এই লেখাটির প্রেক্ষাপট বিবিসি তে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন – Coronavirus: Is India the next global hotspot? যেখানে লেখকরা তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছেন যে পরবর্তী বিপর্যয় ভারতেই। যে তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে লেখকরা এই দাবী করছেন, তা নিয়ে সংশয় হওয়ার কারণে মনে হল এই বিষয়ে পর্যালোচনা প্রয়োজন। প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল যে সংশয় তথ্যের সত্যতা নিয়ে নয়, তার ব্যাখ্যা নিয়ে। আমি তাই চেষ্টা করব একই তথ্যকে একটু অন্যভাবে দেখার।
“ভগ্নাংশ না ত্রৈরাশিক?”
যাঁরা এই লেখা পড়ছেন তাঁরা নিশ্চয়ই ভারতে প্রতিদিনের লাফিয়ে বাড়তে থাকা করোনা আক্রান্তের সংখ্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তাঁদের নিশ্চয়ই এটাও মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই যে মোট করোনা আক্রান্তের বিচারে ভারত এই মুহূর্তে তৃতীয় স্থানে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রাজিল এর পরেই। কিন্তু প্রশ্ন হল, ভারতে করোনা পরিস্থিতির তুলনামূলক বিচারের জন্য সঠিক মাপকাঠি কোনটি? মোট আক্রান্তের সংখ্যা নাকি দেশের জনসংখ্যার কত শতাংশ আক্রান্ত সেটি? কারণ এটা তো ভুললে চলবে না যে ভারতের জনসংখ্যা সুবিশাল – প্রায় ১৩০ কোটি। সুতরাং, দেশের জনসংখ্যার ১ শতাংশকেও করোনা আক্রান্ত হতে হলে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা হতে সেরকম একটি দেশের এক কোটিরও বেশী লোকে আক্রান্ত হতে হবে। একবার দেখে নেওয়া যাক ভারত সহ বেশ কিছু দেশের কত শতাংশ লোক এই মুহূর্তে করোনায় আক্রান্ত। শতাংশের হিসেবে সংখ্যাটি খুব কম আসবে বলে আমরা প্রতি এক মিলিঅন (১০ লাখ) জনসংখ্যায় কত লোক আক্রান্ত সেই হিসেবটি দেখে নিই নিচের রেখাচিত্রে। তথ্যসূত্র হিসেবে আমি, বিবিসি র প্রবন্ধ যা ব্যবহার করেছে (Our World in Data (OWID)), তাই করেছি। এই তথ্যের সময়কাল জুলাই, ২০২০ র প্রথম সপ্তাহ।
আনুপাতিক হিসেবে দেখা যাচ্ছে ফ্রান্স, জার্মানির মত দেশে প্রতি দশ লাখ জনসংখ্যায় আক্রান্তের সংখ্যা আড়াই হাজারের কাছাকাছি। (একটা কথা এখানে বলে নেওয়া ভাল। আমি কয়েকটি দেশকে এই আলোচনায় স্থান দিয়েছি কারণ সব দেশ একসাথে নিয়ে আলোচনা সম্ভব নয়। আমি ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলি কে নিয়েছি আর কিছু উন্নত দেশ, যেখানে অতিরিক্ত করোনা সংক্রমণের খবর সংবাদমাধ্যমে বেরিয়েছে। এছাড়া ব্রাজিল, যে ঠিক উন্নত না হলেও উন্নয়নশীল দেশের একদম উপরের সারিতে এবং সেখানে করোনা সংক্রমণের হার ক্রমশ বাড়ছে। কয়েকটি দেশ করোনা প্রতিরোধের কাজ খুব সাফল্যের সাথে করেছে তার মধ্যে পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ, জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়া, যেমন রয়েছে তেমনই রয়েছে নিউজিল্যান্ড। অবশ্য, আমাদের প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কাও এই সাফল্যের তালিকায় থাকবে । যাই হোক, পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিকে আমি পরের কিস্তির লেখায় আলোচনায় আনব।) উত্তর আয়ারল্যান্ড সহ বৃটেন (যাকে ইউনাইটেড কিংডম, বলা হয়), ইতালি আর রাশিয়াতে সেই সংখ্যাটিই চার থেকে পাঁচ হাজারের মধ্যে। আমেরিকা আর ব্রাজিল সেদিক থেকে সবাইকেই ছাপিয়ে গেছে, প্রতি দশ লাখে সেখানে প্রায় আট থেকে নয় হাজার মানুষ আক্রান্ত। দক্ষিণ এশিয়াতে এই সংখ্যাটি অনেকটাই কম, ভারতে প্রতি দশ লাখ জনসংখ্যায় প্রায় পাঁচশর মত মানুষ আক্রান্ত. পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এই সংখ্যাটিই ভারতের প্রায় দ্বিগুণ, প্রতি দশ লাখে সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় এক হাজারের কাছাকাছি।
সমুদ্রে পেতেছি শয্যা...
তাহলে মোদ্দা কথাটা দাঁড়ালো যে মোট জনসংখ্যাতে করোনা ভাইরাস আক্রান্তের অনুপাত আর মোট করোনা ভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দিচ্ছে। তাহলে কোনটি নেব আমরা? সাধারণ ভাবে কোন বিষয়ের আন্তর্জাতিক তুলনার জন্য জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে অনুপাত প্রকাশ করাটাই দস্তুর। কিন্তু এক্ষেত্রে বিষয়টি একটু জটিল। মানে ধরুন, একটা পাড়ায় ২০ জনের কলেরা হয়েছে, আর অন্য পাড়ার ৫০ জনের। মোট সংখ্যার বিচারে নিশ্চয়ই দ্বিতীয় পাড়ায় কলেরার প্রকোপ বেশী। কিন্তু, যদি আমি জানি যে প্রথম পাড়ায় ৪০ জন থাকে আর দ্বিতীয় পাড়ায় ১৫০ জন, তাহলে আনুপাতিক বিচারে প্রথম পাড়ায় কলেরার প্রকোপ বেশী। কোন পাড়ায় কলেরা বেশী ছড়িয়েছে সেই প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই প্রথম পাড়া – সেখানে মোট বাসিন্দাদের ৫০% কলেরায় আক্রান্ত, যেখানে দ্বিতীয় পাড়ার ৩৩% কলেরায় আক্রান্ত। কিন্তু এবারে অন্য একটা বিষয় ভাবুন। ধরুন দুটো পাড়াতেই দুটি ৩০ শয্যার হাসপাতাল রয়েছে। এবারে বুঝতেই পারছেন যে সমস্যাটা অনেক বেশী হবে দ্বিতীয় পাড়ায় যেখানে আনুপাতিক হিসেবে কম হলেও, মোট রোগীর থেকে শয্যার সংখ্যা কম। আর এই কারণেই, আনুপাতিক হিসেবে কম হলেও, রোগীর মোট সংখ্যা ভারতের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। 2011 সালের হিসেব অনুযায়ী প্রতি হাজার জনসংখ্যার জন্য মোট হাসপাতাল শয্যা মাত্র ০.৭। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর জন্য এই সংখ্যাটা ২.৯, ইউনাইটেড কিংডমের জন্য ২.৮, ব্রাজিলের জন্য ২.২। ফ্রান্স (৬.৫) বা জার্মানির (৮.৩) জন্য এই সংখ্যাটি আরও বেশী (তথ্য সূত্র বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইট)। সব দেশের জন্যই এই তথ্যটি 5-10 বছরের পুরনো। তবে খুব পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। এই সময়ের মধ্যে হাসপাতালের শয্যার সংখ্যা যেমন বেড়েছে, জনসংখ্যা তেমনি বেড়েছে। আমরা সাম্প্রতিক করোনা বিপর্যয়ের সাপেক্ষে এই সংখ্যাগুলির গুরুত্ব একটু বুঝে নি। পরবর্তী রেখাচিত্রে আমরা বিভিন্ন দেশে প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যায় হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা আর করোনা রোগীর সংখ্যার আর তুলনা করে দেখি। এই দুই সংখ্যার মধ্যে ফারাক আমাদের বলে দেবে যে আমরা ইতিমধ্যেই হাসপাতালের ধারণ ক্ষমতার অতিক্রম করে ফেলেছি কিনা। মনে রাখবেন, এটা একটা সাধারণ ধারণা পাওয়ার জন্য, খুব নির্দিষ্ট করে এ থেকে কিছু বলা যায় না। কারণ অনেক হাসপাতালেই অন্য রোগীরা আছেন, আবার সব করোনা রোগী যে হাসপাতালে যাচ্ছেন তাও নয়। তাছাড়া হাসপাতাল হয়ত সারা দেশেই ছড়িয়ে আছে, রোগের প্রকোপ সেখানে মুম্বাই, দিল্লি বা নিউ ইয়র্কের মত কিছু শহরেই কেন্দ্রীভূত। তাহলেও, এই দুটি সংখ্যা থেকে একটু সাধারণ ধারণা আমাদের পরিস্থিতি বুঝতে সাহায্য করবে। বিষয়টি আরও ভাল ভাবে বোঝার জন্য আমরা একটি চলক (অর্থাৎ variable, এযুগের পাঠকদের অনেকেই বাংলায় অঙ্ক করেন নি হয়ত। তাই ইংরিজিটাও জানিয়ে রাখলাম) তৈরি করলাম – হাসপাতাল শয্যার অতিরিক্ত যোগান। প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যায় হাসপাতাল শয্যার সংখ্যা থেকে প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যায় করোনা রোগীর সংখ্যা বাদ দিয়ে এই চলকটি তৈরী হয়েছে। এই চলকের মান শূণ্যের থেকে বেশী মানে পরিস্থিতি অতটা বিপজ্জনক নয়, কিন্তু শূন্যের থেকে যত কম হবে সংখ্যাটি, ততই বিপর্যয় ঘনীভূত।
উপরের চিত্রটি একটু ব্যাখ্যা করলে বিষয়টি বোঝা যাবে। ফ্রান্সে যদি সব করোনা রোগীকে হাসপাতালে দেওয়া যায় তাহলেও প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যার জন্য প্রায় চার হাজার শয্যা পড়ে থাকবে। জার্মানিতে পড়ে থাকবে প্রায় ছ হাজার শয্যা। অন্যদিকে আমেরিকা আর ব্রাজিলে সব করোনা রোগীকে হাসপাতালে দিতে হলে প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যায় প্রায় ৬ হাজার শয্যা কম পড়বে। সেই একই ভাবে ভারতে করোনা রোগীকে হাসপাতালে রাখলেও প্রতি ১০ লাখে ২১২ টা শয্যা বেশী থাকবে। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে এই ব্যাখ্যাতে আমরা ধরে নিচ্ছি অন্য কোন রোগের রোগী হাসপাতালে ভর্তি নেই, যা সত্যি হতে পারে না। তাই হাসপাতাল শয্যার অতিরিক্ত যোগানের মান শূন্যের থেকে বেশী হলেই পরিস্থিতি ভালো তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কিন্তু শূন্যের থেকে কম হলে যে পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক (যেমন দেখা যাচ্ছে ইউনাটেড কিংডম, ইটালি, আমেরিকা আর ব্রাজিল এর ক্ষেত্রে), তা অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে বলা যায়।
মৃত্যু বিষয়ে দুটো একটা কথা যা আমরা জানি
এবার তাহলে মৃত্যুর কথায় আসা যাক। মৃত্যুর ক্ষেত্রেও একই ভাবে মোট মৃত্যু আর প্রতি দশ লাখ জনসংখ্যায় মৃত্যু দুভাবেই দেখা যাক।
এখানেও লক্ষণীয় বিষয় যে ইউনাটেড কিংডম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিলের মত দেশগুলি দুটি তালিকার শীর্ষে আছে। ভারত মোট মৃত্যুর নিরিখে এই বাছাই ১১ টি দেশের মধ্যে পঞ্চমে আর মৃত্যুহার এর নিরিখে নবম স্থান এ আছে।
উপরের আলোচনা থেকে একটা জিনিষ পরিষ্কার। সেটা হল, করোনা সংক্রমনের নিরিখে ভারতের অবস্থান নিয়ে সংশয় থাকলেও,মৃত্যুর হার কিন্তু ভারতে বেশ কম। আর আক্রান্তের তথ্য চেপে যাওয়া খুব কঠিন না হলে, মৃত্যুর সংখ্যায় খুব অদলবদল করা কঠিন। কিন্তু এই জাতীয় আলোচনায় একটা কথা উঠে আসছে, সেটা হল ভারতে আক্রান্তের হার কম কারণ পরীক্ষা কম। এটা বিবিসির প্রবন্ধে ভারত সম্পর্কে বলা হয়েছে, কিন্তু কিছুদিন আগেই বিভিন্ন মহল থেকে পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে বলা হচ্ছিল। এই লেখার পরের কিস্তিতে আমি এই সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করব।
করোনা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনায় চীনের পরিসংখ্যান থাকলে ভাল হতো। কেননা জনসংখ্যার দিক দিয়ে ভারত ও চীন প্রায় কাছাকাছি। আশাকরি লেখক এব্যাপারটা ভেবে দেখবেন।
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখা,পরের কিস্তির জন্য অপেক্ষা করছি..
ছবি সমস্যার একটা সমাধান করতে পেরেছি বলে মনে হয়। তবে লিঙ্কে ক্লিক করে দেখতে হবে। আর চিনের আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু চিনে রোগটা খুব বেশি ছড়ায় নি অন্যান্য দেশের মত। মূলত একটি প্রদেশেই ছিল। তবে আমি পরের লেখায় চিনের পরিসংখ্যানও দিয়ে দেব।
প্রতি 10 লাখে পজিটিভ হওয়াটা কত দিনে.. আসলে সব কটা constraint consider করাটাই বাঞ্চনীয়..না হলে খানিকটা অসম্পূর্ণ থেকেই যায়..