত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মনি সিংহ ১৯৩৭ সালে টংক প্রথা উচ্ছেদ, টংক জমির খাজনা স্বত্ব, জোত স্বত্ব, নিরিখ মতো টংক জমির খাজনা ধার্য, বকেয়া টংক মওকুফ, জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ ইত্যাদি দাবিতে টংক আন্দোলন সংগঠিত করেন।
১৯৫০ সালে জমিদার প্রথার বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত টংক আন্দোলন চলে। ‘পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহন ও প্রজাস্বত আইন ১৯৫০’ এর বলে সকল টংক কৃষককে তার দখলীকৃত জমির স্বাভাবিক মালিক হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
______
ছবি (c) : বিপুল হাজং, দূর্গাপুর, বিরিশিরি, নেত্রকোনা।
______
সংযুক্ত : বিঝু ফেগ ডাকে, বিঝু বিঝু...
সাংগ্রেং : সাগরপারের আদি রাখাইন উৎসব
একটি প্রায় বিলুপ্ত আদিবাসী উৎসব
এইসব উৎসবকেই স্বাগত। এরা প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের অচ্ছেদ্য বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দেয়। এদের পাশে ডিজে খচিত আলোকমালা সজ্জিত শহুরে উৎসবগুলি নেহাতই হুল্লোড়।
অনেক ধন্যবাদ দিদি। তোমার মন্তব্য সব সময়ই উৎসাহব্যঞ্জক