খবরটা হয়তো অনেকেই পড়েননি। এমনকি "আমচী পুণে" র বাসিন্দারা, যার মধ্যে ৩-৪ লাখ বাঙালি আছে, বাঙালি মহিলা আছে, কন্যা সন্তানের বাবা-মারা আছে, তাদেরও অনেকের নজর এড়িয়ে গেছে খবরটা।
গত ২৫ শে ফেব্রুয়ারি ভোর সাড়ে পাঁচটায় একজন ২৬ বছরের তরুণী স্বাস্থ্যকর্মী দূরপাল্লার বাস ধরে নিজের দেশের বাড়িতে পৌঁছানোর জন্য পুণের স্বারগেট বাস টার্মিনাসে নিজের গন্তব্যস্থলগামী সরকারি বাস খুঁজছিল। এক যুবক তাকে "দিদি, দিদি" ডাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া সুরে দেখিয়ে দেয় একটি অন্ধকার সরকারি "শিবশাহী" বাস। মেয়েটি বলে ওটা তো অন্ধকার, ওটা কী করে যাবে? ছেলেটি বলে, না ওটাই যাবে, বাসভর্তি লোক আছে, সবাই ঘুমোচ্ছে। এমনটা যে একেবারে হয়না তা নয়। অনেক সময়ই দূরপাল্লার বাসের ড্রাইভাররা এইভাবেই কোন একটা বাস স্টেশনে বাস দাঁড় করিয়ে বিশ্রাম নিতে যায়। মেয়েটিও তাই ভেবে বাসে ওঠে, ওই ছেলেটির ফাঁদে পড়ে, এবং ধর্ষিতা হয়। না, ছেলেটি তাকে খুন করে ফেলেনি। কিন্তু অভয়া কান্ডের সাথে একটা মিল আমি খুঁজে পাই: দুটোর ই অকুস্থলে এয়ারকন্ডিশনার ছিল, অর্থাৎ দরজা-জানলা বন্ধ।
মেয়েটি ছাড়া পেয়ে পুলিশকে জানায়। অত বড় টার্মিনাস, চতুর্দিকে সিসিটিভি। ফুটেজ খুঁজতে সময় লাগেনি। অপরাধী চিহ্নিত করাও গেল। অপরাধী কয়েকদিন লুকিয়ে ছিল, তার সন্ধানের জন্য পুরস্কার ঘোষণাও হল। পুরস্কার দেওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল কিনা জানি না, কিন্তু অপরাধী ধরা পড়লো। এবং তারপরেই ঘটনার মোড় ঘুরতে শুরু করেছে।
অপরাধীর উকিল আদালতে জানিয়েছে যে, মেয়েটির শরীরে নাকি অন্য কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না। সেটা প্রমাণ করে যে সে স্বেচ্ছায় নিরিবিলি বাসে আনন্দ করার জন্য অপরাধীর সঙ্গে গিয়েছিল। এটাকে ধর্ষণ বলে না।
এর পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা মনে পড়ছে। সাক্ষ্য ও তথ্য প্রমাণ যাই বলুক না কেন, এবং মহামান্য আদালত যাই রায় দিক না কেন, গত আগস্ট মাস থেকে আজ পর্যন্ত দেখছি বেশিরভাগ লোকই এটা বিশ্বাস করে ফেলেছে যে অভয়ার মৃত্যুর কারণ গণপিটুনিতে খুন এবং খুনের মোটিভ হল হাসপাতালে বিভিন্ন চক্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
খুব সুচতুরভাবে একটা কথা অনেক নেতৃস্থানীয়দের প্রচার করতে দেখেছি সেই রাত দখলের আগের দিন থেকে, অভয়ার জায়গায় কোন প্রতিবাদী ছেলে থাকলে তার ও একই দশা করা হত, কারণ ধর্ষণ তো হয়নি!!! নারী সুরক্ষার দাবির প্রশ্ন তো তাই এই মুহূর্তে ওঠেই না! ওটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে।
এর সপক্ষে যে যুক্তি বা তত্ত্বগুলো খাড়া করা হয়েছে, অবাক হয়ে দেখি, অনেক উচ্চশিক্ষিতা, উচ্চপদস্থা মহিলাও সেগুলো তোতা পাখির মত বলে যাচ্ছে:
১) একা একজন পুরুষ কিছুতেই নাকি একজন প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাকে ধর্ষণ করতে পারে না।
২) ঘুমন্ত অবস্থাতেও যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক মহিলার নাকি শরীর ও মন ততটাই সজাগ থাকে, যাতে সে পুলিশ বা গুন্ডা বা যে কোনো বলশালী পুরুষের হাত থেকে ধর্ষণ এড়াতে পারে। যদি সে মহিলা ডাক্তার হয় তাহলে নাকি আরোই অসম্ভব কারণ সে পুরুষ এবং নারী এনাটমি খুব ভালো করে জানে।
৩) মাতালরা সোজা হয়ে হাঁটতেই পারেনা, ধর্ষণ করবে কি করে! একটা ল্যাং মারলেই তো উল্টে পড়বে!
৪) নিচু পদের কর্মীরা, যেমন দারোয়ান এবং সিভিক ভলেন্টিয়াররা মহিলা ডাক্তারদের অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখে, দিদি বলে ডাকে। যারা দিদি বলে ডাকে তারা কি ধর্ষণ করতে পারে!
অভয়াকান্ডের আন্দোলন যে আন্তর্দলীয় রাজনৈতিক রেষারেষি এটা এখন সবার কাছেই পরিষ্কার। কিন্তু “একা কোন পুরুষ ধর্ষণ করতে পারে না” তত্ত্বটি কাদেরকে লাভবান করছে? নারী বিদ্বেষী, পিতৃতান্ত্রিক কারা তারা? সমাজমাধ্যমে বিক্ষিপ্তভাবে তাদের দেখি ট্রল করতে, কিন্তু এতটা সঙ্ঘবদ্ধ প্রচার, যা শিক্ষিত নারীকে তার নারী হিসেবে সুরক্ষার অভাব বিস্মৃত করে দেয়?
পুণের কথায় ফেরত আসি। এখন বোধহয় পশ্চিমবঙ্গে এমন কোন পরিবার নেই যাদের পরিবারের কেউ বা ঘনিষ্ঠ কেউ পুণের বাসিন্দা নয়। গত ত্রিশ বছরে তথ্যপ্রযুক্তির রমরমার সাথে সাথে অতিদ্রুত বেড়েছে কম বয়সী মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের বাঙালির সংখ্যা। কেউ বা ছাত্র হিসেবে, কেউ বা কর্মী হিসেবে এসেছে এখানে। অনেকেই রয়ে গেছে পাকাপোক্তভাবে। তাল মিলিয়ে নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালিও প্রচুর এসেছে ভাগ্য অন্বেষণে। পুণের প্রচুর সুনাম। একসময় আবহাওয়া ছিল অতি মনোরম। তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্র হয়ে ওঠার সাথে সাথে আধুনিক জীবনের কিছু কিছু সুযোগ-সুবিধে এখানে সহজলভ্য। ন গজ শাড়ি পরিহিতা মহিলারা একসময় পাহাড়ে চড়া থেকে শুরু করে, লুনা হাঁকিয়ে রাজ্য জয় করে বেড়াত। আমরা, পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ করে কলকাতার বাসের ট্রামে ট্রেনের ভিড়ে বাঙালি পুরুষদের যে রূপে দেখে অভ্যস্ত ছিলাম, মহারাষ্ট্রের পুরুষরা সাধারণভাবে তার চেয়ে অনেক সভ্য ভদ্র।
গত ত্রিশ বছরে মহিলা কর্মীদের সংখ্যা অনেক অনেক গুণ বেড়েছে পুণেতে। এরমধ্যে প্রচুর বাঙালি মহিলা ও আছে। ন গজী শাড়ি এখন পারিবারিক অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ। পশ্চিমা পোশাকের চল বেড়েছে বহুগুণ। বহু মহিলা "লিভ টুগেদার" এ থাকে, এবং এদের মধ্যে অনেকেরি বাবা মা এ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল।
স্বাভাবিকভাবেই পুণে "নিরাপদ শহরের" তকমা পেয়েছে।
কিন্তু সত্যিই কি পুণে ততটাই নিরাপদ?
গত ২০ বছরে বহু উচ্চশিক্ষিত, উচ্চপদস্থ মহিলা কর্মী খুন হয়েছে পুণেতে। বেশিরভাগই তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী। এই খুনগুলির মধ্যে বেশ কিছু ধর্ষণ ও আছে। এর মধ্যে আছে ২০১৭ সালে ইনফোসিস এর অফিস বিল্ডিং এর মধ্যে মহিলা কর্মীর খুন ও ধর্ষণের ঘটনা ও। এগুলো নিয়ে কেউই তেমন কোন আলোচনা তো করেই না, খুব সহজে ভুলে গেছে মনে হয়। বাঙালি তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী একটি মেয়ে তার অফিস বিল্ডিং এর সামনে খুন হয়। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা মেয়ে- তার বাবা মা পশ্চিমবঙ্গের প্রান্তিক জায়গা থেকে এসে দৌড়োদৌড়ি করেও দোষী ধরা পড়ে না। মেয়েটির প্রাক্তন প্রেমিক প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যায়। ২০০৫ সাল নাগাদ আইনের ছাত্রী একটি বাঙালি মেয়েকে প্রেমিকের সাথে গল্প করার অপরাধে পুলিশবেশী একজন থানায় নিয়ে যাওয়ার ছুতোয় পুণা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্যে ঝোপঝাড়ে টেনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। পুনের প্রায় প্রতিদিনের খবরের মধ্যে কোন না কোন নারী নির্যাতনের ঘটনা থাকে, সেখানে ৮৫ বছরের বৃদ্ধা থেকে কিন্ডারগার্টেনের শিশু কারুর রেহাই নেই!
নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধ ছাড়াও গুণ্ডামি, ছিনতাই, ধনী সন্তানের দামী গাড়ির নিচে জনগণের পিষে যাওয়া এবং টাকার জোরে চোখের সামনে সেগুলো ধামা চাপা দেওয়া এগুলো এখানে এত নৈমিত্তিক ঘটনা যে বাংলা কাগজেরা ক্লান্ত হয়ে পড়ত সব খবরকে নাটক বানাতে গিয়ে।
অভয়ার নাম নিয়ে পুণের বাঙালিরা প্রতিবাদ মিছিল টিছিল করেছে। যে পশ্চিমবঙ্গ তারা ছেড়ে এসেছে, যেখানে তাদের ভোট আর নেই, সেইখানের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে তাদের বক্তব্য। কর্মরতা মহিলাদের কর্মস্থলে সুরক্ষা চাওয়া নয়। এমন কি, যে পুণে তে প্রতিদিন এখানে ওখানে যে সব নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, সে সব যে যেকোনো দিন নিজের ঘরেই ঘটতে পারে, সেই বিষয়ে কোনোদিন কোন সংঘবদ্ধ প্রতিবাদের উদ্যোগ দেখি না। ভোরবেলা, মাঝরাতে কত বাঙালি মেয়েকে ই তো প্রতিদিন একলা একলা বাস ধরতে যেতে হয়।
সেদিনের বাসে ধর্ষিতার চরিত্রহনন করে যে সব বয়ান এখন ঘোরা শুরু হয়েছে, মেয়েটির উকিল তার প্রতিবাদ করেছে। হায় রে! এখনো ধর্ষিতাকেই প্রমাণ করতে হবে সে দোষী নয়! ২০০৫ সালে আইন ছাত্রী যে বাঙালি মেয়েটি ধর্ষিতা হয়েছিল, তার কলেজ এবং সংলগ্ন আরেকটি আইন কলেজ, দুটিই ভারতে সুবিখ্যাত, সেখানে বাঙালি ছাত্রীরা বিশ্বাস করে নিয়েছিল যে মেয়েটি চরিত্রহীন। সে নাকি গর্ভবতী ছিল, বাড়িতে সেটা লুকানোর জন্য ধর্ষণের গল্প ফেঁদেছিল! অথচ, এই ঘটনা যে সময়ে ঘটে, তখন ওই অকুস্থল অর্থাৎ পুনে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের মধ্যে আমি নিজেও থাকতাম। তখনকার নতুন উপাচার্য হঠাৎ ছেলেমেয়েদের একসাথে বসে গল্প করা, প্রেম করা ইত্যাদির ওপর কড়াকড়ি শুরু করেছিলেন, যার ফলস্বরূপ ক্যাম্পাস সন্ধ্যে হতেই শুনশান হয়ে যেত। পুলিশ থানা ও ক্যাম্পাসের মধ্যে বটে, কিন্তু ৭০০ একর জায়গাটার বেশিরভাগই তখন ছিল গাছ-গাছড়া, ঝোপ জঙ্গল ভরা। একটা ১৮-১৯ বছরের বাচ্চা মেয়েকে বিদেশ বিভূঁই তে যদি কেউ বলে আমি পুলিশ, থানায় চলো, তাহলে তাকে বিশ্বাস করে তার সাথে বাইকে ওঠা বাঙালিদের কাছে অবিশ্বাস্য লেগেছিল? এ ঘটনার ও "ফলোআপ" কিছু শুনতে পাইনি। বাঙালিরা বলেছিল, মেয়েটির বাড়ির লোক সব ধামাচাপা দেবে বলে কলকাতা নিয়ে চলে গেছে। অর্থাৎ বাঙালিরা বিশ্বাস করে একজন পুরুষের দ্বারা কিছুতেই ধর্ষণ হয় না!
রবীন্দ্রনাথের লেখা মনে পড়ছে। যোগাযোগের কুমু অপমানিত বোধ করে স্বামীর শয়নঘর ছেড়ে শুতে যায় কয়লা ঘরে। তার সেই তেজ ভাঙার জন্য তার গর্বিত স্বামী মধুসূদন কয়লা ঘরে গিয়ে যেটা করে, তাকে ধর্ষণ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। রবীন্দ্রনাথ এসব ঘটনার কোন ডিটেইল বর্ণনা দেননি। জানতেন প্রাপ্তমনস্করা এমনি বুঝতে পারবে ঘটনার বীভৎসতা। কুমুদিনী কি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল? মনে হয় না। ঘটনার আকস্মিকতায় সে হতবাক হয়ে গিয়েছিল, তার সাথে ঘৃণায় তার সারা শরীর অবশ হয়ে গিয়েছিল নিশ্চয়ই। আর তার উপরে, ওই লোকটা তো তার স্বামী! চিৎকার করা বা বাধা দেওয়া মানে তো লোক জানাজানি হওয়া!
রবীন্দ্রনাথ পুরুষ মানুষ হয়ে যেটা বুঝেছেন, বাঙালি উচ্চশিক্ষিত, উচ্চপদস্থ মহিলারা সেটা কবে বুঝবে?
আজ তো মনে হয়, যদি অভয়া অপরাধী কে আঁচড়ে কামড়ে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা না করত, যাতে অপরাধীর "পৌরুষ" চার গুণ বেড়ে উঠে তাকে গলা টিপে না মারত, যদি ভয়ে অবশ হয়ে ওই লোকটাকে তার ইচ্ছেমতো ভোগ করতে দিত, এবং প্রাণে বেঁচে যেত, তাহলে তো পুরো ন্যারেটিভ ই বদলে যেত। অভয়াকেই তখন প্রমাণ করাতে হতো যে সে নির্দোষ!
আজ নারী দিবসে উচ্চশিক্ষিতা, প্রতিষ্ঠিতা নারীরা যদি বকলমে পিতৃতান্ত্রিকতার প্রতিভূ হওয়া বন্ধ না করেন, যদি কর্মক্ষেত্রে, পথে-ঘাটে এবং সংসারে নারীর অত্যাচারের জায়গা গুলোকে খুঁটিয়ে বোঝার চেষ্টা না করেন, তাহলে নারী দিবস একটা ইভেন্ট মাত্র হয়েই রয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে এই সমাজ ব্যবস্থায় কোনো নারী রাষ্ট্রপ্রধান ও নিরাপদ নন।