এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • সেপিয়েন্স এর উদ্ভব আর বিস্তার

    souvik ghoshal লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১৯ মে ২০২০ | ৩২৬২ বার পঠিত
  • হারারি তাঁর বিখ্যাত সেপিয়েন্স বইতে বলছেন - প্রথম যখন হোমো সেপিয়েন্সরা আফ্রিকা থেকে ইউরেশিয়ার দিকে আসার চেষ্টা করে, তখন মানজাতির আরেক প্রজাতি নিয়ান্ডার্থালদের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ হয়। নিয়ান্ডার্থালরা সম্ভবত জ্ঞাতি সেপিয়েন্সদের সে যাত্রায় হঠিয়ে দিয়েছিল। সেটা প্রায় এক লক্ষ সত্তর হাজার বছর আগের ঘটনা।
    বেশ কয়েক হাজার বছর পর পরবর্তী প্রচেষ্টায় হোমো সেপিয়েন্সরা এই লড়াইতে বিজয়ী হয়। হারারি ইঙ্গিত করেছেন যে ভাষাবিপ্লবের মধ্যে দিয়ে বড়সড় সামাজিক সংগঠন তৈরি করার কৌশল ততদিনে সেপিয়েন্স এর রপ্ত হয়েছে। ভাষা শুধু সেপিয়েন্সকে তথ্য আদান প্রদান করতেই শেখায় নি। কাল্পনিক রেস এর ধারণাতে উন্নীত হতে সাহায্য করেছিল। এই ধারণা-জগত একধরনের বিশেষ বস্তুগত শক্তিতে রূপান্তরিত হয়, অনেকটা আজকের দিনের জাতিয়তাবাদের সাথে তার তুলনা করা যায়। আর এর সাহায্যেই শারীরিকভাবে অনেক শক্তিশালী নিয়ান্ডার্থালদের সে হারাতে পারল।
    এক কোটি বছর আগে আফ্রিকার জলবায়ু বদলে যাচ্ছিল। ঘন অরণ্যের আফ্রিকায় তৃণভূমি দেখা দিতে শুরু করল। মানুষের উৎপত্তি যে এপ থেকে, যারা গাছে ও মাটিতে দু জায়গাতেই থাকত, তারা সেই সময়ে মাটিতে অপেক্ষাকৃত বেশি সময় থাকা শুরু করল।
    কয়েক লক্ষ বছর ধরে চলল অভিযোজন। ষাট লক্ষ বছর আগে এপ থেকে দুটি শাখা আলাদা হয়ে গেল। একটি হল শিম্পাঞ্জি। অন্যটি হোমিনিড। এই হোমিনিডরা অনেকটা সোজা হয়ে হাঁটল।
    ক্রমশ তাদের অনেকের হাতের নানারকম ব্যবহার বাড়ল। বাড়ল মস্তিষ্কের আয়তন। দাঁতের গঠনে পার্থক্য এল। এই নতুন বৈশিষ্ট্যের হোমিনিডদের একটা নাম দেওয়া হয়েছে। অস্ট্রালো পিথেকানস। চল্লিশ লক্ষ বছর আগে তাদের উদ্ভব।
    এপ আর মানবজাতি অর্থাৎ স্পিসিস হোমো র মাঝখানে দাঁড়িয়ে এই অস্ট্রালোপিথেকানসরা। এদের বিবর্তনের মধ্যে দিয়েই আলাদা আলাদাভাবে একদিকে চব্বিশ লক্ষ বছর আগে হোমো হ্যাবিলিস, উনিশ লক্ষ বছর আগে হোমো ইরগারস্টার এবং আঠারো লক্ষ বছর আগে দীর্ঘজীবী হোমো ইরেকটাস এর জন্ম হয়।
    গোটা মানব জাতির অনেক ভাই বোন ছিল। বাকী ভাই বোনেরা এখন প্রয়াত। কেবল বেঁচে আছে হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতিটি।
    অন্যান্য যে সব প্রজাতি ছিল আমাদের মানব জাতির তার মধ্যে আছে -
    ১) হোমো হ্যাবিলিস ২) হোমো ইরগাস্টার ৩) হোমো ইরেক্টাস ৪) হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস ৫) হোমো অ্যান্টেসেসর ৬) হোমো হাইডেলবার্গনেসিস ৭) হোমো নিয়ান্ডারথালেনিস
    এই সাতটি (এখনো অবধি জানা) প্রজাতির কেউ আর এখন বেঁচে নেই। বেঁচে আছে কেবল
    ৮) হোমো স্যাপিয়েন্স।
    এরকম কিন্তু নয় যে একটি প্রজাতি থেকে আরেকটি প্রজাতি জন্ম নিয়েছে। তারা আলাদা আলাদাভাবেই জন্মেছে এবং অতীতে কোনও কোনও সময় একই সময়কালে পৃথিবীর মাটিতে এইসব মানব প্রজাতি পাশাপাশি থেকেছে। মাত্র বারো হাজার বছর আগে হোমো সেপিয়েন্স এর শেষ ভাই বা বোনটি মারা যায়। এই প্রজাতিটির নাম হল হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস। অর্থাৎ বারো হাজার বছর আগে, মিশরে যখন পিরামিড বানানো শুরু হচ্ছে তার হাজার ছয়েক বছর আগে কোনও হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস প্রজাতির বোন হয়ত আমাদের হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির কোনও ভাইয়ের সাথে বসে বসে গল্প করছিল আগুনের ধারে বসে।
    আর আজ থেকে তিরিশ হাজার বছর আগের ছবি যদি কল্পনা করা যায়, তাহলে হোমো সেপিয়েন্স আর হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস প্রজাতির পাশাপাশি কোনও জমায়েতে আরো দুই প্রজাতির উপস্থিতির কথা ভাবা যায়। হোমো ইরেক্টাস এবং হোমো নিয়ান্ডারথালেনসিস। অর্থাৎ আজ থেকে তিরিশ হাজার বছর আগে এই চার প্রজাতির পাশাপাশি বসে গল্পগাছা করা সম্ভব ছিল। অবশ্য মনে রাখতে হবে এরা ভৌগলিকভাবে একই অঞ্চলে ছিল না। যেমন হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরে দ্বীপপুঞ্জের বাইরে সম্ভবত পা রাখে নি। আবার হোমো ইরেক্টাস আফ্রিকায় জন্ম নিয়ে পৃথিবীর নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল।
    অস্ট্রালোপিথেকানস দের অন্য প্রজাতি ধরে নিলে মানব জাতির বড়দা বা বড়দি বা সবচেয়ে প্রাচীন প্রজাতি সম্ভবত হোমো হাবিলিস। ২৪ লক্ষ বছর আগে তাদের উদ্ভব। দশ লক্ষ বছর পৃথিবীতে টিঁকে থাকার পর এই প্রজাতিটির মৃত্যু হয়। সে প্রায় আজ থেকে ১৪ লক্ষ বছর আগে।
    মেজদা বা মেজদি বলা যায় হোমো ইরগাস্টারকে। আবির্ভাব ১৯ লক্ষ বছর আগে আর লয় ১৫ লক্ষ বছর আগে।
    এরপর আবির্ভাব হোমো ইরেক্টাস প্রজাতির। সবচেয়ে দীর্ঘজীবনের অধিকারী এরা। ১৮ লক্ষ বছর আগে তাদের উদ্ভব। মাত্র তিরিশ হাজার বছর আগে তারা বিলুপ্ত হয়ে গেল। সতেরো লক্ষ বছরের বেশি সময়কাল জুড়ে আর কোনও মানব প্রজাতিই টিঁকে থাকে নি।
    হোমো অ্যান্টেসেসর এর আবির্ভাব ৮ লক্ষ বছর আগে। লয় ৫ লক্ষ বছর আগে।
    হোমো হাইডেলবার্গেনসিস এর আবির্ভাব ৬ লক্ষ বছর আগে। লয় ১ লক্ষ বছর আগে।
    হোমো নিয়ানডারথেলেনিস এর আবির্ভাব চার লক্ষ বছর আগে। এরাও বিলুপ্ত হল হোমো ইরেক্টাস যখন বিপুপ্ত হচ্ছে সেই সময়টাতেই। হাজার তিরিশ বছর আগে।
    আজ থেকে দু লক্ষ বছর আগে আমাদের প্রজন্ম হোমো স্যাপিয়েন্স এর আবির্ভাব। কিন্তু তার পরেও জন্ম নিয়েছে হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস। এক লক্ষ বছর আগে। সেই মানব প্রজাতির সবচেয়ে কনিষ্ঠ ভাই বা বোন। তার জীবনকালও সবচেয়ে কম। আজ থেকে ১২ হাজার বছর আগে যখন সে মারা যাচ্ছে তখন দেখা যাচ্ছে পৃথিবীতে এই প্রজাতি থেকেছে মাত্র আশি হাজার বছর। এত কম আয়ু আর অন্য কোনও প্রজাতির ছিল না।
    মানব জাতির অন্যান্য ভাই বোনেরা বেশ কয়েক লক্ষ বছর আগে ধরাধাম থেকে বিদায় নিলেও এই সেদিন মানে তিরিশ হাজার বছর আগে পর্যন্তও যারা টিঁকে ছিল তারা হল - হোমো ইরেক্টাস, হোমো নিয়ান্ডারথালেনসিস, হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস এবং হোমো স্যাপিয়েন্স। এদের মধ্যে হোমো সেপিয়েন্স এখনো ব্যাট করে চলেছে। এখনো সেই একমাত্র নট আউট।
    অনেক লক্ষ বছর আগেই যারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তাদের বিলুপ্তির কারণ খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। কিন্তু কেন আজ থেকে তিরিশ হাজার বছর আগে দুম করে হোমো ইরেক্টাস, হোমো নিয়ান্ডারথালেনসিস এই দুটি প্রজাতি প্রায় একসাথে বিলুপ্ত হয়ে গেল - সেই বিষয়ে কৌতূহল তৈরি হয়। বড় কোনও ভৌগলিক বিপর্যয় না কোনও মারণ রোগের সংক্রমণ? যার হাত এড়াতে পারে নি এই দুই প্রজাতি?
    হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস সে যাত্রায় সম্ভবত টিঁকে গিয়েছিল একটি ছোট দ্বীপপুঞ্জে "লক ডাউন" থাকায় আর হোমো সেপিয়েন্স এর উন্নততর অভিযোজন ক্ষমতাই কি তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল ধ্বংসের হাত থেকে?
    হোমো সেপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষের যাত্রাপথটা শুরু হয়েছিল আফ্রিকা থেকে। প্রথমদিকে অনেক বছর হোমো সেপিয়েন্স আফ্রিকাতেই “লক ডাউন” ছিল। হোমো সেপিয়েন্স এর উদ্ভব দু লক্ষ বছর আগে বলে ধরা হয়। আর্কেকিক হোমো সেপিয়েন্স এর উদ্ভব তিন লক্ষ বছর আগে বলেও কেউ কেক মনে করেন। পূর্ব আফ্রিকা থেকে আরব হয়ে এশিয়ার দিকে হোমো সেপিয়েন্স এর বিস্তার হয় সৌদি আরবের মধ্যে দিয়ে, আজ থেকে প্রায় সত্তর হাজার বছর আগে। সৌদি থেকে ভারতের পশ্চিমে গুজরাট এলাকায় তারা আসে। পশ্চিম উপকুল করে দক্ষিণে কন্যাকুমারিকা অবধি এসে আবার উত্তরে যেতে থাকে তারা পূর্ব উপকুল ধরে। এরপর বাংলা অবধি এসে তারা বাঁক নেয়। ঘটনাগুলি অবশ্যই কয়েক হাজার বছর ধরে ঘটছিল। ব্রহ্মদেশ, লাওস, ভিয়েতনাম সহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে দিয়ে ইন্দোনেশিয়া হয়ে তারা পৌঁছায় অস্ট্রেলিয়ায়। হোমো সেপিয়েন্স অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছোয় আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার বছর আগে।
    গুজরাট অঞ্চল থেকে কয়েকটি দল যেমন ভারতের পশ্চিম উপকুল ধরে এই অভিযাত্রায় সামিল হয়, অন্য কয়েকটি দল আবার গুজরাট অঞ্চল থেকে উত্তরাভিমুখে যাত্রা করে। এর মধ্যে কয়েকটি দল উত্তরে চলতে চলতে চিন ও রাশিয়ায় গিয়ে পৌঁছায়। কয়েকটি দল আবার পশ্চিমে বাঁক নেয় এবং পূর্ব ইউরোপ হয়ে পশ্চিম ইউরোপের দিকে এগোতে থাকে। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ হাজার বছর আগে হোমো সেপিয়েন্সরা ইউরোপে পৌঁছায়। এর এক লক্ষ বছর আগে তাদের প্রথম অভিযাত্রা প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছিল এবং নিয়ান্ডার্থালদের কাছে তারা লড়াইতে হেরে গিয়েছিল। এইবার উল্টো ঘটনা ঘটে। তারা নিয়ান্ডার্থালদের হারিয়ে দেয়। আজ থেকে তিরিশ হাজার বছর আগে হোমো নিয়ান্ডার্থালরা বিলুপ্তই হয়ে যায়।
    আফ্রিকা থেকে আরো কয়েকটি দলের অভিযাত্রা প্রথম থেকেই অন্য পথে হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেছেন। তারা ভারতের দিকে না এসে সরাসরি তুরষ্কের মধ্যে দিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করে।
    মানুষের বিকাশ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে দীর্ঘদিন ধরেই "ফেলো ফিলিং" খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কিন্তু এই ফেলো ফিলিং এর ব্যাপারটি সরল একরৈখিক নয়। যেহেতু তা একটি নির্মিত আখ্যান, তাই তাকে নানাভাবে পাল্টানো যায়, রদবদল করা যায়। ইতিহাসে আমরা বারবার তার সাক্ষ্য পেয়েছি। কে কার ফেলো, কে কার শত্রু - এই নির্মাণ মানুষের ইতিহাসের অন্যতম নির্ণায়ক ব্যাপার।
    বিভিন্ন মানব প্রজাতির মধ্যে কি যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল? জিন সংকর কি ঘটেছিল? এর নিশ্চিত কোনও উত্তর দেওয়া কঠিন।
    সেপিয়েন্স যখন মধ্য প্রাচ্যে আসে তখন ইউরেশিয়ার বেশির ভাগ এলাকা অন্যান্য প্রজাতির মানুষে ভরপুর। পরবর্তী সময়ে কোথায় হারালো মানুষের অন্যান্য প্রজাতির সদস্যরা? এ ব্যাপারে দুটো পরস্পরবিরোধী তত্ত্ব আছে। তার একটা হলো সঙ্কর প্রজনন (Interbreeding) তত্ত্ব। এই তত্ত্ব নিজের প্রজাতির সদস্য এবং অন্য প্রজাতির সদস্যদের সাথে একটি প্রাণীর প্রজনন সম্বন্ধে আলোচনা করে। এ তত্ত্ব অনুসারে, আফ্রিকার মানুষ পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে এক প্রজাতির মানুষ আরেক প্রজাতির মানুষের সাথে প্রজননে লিপ্ত হয়। আর আজকের আধুনিক মানুষ এই সঙ্কর প্রজননের ফলাফল।
    সঙ্কর প্রজনন তত্ত্ব বলে, যখন সেপিয়েন্স নিয়ান্ডার্থালদের এলাকায়, মানে ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ল তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা ঘটল। সেপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডার্থালেরা মিলে সন্তান উৎপাদন শুরু করল। এভাবে দুটি প্রজাতি মিলে মিশে একটি জনগোষ্ঠীতে পরিণত হলো।
    এই তত্ত্বের বিপরীতে আরেকটা তত্ত্ব আছে যেটার নাম প্রতিস্থাপন তত্ত্ব বা Replacement Theory। এই প্রতিস্থাপন তত্ত্ব পুরো বিপরীত ধরনের একটি গল্প বলে আমাদের। এ গল্প অসহিষ্ণুতার, এ গল্প ঘৃণার এবং সম্ভবত গণহত্যারও।
    প্রতিস্থাপন তত্ত্ব অনুযায়ী সেপিয়েন্সের সাথে অন্য কোন প্রজাতির মানুষের, নিয়ান্ডার্থাল বা ইরেক্টাস কারো সাথে কোনো প্রকার যৌন সম্বন্ধ সংঘটিত হয়নি। সেপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডার্থালদের দেহের গঠন ভিন্ন ছিল এবং তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা যৌনমিলন প্রক্রিয়া ছিল। এমনকি তাদের শরীরের গন্ধও ভিন্ন ভিন্ন ছিল। অন্য কোন প্রজাতির সাথে যৌন মিলনে আবদ্ধ হওয়ার প্রতি তাদের খুব কমই আগ্রহ ছিল। যদি কোন নিয়ান্ডার্থাল রোমিও সেপিয়েন্স জুলিয়েটের প্রেমে পড়েও এবং তাদের যদি কোনো সন্তানও হয়- প্রতিস্থাপন তত্ত্ব অনুযায়ী এ শিশুটি হবে বন্ধ্যা (Infertile)। ঠিক যেভাবে গাধা এবং ঘোড়া মিলিত হতে পারে, কিন্তু তারা শুধু প্রজনন-অক্ষম খচ্চরেরই জন্ম দিতে পারে। একইভাবে নিয়ান্ডার্থাল রোমিও এবং সেপিয়েন্স জুলিয়েট কেবল প্রজনন-অক্ষম সঙ্কর প্রজাতিরই সৃষ্টি করতে পারে।
    সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিস্থাপন তত্ত্ব বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এর পক্ষে জোরালো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ মিলেছে আর এই তত্ত্ব রাজনৈতিক দিক থেকে অধিক উপযোগী (আর বিজ্ঞানীরাও আধুনিক মানুষের জিনের ভিন্নতা দেখিয়ে সাম্প্রদায়িক কলহ তৈরি করতে চাননি)। কিন্তু ২০১০ সালে তা আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। চার বছর চেষ্টার পর নিয়ান্ডার্থাল জিনোম (Genome) প্রকাশের ফলে তা আর চাপা থাকেনি। জিন-বিশেষজ্ঞরা ফসিল থেকে যথেষ্ট পরিমাণে নিয়ান্ডার্থাল মানুষের ডিএনএ সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়েছেন। এই ডিএনএর সাথে সমকালীন মানুষের ডিএনএ তুলনা করে যে ফলাফল পাওয়া গেলো তা চমকে দেওয়ার মতো।
    সমীক্ষায় দেখা গেলো, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের বর্তমান মানুষের ১ থেকে ৪ শতাংশ মৌলিক ডিএনএ হলো নিয়ান্ডারর্থাল ডিএনএ। মিলের পরিমাণটা খুব বেশি না হলেও একেবারে অগ্রাহ্য করার মতো নয়। কয়েক মাস পর আরও বড় একটি চমক আসে। ডেনিসোভা গুহায় প্রাপ্ত জীবাশ্মে রূপান্তরিত মানুষের আঙুলের ডিএনএ মানচিত্র তৈরী করা হয়। ফলাফলে দেখা গেলো, আধুনিক মেলানেসিয়ান এবং অষ্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ডিএনএর সাথে ডেনিসোভা মানবের ডিএনএ প্রায় ৬ শতাংশ মিলে যায়।
    তবে এখনই কোনো উপসংহার না টানাই উচিত, কারণ এ গবেষণা এখনও শেষ হয়নি, শেষ পর্যন্তু এই ফলাফল নাও টিকতে পারে। যদি এই ফলাফলগুলোই টিকে থাকে, তবে সঙ্কর প্রজনন তত্ত্বের সমর্থকদের দাবি আরেকটু জোরালো হবে। তাই বলে প্রতিস্থাপন তত্ত্বকে একেবারে ফেলে দেওয়া যাবে না। আজকের মানুষের জিনে নিয়ান্ডার্থাল ও ডেনিসোভা মানুষের জিনের পরিমাণ খুবই অল্প, তা থেকে বোঝা যায় সেপিয়েন্সদের সাথে অন্যান্য মানব প্রজাতিগুলোর ‘মিশে যাওয়ার’ সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সেপিয়েন্সদের সাথে মানুষের অন্যান্য প্রজাতির জিনের পার্থক্য এত বেশি ছিল না যাতে তাদের সন্তান জন্মদান ব্যাহত হয়, কিন্তু তারপরেও এমন ঘটনা ছিল বিরল।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৯ মে ২০২০ | ৩২৬২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ২০ মে ২০২০ ১৯:৩১93506
  • নতুন করে নিজেদের ইতিহাস আবারও জানলাম।  লেখায় "লকডাউন" ও রোমিও-জুলিয়েটের  ভিন্ন ব্যবহার ভাল লাগলো।  

    দু-একটি ছবি, ভিডিও ক্লিপ এবং তথ্যসূত্র উল্লেখ করলে সোনায় সোহাগা হতো। উড়ুক         

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন