আমার সন্দেহ আগে থেকেই ছিল, ছিল বলেই আমি কয়েকদিন আগেই লিখেছিলাম অনেক কিছুই পরিষ্কার হবে ১৫ আগস্ট। আগাম বললেই তো হবে না, তাই অপেক্ষায় ছিলাম ১৫ আগস্টের জন্য। আন্দোলনের শুরু থেকেই আমাদের অনেকের শঙ্কা ছিল এই সরকারকে না হয় নানা কারণে আমি সরাচ্ছি, কিন্তু এই যে এতদিন ধরে বলে আসছে আওয়ামীলীগ তাদের ছাড়া বিকল্প নাই, এইটা তো খুব একটা ভুল কিছু না। আমি শুধু মাত্র ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত আগুনে নামার জন্য এত ত্যাগ, এত মানুষের জীবন বাজি ধরছি? আমাদেরকে নিশ্চয়তা দেওয়া হল বিকল্প আছে। সময় মতো বিকল্প আসবে। আমাদের শঙ্কা যায় না। আমরা অপেক্ষায় থাকি। আমরা দেখি সরকার পতন হল। ছাত্ররা নাম দিল নতুন স্বাধীনতা বেশ ভালো। এরপরে? ইউনুস সাহেব ক্ষয়তায় বসলেন। ইউনুস সাহেব খারাপ মানুষ এইটা বলার সুযোগ নাই। তাকে নিয়ে নানা সন্দেহ আছে, নানা মতবাদ আছে কিন্তু এইটাও সত্য লোকটা খারাপ না। তো আমরা একটু আশ্বস্ত হলাম। বাকি উপদেষ্টারাও ভালোই, দুই একজন নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থে সব মেনে নিতেই হবে আমাদের, এইটাই বলা হল। এবং আবার আমাদেরকে মনে করায় দেওয়া হল কোনমতেই এই সরকার কারও ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হবে না।
এই জায়গায় এসেই আমি বলছিলাম অনেক কিছুই ১৫ তারিখ স্পষ্ট হবে। সরকার শোক দিবস বাতিল করল, ছুটি বাতিল করল। এইটাও সমস্যা না। নাই বা থাকল শোক দিবস বা ছুটি। বঙ্গবন্ধু এত বিশাল যে এই সব না হলেও এই লোকের বিন্দুমাত্র মর্যাদার হেরফের হবে না। হুমায়ুন আজাদ বলছেন, "শেখ মুজিব দৈহিকভাবেই মহাকায় ছিলেন, সাধারণ বাঙালির থেকে অনেক উঁচুতে ছিল তার মাথাটি- সহজেই চোখে পড়তো তাঁর উচ্চতা, এবং আমাদের বামন রাজনীতিবিদদের মধ্যেও তিনি ছিলেন মহাকায়।" আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম বইয়ে হুমায়ুন আজাদ আরও লিখেছেন, "১৯৬৮ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন আমাদের রাজনীতির প্রধান পুরুষ, এবং ঐতিহাসিক বিচারেও তাঁর সঙ্গে তুলনীয় আর কোন বাঙালি রাজনীতিবিদ নেই। সোহরাঅর্দি? ফজলুল হক? ভাসানি? তাঁর পাশে অগ্রজরা মাঝারি, অনুজরা তুচ্ছ ও হাস্যকর।"
তো এই লোকের জন্য শোক দিবস রাষ্ট্রীয় ভাবে থাকল না না নিষিদ্ধ হল তা আসলে কোন মানে রাখে না। আওয়ামীলীগ স্বভাবসুলভ ভাবেই মুক্তিযুদ্ধ ও তা সংক্রান্ত সকল কিছুকে নিজেদের করে নিয়েছে। ৭৫ পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু বা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যা হয়েছে তার শোধ তোলার জন্যই হোক বা অন্য যে কারণেই হোক মানুষকে বঙ্গবন্ধু গুলিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা চলেছে। তো এবার না হয় থাকলই না রাষ্ট্রীয় কোন দিবস। না হয় ভেঙ্গেই ফলা হল সমস্ত ভাস্কর্য। মানুষের মনে যদি জায়গা না থাকে তাহলে এমন হাজারও ভাস্কর্য থাকলেই কী আর না থাকলেই কী! আমরা চেয়েছিলাম যারা শোক অনুভব করে, যারা মনি করে বাংলাদেশের ইতিহাসে এইটা অন্যতম নৃশংস ঘটনা তারা যেন এই একটা দিন সুযোগ পায় নিজেদের মনভাব প্রকাশের। কিন্তু আমাদের ভাবনা আর মহামান্যদের ভাবনা তো আর এক না!
হুট করেই নানা জায়গা থেকে বলা হতে থাকল আওয়ামীলীগ ১৫ আগস্ট ঘিরে পরিকল্পনা করছে প্রতিবিপ্লব করার! তারাই বলল এবং তারাই এই প্রতিবিপ্লবকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে দিল! বলা হতে থাকল নাকের ডগায় লাশের গন্ধ রেখে ৫০ বছর আগের শোক পালন করার কোন মানে হয় না। বলা হল যেখানে আওয়ামীলীগকে পাওয়া যাবে সেইখানেই প্রতিহত করা হবে। এমন পরিস্থিতিতে গতকাল রোকেয়া প্রাচী যখন ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারে গেলেন তখন মোমবাতি দেওয়ার সময়টুকুই পেয়েছিলেন, এরপরেই লাঠিপেটা খেতে হয়েছে তাকে। এবং এরপরে শুরু হল তথাকথিত প্রতিবিপ্লব ফেরানোর আয়োজন।
রাতে ৩২ নাম্বারের আশেপাশের সব এলাকা দখল হয়ে গেল ছাত্রদের হাতে। আর্মি পুলিশ ৩২ নাম্বার ঘিরে রইল। শুধু এই জায়গায় না, সারা ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ছাত্ররা অবস্থান নিলো। রাত জেগে প্রতিবিপ্লব ফেরানো হবে। রাতেই ভিডিও দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য সেন হলের। বিকট শব্দে হিন্দি গান বাজানো হচ্ছে, তাণ্ডব নৃত্য চলছে সবাই মিলে।
সকাল হতেই আমি অপেক্ষায় ছিলাম সরকার নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করবে সাধারণ মানুষের জন্য। যারা ৩২ নাম্বারে যেতে চায় আজকের দিনে। যারা বনানী কবরস্থানে যেতে চায় বঙ্গবন্ধুর পরিবারের জন্য দোয়া করতে। আমাকে হতাশ করে সরকারের তরফ থেকে একটা শব্দও করা হল না। একটা দুইটা করে ভিডিও দেখতে থাকলাম ছাত্র নামের এই কলঙ্কদের। ৩২ নাম্বারে যারাই যাওয়ার চেষ্টা করেছে তাদেরকে ধরে ধরে পিটুনি দেওয়া হয়েছে। কেউ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। কালো ব্যাজ পরা অবস্থায় যাকে পেয়েছে তাদেরকে পিটিয়েছে। সাদা দাঁড়িওয়ালা এক মুরুব্বিকে কান ধরে উঠবস করানো হচ্ছে! এমন অনেকেকেই কান ধরে উঠবস করানো হয়েছে। এখানেই শেষ না, রাস্তায় কাপড় খুলে নগ্ন করে নাচানো হয়েছে! ভদ্রলোক একজন মুক্তিযোদ্ধা! ভদ্রলোক বাড়ি ফিরে এই ট্রমা থেকে বের হতে পারেন নাই, কবে পারবে বা কোনদিন পারবে? আমি এই লজ্জা কই রাখব! আমার এখন কী করা উচিত? ভণ্ড সেজে থাকা? কোন প্রতিবাদ হবে না এর? একজন মুক্তিযোদ্ধাকে লেংটা করে নাচানো হচ্ছে, রাষ্ট্র, পূর্ণ সহমত দিয়ে যাচ্ছে এতে!
মোবাইল পরীক্ষা করা হচ্ছে, নিজেদের মতের সাথে না মিললেই মিলছে শাস্তি। সারাদিন ব্যাপী এই অরাজগতা চলছে। কেউ দেখার নাই, কেউ শোনার নাই। দুপুরের একটা ভিডিও দেখলাম ৩২ নাম্বারের সামনেই লাউড স্পিকারে গান বাজিয়ে নাচ হচ্ছে। কেউ একবারও বলল না ৪৯ বছর আগের শোক না হয় এখন পালনের কোন যুক্তি নাই, সদ্য যাদের লাশের উপর দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া হল তাদের জন্যও কোন শোক নাই? নাকের ডগায় লাশের গন্ধ নিয়ে ৫০ বছর আগের শোক পালন করা যায় না কিন্তু উদ্দাম নৃত্য করা যায়? ওই লাশ গুলো যে স্রেফ লাশ, আর এক বিন্দু বেশি কিছু না তাদের কাছে এইটা হচ্ছে বড় প্রমাণ। তাদের লাশ দরকার ছিল, শোক টোক হুদা কথা। মহান ছাত্ররা, যাদেরকে আমি চাই না প্রতিপক্ষ ভাবতে। তারা জেনে করছে না না জেনে করছে জানি না, কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত এই সব কিছুকেই জায়েজ বলে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত একটা ছাত্র সংগঠন থেকে বা একটা তথাকথিত সমন্বয়কের কেউ বলল না বাড়াবাড়ি হচ্ছে, এইটা বন্ধ করা উচিত। বলার কথাও না, কারণ তারাই হুংকার দিয়েছিল এই সবের।
আমাদের শেরপুরে কী হল আজকে? বিএনপি শহরের দখল নিয়ে নিয়েছে। সারাদিন একটা কাকপক্ষীকেও দেখা যায় নাই বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করতে। তার মধ্যেই খবর পেলাম এক শ্রমিক নেতা, যার কথা আগেও লিখছিলাম, তিনি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করছে। এই লোক নিজেই একটা জিনিস। শহরের মধ্যে গরম গরম কথা বললেও কেউ তার কাছে গিয়ে এইটা বন্ধ করতে বলে নাই।
আমরা কয়েকজন নিজেদের মতো করে কিছু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শ্রাবণ শেষ, ভাদ্র মাস চলে আসছে, ভাদ্র মাসে বিশেষ এক প্রাণীর মাথা আউলায় থাকে। তাদের কথা চিন্তা করেই বাদ দিলাম সব। বিকালের আগে ষোল কলা পূর্ণ হল শিবিরের আগমনে। বিশাল মিছিল নিয়ে শিবির আসল। জামাতের শীর্ষ নেতার বাড়ি শেরপুর, এইটা ভুলেই গেছিলাম আমরা। প্রবল ভাবে মনে করায় দেওয়া হচ্ছে এখন। আজকে তাদের উপস্থিতি জানানোর এই সুবর্ণ সুযোগ তারা কেন হারাবে?
আওয়ামীলীগকে দোষ দেওয়া হয় তারা বঙ্গবন্ধুকে, মুক্তিযুদ্ধকে নিজের করে রেখেছে। তো? আজকেই তো সুবর্ণ সুযোগ ছিল আওয়ামীলীগের কবল থেকে মুক্তিযুদ্ধকে, বঙ্গবন্ধুকে বের করে নিয়ে আসার। বঙ্গবন্ধু সর্ব সাধারণের, জয় বাংলা সবার স্লোগান ছিল। এখনই তো সুযোগ ছিল এগুলা ছিনিয়ে নেওয়ার। কিন্তু আজব এক দেশ বাংলাদেশ। এমন কাজ করা হল যে বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ আরও আওয়ামীলীগের কব্জায় ভালো করেই গেল। আওয়ামীলীগ বলবে আমরা না দেখলে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধারা সবাই শেষ হয়ে যাবে!
মহিউদ্দিন মোহাম্মদ বলছেন বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে জিলাপির ভিতরে চিনি গুড়ের মতো। আলাদা করার উপায় নাই। তো আপনারা করলেন কী? বঙ্গবন্ধুকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। আচ্ছা, আজকে ১৫ আগস্ট না হয় ফেলে দিলেন। ডিসেম্বরে বিজয় দিবসেও কেউ শেখ মুজিবের নাম নিবে না? কেউ জানতে চাইবে না বিজয়টা কীভাবে হল? ইতিহাসটা কী? কালকে লিখছিলাম রাম ছাড়া রামায়ণ, হাস্যকর মনে হলেও এইটাই সত্য। অস্তিত্ব থাকবে না অথচ এই দেশেই রাজনীতি করে যাবে, রাষ্ট্র শাসন করবে।
আজকের সমস্ত কাজের দায় নিতে হবে ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুসকে। অবশ্য এগুলা বলার কোন মানে হয় না। ইউনুস সাহেব এরচেয়েও জঘন্য পথে হাঁটছেন। যদি এইটাই সত্য হয় শেষ পর্যন্ত, যদি এত রক্ত এত ত্যাগ সব কিছু হয় বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার জন্য, তাহলে মুক্তিযোদ্ধাকে নগ্ন করে নাচানোর অপরাধ কিছুই নাই। বিএনপি তো নামে, জামাত এবার সম্ভবত তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী হয়েই ফিরবে।
আওয়ামীলীগ বলে আসছে তাদের কোন বিকল্প নাই। এইটা সত্য মিথ্যা তর্ক সাপেক্ষ। কারও কোন বিকল্প থাকবে না এইটা মেনে নেওয়া কষ্টকর। কিন্তু সারাদেশ জানি না, আমাদের শেরপুরে এত বছর, সেই ১৯৯৬ সাল থেকেই কোন বিকল্প ছিল না। কারণ বিএনপি এখান থেকে মনোনয়ন দিত জামাত নেতা কামরুজ্জামানকে। যে চিহ্নিত রাজাকার! তো কেউ বলেন আমাকে আমার বিকল্প কী ছিল? এই কাজ একবার দুইবার না, প্রতিবারই করে গেছে। শেরপুরবাসি প্রতিবারই এই রাজাকারকে পরাস্ত করেছে। এইটাই সান্ত্বনা ছিল আমাদের।
দুইদিন আগেও আমাদেরকে বলা হল, দেশে জামাতের অস্তিত্ব আছে? কোথাও নাই, সব আওয়ামীলীগের বানানো কথা, কিছু হইলেই জামাতের নাম দেয়! এখন সম্ভবত ঘুম ভাঙছে অনেকের, স্বপ্নে যে বাংলাদেশ দেখে থাকে তা যে বাস্তব না এইটা এখন অনেকের কাছেই পরিষ্কার। আমার পরিচিত শেরপুরেই আমি অবাক হয়ে জামাতের আস্ফালন দেখছি, বাকি দেশের কথা কী বলব?
এই লেখটা শেষ করার আগে আমার পরিচিত এক সাংবাদিকের মাধ্যমে জানতে পারলাম ৩২ নাম্বারে যে মুক্তিযোদ্ধাকে উলঙ্গ করে নাচানো হয়েছে তাঁর নাম আব্দুল কুদ্দুস মাখন। তিনি বাসায় চিকিৎসাধীন আছেন। উনার ফেসবুকের সন্ধানও পেলাম। দেখলাম তিনি বাংলার অগ্নিকণা মতিয়া চৌধুরীকে ইচ্ছামত ধুয়েছেন। যে বাম রাজনীতি থেকে শেখ হাসিনা মতিয়া চৌধুরীকে নিয়ে এসেছিলেন সেইদিকেও খোঁচা দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত মতিয়া চৌধুরী কোন কথা বলেন নাই, হয়ত কোথাও আত্মগোপন করে আছেন, কে জানে! যাই হোক, ভদ্রলোক সুস্থ হোক, এই ট্রমা কবে কাটবে কে জানে। সুস্থ হওন দ্রুত এইটাই চাওয়া।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।