এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • ওয়াতন

    Supratik Chakraborty লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ৩৯ বার পঠিত
  • আসানবনির জঙ্গল নিয়ে বুদ্ধদেব গুহর কোনো লেখা আছে?? আই ডোন্ট নো! ওঁর গামহারডুংরীটা পড়ে ছিটকে গেছিলাম। বীরসা মুন্ডার ওই গ্রামে ছিলাম বেশ কয়েকদিন। ব্ল্যাকহোলের মতো অন্ধকার!  অ্যাকচুয়ালি এমন কিছু নিসর্গের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো দরকার, ভেতরটা যাতে ব্ল্যাঙ্ক হয়ে যায়! বিয়ন্ড অফ লাইফ অ্যান্ড ডেথ,কিছু একটা..প্রকৃতি, মাদার, তুমি উচ্চ আমি তুচ্ছ! শক্তির মহিমা উপেক্ষা করতে পারা যায় না! এক বীভৎস ডার্কনেস, ব্লাইন্ড ভিশন,মহামায়া অরণ্য,গোবিন্দ উনুনে ভাত চাপিয়েছে। বারান্দার এক কোণে কেরোসিনের কুপি!কাল বনমুরগী খেয়েছিলাম। কলপাড়ে মুরগীটার মাথা মুচড়ে ভেঙে দিল গোবিন্দ! আর্তনাদ। খাদ্য আর খাদকের অমীমাংসিত সংঘাত। আজকেও ওর হাতে মুরগী।
    গোবিন্দ মূর্মূ বাসন মাজতে মাজতে শোনাচ্ছিল সেসব কথা। তুঁত গাছটার পিছনে কবর আছে একখানা! এখানকারই একজন জলে ডুবে মরেছিল কোনকালে, গোবিন্দর কুঞ্চিত ভ্রু! প্যাটে জল নাই! তাইলে মরল কেমনে?
    ডানদিকে পাহাড় খাড়া উঠে গেছে। হামাগুড়ি দিয়ে হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠেছিলাম কিছুক্ষণ আগে। একটা জরাজীর্ণ বাংলো, দুজন সাঁওতাল বৃদ্ধ ছাড়া আর কাউকে দেখিনি। নধর ছাগল, হোগলা পাতার বন! বন মুরগীর এদিক  দ্রুত সঞ্চারন!
    বাংলোয় আগে আলো জ্বলত। সাঁওতালি মেয়েদের ধরে এনে ফূর্তি করত বাবুরা! ধিকি ধিকি আগুনে শুয়োর পোড়াত! ঝলসে উঠলে টকটকে লাল চর্বিটা জলে ভিজিয়ে, সাথে তাড়ির ঝাঁঝ! গোবিন্দ খায় না এসব। ও আর ওঁর বউ  মহাদেবের ভীষণ ভক্ত! বউয়ের পেটে লাফাচ্ছে নতুন প্রাণপিন্ড! খুশী ও। প্রথম সন্তান। হাতে রাজ্যের মাদুলি!
    এত মাদুলি কিসের?
    বুইঝবেন না! রাইতে মাসানজোড়ের জঙ্গল পাইর হইতে হয়! ওদের বেরোনোর সময় ওইটা!
    ওদের মানে?
    ভূত!
    প্রেতের বাসা নাকি মাসানজোরের জঙ্গলে! বহু লোক আর ফেরেনি! লক্ষী পূর্ণিমার পরের একাদশীতে সেই জঙ্গলে মাদল আর ধামসা বাজে! আগুন জ্বেলে ওরা নাচে! বনবাদ্যে মুখরিত হয় রাত্তির।
    আমাকে নিয়ে যাবে গোবিন্দ দা?
    -শিবে ভক্তি থাইকতে হবে! তবেই....
    - আছে! ভয়ানক ভালোবাসি ওনাকে আমি। সাক্ষাৎ মহাকাল!
    সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়! আগুন জ্বলবে। লাল মাটির দেশ। মেহগনির শুষ্ক গভীর জঙ্গল! গোবিন্দর হাতে  দেখলাম একটা দাঁ। মুরগী টাকে কেটে ফেলল এক লহমায়! ওঁর বাম হাতে ধরে থাকা অসহায় ক্ষুদ্র নরম ফুসফুস দপ দপ করছে! গোবিন্দর হাতে টাটকা রক্ত!
    আকাশে মেঘ করেছে আবার। মাসানজোর ভিজবে।
    দ্য প্লেজ ফুল অফ প্লেজার! সামনেই ময়ুরাক্ষী! সনাতন কিশকুর বাড়ির পাশ দিয়ে আরো ওপরের দিকে আরোহন করলে পাহাড়পুর গ্রাম। অ্যাবসোলিউট লাইক অ্যান ইমেজ। জলের ওপর মেঘের শরীর, বারিষের আগের বায়ু সঞ্চার। সনাতনের বউ মারা গেছে! সাঁওতাল অকুপায়েড!  সে এক পিকিউলিয়ার দৃশ্য চলে এল সামনে! সনাতনের সাথে এদিক ওদিক ঘুরছি, হঠাৎ বাঁশির সুর...হিপনোটিক। শরৎকালের মেলোডি। এক চাষী বাজায় বাঁশি। কথা বলতে গেলাম,দৌড়ে পালাল। নাম বাঘা। সাত কূলে কেউ নেই। ক্ষ্যাপাটে। কিন্তু সুরটা বড়ই সপ্রতিভ। সময়ের বিপ্রতীপ! কথার কতটা ভেতরে কথক লুকিয়ে থাকেন জানা নেই! কিছু সুঠাম চিত্রনাট্যে এসে দাঁড়ানো যায়। কালো আকাশ ভরে রেখেছে সাদা সাদা নক্ষত্র কুঁড়ি..সনাতন কিশকুর শরীর জুড়ে আগুন গন্ধ! বার্নিং স্মেল। বিড়ি খাচ্ছে। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার আর একটা বিড়ির ফুটকি আলো,বিন্দু, নাথিং ইজ ভিজিবল! জঙ্গলের শব্দ শুনতে পাচ্ছো?
    - পাচ্ছি।
    জঙ্গলের ভেতর জঙ্গল,তার ভেতরেও জঙ্গল! অলীক কাটাকুটি,পুরনো চাতাল। সনাতন নকশাল ছিল। বিস্তৃত ব্লাডি ইতিহাস! বানের জলে ভেসে যাওয়া মানুষ গুলো! ছায়া গুলো! প্রেত গুলো! সনাতনের চোখ গুলো ঘোলাটে! অবসকিয়োর! ঘটে গেছে কতকিছু! ঢেউ,ভাঙন,শরীর জুড়ে মারের দাগ! শার্ট খুলে দেখিয়েছিল।। 
    বুনো শুয়োর ডাকছে। আকাশ ভরা তারা। সনাতন, কত মানুষ মেরেছ তুমি? অনেক?? তীরে আগায় বিষ মাখিয়ে নাকি সস্তার বন্দুক পেয়েছিলে?? কেন মেরেছিলে? হাত কাঁপেনি একবারো?
    স্তব্ধতার গহীনের যে সিম্ফনি!  সনাতনের চোখ চকচক করে। আঁসু?? " গলতি কিয়ে...জোশ মে আকর....."
    ভুল করেছে সনাতন?? মহাজনরা ওঁর বাপকে মেরেছিল। জমি ছিনিয়ে নিয়েছিল! জঙ্গল তখন আরো গভীর। ঘরে ঢুকে মেয়ে বউদের বুকে হাত দিয়ে খ্যাঁ খ্যাঁ করে হাসত! কী  বলতো ওরা সনাতন??
    তোমার মা কে ওরা নিয়ে গেছিল এক রাত। " রেন্ডি বেড পে বহুত চিল্লাতি হ্যায়...." সনাতন!! তুমি মায়ের শীৎকার শুনতে পাও?? এই যে অন্ধকার কালশিটের মতো ডুমরি পাহাড়ের কোলে, এই এত বড় জঙ্গলের মধ্যে ঢুকলে শুনতে পাও মায়ের কান্না! সনাতন! আমি তোমার জায়গায় থাকলে আমার হাতেও বন্দুক থাকত,ভগবৎ গীতা থাকত না।
    আমার পাশে একটা আস্ত ভারতবর্ষ ঘন নিশ্বাস ফেলছে। পোক্ত স্নায়ু! ডুমরি পাহাড়ের নীচে আজো চৌষট্টির সনাতন তেইশের সনাতনকে দেখতে পেয়ে যায়। তুমুল চাঁদের আলোর নীচে ওদের সাক্ষাৎ হয়। চৌষট্টির সনাতন বলে " বন্দুক ফেলে দাও। গান ধরো"। তেইশের সনাতন খিঁচিয়ে ওঠে " চোওওপ! ওরা আমাদের সবাইকে মেরেছে..."
    ডোঙার হাঁড়িয়ায় অনেকক্ষণ চুমুক দিই নি। এবার দিলাম। সনাতন একটা বিড়ি ধরিয়ে বলল " কাল আসবেন আমার ঘরে। একটা জিনিস দেখাব..."
    গেছিলাম। পাহাড়পুর আর সিকন্দরপুর পেরিয়ে ডুমরি পাহাড়ের গায়ে ওঁর ঘর। মাটির কূটীর। নিকোনো উঠোন৷ ঘরের দেওয়ালে ফুল পাতার নকশা আঁকা! ওঁর নাতি আদুল গায়ে একটি ময়ূরের বাচ্চার পিছু নিয়েছে। সনাতন একগাল হাসি মুখে একটি যন্ত্র আমার চোখের সামনে তুলে ধরল।  তাজ্জব! বেহালা! বাঁশ আর কাঠ দিয়ে বেহালা বানিয়েছে সনাতন নিজে!
    " তুমি বানিয়েছ?? নিজে??"
    মানুষ মারা নকশালের চোখে তখন আস্ত শরৎ কাল।
    " বাজাও শুনি..."
    সনাতন ছড়া টানল। খুব চেনা সুর। আপনিও চেনেন। সনাতনও চেনে। রাষ্ট্রদ্রোহী এক সাঁওতালি তখন তাঁর ছোট ভুট্টাক্ষেতের পাশে দাঁড়িয়ে সুর তুলছেন " জনগণমন অধিনায়ক জয় হে..."
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ৩৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে প্রতিক্রিয়া দিন