রাস্তার দুপাশে স্যালভিয়া ফুল। কী গভীর লাল! নিখাদ ভালোবাসার মতো লাল। আলাস্কা হোয়াইট ক্রেসেনথিমাম, পুটুস। মাঝে মাঝে আখাম্বা গতর বাগিয়ে ডালিয়া আর সূর্যমুখীর দল। আর হলুদ গাঁদা। এখানে কমলা গাঁদা হয়না বড়ো একটা। `হলুদ গাঁদার ফুল, রাঙা পলাশ ফুল, এনে দে এনে দে, নৈলে বাঁধব না, বাঁধব না চুল।' - ভোলানাথের মনে পড়ে ছোটবেলায় মা রেডিও চালাতো, বিবিধ ভারতী। তা পলাশ ও আছে বইকি রাস্তার দু ধারে - গনগনে করছে আগুনের মতো। বসন্তের দুপুরে, সোনাগাছির বাতিল বেশ্যার দীর্ঘশ্বাসের মতো করুণ হাওয়া ওঠে একটা মাঝে মাঝে, পলাশের শুকনো পাতা ঝরে পড়ে রাস্তার দুধারে, রাস্তাটাকে তখন দেখায় যেন বৃদ্ধাশ্রম।
কুসমি রং শাড়ি আর বেলোয়ারী চুড়ি পরা দেহাতি সুন্দরীর দলকে এখন আর দেখা যায় না পাঁচিল ঘেরা, প্রায় একটা গোটা গ্রামের মতো ব্যাপ্ত এই অত্যাধুনিক আবাসনে। করোনা তাদের কাজ কেড়েছে, ভেতরে ঢোকা বারণ। তারা দলে দলে আসতো কাছে দূরের গ্রাম গুলো থেকে, দু তিন কিলোমিটার ঠেঙিয়ে। নিপুণ হাতে হোসপাইপ দিয়ে ধুয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করতো সব ফুলগাছ। একবিন্দু ধুলো যেন লেগে না থাকে গাছের একটা পাতাতেও। ঝকঝক ঝকঝক করতো সবুজ পাতা লালফুল। বিদেশি অতিথিরা প্রাতঃভ্রমণের সময় সামনে দাঁড়িয়ে বলতেন - বাঃ! আবাসনের বাসিন্দাদের গর্বে বুক ফুলে উঠতো তা শুনে।
বেলোয়ারী চুড়িওয়ালীদের গর্ব হতো কী? ভোলানাথ ঠিক জানে না সেটা। দেহাতী সুন্দরীরা দুপুরে উবু হয়ে বসে কাজ করতো মখমলের মতো ঘাসওয়ালা মাঠে। ভারতবর্ষের এইসব অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে পয়ঁতাল্লিশ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা সারা মে মাস ধরেই থাকে, কোনো কোনো দিন এমনকি সাতচল্লিশ-আটচল্লিশ। দুপুরের দিকটাতেই তাপমাত্রা সর্বাধিক, ওই বেলা তিনটে নাগাদ - এটাই বিজ্ঞানের নিয়ম। সুন্দরীরা গামছা জড়িয়ে নিতো মাথায় মুখে, যার গামছাও জোটে না সে শাড়ির আঁচল - নাভি বেরিয়ে গেলো নাকি নিতম্বের বিভাজিকা, তা দেখার অবকাশ কোথায়? প্রতিপদের চাঁদের মতো পাতলা কিন্তু অনায়াসে মানুষের মাথা নামিয়ে দেওয়া যায় এমন ধারালো কাস্তে গুলো অক্লান্ত চলতো - সমবেত আওয়াজ ওঠে ঘস ঘস ঘস - ক্যাম্পাস বিউটিফিকেশন গুনগুন করে গান গেয়ে ওঠে যেন।
শুনশান রাস্তা, মানুষের চিন্হমাত্র নেই। সকাল দশটার পরে আবাসনের মানুষরা বেরোতে সাহস করেন না বিশেষ, হুশ করে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়িতে করে বিদ্যুৎগতিতে চলে যাওয়া ছাড়া। থিরথির করে আয়নার মতো দাবদাহের ঝলক কাঁপতে থাকে রাস্তার ওপর, দুদিকের গাছের কোটরে থাকা টিয়াপাখিগুলো পর্যন্ত ঝিমোতে থাকে ভিতরে, কখনো সখনো অসহ্য কর্কশ গলায় ময়ূর ডেকে ওঠে, আবাসনে ঘুরে বেড়ায় ওরা, এই সময়টা যদিও গাছের ছায়ায় বসে ঝিমোয়।
কুসমি রং শাড়িদের জন্য গাছের ছায়া নেই। ঘুরে ঘুরে, ঘাসের ওপরে পেছন থেবড়ে থেবড়ে, এগিয়ে পিছিয়ে, তারা আবাসন সাজিয়ে তুলতে থাকে। এ সব অঞ্চলে ঘাম হয়না বিশেষ, সুন্দরীদের ব্লাউজের বাহুমূল ভেজা নয় তাই, যেন সবকিছুই খুব স্বাভাবিক। কিন্তু ভোলানাথের নাকের ফুটো দিয়ে, কানের গর্ত দিয়ে ক্যাকাসের এর নিঃশ্বাসের মতো হলকা নিয়ে ঢুকে যেতে থাকে মাঝ দুপুরের লু, হাতের মুখের গালের চামড়া চড়চড় করে ওঠে। পারছে কি করে ওরা? বাপরে! শিউরে ওঠে ভোলানাথ। `এই শোনো শোনো' - থাকতে না পেরে একজনকে ডেকেই ফেলেছিলো ভোলানাথ, অবাক হয়ে সেই মহিলা মুখ ফেরান - `বলছি কী, ওই যে হোস পাইপ টা দিয়ে পাতা ধুচ্ছো , ওটা দিয়েই তো নিজেদের একটু ভিজিয়ে নিতে পারো, নাকি?'
`কানুন নহি বা ..' - মহিলা বাপের জন্মে এরকম প্রস্তাব শোনেন নি আবাসনের কারো কাছে, ঘাবড়েই যান বোধহয়।
`আরে নিয়ম কানুনের কী ব্যাপার আসে এর মধ্যে .. কি আশ্চর্য !'
`আয়োতানি! তু ন সমঝিস ...'
`তা'লে মরো শালা রোদে পুড়ে ...' ক্ষেপে যায় ভোলানাথ।
অপরপক্ষ বিড়বিড় করে যা বলতে থাকে তার মানে হলো রোদে পুড়ে মরা তো সৌভাগ্য তাদের, অন্তত ভরা পেটে মরতে পারবে। খালি পেটে, মাতাল বরের চ্যালাকাঠের বাড়ি খেয়ে, বা উচ্চবর্ণের গাওঁপ্রধানের নতুন পাখনা ওঠা ছেলের থেকে ধর্ষিতা হয়ে যোনির ঘা সেপসিস হয়ে, কিংবা চার পাঁচ কিলোমিটার দূরের প্রাথমিক স্বাস্থকেন্দ্র অবধি হেঁটে যাওয়ার ক্ষমতা না থাকায় ডায়ারিয়া ধরা অবস্থায় বমি করে হেগে মুতে মরার থেকে রোদে পুড়ে মরা ঠিক কতটা বেশি ক্ষতিকর, সেটা মহিলা বুঝে উঠতে পারেন না। `বাবুঠো পাগল বা ...' বিড়বিড় করতে থাকেন উনি।
অবশ্য তাদের মাতাল বরেরাও অমনি করেই মরে, হয়তো বা মৃত্যুর কারণ সামান্য এদিক ওদিক। কুকুর বেড়ালের মৃত্যুর আর কী ই বা লিঙ্গবিভাজন।
আবাসনে প্রথম যখন ঘর নেয় ভোলানাথ, এক দেহাতি মহিলা পাংশু মুখে তার দরজার কড়া নাড়ে এক দুপুরে, সাথে বছর বারো তেরোর একটি বাচ্চা মেয়ে। সনির্বন্ধ অনুরোধ জানায় বাচ্ছাটা'কে যদি ভোলানাথ বাসন মাজার কাজ দেয় তাহলে বড়ো ভালো হয়, বরের সিরোসিস অফ লিভার তাড়ি গিলে গিলে, তায় আবার কোথায় মারপিট করতে গিয়ে মাথা ফাটিয়ে এসে হাসপাতালবন্দী, কতদিনে বেরোতে পারবে জানা নেই, এবং এটা তো সবাই জানে, যে, আধা-মফস্বলী, সরকারি, জেলা হাসপাতালের মেঝেয় পড়ে থাকা রোগীরা যদি বাড়ি ফেরে, তবে তা একান্তই নিজগুনে। মহিলা সকাল থেকে সন্ধ্যে লোকের বাড়ি বাসন মাজে, নতুন কোনো কাজ নেওয়ার মতো ফাঁকা অংশই নেই দিনের, তাই মেয়েকে বাসন মাজানোর কাজে যদি লাগিয়ে দেয় ভোলানাথ মেহেরবানী করে, সংসারটা বাঁচে।
ভোলানাথ রেখেছিলো বাচ্চাটাকে। যদিও আবাসনের অনেকের কাছেই সে নিন্দার পাত্র হয়েছিল সে জন্য। শিক্ষিত মানুষ হয়ে কি করে শিশুশ্রমিক রাখাকে মান্যতা দিচ্ছে ভোলানাথ, এই বেআইনি, ঘৃণ্য, অমানবিক কাজ কি করে করছে - সে নিয়ে আবাসনে উত্তপ্ত বিতর্ক দানা বাঁধে। প্রায় খাপ পঞ্চায়েত ই বসে যায়। সেখানে ভোলানাথ বাধ্য হয়ে বিনীত প্রশ্ন রাখে, যে, বাচ্চা মেয়েটা যে কটা টাকা পাচ্ছে এভাবে, সেগুলো বন্ধ হয়ে গেলে তাকে যখন মাইল পাঁচেক দূরের রেন্ডি-গলি তে দাঁড়াতে হবে, হয়তো বা বাড়িরই লোক ই দাঁড় করিয়ে দিয়ে আসবে তাকে, তখন তাকে যে ধরণের `শ্রম' দিতে হবে, শিশু-শ্রম তার চেয়েও অমানবিক কিনা, এবং যদি তাই হয় তাহলে ভোলানাথ নিজে যতটা পারবে দেবে, বাকিটার জন্য আবাসনের কে কে রাজি আছেন চাঁদা তুলে বাচ্ছাটার পরিবারের দেখভাল করতে আগামী কয়েক মাসের জন্য। খাপের জ্ঞানী ব্যক্তিরা আকাশের তারা দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ভোলানাথের প্রস্তাব শুনে।
ফলে বাচ্চাটা রয়ে যায়।
মাসকয়েক পরে একদিন আবাসনের নিরাপত্তা কর্মী রা ভোলানাথের বাড়িতে ফোন করে জানায় বাচ্চাটাকে যেন বাড়িতে যেতে না দেওয়া হয়, কারণ ওদের মহল্লার কেউ একজন পাশের গ্রামের উচ্চবর্ণের এক মেয়ের সাথে আশনাই করেছিল, তাই সেই গ্রামের লোক দলবেঁধে এসে মহল্লায় আগুন দিয়েছে বাচ্চাটা কাজে বেরোনোর পর। বাচ্ছাটার মা কোথায় পালিয়েছে কেউ জানে না, বাবা টা'কে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে কিনা ইতিমধ্যেই সেটাও জানা নেই, ফলে মেয়েটা যেন না বেরোয়। দিন পনেরো রয়ে গেছিলো মেয়েটি ভোলানাথের বাড়িতে। তারপরে মা এসে তাকে নিয়ে যায়। ভোলানাথের ঘরণী সেই মহিলাকে জিগেস করেন বিপদের মুখে মেয়ে ফেলে পালালে তুমি কেমন মা বাপু। তাতে থতমত খেয়ে মহিলা বলেন যে আর মিনিট পাঁচেক দেরি হলে পালাতে, জনা দশেক তাকে ক্ষেতি তে ফেলে পরপর ধর্ষণ করতো, তারপর বডি তে কেরোসিনের ডিব্বা উপুড় করে দিয়ে পুড়িয়ে জঞ্জাল সাফ করে চলে যেত, যা কিনা প্রায়শই হয়ে থাকে এই সব অঞ্চলে, থানা পুলিশ খুব একটা তাকিয়ে দেখে না - ওই সময়ে তাই তার মাথায় মেয়ে বর কিছুই ছিলো না, জন্তুর মতোই পালিয়েছে। ভোলানাথের ঘরণী আপাত নিস্তরঙ্গ কলকাতার স্বচ্ছল পরিবারে মানুষ - `এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা' - সেটাকে দেখতে শেখেননি কোনোদিন, ফলত গায়ে আঁচ লাগেনি কখনো। এই বর্ননা শুনে তিনি আতঙ্কে হাঁ করে থাকেন।
মেয়েকে নিয়ে মা চলে যায়। গাঁও পুড়ে গেছে, অন্য্ কোথাও থাকার ব্যবস্থা করতে হবে, দলে দলে তাই পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে পথে নামে। ভোলানাথের আবাসনে আর ফিরে আসেনি তারা। কোথায় চলে গেলো, কী ভাবে গেলো, ভোলানাথ তা জানে না। জানলেও, কিছু করে ওঠার মতো সাহস বা উৎসাহ, ভোলানাথের, সম্ভবত ছিলো না। সে সংসারী মানুষ, দায়িত্বশীল চাকুরে, সব ব্যাপারে মাথা ঘামানো কি তার পক্ষে সম্ভব?
যেমন কুসমি রং শাড়িরা কোথায় যায় তাও সে জানে না। বাগানের কাজ হয়ে গেলে, চাঁদের মতো কাস্তে টা তারা মাথার খোঁপায় গিঁথে নেয়, ফলাটা গোছখোঁপার মধ্যে গেঁথে থাকে, কাঠের হাতল টা ঝুলতে থাকে বাইরে। কাস্তে বহন করার এহেন পদ্ধতি ভোলানাথ বাপের জন্মে দেখেনি। এখানে অনেক কিছুই নতুন লাগে তার, যেমন ঘুঁটে গুলো গোল নয়, লম্বা, আয়তাকার, এবং অবতল, বোধহয় দেওয়ালের বদলে খাপরার চালে দেওয়া হয় বলে ওরকম আকৃতি হলে আটকে থাকার সুবিধা, কে জানে।
খোঁপায় কাস্তে গোঁজা আর মাথায় লাকড়ির বোঝা। যেখানে যা গাছের শুকনো ডাল ভেঙে পড়ে থাকে, তা কুড়িয়ে মাথায় নেয়। কাটা ঘাসের স্তুপ, যে গামছায় মাথা ঢাকা ছিল, তাতে বেঁধে নিয়ে ঝুলিয়ে নেয় কাঁধে, আবাসনের নিরাপত্তা রক্ষীদের কাছে অনুরোধ উপরোধ করে এগুলো বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য। এখানে তো কাজে লাগবে না কোনো, বাড়িতে নিলে শীতে জ্বালিয়ে আগুন হবে, বা ঘরে ছাগল `মুংলী বা ..', সে একটু বেশি দুধ যদি দেয় ঘাস বেশি পেলে। নিরাপত্তা রক্ষীদের দয়া দাক্ষিণ্য হলে সেগুলো নিয়ে তারা দল বেঁধে বেরোয় কিচিরমিচির করতে করতে। বেরিয়ে কোথায় যায় বটে? ভোলানাথ জানে না। আবাসনের সামনে দিয়ে চলে গেছে পিচের রাস্তা, তার দু ধারে অন্তহীন মাঠ, দূরে দূরে নীলাভ ছায়ার মতো গাছপালা আর গ্রামের সারি দেখা যায়। ধান কাটার পর গোড়া জেগে থাকে - শক্তি মনে পড়ে - `এ-মাঠ আর নয়, ধানের নাড়ায় বিঁধে কাতর হ'লো পা'। আলপথ চলে গেছে সিঁথির মতো, তাই ধরে দেহাতি সুন্দরীদের ফিরে যাওয়ার ঢল। বর্ষায় থকথকে কাদা, জোঁক, বিষাক্ত সাপ, সূর্য ডুবলে নরকের মতো অন্ধকার। `সেবন্নে শাকের শরীর মাড়িয়ে মাড়িয়ে' তারা কোথায় যায়? কতদূরে? ভোলানাথের জানা নেই। সে কাজের মানুষ, দেশের, সরকারের কলমপেষক, ঠান্ডা ঘরে থাকে। তার এতো মাথা ঘামিয়ে দরকার ই বা কী?
মাথা ঘামাতে নেই, মাথা ঘামাতে নেই, এরা আসবে যাবে, এই দেহাতি মেয়েরা, তাদের মাতাল, বৌ পিটানো কিন্তু একইভাবে অসহায় বরেরা, কুকুর বেড়ালের বাচ্চার মতো বেড়ে ওঠা ছেলেরা, ব্রিজ ভেঙে গেলে গুনসুতো দিয়ে বাঁধা ঘোলাটে কাঁচের চশমা পরা তোবড়ানো গালের বুড়োবুড়ি রা, এরা আসবে যাবে, এদের নিয়ে মাথা ঘামাতে নেই। সময়ের অপচয় মাত্র। তার থেকে অনেক বড় কাজ আছে ভোলানাথের, দেশের, সমাজের, বিদ্যাস্থলের। সে মন দিয়ে সেইসব কাজ করে। মাথা ঘামাতে নেই।
সন্তান কেও তাই শেখাবার চেষ্টা করে ভোলানাথ। এদের নিয়ে মাথা ঘামাতে নেই, একমাত্র জ্ঞানগর্ভ গবেষণাপত্র লেখা ছাড়া, অর্থনীতি বা সাবল্টার্ন তত্ত্ব নিয়ে।
করোনার দাপটে পড়ে তাই হতভম্ব হয়ে গেছিলো ভোলানাথ। তাকেও কি তাহলে এবারে মাথায় করে বাজারের ঝোলা বয়ে আনতে হবে ওদের মাথার লাকড়ির বোঝার মতো ? ভোলানাথের সন্তান ও কি তাহলে রোদে জলে বেরোবে মাছের ব্যাগ টেনে আনতে? কি হবে যদি না পাওয়া যায় ফল আর দুধ? মিষ্টির দোকান বন্ধ থাকে? পুলিশ নাকি আবার লাঠি চালাচ্ছে রাস্তায় লোক দেখলে।
কিন্তু উপায় নেই, ফলে বেরিয়ে পড়ে ভোলানাথ। সমস্ত বন্ধ, রাস্তা খাঁ খাঁ করছে। হেঁটে হেঁটে হেঁটে হেঁটে প্রায় আড়াই তিন কিলোমিটার গিয়ে এদিক ওদিক ঝোপড়ি থেকে কেনে কাঁচাবাজার, যা পাওয়া যায়। টেনে টেনে ফিরতে থাকে। রাস্তার লোকে দেখে তাকিয়ে - জিভ বার করে হাঁপাতে হাঁপাতে বাজারের থলে হাতে চলা এই জীব টি গ্রামের কাঁচা রাস্তায় খুব ই বেমানান, রাস্তা ঘাটে জটলা পাকিয়ে থাকা কিছু লোকের চোখে পড়ে ফলতঃ। ভোলানাথ ও তাদের দ্যাখে। এই লকডাউনের বাজারে চারজন লোক একসাথে ? ছিঃ! এই ছোটোলোকগুলোর জন্যই রোগ ছড়াচ্ছে। বেশ করেছে বরেলি তে এদের ওপর ব্লিচিং গোলা জলে হোস পাইপ মেরেছে, না তো কি গোলাপ জল ছিটোবে ? রেগে ওঠে ভোলানাথ।
হঠাৎ একজন এগিয়ে আসে, ভয়ে সিঁটিয়ে যায় ভোলানাথ, মারধর করে বাজার কেড়ে নেবে নাকি? এই ছোটোলোকরা সব পারে বাবা!
`কঁহা জাবিস?'
অবাক হয় ভোলানাথ, কেন বাপু, আমি কোথায় যাবো তাতে তোর কি দরকার!
`হমারা সাইকিলঠো লেনা হ্যায় কা? সামান ঘরমে ডাল'কর সাইকিল বাপস কর দিস ...'
সাইকেল? ওরে বাবা! সিটে, রডে, কেরিয়ারে সর্বত্র করোনার জীবাণু থিকথিক করছে নিশ্চয়ই? এই ছোটোলোকগুলোই তো করোনা ছড়ায়। লকডাউনের বাজারেও দেঁড়েমুসে মুরগি আর সুরা গিলে (প্রথম কদিন পাওয়া যাচ্ছিলো) নেয়াপাতি টা আরো বেড়েছে, ওয়ার্ক ফ্রম হোম বলে কথা! তাও সেই নেয়াপাতি দুলিয়ে প্রায় দৌড়েই পালিয়ে গেলো ভোলানাথ। হাঁফাতে হাঁফাতে আলপথ ধরে অনেকটা হেঁটে গেলো। কি রোদ, বাপরে! মার্চের শেষেই এই, মে মাসে কি হয় তাহলে। আবাসনে বাসন মাজার মেয়েগুলো আসে কি করে রে বাবা সেই সময়। যাকগে, যাকগে, ভোলানাথ এত ভেবেই বা কি করবে, গরিব মানুষকে দেখার জন্য ভগবান আছেন, ভোলানাথের আর কি ই বা করার আছে ওদের জন্য।
মেঠো রাস্তায় আরো খানিক ঘুরপাক খেয়ে পিচের রাস্তায় উঠে আসে। সামনেই হামিদ মাছওয়ালার দোকান। দোকান বলতে সরু পিচরাস্তার পাশের মেঠো জমিতে হামিদের ঝোপড়ি, তার সামনে খোলা মাটিতে কালো পলিথিন পেতে মাছ আর বঁটি নিয়ে বসে। পাশে একটা ছোট ডোবা ধরণের আছে। ব্যাটাকে ফোনে বলেছিল মাছ বাড়িতে পৌঁছে দিতে, কিন্তু এলোনা, বলে কিনা পুলিশ লাঠি চালাচ্ছে গাঁয়ের লোক রাস্তায় দেখলে! আরে, তোরা ছোটোলোক, দিনরাত মদ গিলে এমনি ই লাঠালাঠি করিস, না হয় পড়তই গায়ে দু এক ঘা। তা বলে তোর এতদিনের কাস্টমার কে মাছটা দিয়ে আসতে পারবি না? গজগজ করতে করতে ঝোপড়ির সামনে গিয়ে হাঁক দেয় - ` এ হামিদোয়া - নিকলা তো বাহার ...'
ধুঁকতে ধুঁকতে হামিদ বেরিয়ে আসে। এ বাবা, এ কি চেহারা ! গাল ভেঙে গেছে, চোখ ঘোলাটে। বছর পঁচিশ বয়েস হামিদের, লাগছে যেন ষাট।
`কি হয়েছে রে তোর? (সর্বনাশ! করোনা নয়তো!)'
কিছুই হয়নি, হামিদ জানায়। হয়েছে সেই সৃষ্টির আদিমতম রোগ। খেতে না পাওয়া। লকডাউনের বাজারে ব্যবসা পত্তর সব বন্ধ, বৌকে বাসন মাজার কাজ ছাড়িয়ে দিয়েছে বাবুদের বাড়ি থেকে, জিনিসপত্রের দাম আগুন, বাচ্চাদুটোকে বাঁচিয়ে রাখবে বলে হামিদ আর তার বৌ গত কদিন না খেয়েই আছে প্রায়।
`চিন্তা ন করে সাহাব, সব ঠিক হো জায়গা ...'
অবাক হয় ভোলানাথ। এতো আত্মবিশ্বাস পায় কোথা থেকে এরা।
`হ্যাঁরে ডিম জোগাড় করে দিতে পারিস? কোথাও পাচ্ছি না। মেয়েটা ডিমভাজা ডিমভাজা করে পাগল করে দিচ্ছে ক'দিন ..'
পাওয়া যাবে, জানালো হামিদ। একটু দাঁড়াতে হবে, বৌ গিয়ে গ্রামের ভিতর থেকে নিয়ে আসছে। দাঁড়ায় ভোলানাথ। অপেক্ষা করে। পাশের ডোবাটায় শুয়োর চরে বেড়াচ্ছে কার একটা। ডোবাময় পাঁক আর পানা। শুওরের চেহারাটা দেখতে হয়েছে অদ্ভুত - স্তনগুলোর নিচের অর্ধেক থেকে পা অবধি পানা ঢাকা সবুজ, ওপরটা পেঁকো কালো। কি সব ব্যাপার, ভাবে ভোলানাথ। এই করোনার বাজারে, যখন কিনা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাতাই শেষ কথা, যখন কিনা মানবসভ্যতা ধ্বংসের মুখে, তখন এইসব অস্বাস্থ্যকর নোংরামি দেশের সর্বনাশ করে দেবে না? আরে ছি! ছি! কান্ডজ্ঞান নেই কোনো ?
`এই হামিদ, কাদের শুয়োর রে?'
হামিদ জানে না। হবে কারোর। গ্রামের ই কারো।
`এখানে চলে এসেছে, কিছু বলিসনা তোরা? রোগে মরবি তো। করোনা হবে!'
এবারে তোবড়া গালে সত্যিই হাহা করে হেসে ওঠে হামিদ। করোনা আর আমাদের নতুন করে কি মারবে সাহাব, আমরা তো মরেই আছি প্রজন্মের পর প্রজন্ম। না খেয়ে মরি, রোগে মরি, বাচ্চা বিয়োতে গিয়ে মরি, উচ্চবর্ণের লোক গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয় পুড়ে মরি, বৌকে এসে গণধর্ষণ করে যায়, সামনে দাঁড় করিয়ে জোর করে সেটা দেখতেও বাধ্য করে বরকে, সেই গ্লানিতে আত্মহত্যা করে মরি। আমরা বেঁচে আছি এতো শ' বছর ধরে, সেটাই কি যথেষ্ট আশ্চর্য নয় সাহেব? করোনা থাকলেই বা কী, গেলেই বা কী, আমাদের কতটুকু তফাৎ বলুন তো?
গুম হয়ে যায় ভোলানাথ। না, নেই বটে। সত্যিই তফাৎ নেই কোনো। কখনো তো ভাবেনি ভোলানাথ এভাবে। এদের কথাও কি ভেবেছিলো কোনোদিন? কোনো খোঁজ রেখেছে? অশিক্ষিত মূর্খ বলে গালমন্দ করেছে, দিনের পাঁচমিনিট ও কি ব্যয় করেছে এদের শিক্ষা ও চেতনা আনতে? ভোলানাথ দের চিন্তাবৃত্তে আদৌ কি আছে হামিদ'রা? হামিদের মতো আরো লক্ষ কোটি ভারতবাসী? `সহনাগরিক' বলে কী যেন গালভরা কথা আছে না একটা? বিদেশ থেকে যে সব আলালের ঘরের দুলাল রা এক এক করে নামছে এসে বিভিন্ন অন্তর্দেশীয় হাওয়াই আড্ডায়, তারা তো মহারাষ্ট্র থেকে, রাজস্থান থেকে, দিল্লী থেকে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে পড়েছে যারা ঘরে ফিরবে বলে, তাদের সহনাগরিক ই হলো ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী? বরেলির রাস্তায় সার দিয়ে বসিয়ে যাদের ওপর জীবাণুনাশক স্প্রে করা হলো, তাদের কোলের বাচ্ছা ও তো সহনাগরিক ই হলো ভোলানাথের কন্যার? ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী ই?
আর ভাবতে পারে না ভোলানাথ, মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে।
এই যে ভোলানাথ রা বিরক্তি উগরে দিচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, বা সামনাসামনি কারো সাথে দেখা হলে, বা কারো সাথে কথা হলে দূরভাষে, যে, এইসব অশিক্ষিত মূর্খের দল লকডাউন মানছে না বলে দেশের ক্ষতি হচ্ছে, এই চাষাভুসো গুলো লকডাউন ব্যাপারটা বুঝছেই না বলে মৃত্যুর আশঙ্কা বেড়ে যাচ্ছে ভোলানাথদের, তাদের সন্তানদের, এই চাষার দল যদি জিগেস করে কতোটা ভেবেছে ভোলানাথ রা তাদের নিয়ে? কতটা চাল দিয়েছে যখন বাচ্ছা খেতে না পাওয়ায় রেন্ডি-গলি তে দাঁড়িয়েছে গিয়ে কারো বৌ? নিকটতম প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে, একশো তিন ডিগ্রী জ্বর নিয়ে সাত কিলোমিটার হাঁটতে হয় একটা প্যারাসিটামল পেতে, হয়তো বা পয়ঁতাল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার ভর দুপুরেই। তাও যদি প্যারাসিটামল স্টক থাকে সেখানে, রাষ্ট্র দয়া করে ব্যবস্থা রাখে। ভোলানাথ রা কি জানে কেমন লাগে সাত কিলোমিটার হাঁটতে জ্বর গায়ে? জেনেছে কোনোদিন? ঘরে থেকে থেকে এক্সপায়ারি ডেট পেরিয়ে যায় কতো ওষুধ, ভোলানাথরা যেগুলো ফেলে দেয়, সেগুলো না নষ্ট করে দিয়েছে কোনোদিন বাসন মাজার ঝি কে? যদি জিগেস করে লক্ষ লক্ষ চাষাভুসো আজ - কেন তারা শুনবে এখন করোনার সাবধানবাণী ভোলানাথদের বাঁচাতে? কী যায় আসে চাষাদের, করোনা হোক কি না হোক, দারিদ্রসীমার অনেক নীচে থাকা মানুষদের মরতে তো হবে এক ই রকম ভাবে, তাহলে কেন ভাববে তারা ভোলানাথদের কথা?
এই যে ভোলানাথের ইংরিজি ইস্কুলে পড়া স্মার্ট গোবদা বাচ্ছা, আর হামিদের খিদেয় শুঁটকো বাচ্ছা, যারা নাকি `সহনাগরিক'! এখন কেউ যদি বলে, যে, ভোলানাথের বাচ্চা যে সুযোগ সুবিধা পায় তা তো শুধু মাত্রই সম্ভাবনার তত্ত্ব মেনে? যেমন কিনা মার্জার শাবক একগাদা জন্মালে বা সারমেয় শাবক, কোনটা কালো, কোনটাই বা সাদা, আর কোনটাই বা সাদা কালো, তা শুধুই স্ট্যাটিস্টিক্যাল মাত্র, প্রোবাবিলিস্টিক। তেমনি ভোলানাথের সন্তান আর হামিদের সন্তান, অথবা ভোলানাথ বা হামিদ, কে কার ঘরে জন্মেছে সেটাও তো বায়োলজিক্যাল কো ইন্সিডেন্স মাত্র। সেই কো-ইন্সিডেন্স মাত্র সম্বল করে এতো অহঙ্কার ধর্মে সইবে? সইবে তো, কী রে, ভোলানাথ? সামলাতে পারবি, তোদের চারিপাশ থেকে শ্রেণীসচেতন রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বলয় উঠে গেলে? পারবি তো রে, ভোলানাথ?
ঠকঠক করে হাঁটু কাঁপতে থাকে ভোলানাথের। ঘেমে নেয়ে ওঠে। চোখে অন্ধকার দেখতে থাকে পুরো।
`আন্ডা লেকে আ গইল বা। কয়ঠি চাহিয়ে?'
হামিদের প্রশ্নে হুঁশ ফেরে ভোলানাথের। কপালের ঘাম মুছে, ডিম মাছ বুঝে নেয়। টাকা দিয়ে চলে আসছে, হামিদ আর হামিদের বৌ পেছন থেকে বলে ওঠে `সামহালকে রেহনা সাহিব, বহ খুদায়েঁ আমানত সাহিব, বহ খুদাহ সপুর্দমত ... '
গনগনে শলাকার মতো বিঁধে যায় কথাগুলো কানে এসে। একবার ওদের দিকে হাত নেড়ে, দ্রুত পা চালিয়ে সরে পড়ে ভোলানাথ।
এতো গলি কথা থেকে এলো? সরু সরু, অন্ধকার, দম আটকে আসা গলি, সাপের মতো এঁকেবেঁকে একটার গায়ে আর একটা জড়িয়ে, দুদিকে ছায়া ছায়া গঠন যতো, বাড়ি, নাকি আর কিছু? প্রানপনে দৌড়োচ্ছিলো ভোলানাথ, গলি ধরে। দ্যাখে উল্টো দিক থেকে কে যেন এসে দাঁড়িয়েছে নিশ্চুপে। আরে এ কী! এ যে অলড্রিন লিংডো ! শিলং থেকে এসেছিলো, আগ্রার রেস্তোঁরায় কাজ করতো, লকডাউনে টাকা না পেয়ে ২রা এপ্রিল ঝুলে পড়েছিল মাঝরাতে, আগ্রার ভাড়া বাড়িতে। কি সর্বনাশ! সে এখানে কেন? পাগলের মতো ঘুরে অন্য দিকে দৌড়োতে শুরু করে ভোলানাথ। পালাতে পারবে না বোধহয়, বুঝেছিলো। তাও দৌড়োচ্ছিলো, প্রানপনে দৌড়োচ্ছিলো, গলি থেকে গলিতে, আরো গলিতে, গলির গলি তস্য গলিতে। যতক্ষণ না আবারো আরো একটা গলির মুখ থেকে ধীরপায়ে হেঁটে আসতে থাকে নতুন দিল্লির এক রেস্টুরেন্টের ডেলিভারি বয় রণবীর সিং। দিল্লি থেকে মধ্যপ্রদেশের মোরেনা গ্রামের উদ্যেশ্যে রওনা দিয়েছিলো পায়ে হেঁটে, কাজ খুইয়ে। প্রায় সোয়া দুশো কিলোমিটার হাঁটার পরে, যখন তার বাড়ি আরো প্রায় একশো কিলোমিটার দূরে, আঠাশে মার্চ রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে। হৃদযন্ত্র সেখানেই বন্ধ হয়ে যায়। আতঙ্কে আবার গলি পাল্টায় ভোলানাথ, দৌড়োতে থাকে পাগলের মতো, হাঁফায়, মুখ দিয়ে মোটা মোটা সুতোর মতো লালা ঝরতে থাকে, বুক যেন ফেটে আসবে। তখনই, ঠিক তখন ই, আরেকটা গলির মুখ থেকে, ঝুঁঝকো আঁধার ভেদ করে নিঃশব্দে উঠে আসে মুম্বাইয়ের রাস্তার চায়ের দোকানের চার জোগাড়ে। কাজ হারিয়ে পায়ে হেঁটে রওনা দিয়েছিলো বাড়ির দিকে, রাজস্থান পেরিয়ে গুজরাটের রাস্তা ধরবে বলে। মহারাষ্ট্র - গুজরাট সীমান্তের ভিলাড়ে পুলিশ আটকে দেয়, আবার তারা ফিরে আসতে বাধ্য হয় পশ্চিম মুম্বাইয়ের ভাসাইয়ের দিকে। মুম্বাই-গুজরাট হাইওয়ের ওপরে ভিরারে মালভর্তি ট্রাক তাদের পিষে দিয়ে গেছে আঠাশে মার্চেরই ভোরে।
আর পারছিলো না ভোলানাথ, একটুও পারছিলো না, দমবন্ধ হয়ে এখুনি মরে পড়ে যাবে গলির মধ্যে, দৌড়ে দৌড়ে প্রায় এরকম দশা যখন, কোন আশ্চর্য জাদুবলে গলিটা শেষ হয়ে গেলো, খোলা এক বিশাল চত্ত্বরে বেরিয়ে এলো ভোলানাথ। এতো লোক কেন? শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে লোক পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে কোথায় যেন চলেছে, তাদের পায়ের তলায় ধুলোর ঝড়, চারিদিকে পুলিশের লাঠি, চিৎকার, কান্না, আর্তনাদ। কারা? এরা কারা?
ওঃ! এরা তো দিল্লীর সেই ঠিকে শ্রমিকরা, দলে দলে যারা এসে ভিড়তো রাজধানী তে, ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে। তারাই ফিরে যাচ্ছে বুঝি আজ। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে থাকে ভোলানাথ। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না, সে আনন্দ-বিহারে এসে পৌঁছোলো কিভাবে, কখন ই বা। খানিক আগেই না সে মাছ কিনছিল হামিদের ঝোপড়ির সামনে দাঁড়িয়ে?
`বাবা!'
`কে?' চমকে ওঠে ভোলানাথ।
`বাবা!' মৃদু, খুব মৃদু, হালকা ডাক - হেমন্তের শুকনো পাতা খসে পড়ার সময় যেভাবে কেঁদে ওঠে পত্রবৃন্ত, বাকল থেকে চ্যুত হচ্ছে বলে - সেইরকম নাবাল আওয়াজ।
কে? কে ডাকে? কে হে? কার বাবা আমি?
আবার! আবার সেই ডাক! `বাবা`! এবারে একটু জোরে - হতভম্ব ভোলানাথ এদিক ওদিক ঘাড় ঘোরায় ইতস্ততঃ - কেউ তো নেই - কচি গলায় কে ডাকে তবে? ততক্ষণে আবার ডাক - আবার! আবার! আবার! মৃদু থেকে জোরালো হয়ে শেষে গর্জনের মতো আছড়ে পড়ে - ডাইনে বাঁয়ে সামনে পিছনে আকাশ থেকে পাতাল ফুঁড়ে - বাবা! বাবা! বাবা! বাবা! - মাথার ভেতরে হাতুড়ির ঘায়ের মতো সেই আকুল আহ্বান আছড়ে পড়তে থাকে।
একি! একি! একি! এ তো ভোলানাথের মেয়ে। ভোলানাথের মেয়ে! হা ঈশ্বর! দিগন্ত জুড়ে সারি সারি দাঁড়িয়ে রয়েছে কন্যা তার, একই বহু হয়ে। এদিকে তাকায়, তার মেয়ে, ওদিকে তাকায়, তার মেয়ে, সামনে তাকায়, পেছনে তাকায়, চারিদিকে শুধু তার ই মেয়ে! কেউ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, কেউ চাল ভিক্ষে করছে, কেউ প্রানপণ চেষ্টা করছে জামা তুলে মুখ ঢেকে নেওয়ার যাতে সরাসরি জীবাণুনাশকের স্রোত নাকে মুখে চোখে আছড়ে না পড়তে পারে হোস পাইপ বেয়ে। চারিকে শুধু ভোলানাথের ই মেয়ে, সেই মুখ, সেই চোখ। সব এক! সব এক! সব এক!
না! না! না! না! পাগলের মতো চিৎকার করে ওঠে ভোলানাথ, দৌড়োতে থাকে, কোনদিকে তা নিজেই জানে না, মেয়ের দিকে দৌড়ে যায় নাকি নিজের থেকে পালিয়ে যায় বুঝে উঠতে পারে না। শুধু দৌড়োতে থাকে, প্রানপনে দৌড়োতে থাকে। দৌড়োতে দৌড়োতে দৌড়োতে দৌড়োতে, সজোরে মুখ থুবড়ে পড়ে। তারপর... চারদিক অন্ধকার।
চমকে জেগে ওঠে ভোলানাথ। বাব্বাঃ! কি স্বপ্ন। ঘামে ভিজে গেছে সারা শরীর। কি ভয়ঙ্কর স্বপ্ন রে বাবা। বাজারের থলি রান্নার মাসির জিম্মা করে দিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল এসে। বড়ো বড়ো শ্বাস পড়ছে এখনো। কি সব দেখলো। এখনো কাঁটা দিচ্ছে সারা শরীরে। সত্যি যদি ওর মেয়েকে ওভাবেই লাইনে দাঁড়িয়ে ....
ধুর! তাও কখনো হয়। ভোলানাথের মেয়ে তো ভোলানাথেরই মেয়ে। সে কি হামিদের মেয়ে হয়ে যাবে কখনো? হয়ে যেতে পারে? কি যে আজেবাজে সব ... নিশ্চয়ই পেট গরম হয়েছে দুপুরে বাজার করতে বেরিয়ে মাথায় রোদ লেগে। ভোলানাথের মেয়ে লাইনে দাঁড়াবে চালের জন্য, তা কখনো হয়? নিজেই নিজেকে আশ্বস্ত করে।
তবে বিবেক বলে একটা ব্যাপার আছে তো। বিবেক। বড়ো ব্যাপার। বিবেক জাগ্রত রাখা দরকার। অজিতেশ যেমন রেখেছিলেন। কলকাতা একাত্তর সিনেমায়। খাওয়ার টেবিলের পাশে জয়নাল আবেদীনের আঁকা দুর্ভিক্ষর ছবি টাঙিয়ে রাখতেন - যাতে মুরগির ঠ্যাং চিবোনোর সময় বিবেকে নাড়া লাগে। তাই মনিটরের সামনে বসে পড়ে ভোলানাথ। দেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু জ্ঞানগর্ভ কথা লিখে ফেলা দরকার সোশ্যাল মিডিয়াতে। সমাজের বিবেক জাগ্রত থাকা দরকার।