ব্যাপারটা একেবারেই জটিল নয়।
ব্যাংক যখন কোনও শিল্পে ঋণ দেয়, তখন সেই সংস্থার সম্পদের একটা ছোটো অংশকে জামানত হিসেবে চিহ্নিত করে। সেটা অতিরিক্ত সুরক্ষা। মূল জামানত থাকে ঋণের টাকায় যে সম্পদ সৃষ্টি করা হয়, সেটি। যেমন ওয়র্কিং ক্যাপিটাল দিলে জামানত কাঁচা মাল ও তৈরি বস্তুর উপর থাকে। টার্ম লোন দিলে যন্ত্রপাতির উপর। কোন ঋণে কতো জামানত হওয়া উচিত বা তার অন্যান্য জরুরি শর্তাবলী বিষয়ে নির্দেশগুলি রিজার্ভ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রক থেকে স্থির করা হয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলির সিদ্ধান্ত, যাকে 'ব্যাংকার্স ডিসক্রিশন' বলা হয়, তার সীমারেখাগুলি খুবই ছোটো। রিজার্ভ ব্যাংক, সেবি, কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক দিশানির্দেশ (যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ প্রণোদিত) ইত্যাদি দিয়ে ঘেরা একটা ছোটো ক্ষেত্রের মধ্যে থেকে ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।
যখন কর্পোরেট ঋণের প্রস্তাবগুলি পরীক্ষা করা হয়, তখন ব্যাংকার ঋণীর সবরকমের উপার্জন ও সম্পদের উৎসগুলিকে একসঙ্গে বিচার করে। কারণ সেটাই বিধি। সরকারিভাবে ঋণী হয়তো ঐ সম্পদের একটা ছোটো অংশকে ঋণের জামানত হিসেবে রাখবেন। যদিও দেশের আইন অনুযায়ী ঋণ খেলাপের ক্ষেত্রে ঋণীর সব সম্পত্তিকেই বাজেয়াপ্ত করার আইন রয়েছে। কিন্তু প্রভাবশালী গোষ্ঠীরা সেটা মানেন না । নানা রকম আইনের ফাঁক দেখিয়ে জাল কেটে বেরিয়ে যেতে চাইবেন। উদাহরণ, কিংফিশার।
ঋণ অনাদায়ী হয়, যখন ঋণীরা ঋণ থেকে পাওয়া পুঁজিটি নিয়ে ফাটকা খেলেন বা তা অন্য ব্যবসায়ে লাগিয়ে দেন। আমাদের দেশের পশ্চিম প্রান্তে একটি রাজ্য রয়েছে। যেখান থেকে আসা বণিকরা সরকার নির্বিশেষে এদেশের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন। অতীতে সব বৃহৎ অর্থনৈতিক কেলেংকারিই তাঁদের মগজের জোরে হয়েছিলো। এই তালিকাতেও তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফাটকাবাজি তাঁদের রক্তে রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলিকে তাঁরা এককথায় কিনে রাখেন। প্রতি নির্বাচনের সময় যেসব লক্ষকোটি টাকা বেআইনি হাতবদল হয়, তার রাশটি তাঁদের হাতেই থাকে। যে দলই সরকারে আসুন না কেন, এই সব বণিক তাঁদের থেকে শাইলকের ভাগের মাংস উঁচু সুদসহ উসুল করে নেন। ব্যাংকের অনাদায়ী ঋণও সেই ভাগের মাংস।
কর্পোরেট ঋণ যে মুহূর্ত থেকে অনাদায়ী হতে শুরু করে দেশের আইন অনুযায়ী ব্যাংকগুলি ব্যবস্থা নেবার চেষ্টা করে। রিজার্ভ ব্যাংক ও অন্যান্য সরকারি নীতিনির্দেশক সংস্থাকে জানায়। কারণ ব্যাংকের আইনগত সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা খুব সীমাবদ্ধ। আদালত বা ট্রাইব্যুনালে গিয়ে নিষ্ফল আর্জি জানানো ছাড়া বিশেষ কিছু করার নেই। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই সব গোষ্ঠীর মালিক রাজনৈতিক ভাবে এতোই ক্ষমতাশালী হয় যে ব্যাংকের অনুরোধ-উপরোধের কেয়ারই করে না। তাদের দাঁড়াবার জায়গা, 'ক্যা কর লেগা? উঠাকে ফেক দেঙ্গে' জাতীয় আকাশছোঁয়া 'আত্মবিশ্বাস'। ঘটনা প্রমাণ করে, তাদের আত্মবিশ্বাস অমূলক নয়।
আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইন অনুযায়ী একটা সময়ের পর অনাদায়ী ঋণগুলিকে ব্যাংকের সচল খাতা থেকে বার করে দিতে হয়। এই ঋণগুলির জন্য ব্যাংককে তাদের লভ্যাংশের একটা বড়ো অংশ আলাদা করে রাখা প্রয়োজন। যাকে প্রভিজন বলে। যেটা দেশের লোকের টাকা। ঘটনা হলো, প্রভিজন করার পর অনন্তকাল ধরে মামলা চলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আইনের ফাঁকে ডাকাতদের কিছুই হয়না। উল্টে নির্দেশ আসে ঐ সব কোম্পানিকে রিফাইনান্স করা হোক নয়তো ব্যাংকের পুরো টাকাই ডুবে যাবে। অনেক সময় চাপের মুখে ব্যাংকগুলিকে তাও করতে হয়। জেনেশুনে আবার বিপুল ক্ষতি। সামান্য ক্ষেত্রে দুর্ভাগা কোম্পানিগুলি (যাদের প্রভাব কম) অনাদায়ী ঋণের খুব ছোটো একটা ফেরত দেয়। যেমন হাজার কোটি টাকা ঋণে আশি কোটি বা এই জাতীয়। ব্যাংকও সোনামুখ করে সেটা নিয়ে নেয়। বাকিটা মায়ের ভোগে।
বেশ কিছুদিন হলো রিজার্ভ ব্যাংকের আত্মনিয়ন্ত্রণ ষড়যন্ত্র করে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তাঁদের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলি এখন সম্পূর্ণত রাজনৈতিক স্বার্থপ্রণোদিত। উর্জিত প্যাটেলের মতো 'অতি প্রভাবশালী' লোককেও রীতিমতো পলায়ন করতে হয়। রাষ্ট্রীয়কৃত ব্যাংকগুলি প্রথম থেকেই সরকার নিয়ন্ত্রিত। আগে ছিলোনা, কিন্তু কিছুদিন হলো এসবিআইয়ের ক্ষেত্রেও এই নিয়ন্ত্রণ জারি করা হয়েছে। অর্থাৎ এদেশের সম্পূর্ণ ব্যাংকিং ব্যবস্থার মালিক কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক। যাবতীয় ব্যাংকিং বিষয়ক সিদ্ধান্ত তাঁরাই নিয়ে থাকেন। অনাদায়ী ঋণের ক্ষেত্রে কী করতে হবে সে বিষয়টিও তার বাইরে নয়। কিছু মূর্খ বা অতিচালাক লোকজন যথারীতি প্রচার করার চেষ্টা করেন সরকারের এতে কোনও দায়িত্ব নেই। ঘটনা হলো এই বিপুল অনাদায়ী ঋণের পুরোটাই দেশের লোকের লক্ষ্মীর ভাঁড় ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ফেরতের কোনও আশা নেই। বড়ো জোর নিয়মরক্ষার জন্য অতি ছোটো একটা ভগ্নাংশ শেয়ালের কুমির বাচ্চার বারবার মতো দেখানো হবে। নিতান্ত অর্থহীন গা বাঁচানো ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ সর্ষের মধ্যেই ভূত।
সেই কবেই ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট আক্ষেপ করে গিয়েছিলেন, “The trouble with this country is that you can’t win an election without the oil bloc, and you can’t govern with it.”
ভালো লাগল লেখা
তবু আমরা মোসাহেবি করতে ঘর অন্ধকার করে মোমবাতি জ্বালাবো।
কঠিন কথা সহজ করে বলা। খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিতে আমার দু'পহাঃ
শ্রী সাকেত গোখলের দ্বিতীয় দফা আর টি আই আবেদনের উত্তরে রিজার্ভ ব্যাংকের দেওয়া পঞ্চাশ জন উইলফুল ডিফল্টারের সূচী-- যাদের সম্মিলিত আউট -স্ট্যান্ডিং ৬০০০০ কোটি রাইট অফ করে দেওয়া হয়েছে-- আপনারা সবাই দেখেছেন। প্রথম সংস্থাটির (গীতাঞ্জলি) মালিক হলেন শ্রীমেহুল চোকসে এবং এই সূচীতে তাঁর আরও তিনটি সংস্থা রয়েছে। উনি একসময় ভাইব্র্যান্ট গুজরাতের রত্ন ছিলেন ।
কিন্তু আমি বলছি চার নম্বর নামটি দেখুন--রুচি সোয়া। এই সংস্থাটি বাবা রামদেব সরকারি অনুমোদনক্রমে গত বছরের শেষে কিনে নিয়েছেন। গত সপ্তাহে রুচি সোয়ার শেয়ার ভ্যালু বেড়েছে। রামদেব কিনেছেন প্রায় ৪২০০ কোটি দিয়ে । বলেছেন ৪০০০ কোটি দিয়ে পাওনাদারদের শোধ দেওয়া হবে। ভাল কথা । কিন্তু সরকারের মানে জনগণের যে টাকা দিয়ে সুচি সোয়ার বকেয়া ঋণ রাইট অফ করা হল-- সেটা বাবা ফেরত দেবেন না? এ কেমন কথা ?
দুই, রাইট অফ করার মানে কার্পেটের নিচে ময়লা ঢুকিয়ে দেওয়া। যখন কোন এন পি এ ঋণের ফেরত পাওয়ার কোন আশা থাকে না-- প্রাইমারি/কোল্যাটারাল সব সিকিউরিট ডুবে গেছে বা ব্যাংকের নাগালের বাইরে , ঋণী ও জমানতদার হয় মৃত , নয় তাদের টিকিটি ধরা যাবে না-- তখন ব্যাংক, শিবাংশু যেমন বলেছেন, লাভের একটা অংশ (প্রোভিজন) দিয়ে এডজাস্ট করে সেই একাউন্টটি ব্যালান্স শীটের বাইরে করে দেয় ।
ব্যস, ব্যালান্স শীটে যখন নেই, তা নিয়ে অডিটর মাথা ঘামাবে না । না চাহিলে দেখিতে পাইবে না । ম্যানেজমেন্টও দেয়ালে মাথা না খুঁড়ে অন্য এন পি এ রিকভারি করোতে তাদের মানব সম্পদ এবং এনার্জি ব্যয় করবে। এইসব ময়লা বের করে দেওয়ায় ব্যাংকের ব্যালান্সশীটও ভদ্র দেখাবে।
টেকনিক্যালি রাইট অফ একাউন্ট থেকে রিকভারি করার ব্যাংকের লিগাল রাইট উপে যায় না । কিন্তু রিকভারির বাস্তব ভিত্তি গায়েব বলেই তো রাইট অফ করা হল।
আর শিবাংশু যেমন বলেছেন রিজার্ভ ব্যাংকের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ এমন আঁটো হয়ে বসেছে যে ওর সুরক্ষা কবচ থেকে ১ ট্রিলিয়নের মতন টাকা সরকার তুলে নিল। বিরল আচার্যের মতন ডেপুটি গভর্নর বিরোধিতা করেছিলেন বটে!
অর্থনীতির একটা অংশ বিনিময়প্রথানির্ভর থাকা জরুরি। ওই একটা জায়গায় কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা সহজে হাত বসাতে পারে না।
অর্থনীতির একটা অংশ বিনিময়প্রথানির্ভর থাকা জরুরি। ওই একটা জায়গায় কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা সহজে হাত বসাতে পারে না।
সংসদ ভবনটা কবে বিক্রি হবে দেখা যাক
ধরা যাক অনিল বাবু পাঁচটা ব্যাংক থেকে পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা লোন নিয়ে, শোধ দিচ্ছে না।এখন প্রথম ব্যাংক এক্স তাকে বললো,আপনি সব শেয়ার বেচে আমার লোন পরিশোধ করুন।বাস্তবে দেখা গেলো অনিলবাবুর সব শেয়ার বেচেও এক্স ব্যাংকের লোন পরিশোধ করা যাবে না।
তখন কি অন্য ব্যাংক গুলো আঙ্গুল চুষবে?
শিবাংশু বাবু,আমার বক্তব্য ছিল অন্যরকম।এন পি এর জেরে ব্যাংকের কর্মী সঙ্কোচন হবে।নতুন রিক্রুট কমে যাবে।শাখার সংখ্যা কমে যাবে।মার্জার হবে।
আমরা চোখের সামনে দেখতে পারছি। 2000 -2009 এর মধ্যে ক্যাপিটাল গেইন ও এনপি এর অনুপাত এক এর অধিক ছিল।2010 সাল থেকে সেটি উল্টো দিকে যাচ্ছে।সুতরাং ব্যাংকের ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে,নিজস্ব সম্পদ বিক্রি করতে হচ্ছে আর সরকারের কাছে হাত পাততে হচ্ছে।
সরকার ও ক্রমশ ক্যাপিটাল স্টিমুলাস কমিয়ে দিচ্ছে বা আরো দেবে।
আলটিমেটলি কোপ পড়ছে সাধারণ ব্যাংক কর্মীর ওপর।যাদের সঙ্গে এই এনপিয়ের কোন যোগ ই নেই।
এর সল্যুশন কি?
সত্যি কথা। করপোরেট লোনের এলিজিবিলিটি নির্ধারণ প্রত্যক্ষ ভাবে সিকিউরিটি বেসড নয়।
দেখতে হবে টার্ম লোন কি ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোন। দেখতে হবে গ্রোথ এর প্রোজেকশন, প্রোডাকশন সাইকল, টার্ণ ওভার, ডেট -সার্ভিস ক্যাপাসিটি, ডেট ইক্যুইটি রেশিও আরও অনেক কিছু। বেশি টেকনিক্যাল, এখানে সে আলোচনা অবান্তর।
একই প্রপার্টি দেখিয়ে একাধিক লোন, বা অ্যাসেটের ভ্যালু বাড়িয়ে লোন নেওয়া, মাঝে ব্যাংককে না জানিয়ে মালিকানা বদলে যাওয়া এসব ৩৫ বছর আগে ঘটেছে। এখন এই ডিজিটাল ইনফরমেশন এবং কোর ব্যাংকিং এর জগতে --শিবাংশু যেমন বললেন-- অসম্ভব।
তবে রুচি সোয়ার কেস দেখুন। রামবাবা কিনে নিলেন অথচ রাইট অফ হয়ে রইল ।