এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • মুরাকামি কীভাবে উপন্যাস লিখতে শুরু করলেন ?

    souvik ghoshal লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ০৬ এপ্রিল ২০২০ | ৩৮৫৮ বার পঠিত
  • "দ্য বার্থ অব মাই কিচেন টেবিল ফিকশন" নামের লেখাটিতে নিজের জীবনের গল্প শোনাতে গিয়ে মুরাকামি লিখছেন -
    “জাপানের বেশিরভাগ লোকের জীবনধারনের একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আছে। তারা প্রথমে গ্রাজুয়েশন শেষ করে। তারপর কোনও একটা কাজ খুঁজে নেয়। চাকরিবাকরি করে। এভাবে বেশ কিছুদিন কাটানোর পর বিয়ে করে সংসার শুরু করে। থিতু হয়। আমিও এই প্যাটার্ন অনুসরণ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা একটু বদলে গেল।
    আমি একদিন দুম করে বিয়ে করে ফেললাম। তারপর চাকরি নিলাম। এবং তারপর গ্রাজুয়েশন শেষ করলাম। অর্থাৎ নিচ থেকে ওপরে না উঠে সিঁড়ির তিনধাপ ওপর থেকে নিচে নামলাম। চাকরিবাকরি আমার কোনওদিনই তেমন পছন্দের ছিল না। তাই অচিরেই চাকরিটা ছেড়ে দেবার ইচ্ছে জাগল মনে। কিন্তু ছেড়ে দিলে রোজগারপাতির কি দাঁড়াবে ? চলবে কি করে ? ভাবলাম স্বাধীনভাবে একটা ব্যবসা করব।
    কী ধরনের ব্যবসা করা যেতে পারে সেটা ভাবতে থাকলাম। আমার ইচ্ছে ছিল একটা কফিশপ চালু করার। এমন একটা কফিশপ যেখানে মানুষজন জ্যাজ মিউজিক শুনতে আসবে। মিউজিক শুনবে, সেইসঙ্গে কফি, স্ন্যাক্‌স, নানারকম ড্রিংকস খাবে। কফিশপ কাম বার টাইপের একটা ব্যাপার। ... ভেবেছিলাম আর কিছু না হোক এরকম একটা ব্যবসা হলে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পছন্দের মিউজিক অন্তত শুনতে পারব আমি।
    সমস্যা হল ব্যবসা করতে মূলধন লাগে। সেটা তো নেই। না আমার কাছে, না আমার স্ত্রীর কাছে কোনও জমানো টাকা পয়সা ছিল।
    মূলধন জোগাড়ের জন্য তিন তিনটে বছর আমরা গাধার মতোই প্রচণ্ড পরিশ্রম করলাম। একসঙ্গে একাধিক চাকরিও করলাম। এতে কিছুটা টাকা জমল। এরপর যাকে সামনে পেলাম তার থেকেই টাকা ধার করতে শুরু করলাম। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কেউই বাকি রইলো না। ব্যাংক থেকেও একটা ছোটখাটো লোন পেয়ে গেলাম। সব টাকা এক করে আমরা টোকিওর পশ্চিমদিকের শহরতলি কোকুবুনজিতে একটা ছোটো কফিশপ কম বার খুললাম।” 
    জাপানে তরুণদের মধ্যে তখন এই ধরনের স্বাধীন ব্যবসার দিকে বেশ ঝোঁক এসেছিল। মুরাকামি ঐ লেখাটিতেই এই প্রসঙ্গে বলছেন, "জায়গাটাকে আমরা একটা স্টুডেন্ট হ্যাঙ আউটের আদল দিতে চেয়েছিলাম। সেটা ১৯৭৪ সালের ঘটনা।
    এখন যেমন একটা ব্যবসা করতে অনেক টাকাপয়সার প্রয়োজন হয়, সে আমলে ততটা প্রয়োজন পড়ত না। আমাদের মতো তরুণ যারা চাকরি করবে না বলে ঠিক করেছে, তারা শহরের অলিতে গলিতে এই ধরনের ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করেছিল। ক্যাফে, রেস্টুরেন্ট থেকে বইয়ের দোকান, স্টেশনারি শপ - সব ধরনের ব্যবসার উদ্যোগই ছিল।" 
    মুরাকামির দ্বিতীয় উপন্যাস "পিনবল ১৯৭৩" যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন সেখানে জাপানের সে সময়ের ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে অনেক কথা আছে। 'বার্থ অব মাই কিচেন টেবিল ফিকশন' লেখাটিতে মুরাকামি সেই প্রসঙ্গে লিখছেন, "কোকুবুনজির আকাশে বাতাসে তখন একধরনের প্রতিবাদী প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক আবহ ছিল। কফিশপের আশেপাশে বেশকিছু কলেজ আর ইউনিভার্সিটি। ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়। কফি খেতে আসে, আড্ডা দেয়। আমরা যারা ঐ এলাকায় এ রকম স্বাধীন ব্যবসা শুরু করেছিলাম, তাদের অনেকেই ছিলাম কয়েক বছর ধরে চলতে থাকা ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় নেতা কর্মী।" 
    মুরাকামি তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে কফিশপ কাম বার চালিয়ে বেশ আনন্দেই দিন কাটাচ্ছিলেন।
    "বড় আনন্দ নিয়ে বেঁচে ছিলাম। বয়েসটা আমাদের পক্ষে ছিল। সবচেয়ে বড় কথা সারাদিন আমরা আমাদের পছন্দের গান শুনতে পারতাম। নিজের রাজ্যে আমি নিজেই ছিলাম রাজা। সকালে ঘুম থেকে উঠে ট্রেনের জন্য দৌড়ই না। দিনে তিন চারটে বিরক্তিকর মিটিং অ্যাটেন্ড করতে হয় না। বসের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়াতে হয় না। ভিড়ের বাসে মানুষের ঘামের গন্ধ শুঁকে রোজ যাতায়াত করতে হয় না। নিজের রেস্টুরেন্টে কাজ করি, মিউজিক শুনি আর মানুষ দেখি।" 
    তখনো লেখালিখি করার কোনও ভাবনাই তাঁর মাথায় আসে নি। সেটা এলো একদিন অকস্মাৎই। ১৯৭৮ সালের ১ এপ্রিল একটি বেসবল খেলা দেখতে দেখতে “শোনো বাতাসের সুর” উপন্যাসটির ভাবনা হঠাৎ করেই তাঁর মাথায় আসে।
    "দিনটার কথা স্পষ্ট মনে আছে আমার। ১৯৭৮ সালের এপ্রিল মাসের এক বিকেল। রৌদ্রজ্জ্বল একটা দিন। জিঙ্গু স্টেডিয়ামে বেসবল খেলা দেখতে গিয়েছিলাম। আমার জ্যাজ ক্লাব থেকে দশ মিনিটের হাঁটাপথ মাঠটা। সেন্ট্রাল লিগের খেলা ছিল সেদিন। মরসুমের প্রথম ম্যাচ। খেলবে ইয়াকুল্ট সোয়ালো আর হিরোসিমা কার্প নামে দুটো দল। 
    আমি তখন ইয়াকুল্ট সোয়েলোর প্রবল সমর্থক। যে সময়টার কথা বলছি তখন হিরোসিমা কার্প বড় দল হলেও সোয়ালো খুবই দুর্বল একটা দল ছিল দলের টাকাপয়সা তেমন ছিল না। তাই খুব নামী খেলোয়াড় নিতে পারত না৷ এ কারণে ততটা জনপ্রিয় ছিল না৷ তাদের খেলাগুলোতে মাঠ মোটামুটি ফাঁকাই থাকত। সে সময় বিকেলে হাঁটাহাঁটির বদলে আমি প্রায়ই মাঠে খেলা দেখতে চলে যেতাম। 
    তখন মাঠটায় দর্শকদের খেলা দেখার কোনও সিট ছিল না। একটা ঘাসে ঢাকা ঢাল ছিল। সেখানে বসেই আরাম করে লোকজন খেলা দেখত। বিয়ার খেতে খেতে খেলা দেখার সে ছিল এক চমৎকার ব্যবস্থা। 
    আকাশে সেদিন এক ফোঁটা মেঘ ছিল না। মৃদু হাওয়া বইছিল। হাতে ধরা বিয়ারটা ছিল বেশ ঠান্ডা। 
    সোয়ালোর হয়ে ওপেনিং ব্যাটার ছিল ডেভ হিলটন নামে এক আমেরিকান খেলোয়াড়। সে বছরই সে দলে যোগ দিয়েছিল। হিলটন ঠিক মাঝ ব্যটে একটা ভালো হিট করে। ব্যাটের ঠিক মাঝখানে বল লাগলে যেমন শব্দ হয়, সে রকম একটা শব্দ পুরো স্টেডিয়ামে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। 
    এবং সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়, আমি একটা উপন্যাস লিখতে পারব। সেই উড়ে আসা ভাবনাটাকে ক্যাচের মতো শক্ত হাতে আমি মুঠোবন্দী করি। মুহূর্তটাকে স্বর্গীয় কিছু বলে মনে হয় আমার। আমার জীবনটা মুহূর্তে বদলে যায়।
    খেলা শেষে আমি ট্রেনে করে শিঞ্জকু স্টেশনে যাই এবং সেখান থেকে কিছু লেখালিখির কাগজ আর একটা সেইলর ফাউন্টেন পেন কিনে ফেলি। সে যুগে এখনকার মতো ওয়ার্ড প্রসেসর বা কম্পিউটার ছিল না। যা কিছু লেখার সেগুলো কাগজ কলমে লিখতে হত।
    সে রাতেই লেখা শুরু করি। অনেক বছর পর সেই রাতে আমি ফাউন্টেন পেন হাতে নিই।"
    কফিশপের ব্যবসা সেরে বাড়ি ফিরে তিনি রোজ একঘন্টা করে লিখতে থাকেন এবং ছ মাস ধরে একটানা লিখে এই উপন্যাসটি শেষ করেন।
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ০৬ এপ্রিল ২০২০ | ৩৮৫৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন