এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • স্মারক ও স্মৃতিচিহ্ন সংক্রান্ত গল্পসমূহ

    সুকান্ত ঘোষ লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১২ জানুয়ারি ২০২০ | ২৩৬১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • বালি, রাম-সীতা এবং অন্যান্য
    ---------------------------------------

    বালি (হাওড়া জেলার বালি নয় তাবলে) আমার খুব প্রিয় জায়গা, অনেকবার গেছি। আর এখন তো ভারত থেকেও বালি যাওয়া খুব সহজ হয়ে গ্যাছে এবং অনেকেই যাচ্ছেন এই অপূর্ব জয়গায়।

    যাঁরা বালি গ্যাছেন বা এর সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখেন তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন যে হাতের কাজের, তা সে কাঠের, আঁকা, পটের, কাঁচের, গহনা (বিশেষ করে রূপো) যাই হোক না কেন, বালি দ্বীপ সে সবের জন্য খুবই বিখ্যাত। বালি দ্বীপের উবুদ নামক জায়গাটা আবার এমন সব শিল্পীদের গ্রাম। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এঁরা এই সব কাজ করে আসছেন। আমার ব্যক্তিগত ভাবে বালির শিল্পীদের কাঠের কাজ কর্ম প্রচন্ড ভালো লাগে। মনে হয় এমনটা পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যাবে না।

    খুব কম সময়ের জন্য বা কনডাকটেড ট্যুরে গেলে সেটা হয়, ওরা আপনাদের শুধু কমার্শিয়াল কিছু জায়গা ঘুরে দেখিয়ে দেবে – তা সে আর্ট গ্যালারী বা তথাকথিত ‘শিল্পী’দের বাড়ি যাই হোক না কেন। এ সবের বেশীর ভাগই একটা ‘সেট-আপের’ অঙ্গ। শুধু এই সব জায়গা পরিদর্শন করলে বলাই বাহুল্য আপনি বালির আসল কারিগরদের কাজ সম্পর্কে তেমন কিছু ধারণা পাবেন না। আর ওই কুটা, সেমনিয়াক ইত্যাদি বীচের ধারে যে দোকান গুলো দেখেন, সে গুলো তো পুরো টুরিষ্টদের জন্য।

    আসল বালির শিল্পদের কাজ দেখলে হলে বা তাদের সাথে পরিচিত হতে চাইলে একটু হাতে সময় নিয়ে ঘুরতে হবে। আর ব্যবস্থা করতে হবে সঠিক লোকের সাথে সেই জায়গায় ঘোরা। এই ফাঁকে বলে নিই, গড়পড়তা বালির লোকেরা খুব সৎ - তেমন কাউকে ঠকায় না। যদি কিছু ঠকে থাকেন তাহলে তা ওই ট্যুরিষ্ট এলকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

    অমৃতার আর আমার দুই জনেরই এই শিল্প, হাতের কাজ নিয়ে কিছু উৎসাহ ছিল বলে অনেক সময় কাটিয়েছি উবুদ বা তার আশেপাশে ভিতরের গ্রামে। আমাদের ড্রাইভার দেবা (দেওয়া উচ্চারণ) প্রায় ঘরের লোক হয়ে গিয়েছিল বারবার যাবার ফলে। শুধু আমি নয়, রেফারেন্স এর মাধ্যমে দেবা-কে আমার চেনাশুনে সার্কেলের অনেকে ব্যবহার করেছে এবং বন্ধুরা তাদের বন্ধুদেরও বলেছে। তবে দেবা-র গল্প অন্য কোনদিন। এই দেবা-কে বলেই আমরা শিল্পীদের আস্তানায় ঘুরেছি, কাটিয়েছি অনেকটা সময়।

    হাতের তৈরী যেকোন আসল জিনিসের মতই সুন্দর এবং সূক্ষ্ম কাঠের কাজের জিনিসেরও প্রচুর দাম – মানে যত গুড় দেবেন তত মিষ্টি হবে। আর্ট গ্যালারীতে কিনলে যা দাম দেবেন তার বেশীর ভাগটাই যাবে এজেন্টের বা ওই দোকানের মালিকের পকেটে। এর এই গ্রামে গিয়ে শিল্পীদের কাছ থেকে সরসরি কিনলে তারা বেশীর ভাগ লাভটা পাবে – হিসাব সরল। কাঠের কারুকাজের জিনিস চেনা খুব সহজ নয়, একটু সময় নিয়ে কথা বললে বুঝতে পারবেন কাঠের উপর, কাজের সূক্ষ্মতার উপর কিভাবে নির্ভর করে শিল্পকার্যের দাম। কি পরিশ্রম করতে হয় কারিগরদের সেটাও টের পাবেন।

    অনেক বড় কাঠের শিল্প কর্ম যাতে খুব সূক্ষ্ম কাজ আছে তেমন কেনা প্রায় সাধ্যের বাইরে। আবার তা যদি আবার ‘মাষ্টার কার্ভার’ এর বানানো হয়। নাম শুনেই বুঝতে পারছেন যে ‘মাষ্টার কার্ভার’ মানে র‍্যাঙ্কিং এর উঁচুর দিকের লোক। তবে হালকা পার্থক্য আছে এই কাঠের কাজের ‘মাষ্টার’ দের সাথে বিখ্যাত ছবি আঁকিয়ে-দের। যদি আপনি ছবি ভালো না বোঝেন, তাহলে শুধু ছবি দেখে চট করে হয়ত বলতে পারবেন না সেটা বিখ্যাত কোন শিল্পীর আঁকা কিনা। কিন্তু বালির কাঠের শিল্পকর্ম অন্যরকম। আপনি শুধু কাঠের শিল্পকর্মটি এবং তার গায়ের কাজ কর্ম দেখে প্রায় শতকরা আশি ভাগ বলে দিয়ে পারবেন যে এ জিনিস ‘মাষ্টার কার্ভার’ এর বানানো কিনা।

    তা অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল তেমনি এক ‘মাষ্টার কার্ভারের’ বানানো একটা কাঠের মূর্তি কিনব – সরাসরি সেই শিল্পীর কাছ থেকে। যেমন সামর্থে কুলাবে – সেই বার দেবা-কে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে তেমনি একটা মূর্তি পছন্দ হয়ে গেল। দরদাম করতে লজ্জা লাগে তেমন শিল্পদের সাথে – কিনে নিলাম। সঙ্গের ছবিটি সেই বালির নর্তকীর – একটু নজর করলে দেখতে পাবেন কাঠের রঙটি দুই প্রকার শেডের। এটা কিন্তু পালিশ নয় – কাঠের রঙটাই এমন। এই রকম কাঠ খুঁজে তাতে খোদাই করে বানানো, স্পেশাল কাঠ। এই মুহুর্তে কাঠের নামটা মনে পড়ছে না। আর এই মূর্তি কিন্তু এক পিস কাঠ থেকে খোদাই করে বানানো, কিছু জোড়া ইত্যাদি নেই।



    সন্ধ্যে বেলা হোটেলে ফিরছি সে সব শিল্পীদের গ্রাম ঘুরে, পরের দিন সকালে ফেরার ফ্লাইট। শেষ একটা মাষ্টার কার্ভারের বাড়ি নিয়ে গেল দেবা। ঘুরতে ঘুরতে পছন্দ হয়ে গেল এর একটা কাঠের কাজ এটা ঠিক থ্রী-ডি মূর্তি নয়, দ্বিমাত্রিক কাজ। অমৃতারও খুব চোখে লেগে গেল – কিন্তু দাম শুনে পিছিয়ে গেলাম। আগেই বালি-নর্তকীর মূর্তি কিনে আমার বাজেট খতম। মাষ্টার কার্ভারের সাথে দেখা হল – তিনি এখন আর কাজ করতে পারেন না, চোখে তেমন ভালো দেখতে পান না। উনার ছেলেও কিছু কাজ করে, তবে বাবার মত তত বড় শিল্পী নয়। ছেলেটাও খুব ভালো – আমাদের বলল এই রাম-সীতার মূর্তিটা অনেক দিন ধরে পড়ে আছে, বিক্রী হয় নি – এদিকে এটা ওর বাবার শেষ কাজ বলে কম দামে বিক্রী করতেও চায় না। আমাদের লজ্জা করল ওর সাথে দরদাম করতে। আমি ওকে বললাম দেখো, আমাদের এই মূর্তি খুব পছন্দ হয়েছে, কিন্তু এতো দাম দিয়ে এবার আমার বাজেটে নেই। তাই আর দরদাম করে তোমাদের অসম্মান করতে চাই না এতো ভালো কাজের। ফিরে আসছি, জিজ্ঞেস করল তুমি কত দিতে পারবে। আমি বললাম ফ্রাঙ্কলি যে এই বারের আবার বালি ট্যুরের বাজেট খতম, আমি ম্যাক্সিমাম এই দিতে পারি। সে বলল এই দামে হলে অনেক আগেই বিক্রী হয়ে যেত, আগে অনেকেই এই দাম দিতে চেয়েছিল। আমি বললাম, বুঝতেই পারছি – কোন অসুবিধা নেই, হয়ত পরের বার আমি কিনতে পারব, এটা না থাকলেও অন্য কিছু কিনব। আমরা হোটেলে ফিরে চলে এলাম।

    বেশ রাতের দিকে ব্যাগ ইত্যাদি গোছাচ্ছি ফেরার জন্য – এমন সময় দেবা-র ফোন এল। সেই মাষ্টারের কার্ভারের ছেলে ফোন করেছিল তাকে। বলেছে মনে হল মেয়েটির (অমৃতা) খুব পছন্দ হয়েছে রামসীতা মূর্তিটা। ওরা চাইলে কালকে যা দাম বলেছিল, সেই দামেই নিতে পারে। দেবাকে হ্যাঁ বললাম, পরের দিন আমাদের এয়ারপোর্টে ড্রপ করতে যাবার আগে দেবা মূর্তিটা সেই গ্রাম থেকে পিক-আপ করে আনল। আমি দেবাকে কালকের বলা দামের থেকে আরো বেশী কিছু দিয়ে দিলাম।



    সেই মূর্তি গত সপ্তাহে বেরোল প্যাকিং বক্স থেকে – এখনো গোটা চল্লিশ বাক্স আছে এমন শুভেনিয়রে ভর্তি – ভর্তি এমন স্মৃতিতে।
    চা চায়ে
    -----------------------

    বাক্স থেকে ক্রমে সেই টি-পট ও বেরিয়ে এল, তাইওয়ানের অনেক ভিতরের দিকে এক গ্রাম থেকে কেনা। হাতে করে বানাচ্ছে কারিগর, তার দোকানেই বিক্রী হচ্ছে এমন নানা শিল্পকর্ম। এবার আপনি হয়ত বলতেই পারেন ধর্মতলায় এমন টি-পট আকছারই হয়ত পাওয়া যায় খুঁজলে। সে তো ধর্মতলায় ফুটপাথে খুঁজলে লুই-ভিটনের ব্যাগ থেকে ব্ল্যাক পার্ল সবই পাওয়া যাবে! এই টি-পটের মূল্য রসিকের কাছে ভালো পেন্টিং-এর মত। যে যেমন চোখে দেখে।



    এমনিতে তাইওয়ানীজদের চীনা বললে ক্ষেপে যায়, তবে কালচার‍্যালি এরা তো চীন দেশেরই মত – এই ধরুণ ভারত বাংলাদেশ যেমন। এই টি-পট খুঁজে পেয়ে তাই আবার চা-য়ের কথা মনে পরে যায়। চা খাবার ব্যাপারে এই চীনে ব্যাটারা আমাদের বহু বহু দিন আগে টেক্কা দিয়েছে। লিখিত তথ্য প্রমাণ ঘেঁটে দেখতে গেলে, খ্রীষ্টিয় তৃতীয় শতাব্দী থেকে চীনে দেশে ‘চা’ শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়। অবশ্য এই বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই যে এরও অনেক অনেক আগে থেকে চীনে চায়ের প্রচলন ছিল। লোককথা মেনে চললে দেখা যাবে যে চীন সম্রাট শিন নুং নাকি খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকেই চীনে চা পান করা প্রচলন করেন। এছাড়াও আরো অনেক অনেক উপকথা, লোককথা আছে চীনে চা কি ভাবে এবং কবে থেকে চালু হয়ে ছড়িয়ে পরে সেই নিয়ে। সেই সব বিস্তারে এই লেখায় ঢুকব না, তবে যেমন আগে বললাম তৃতীয় শতাব্দীতে যাং ই নামে এক ভদ্রলোক প্রথমে লেখেন কেমন ভাবে চা চাষ, প্রক্রিয় এবং প্রস্তুত করা হয় সেই নিয়ে বিস্তারে





    চা শব্দটি চীন দেশীয়। চীনা লিপিতে যে ছবি দিয়ে চা লেখা হয় তাকে দুরকম ভাবে পড়া যায়। মান্দারিণ বুলিতে ‘ছা’, ফুফিয়েনের বুলিতে ‘তে’ (tea)। জাপান, ইন্দোচীন, পোর্তুগাল, গ্রীস আর রাশিয়াতে প্রথম উচ্চারণটি গ্রহণ করা হয়। বাকি সব ইউরোপীয় ভাষায়, আর আমাদের দেশে তামিল/তেলেগু আর মালোয়ালি ভাষায় দ্বিতীয় উচ্চারণটি গ্রহণ করা হয়। বাংলা ভাষায় প্রথম উচ্চারণটি স্বীকৃত। তাই অনুমান করা হয় যে পর্তুগীজরাই শব্দটি বাংলা ভাষায় এনেছে। ইংরাজীতে চা-এর প্রতিশব্দ ‘টি’। চা এর বিজ্ঞান সম্মত নাম ক্যামালিয়া থিয়া আর ক্যামেলিয়া সাইনেসিস।

    ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগীজ যাজক এবং ব্যবসায়ীরা ঘুরতে ঘুরতে চীনে চা-য়ের সন্ধান পায়। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে ইংরেজরা ব্যপক হারে চা পানে আসক্ত হয়ে পড়ে এবং একে পানীয় হিসাবে ঘোষণা করে। আফিমের ব্যবসা নিয়ে চীনাদের সাথে ইংরেজদের খটমট লেগে গেল। এদিকে চা সাহেবদের এত বেশী ভালো লেগে গেছে ততদিনে যে এই চায়ে যাতে চীনে একছত্র আধিপত্য না ঢুকে যায় তাই ইংরেজরা ভারতে চা চাষে মন দেয় ১৮১২ সাল নাগাদ। এতে করে চীনাদের উপর চায়ের জন্য বেশী নির্ভর হতে হবে না। ঠিক একেবারে পিন পয়েন্ট করা যাবে না হয়ত ভারতে কবে থেকে চা চাষ শুরু করেছিল ইংরেজরা, তবে ১৮১২ থেকে ১৮৩২ সালের মধ্যে তো বটেই।

    স্কটিশ বটানিষ্ট রবার্ট ফরচুন ব্রিটিশ রয়াল বোটানিক গার্ডেনে কাজ করতেন, তিনি নাকি ১৮৪৮ সালে চীন থেকে ফিরে কলকাতার গভর্নর জেনারেলকে চায়ের বীজ ও চারা দেন। সেই বীজ ও চারা ভারতে নানা জায়গায় ছড়ানো হয়েছিল দার্জিলিং যার মধ্যে অন্যতম। কি হইতে কি হইয়া গেল, দার্জিলিং এর চা মাটির এবং জলবায়ুর গুণে কিনা কে জানে, স্বাদে গন্ধে একবারে অতুলনীয় হয়ে উঠল। দার্জিলিং ও কার্সিয়াং অঞ্চলে মাকাইবাড়ি এলাকায় প্রথম চা ফ্যাক্টরি তৈরী হল ১৮৫৯ সালে। এর পর দেখতে দেখতে ১৮৭৮ সালে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি মিটারগেজ লাইন চালু, এবং ১৮৮০ সালে শিলিগুড়ি থেকে কার্শিয়াং টয় ট্রেন চালু হল – দার্জিলিং চা এর নাম আস্তে আস্তে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল।

    সারা পৃথিবীতে চায়ের উৎপাদন দেখলে ভারতের স্থান দ্বিতীয় – ২০১৬ সালে পৃথিবীতে চা উৎপাদিত হয়েছিল ৫৫ লক্ষ মেট্রিক টন যার মধ্যে ভারতের অবদান ছিল ১২.৫ লক্ষ মেট্রিক টন। পৃথিবীতে চা উৎপাদনকারী প্রথম পাঁচটি দেশ হল – চীন, ভারত, কেনিয়া, শ্রীলঙ্কা ও ভিয়েতনাম।

    পশ্চিমবঙ্গে মোট ১ লক্ষ হেক্টর জমিতে চা চাষ হয়ে থাকে বর্তমানে – মোট চা বাগিচার সংখ্যা ৩৫৯ যাদের মালিক ২৭৫ জন। দার্জিলিং এ চা বাগান আছে ৮৮ খানি, হেক্টর প্রতি যাদের চা উৎপাদন ৬৫০ কেজি করে। ২০১৭ সালে দার্জিলিং-য়ের ‘এ গ্রেড চা’ (ফার্ষ্ট ফ্ল্যাস – অর্থাৎ দুটি পাতা একটি কুঁড়ি) উৎপাদন ছিল ২০ লক্ষ কেজি। দার্জিলিং-য়ে বছরে উৎপাদন হয় মোট প্রায় ৯০ লক্ষ কেজি। এর মধ্যে ৩০-৪০ লক্ষ কেজি দেশের বাজারে বিক্রী হয়ে বাকি বিক্রী হয় বিদেশের বাজারে। দার্জিলিং চা নিলাম হয় কলকাতা এবং লন্ডনে, বছরে আয় প্রায় গড়ে হাজার কোটি টাকা।

    ভারতে টি বোর্ড তৈরী করার চিন্তা ভাবনা শুরু করেছিল সেই ইংরেজরা ১৯০৩ সাল নাগাদ, তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল যারা বিদেশে চা রপ্তানী করে তাদের কাছে লেভির টাকা সংগ্রহ করা। সেই লেভির টাকা দিয়ে ভারতের ভিতরে এবং বাইরে চায়ের বাজার সম্প্রসারণ করার চেষ্টা করা হবে। সেই সব মনে রেখে ভারত স্বাধীন হবার পর ১৯৫৪ সালে কলকাতায় টি বোর্ড এর অফিস তৈরী হয়েছিল। এই টি বোর্ডের মূল লক্ষ্য ছিল চায়ের গুণমান রক্ষা করাতে নজরদারী করা যাতে বিদেশে ভারত থেকে খারাপ চা রপ্তানী না হয়ে মান সম্মান খোয়া যায়।

    ব্যবহারের ধরণ অনুসারে বা তৈরী করার প্রক্রিয়ার তারতম্য অনুসারে চা কে চার ভাগে ভাগ করা যায়ঃ

    ১) কালো চা (Black Tea) - ঝলসানো বা সেঁকা কালো চা। ভারতে এই চা সবচেয়ে বেশী চলে
    ২) সবুজ চা (Green Tea) – রোদের তাপে সুকানো হয় বলে এই চা এর রঙ সবুজ থাকে
    ৩) ইষ্টক চা (Brick Tea) – গুঁড়ো চা এর সাথে মশলা, মাখন, ভাতের মন্ড মিশিয়ে তাতে চাপ দিয়ে ইটের আকারে এই চা বানানো হয়
    8) ওলং চা (Oolong Tea) – বিশেষ সুগন্ধি যুক্ত হয় এই চা।

    বাঙলী বলাই বাহুল্য হুলিয়ে চা খায় – বাঙালীই ইন ফ্যাক্ট এক মাত্র প্রজাতি যারা চা ‘খায়’। বাকি সবাই পান করে। বাঙালী চা খাবে আর রবি ঠাকুর সেই নিয়ে কিছু লিখবেন না, সেটা আবার হয় নাকি! উনিও চা নিয়ে খান দুই কবিতা নামিয়ে ফেলেছিলেন, খুঁজলে হয়ত আরো পাওয়া যাবে। বিধুশেখর শাস্ত্রীর নিমন্ত্রনে শান্তিনিকেতনের চা-চক্রে গিয়ে অতিথিদের উদ্দেশ্যে নিবেদিতঃ

    “কী রসসুধা – বরষাদানে মাতিল সুধাকর
    তিব্বতীর শাস্ত্র গিরিশিরে।
    তিয়াষিদল সহসা এত সাহসে এ করি ভর
    কী আশা নিয়ে বিধুরে আজি ঘিরে।
    -----------------------
    চা-রস ঘন শ্রাবণধারাপ্লাবন-লোভাতুর
    কলাসদনে চাতক ছিল এরা –
    সহসা আজি কৌমুদিতে পেয়েছে এ কী সুর,
    চকোর-বেশে বিধুরে কেন ঘেরা।

    এর পর শান্তিনিকেতনে চা-চক্র প্রবর্তন উপলক্ষ্যে (সুসীম চা-চক্র, চীনা বন্ধু সু-সুমোর উৎসাহে)

    হায় হায় হায়
    দিন চলি যায়!
    চা – স্পৃহ চঞ্চল
    চাতক দল চল
    চল চল হে।
    টগবগ উচ্ছল
    কথলিতল জল
    কল কল হে

    এল চীন গগন হতে
    পূর্বপবনস্রোতে
    শ্যামল রসধর পুঞ্জ,
    শ্রাবণবাসরে
    রস ঝরঝর ঝরে
    ভুজ হে ভুজ
    দলবল হে।

    চা পান করা ভালো – তবে বেশী পান করা ভালো নয়। চা বেশী পান করলে নিজের জিনিস গুলি হালকা প্রবলেম নিয়ে আসতে পারেঃ

    ১) ঘুমের সমস্যা
    ২) কোষ্টকাঠিন্য
    ৩) হতাশা
    ৪) খিদে কমে যাওয়া
    ৫) ত্বকের ক্ষতি করে

    তবে এই কোষ্টকাঠিন্য-র দাবিটা আমি মানতে পারলাম না। প্রচুর পাবলিক কে দেখেছি সকালে এক চাপ চা না খেলে হাগু হয় না!

    এর উল্টোদিকের কেসও আছে। চা পানে স্বাস্থ্যের নাকি উন্নতি হয়ঃ

    ১) মেজাজ ভালো থাকে
    ২) স্বাস্থ্যে উন্নতি
    ৩) চা পান হার্ট অ্যাটাক থেকে বাঁচায়

    মেজাজ ভালো থাকে এটা মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু হার্ট অ্যাটাক থেকে বাঁচায় – একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল মনে হয় দাবি দাওয়া।

    ২০১৪ সালে নাকি বাংলাদেশে একটা সিনেমা বানানো হয় – “এক কাপ চা”, প্রেমের গল্প বলছে এক কলেজ শিক্ষক এবং কলেজ লাইব্রেরীয়ানের মধ্যে। এই সিনেমা দেখা হয় নি, দেখে নেব কোন একদিন।

    কলকাতায় প্রথম কোথায় চায়ের দোকান চালু হয়েছিল? কেউ বলেন উত্তর কলকাতায় আর কেউ বলেন মধ্য কলকাতায়! আমি কলকাতার ছেলে নই – তাই এই নিয়ে বিশেষ মাথা ব্যাথাও নেই!

    তথ্যসূত্রঃ

    ১। ‘কৃষি জাগরণ’, ফেব্রুয়ারী ২০১৮
    ২। ‘এ ব্রীফ হিষ্ট্রী অব টি’ – রয় মোক্সহাম এর লেখা।

    -----------------------------------------------------
    ভিয়েতনাম – এজেন্ট অরেঞ্জ
    -----------------------------------------------------

    এতবছর ধরে এত জায়গায় বেড়াতে গেলেও দল বেঁধে কনডাকটেড ট্যুরে প্রায় কোথাও যাই নি বলতে গেলে। কারণ একটাই, ঠিক পোষায় না। নানা জনের নানা মতামত, নানা ভালোলাগা – সব মিলিয়ে ঘেঁটে যায়। আর ওই বড় গ্রুপে কনডাকটেড ট্যুরে তো একদমই না। বড় বাসে করে কোথাও নিয়ে গিয়ে টাইম বেঁধে ছেড়ে দেওয়া – কখন পেচ্ছাপ করতে হবে, কখন কি খেতে হবে, কোথায় কি দেখতে হবে সব ঠিক করে দেওয়া – বড় চাপের ব্যাপার। যে রিল্যাক্স ভাব আনার জন্য নতুন দেশ দেখতে যাওয়া, সেই রিল্যাক্স উবে কি টেনশন চলে আসে এই বুঝি বাস চলে গেল আর গাইড আমাকে ফাঁকি দিল। বর্ধমানে রমনার বাগানে একবার স্যারদের সাথে গিয়েই শখ মিটে গিয়েছিল – স্যার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি সব বলছে আর আমরা ছেলেপুলেরা স্যারকে ঘিরে ধরে ঠেলাঠেলি করে কাছে গিয়ে কি বলছে সেটা শোনার চেষ্টা। ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়!

    একবার চীনে কনডাকটেড ট্যুর নিয়েছিলাম সবার সাথে বাধ্য হয়ে – ওই ভাষার সমস্যার জন্য। তো সে গাইড ফরবিডেন সিটি-তে নিয়ে গিয়ে তার ইতিহাস বলবে কি, সম্রাটের সেক্স লাইফ নিয়েই ভাঁট দিয়ে গেল প্রায় এক ঘন্টা! তেরো হাজার না কত হুরী-পরী রেখেছিল রাজা সেই গাইডের মতে।

    তো যে কথা বলা, এই কনডাকটেড ট্যুরে গেলে আপনারা তো সবাই জানেন যে কিছু কিছু কর্মাশিয়াল জায়গায় ওরা স্টপ দেবে স্যুভেনিয়র কেনার জন্য। আর যারা কেনেন তাঁরা অনেকেই জানেই এই সব বেশীর ভাগটাই সাজানো – আপনি অন্য জায়গা থেকে কিনলে আরো ভালো এবং হয়ত আরো কম দামে জিনিস পত্র পেয়ে যাবেন। এমনকি আপনি যদি নিজে প্ল্যান করে ট্যুরে যান, তাহলেও আপনার ড্রাইভার চেষ্টা করবে এমন কোন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে। সবই কমিশনের ব্যাপার আর কি – আসলে অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোতে ট্যুরিষ্টদের দিকে চেয়ে অনেকে বসে থাকে – একটু ঠকানোর ব্যাপার ও থেকে যায় বৈকি।

    তবে এমন নয় যে সব শ্যুভেনিয়র দোকানই দুনম্বরী বা ঠকাচ্ছে। কিন্তু আপনি যদি বেশী দিন সেই দেশে না থাকেন বা আগে থেকে খোঁজ খবর নিয়ে যান, তাহলে হয়ত মালুম করতে পারবেন না যে আপনি ঠকছেন কিনা। এই সব জেনে শুনেও অনেক জায়গায় এমন টুরিষ্ট ট্র্যাপ গুলো থেকে জিনিস কিনেছি খুব পছন্দ হয়ে গেলে। তেমনই এক ঘটনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে ভিয়েতনামে গিয়ে।

    হ্যানয় শহর থেকে হ্যালঙ-বে যাচ্ছিলাম – গাড়ি করে অনেকক্ষণের রাস্তা। গাড়ি করে আমি, অমৃতা আর ড্রাইভার। এবার রাস্তায় ব্রেক নেবার দরকার হলে ড্রাইভার নিয়ে গেল তেমনি এই ট্যুরিষ্ট ট্র্যাপে। টয়লেট ব্যবহার করতে হবে, কিছু করার ও ছিল না। দোকানে ঢুকলাম – এবং গিয়ে এমন এক জিনিসের খোঁজে পেলাম যেটা নিয়ে আমি আগে থেকে জেনে যাই নি যে সেটা ওখানেই থাকবে।

    জানা ছিল যে ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে আমেরিকা যে বিষাক্ত গ্যাস ‘এজেন্ট অরেঞ্জ’ ছড়িয়ে ছিল তাতে অনেক অনেক লক্ষ মানুষের প্রভূত ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল। হো-চি-মিন শহরে আছে সেই বিখ্যাত ওয়ার-মিউজিয়াম। এবং সেই মিউজিয়ামের একদিকে আছে ছবির প্রদর্শনী – যাতে দেখানো হয়েছে এজেন্ট অরেঞ্জের বিভৎসতা। সেই সব ছবি এতই ভয়ঙ্কর যে বেশীক্ষণ দেখা যায় না মনের খুব জোর না থাকলে। অমৃতা বেশীক্ষণ দেখতে পারে নি সেই ছবি – ইনফ্যাক্ট সেই পুরো ওয়ার মিউজিয়ামটাই কেমন এক নিষ্ঠুর সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।

    আমেরিকা এজেন্ট অরেঞ্জ ছড়িয়েছিল মূলত ফসল এবং গাছপালা ধ্বংস করতে। নর্থ ভিয়েতনামে যাতে করে খাদ্য সরাবরাহ না করা যায় সেই ব্যবস্থা করতেই চাষ আবাদ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া। কথিত আছে প্রায় ৩০ লক্ষ লোকের স্বাস্থ্য খারাপ হয়েছিল এই গ্যাসের জন্য – লিউকেমিয়া, ক্যান্সার এবং আরো অনেক অনেক পঙ্গুত্ব গ্রাস করেছিল অসহায় মানুষের। এটাও জানা ছিল যে সেই যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত-পঙ্গু মানুষের পুনর্বাসনের জন্য ভিয়েতনাম সরকার অনেক প্রকল্প চালু করেছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে তাদের হাতের কাছ শিখিয়ে সেই হস্তশিল্পের জিনিস বিক্রী করা। এটা জানা থাকলেও, আমি জানতাম না যে এমন এক সেন্টারের মুখোমুখি হয়ে যাব সেই হ্যানয় থেকে হ্যালং-বে এর মধ্যের রাস্তায়।

    এটুকু কমন সেন্স যে অনেক ব্যবসায়ী এবং ট্যুরিষ্ট ট্র্যাপ আছে যেখানে এই যুদ্ধ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ-দের সেন্টিমেন্ট ভাঙ্গিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছে। আপনার সামনে হয়ত দেখবেন দুই-চার জন্য পঙ্গু মানুষ কাজ করছে, এবং বলা হচ্ছে যে আপনি যা কিনছেন সেটা ওদের তৈরী এবং দামের একটা বড় অংশ সেই পঙ্গু শিল্পী পাবে। আমি আর অমৃতা নিজেদের মানসিক ভাবে প্রস্তুত করে সেই দোকানে ঢুকলাম। সাথে সাথে পিছনে পিছনে এক সেলসের মেয়ে চলে এল – আমরা কয়েকবার বলে তাকে পাশ কাটালাম, বললাম যে আমাদের ইন্টারেষ্ট নেই কিছু কেনার। টয়লেট গিয়ে সেই দোকানের ভিতরে একটা খাবার জায়গায় বসে ঠান্ডা পানীয় খাচ্ছি, হঠাৎ চোখে পড়ল সেই অপূর্ব এমব্রয়ডারী করা কাজ গুলোর দিকে।

    খাওয়া শেষ করে একটু ঘুরতে ঢুকলাম সেই এমব্রয়ডারী করা কাজ গুলোর দিকে – বেশ চোখ ধাঁধিয়ে গেল। দেখলাম প্রায় জনা কুড়ি বয়ষ্ক মানুষ একমনে তৈরী করছে এমব্রয়ডারী গুলি। তারা সবাই ওই যুদ্ধ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত এবং পঙ্গু। এমব্রয়ডারী পেন্টিং গুলো উল্টেপাল্ট দেখতে লাগলাম – প্রতিটি ছবির পিছনে দাম লেখা আছে ডং (ভিয়েতনামের মুদ্রা) এবং ডলারে। এবং বেশ দামী – ততদিনে ভিয়েতনামে ঘুরে এবং বিশেষ করে সেই দোকানের মালিক যেখানে চাইনীজ সেটা দেখে নিয়ে বুঝে গেলাম দরদাম না করে কেনা যাবে না। বয়ষ্ক শিল্পীরা ইংরাজী বলতে পারেন না ঠিক। তবে হঠ করে দেখা হয়ে গেল একটু বয়েছে ছোট মেয়ের সাথে তার দিদিমা/ঠাকুমা দেখালো বসে কাজ করছে। সে স্কুলে ছুটি বলে ঠাকুমার কাছে এসেছে কি দরকারে। সেই মেয়ে ইংরাজী বলতে পারে – এবং অমৃতার দৌলতে তার সাথে কথা বলা গেল। তার কাছ থেকেই জানতে পারলাম যা দামে সেই এমব্রয়ডারী বিক্রী হবে তার ৬০% পাবে সেই শিল্পী। এই দাবী কতটা সত্যি আমি বলতে পারব না, কিন্তু মেয়েটির কথা আমাদের বিশ্বাসযোগ্যই মনে হল। তবে তার থেকেও বড় কথা অমৃতা ততক্ষণে একটা এমব্রয়ডারী পেন্টিং পছন্দ করে ফেলেছে। সিল্কের সুতো দিয়ে বোনা – হাতে করে পুরোটা বোনা। বেশ বেশ দামী সেই এমব্রয়ডারীটা।

    ততক্ষণে আমাদের ঘুর ঘুরে করতে দেখে আবার সেলসের মেয়েটি চলে এসেছে – সেলস মেয়েটিকে আসতে দেখে নাতনী হাওয়া। আমরা হালকা দরদাম করার চেষ্টা করলাম – আমি একদমই পারি না দরদাম করতে। অমৃতা বেশ ভালোই পারত – কিন্তু ওই যে জেনে ফেলেছি যা দাম দেব তার ৬০% পাবে সেই বৃদ্ধা – এর পর আর বেশী দরাদরী করতে ইচ্ছা করল না। সেলসের মেয়েটি জানালো ছবির পিছনে শিল্পীর নাম লেখা আছে – বিলিং হবে তেমন ভাবে এবং শিল্পী তার টাকা পেয়ে যাবে। আমরা বিশ্বাস করলাম

    এই সেই ছবি – সিল্কের সুতোর কাজ, মালয়েশিয়া থেকে আমাদের চেনা ছেলেটিকে দিয়ে বাঁধিয়ে এনেছিলাম। এখন আমাদের বাড়িতে শোভা পাচ্ছে বসার জায়গায়। আমাদের বড় প্রিয় ছিল – এখনো তাই।






    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১২ জানুয়ারি ২০২০ | ২৩৬১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ***:*** | ১২ জানুয়ারি ২০২০ ০২:৪২51316
  • সুকির লেখা পড়তে সব সময়ে ইন্টারেস্টেড।
  • de | ***:*** | ১২ জানুয়ারি ২০২০ ০৪:৪৫51317
  • বাঃ! সুন্দর লেখা!
  • সুকি | ***:*** | ১২ জানুয়ারি ২০২০ ০৬:৫২51315
  • এগুলো কয়েকদিন আগে থেকে লেখা শুরু করেছিলাম, ফেসবুকে পোষ্ট করেছিলাম। এখানেও দিয়ে যাই, যদি কেউ ইন্টারেষ্টেড থাকেন পড়তে।
  • সুকান্ত ঘোষ | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৮:৫৯91030
  • গোলাপী পাথর (রোজ স্টোন) – তাইওয়ান
    ------------------------------------------------------

    তাইওয়ানে আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু বসবাস করে – সব একসাথে ইংল্যান্ডে থাকতাম ও পড়াশুনা করতাম। পড়াশুনা শেষে ওদের অনেকে যখন দেশে ফিরে গেল, তার পর থেকেই মাঝে মাঝে বলত সেখানে বেড়াতে যেতে। একসময় তাই সময় বের করে ঘুরতে গেলাম তাইওয়ান – তবে সেই ঘুরতে যাবার গল্প অন্য এক সময় – এই পর্বে থাক সেই ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য অলঙ্কার “পাহারাদার সিংহ” (Guardian Lion) এর গল্প।

    এই পাহারাদার সিংহ ধারণার জন্ম আদিতে চীনে এবং পরে তা চৈনিক বুদ্ধধর্মের সাথে এক প্রতীক হয়ে জুড়ে যায়। প্রথম দিকে চীনে রাজ-রাজাদের প্রাসাদ এবং সমাধিক্ষেত্রে এর ব্যবহার হলেও ক্রমশঃ এর জনপ্রিয়তা বেড়ে ছড়িয়ে পরে এশিয়ার অন্যদেশে – জাপান, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কাম্বোডিয়া, নেপাল, তিব্বত, বার্মা, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা এবং লাওস-এ। চীনাদের বিশ্বাস ছিল যে এই পাহারাদার সিংহের মধ্যে কিছু একটা আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে যা দিয়ে সে প্রাসাদ এবং বাড়িঘর রক্ষা করবে অশুভ শক্তির হাত থেকে। নানা কিসিমের সিংহ নানা ভাঙ্গীতে দেখা যেত কারণ দীর্ঘদিন ধরে নানা সম্রাট ও সাম্রাজ্যের সময়কালে মধ্যে দিয়ে বিবর্তিত হয়েছেন তিনি। তবে আজকালকার যে ফর্ম আমরা দেখতে পাই সিংহের, তা মূলত দাঁড়িয়েছে মিং এবং কুইং সম্রাটদের সময়কালের আদর্শায়নের ফলে।

    সঙ্গের ছবিগুলি তেমনি এক গার্ডিয়ান লায়নের স্থাপত্য মূর্তির ছবি। অমৃতার পছন্দ করা এটা আমরা কিনেছিলাম তাইওয়ানের সেই হুয়ালিন প্রদেশ থেকে। তবে এটা কিন্তু সাধারণ পাথরের মূর্তি নয়, এর বিশেষত্ব এই যে এই মূর্তি একটু দুঃস্প্রাপ্য ‘রোজ স্টোন’ বা গোলাপী পাথর দিয়ে বানানো।

    তাইওয়ানে যাকে ‘রোজ স্টোন’ বা গোলাপী পাথর বলা হয় তা আদপে খনিজ হিসাবে ‘রোডোনাইট’ (Rhodonite)। এদের রং গোলাপী, গোলাপ-লাল বা বাদামী-লাল হতে পারে। এই পাথরের মধ্যিখানে মাঝে মাঝে সাদা স্ট্রাইপের মত এবং অনেক সময় কালো রঙের ম্যাঙ্গানিজ অক্সাইডের প্যাচও থাকে। তাইওয়ানে রোডোনাইট মূলত হুয়ালিন প্রদেশের সিমোশন এবং লিউউ, মুগুয়া এবং সানজান নদীর তীরে দেখা যায়। আজকালকার দিনে বেশী ভাগ রোডোনাইটই ব্যবহৃত হয় সজ্জার পাথর হিসাবে বা গহনা বানানোর কাজে।

    জাপানের উপনিবেশের আমলে রোডোনাইট প্রথম তাইওয়ানে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল ১৯৩১ সাল নাগাদ, সিমোশন নদীর ধারে। ক্রমে ক্রমে আরো রোডোনাইট খুঁজে পাওয়া গেল হুয়ালিন নদীর উপত্যকায় এবং সানজান নদীর ধারে – তাই সানজান নদীকে ‘গোলাপী নদী’-ও বলা হতে লাগল। ১৯৮০ সালের মধ্যে রোডোনাইট খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠল সজ্জার এবং গহনায় ব্যবহারে। কিন্তু তখনো পর্যন্ত এই রোডোনাইট সংগ্রীহিত হত ব্যক্তি মালিকানায় – কারণ জেম-স্টোন হিসাবে সরকারী ভাবে তখনো রোডোনাইট-কে খনন করা হয় নি। এর ফলে কালক্রমে যা হবার তাই হল – রোডোনাইট ক্রমশ দুঃস্প্রাপ্য হয়ে উঠল যোগান কমে যাবার জন্য। দাম বাড়তে বাড়তে আকাশছোঁয়া হয়ে গেল এবং লোভী মানুষ বেআইনী ভাবে খননকার্য চালিয়ে যেতে লাগল টাকার লোভে। এখনকার দিনে রোডোনাইটের বেশীর ভাগটা রয়েছে টারোকো ন্যাশানাল পার্কে এবং ন্যাশানাল পার্কের নিয়ম অনুসারে সেখানে রোডোনাইটের খননকার্য নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে।

    তাইওয়ান ছাড়াও রাশিয়া এবং চীনের মত কয়েকটি জায়গায় রোডোনাইট রয়েছে, কিন্তু তাইওয়ানের জাতটি বিশেষভাবে আকর্ষণীয় তার অনন্য রঙ এবং পাথরের অভ্যন্তরে শিরাজালিকার অবস্থানের জন্য। তাবলে কিন্তু ভাববেন না যে গোলাপী পাথর হুয়ালিন নদীর ধারে ছড়িয়ে আছে, আপনি সময় করে গেলেন আর টুক করে তুলে নিলেন! ইনফ্যাক্ট সঠিক রোজ স্টোন খুঁজে পাওয়া বেশ চাপের ব্যাপার – শ্রমের ব্যাপারটা ছাড়াও চাই চিনে নেবার ক্ষমতা। স্বাভাবিক প্রাকৃতিক অবস্থায় এই রোডোনাইটের বাইরে কালো রঙের প্যাটিনা দ্বারা ঢাকা থাকে। ব্যাপারটা অনেকটা হীরের খনির মত ব্যাপার আর কি! কাটিং ইত্যাদির ব্যাপার আছে। যদি একটা পাথর সঠিক ভাবে কেউ নামাতে পারে তবে তার দাম স্থানীয় লোকের বেশ বেশ কয়েক মাসের মাইনের থেকেও বেশী হতে পারে।

    আমরা কিনলাম একটা ‘গার্ডিয়ান লায়ন’ এর মূর্তি। খুব বড় কিছু নয়, কিন্তু আসল রোজ স্টোনে তৈরী। এই জিনিসের বড় কেনা প্রায় ক্ষমতার বাইরে – এটা কিনতেই বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। তবে কিনা কালেকটরস্‌ আইটেম টাইপের। খুব অপূর্ব দেখতে – গোলাপী, মাজে মাঝে হালকা সাদার আভাস এবং কালো স্ট্রাইপ – এই সব বৈশিষ্ট আছে বলেই এর দাম এত বেশী।

    আমি জিজ্ঞেস করলাম এর দাম এত বেশী হবার কারণ কি। আসলে ব্যাপারটা বোঝা খুবই সহজ – একে তো মূল পাথরের বাইরেটা কালো। মানে আপনি জানছেন না ভিতরে কি রং কেমন আছে। এবার কাটতে শুরু করলেন আপনি – এদিক ওদিক কেটে ফেললে ঠিক মত কালো বা সাদা স্ট্রাইপ গুলো আসবে না। মানে আপনার প্রোডাক্ট মার খেয়ে গেল। এই ভাবে ব্যালেন্স করে কেটে স্থাপত্য বানায় এবং তাতে অনেকটা ভাগ্য জুরে থাকে বলে বেশী দাম নিয়ে সব পুষিয়ে নেয়। কেনার পর থেকে আমাদের আলমারিতে রাখা ছিল সেই গার্ডিয়ান লায়ন – দরজার দিকে মুখ করে। ব্রুনাই থেকে আসার পর এই এত দিন পরে প্যাকিং বাক্স খুলে তিনি বেরোলেন। সেই আগের মতই আবার তেনাকে রাখলাম কাঁচের আলমারীতে মূল দরজার দিকে মুখ করে।







  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন