ঘরের দেওয়ালে কত ছোট ছোট ঢেউ আটকে আছে দ্যাখো। কবেকার ঢেউ এসব। হয়তো তোমার মনে আছে। আমারও মনে আছে। ঢেউগুলোর পাথর আত্মাও হয়তো তোমাকে, আমাকে আমাদের মতোই মনে রেখেছে। স্টেশনের ভীড়ে জরদ্গব মানুষেরা যেমন ঠেলে, ঢুঁসিয়ে এগিয়ে যায় পড়ন্ত, অস্তগামী কোনো ট্রেন ধরবে বলে, আমাদের এলোমেলো অবিন্যাস্ত করে দিনগুলি এগিয়ে গেছে। সেই ভীড়, সেই ছোটাছুটি চিৎকারের পর তুমি আমি আছি। এমন আলস্যে আজ পাশাপাশি ভেঙে পড়ে আছি আর দেওয়ালে আছে ওই স্থির ঢেউ। কখনো তোমার অবর্তমানে দেখেছি, ঢেউগুলি যেন মাছের চোখের মতো জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে আছে। হয়তো অলীক, হয়তো দেখার ভুল। কিন্তু দেখেছি, মাছের চোখের মতো জ্বলজ্বলে চোখে ওরা চেয়ে থাকে। প্রতিহিংসা নয়, বরং যেন কেমন বিষণ্ণ সেই চোখের দৃষ্টি। যেদিন বাইরে সাদা থান পরা বৃদ্ধার মতো বৃষ্টি নামে, মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পরস্পরের থেকে, প্রাচীন রোমশ কাঁঠালগাছের ত্বক বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে, মানুষের তেমন করণীয় কিছু থাকে না বলে ঘরে সুখাদ্যের গন্ধ ওঠে, সেইদিন ঢেউগুলি মাছের চোখের বদলে বহুদূরের তারার মতো মিটমিট করে। যেন তাদের পাথর আত্মা, পাথরের ভেতরেই আরও গাঢ় পাথরের দিকে যায়। বাইরে হু হু করে চলে সাদা থান পরা বৃদ্ধার মতো বৃষ্টি। অশিতীপর মানুষের মতোই বিচারের চেতনা লোপ পায় তার। প্রাচীন রোমশ কাঁঠালগাছের ত্বক দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে জল পড়ে। সুখাদ্যের টানে, গন্ধে ঘরের মানুষেরা বেড়ালের মতো ছটফট করে
আলস্যে যখন আজ পাশাপাশি ভেঙে পড়ে আছি, দেওয়ালে আটকে থাকা কবেকার ঢেউগুলিকে দ্যাখো। তিমির মতো আকারের সব ঢেউ, কোথা থেকে যেন ছুটে এসেছিল। কোনো সমুদ্রের গর্ভ থেকেই হয়তো। এই রহস্যের সমুদ্র কেউ কি কখনো দেখেছে? কোনো যুথবদ্ধ গাছের সীমানা দেওয়া পথ দিয়ে গেলে ফাঁকে ফাঁকে সেই সমুদ্র কি দৃশ্যমান হয়? ভাবি আমি। তুমি ভাব কি? নাকি আড়ষ্ট, ক্লান্ত চুলের ঢলে আঙুলে বিলি কাটতে কাটতে ভাব, জীবনে কিছু তেমন দেখাই হল না শুধু এই চতুর্দিকে মনুষ্যসমান দেওয়ালগুলি ছাড়া, জানালার বাইরে ওই যে কী এক আগাছার শীর্ষ, সেটুকু ছাড়া। মনকে সুদূরে পৌঁছে দেওয়া কোনো সুগন্ধের বদলে, গুপ্তচরের মতো লুকিয়ে থাকা একটি এঁদো নালার কটু গন্ধ ছাড়া। তুমি নও, তোমার শরীরে যে মৃদু বাতাস লেগে থাকে, তারা হাহাকার করে। তোমাকে ঘিরে যে অলীক পতঙ্গগুলি ওড়ে, তারা হাহাকার করে। সেই হাহাকার যেন আমি শুনতে পাই। আমার দেহগত যে আরেকটি মানুষ, সেও শুনতে পায়। শুনতে পায় অন্তরীক্ষে সেসময় অবসর যাপনে বসা তোমার পূর্বসুরীরা। শুনতে পান আরেকজনও, যাঁর বাহুতে শক্ত, লোহার মতো পেশী আছে। এইসব কথা হয়তো- বা ঢেউগুলি জানে। যেহেতু তারা ঢেউ, নিশ্চল একেকটি ঢেউ, আত্মা পাথরের তাই ওরা অমন অবিচল থাকে। হয়তো তুমিও দৈব, তোমার সহচর বাতাস, পতঙ্গদের হাহাকার দৈব, ফলে সেই রহস্যের সমুদ্র থেকে একটি রেশমের ঝুলে সাজান শকট আসে। সদরে দাঁড়িয়ে আওয়াজ দেয় আর তুমি যেন কোনো শূন্যে উবে যাও
তোমার ঘ্রাণ, গোপনীয়তা রক্ষার পোশাক, চাঁদের মতো একটি অন্তর্বাস, কয়েকজোড়া ক্লান্ত, বুড়ো সহিসের মতো ফিতের চপ্পল ঘরে পড়ে থাকে। ঢেউগুলির চোখ তখন ফের জ্বলজ্বল করে, সবুজ বিষণ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে