আমরা তো ভুলি নাই শহীদ
সেদিন সন্ধ্যা হতে না হতেই তথ্য সাংবাদিকতার সূত্রে একের পর এক আসতে থাকে পার্বত্য জেলা রাঙামাটির দুর্গম বাঘাইছড়ির সহিংসতার তাজা সব খবর। জানা যায়, জায়গা-জমি দখলের উন্মোত্ততার শিকার হয়েছেন কয়েকটি গ্রামের পাহাড়ি মানুষ। অন্তত দু-জন পাহাড়িকে নিরাপত্তা বাহিনী ও সেটেলাররা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আরেকজন গুম খুন হয়েছেন। “নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর” ধ্বণীতে মহান সৃষ্টিকর্তার নামে নির্বিচারে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে একাধিক পাহাড়ি গ্রাম, বৌদ্ধ মন্দির, স্কুল, হাট-বাজার।…
স্থানীয় সাংবাদিকরা ছাড়াও বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাংখীরা একের পর এক টেলিফোন করতে থাকেন, টেক্সটের পর টেক্সট, ইমেইলের পর ইমেল, ফ্যাক্সেও আসে কিছু খবর। মুহুর্মুহু গুলি, ধারালো দায়ের কোপ, মশালে পুড়িয়ে দেওয়া সারি সারি আদিবাসী গ্রাম, আর ভয়ার্ত মানুষের আর্তনাদ একের পর এক সিনেমার স্লাইডের মতো মূর্ত হতে থাকে এতোশত মাইল দূরে পাষানপুরীর হিমশীতল নিউজ রুমে। এ যেন স্বাধীন দেশেই আরেক ১৯৭১ সাল! পাকিস্তান সেনা বাহিনী যে নির্মম অপরারেশন সার্চ লাইট চালিয়েছিল এদেশে, এখন জয় বাংলার নিরাপত্তা বাহিনী যেন একাই পদাংক অনুসরণ করে চলেছে!…
পাহাড়ে এখনো পাকিপনা
২০১০ সালের ১৯-২০ ফেব্রুয়ারি বাঘাইছড়ির ওই বর্ববরতার দিন দশেক পরে ঘটনার সরেজমিন তদন্তে পৌঁছানো গেল বাঘাইহাট বাজারে। মার্চ পহেলা খর দুপুরে বাজারের রাস্তার দু-পাশে সার সার পোড়া ঘর-বাড়ির কংকাল, মাটির ঘরের ধ্বংসস্তুপ। বাজারের পোড়া দোকান-পাটের টিনগুলো আগুনের উত্তাপে বেঁকেচুড়ে ছিন্নভিন্ন বাতিল খবরের কাগজের মতো এখানে-সেখানে পড়ে আছে।
ওই আগুনে পোড়া বাজারের সড়কেই দেখা মেলে কিছু আশ্রয়হীন, বিপন্ন পাহাড়ি নারী-পুরুষের, তাদের অধিকাংশই জাতিগতভাবে চাকমা জুম চাষী (পাহাড়ের ঢালে বিশেষ ধরণের চাষাবাদ), অল্প কিছু মারমা জাতিগোষ্ঠীও আছেন। ভাঙা চাকমা ভাষা ভরসা করে টুকরো আলাপে জানা যায়, তারা সেখানে এসেছেন সামান্য ত্রাণের আশায়।
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, গ্রিন হিল ছাড়াও আরো কিছু বেসরকরি সংগঠন চাঁদা তুলে বাঘাইছড়ির অসহায় মানুষের জন্য সামান্য কিছু চাল, আলু, শুটকি মাছ ইত্যাদি খাদ্য সাহায্য দিচ্ছে। স্থানীয় যাত্রী ছাউনিটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে অস্থায়ী ত্রাণ কেন্দ্র হিসেবে। তালিকা ধরে মাইকে নাম ঘোষণা হতেই একেকজন নারী-পুরুষ সুশৃঙ্খলভাবে ত্রাণ নিচ্ছেন। সবার চোখে-মুখে কেমন যেন চাপা আতংক, অজানা ভীতি খেলা করে। এতো মানুষের চলাচল, কিন্তু কোথাও কোনো কলরব নেই, সবাই কথা বলছেন ফিসফিসিয়ে, মুখে গামছা না হয় খাদি (তাঁতে বোনা চাকমা ওড়না) চাপা দিয়ে।
বাজার থেকে একটু দূরে সড়কের একপাশে দেখা যায়, দুজন নিহত পাহাড়ির স্মরণে নির্মিত অস্থায়ী স্মৃতির মিনার। সেখানে তীব্র রোদ ও ভ্যাপসা গরম উপেক্ষা করে ঘুর ঘুরে করছে ছোট চাকমা ছেলেমেয়ের একটি দল। বাড়ির বড়রা যখন ত্রাণ নিতে ব্যস্ত, তখন এই সব শিশুর দল পোড়া ও প্রায় পরিত্যাক্ত বাজারে এদিক-সেদিক আপন মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুর্বল চাকমা ভাষা সম্বলে সহজেই কথোপকথন হয় শিশুদের সঙ্গে।
আমার সোনার বাংলা
আলাপচারিতায় জানা গেল, নিরাপত্তা বাহিনী আর বাঙালি সেটেলারদের সহিংস আক্রমণের বিভীষিকাময় ছাপ পড়েছে কচি শিশুদের মনেও। গোলাছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রছাত্রী এসব ছেলেমেয়ের এরই মধ্যে হয়েছে সশস্ত্র আক্রমণের নির্মম অভিজ্ঞতা। কম-বেশি এক সপ্তাহ জঙ্গলবাসও করেছে তারা। আগুনের কবল থেকে স্কুল ঘরটি রক্ষা পেলেও সবার বসতবাড়ি পুড়ে গেছে। আগুনে পুড়েছে জামা-কাপড়, বই-পত্র, বিছানা, হাড়িকুড়ি, আসবাব- সবই। এখনো থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। রাতে পরিবারের বড়রা নানা আশঙ্কার কথা বলাবলি করেন। তাই শুনে তারাও ভীত-সন্ত্রস্ত। কেউ জানে না, কবে পরিস্থিতি শান্ত হবে, কবে আবার তারা স্কুলে যেতে পারবে।…
সুনীল কুমার চাকমা নামের এক শিশু ২০ ফেব্রুয়ারির (২০১০) ঘটনার বর্ণনা দিয়ে এই প্রতিবেদককে বলে, “গুলি শুরু হতেই মা আমাকে নিয়ে হাত ধরে জঙ্গলের দিকে পালাতে থাকেন। দূরে বাঙালি সেটেলারদের দা হাতে আমি আমাদের গ্রামটির দিকে দৌড়ে আসতে দেখি। ভয়ে আমি তখন চিৎকার করে কাঁদছিলাম।“…
পরান থু চাকমা বলে, “জঙ্গলের ভেতরে অনেক পাহাড়িসহ আমরা এক নাগাড়ে কয়েকদিন লুকিয়ে ছিলাম। সেখানে একদিন-একরাত আমরা ভাত-পানি কিছুই খাইনি। পরদিন মা জঙ্গল থেকে বুনো আলু খুঁজে এনে খাইয়েছেন।“…
অনিশ্চয়তার ভেতরে অভুক্ত অবস্থায় জঙ্গলে লুকিয়ে থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছে একই শ্রেণীর ছাত্রী কমলা রানি চাকমারও। সে বলে, “জঙ্গলের ভেতর খিদের জ্বালায় আমরা ছোটরা অনেকে কান্নাকাটি করছিলাম। বড়রা সবাই লাঠি নিয়ে আমাদের পাহারা দিচ্ছিলেন। তারা বারবার আমাদের কান্না করতে নিষেধ করছিলেন। তারা বলছিলেন, কান্নার শব্দে হয়তো সেটেলার বাঙালিরা জঙ্গলের ভেতরে আমাদের অবস্থান জেনে ফেলবে; তখন তারা সেখানেই দা দিয়ে কুপিয়ে খুন করবে আমাদের।“…
কনক বিকাশ চাকমা বলে, “আমাদের ঘরবাড়ি, বই-পত্র, জামা-কাপাড় সব আগুনে পুড়ে গেছে। এক জামা-কাপড় পরে থাকতে ভালো লাগে না। আবার স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে। আগের মতো খেলাধুলা করতে ইচ্ছে করে।“...
আরো তথ্য সংগ্রহ, আরো আলোকচিত্র গ্রহণ করে একের পর এক সরেজমিন সচিত্র সংবাদ প্রকাশ করা হয় সে সময়ের কর্মস্থল দৈনিক কালের কণ্ঠে। করা হয় কয়েকটি পার্শ্ব প্রতিবেদন। পাহাড়িদের কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিন ও ব্লগের জন্যও লেখা হয় নোট। উইকিমিডিয়ায় দান করা হয় কয়েকটি ছবি।
শত ব্যস্ততা, নিত্যকর্ম, কর্পোরেট কার্টিসির ব্যুহ ভেদ করে বার বার মনের গহিনে গোপনে হানা দেয় পাহাড়ের গণহত্যা, গণধর্ষন, ত্রিপুরার শরণার্থী শিবির, কল্পনা চাকমা অপহরণ, মেশিন গানের গুলির ভেতর পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের মিছিল-- আরো অসংখ্য রক্তাক্ত অতীত স্মৃতি… কেউ জানে না সে এক গোপন হরর থ্রিলার যাত্রা, ব্যাং ব্যাং ক্লাবের একই কেভিন-যন্ত্রণা! আর ঘুমের ঘোরে এখনো ফিরে ফিরে আসে বাঘাইছড়ির সেই আশ্চর্য দেবশিশুর দল।...
__
ছবি © : নিহতদের স্মরণে স্মৃতির মিনার এবং আশ্রয়হীন শিশুর দল, বাঘাইছড়ি, মার্চ ২০১০, লেখক
কী ভয়াবহ কঠিন বাস্তব ! অথচ এইরকম তো হবার কথা ছিল না !
প্রতিভা দি, বোধিস্বত্ত্ব,
এই আমার দেশ। সংগে থাকার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
ar,
"এক স্বাধীন রাষ্ট্রের শৈশবকাল থেকেই প্রান্তিক (পার্বত্য চট্টগ্রাম) মানুষের প্রতি (রাষ্ট্রের) নিদারুণ অবহেলা ধীরে ধীরে ৪০-৫০ বছর ধরে ক্রমেই অত্যাচারের মহীরুহতে পরিণত হল।"
প্রথমেই আগ্রহের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনার ওই বক্তব্যের ভেতরেই আছে পার্বত্য চট্টগ্রামের করুণ ইতিহাস। খুব সংক্ষেপে-
পাহাড়িদের বঞ্চনার শুরু পাকিস্তান আমলেই। ৬০ দশকে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র করে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় এক লাখ পাহাড়ি আদিবাসীকে উদ্বাস্তু করা হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের সংবিধানে উপেক্ষিত হয় আদিবাসীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি। আট ও নয়ের দশকে জিয়া-এরশাদ- খালেদা সরকার পাহাড়িদের গেরিলা গ্রুপ শান্তি বাহিনী দমনের নামে পাহাড়ে ব্যাপক সামরিকায়ন ও বাংগালি সেটেলার অনুপ্রবেশ ঘটায়। নিরাপত্তা বাহিনী ও সেটেলারদের যৌথ হামলায় পাহাড়ি জনপদে অন্তত ১৩টি গণহত্যা হয়। ৭০ হাজার পাহাড়ি শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেন ত্রিপুরায়।
আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় এলে ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তিতে শান্তি বাহিনী অস্ত্র জমা দেয়, শরণার্থীরা দেশে ফেরে, আড়াই দশকের গৃহযুদ্ধের অবসান হয়।
কিন্তু এরপর গত আড়াই দশকে শান্তি চুক্তির মৌলিক শর্ত (যেমন, ভূমির ওপর পাহাড়িদের অধিকার প্রতিষ্ঠা) তেমন কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। উপরন্তু পাহাড়ে জমির বিরোধ আরো বেড়েছে। আর সেটেলার বাংগালী ও নেপথ্য উস্কানিদাতা নিরাপত্তা বাহিনীর একই জাতিগত বিদ্বেষ রয়েই গেছে। এরই জেরে রামগড়, বাঘাইছড়ি, মাটিরংগা, লংগদু জনপদে একের পর এক সহিংসতার ঘটনা ঘটছে।
এই লেখায় এরই একটি খণ্ড চিত্র দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আরও দেখুন :
ar,
স্বাধীনতার পরে বাংগালী জাতীয়তাবাদের জোয়ারে হয়তো আদিবাসীদের স্বাধিকারের দাবি ভেসে গিয়েছিল।
একদা পাহাড়ের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নথিপত্রসহ মুক্তমনা ব্লগে ধারাবাহিক লিখেছিলাম, পুরো লেখাটি আমার বইয়ে আছে, এর প্রথম পর্ব এখানে :
,ar,
কাল মোবাইলে চার্জ ফুরিয়ে গিয়েছিল, দ্রুততায় বলা হয়নি। সংগে থাকার আবারও আপনাকে ধন্যবাদ। শুভ