লেখক বলছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলের গ্রামজীবনের স্মৃতিচিত্রণ হলেও বাংলার যে-কোনো গ্রামের সঙ্গে এর মিল পাবেন।’ কথাটি সত্য বলব, না বলব আংশিক সত্য? আমি ভারতের যে প্রান্তিক ভূমিতে বাস করি এটাকে বাংলা বললে ওঁরা যে গোঁসা করবেন। আবহমান বাংলারই সম্প্রসারিত এ এলাকাকে আমরা বলি নির্বাসিতা বাংলা। বলি দুখিনী বর্ণমালার ভূমিও। রাষ্ট্রনৈতিক বাংলার মানচিত্র থেকে অনেক দিন আগে এর নির্বাসন হয়ে গেলেও গ্রামকাছাড়ের আলো-হাওয়া-রোদ্দুর, কাদা-জল-ঘাসপাতা-ধুলো জোছনার সঙ্গে ইমানুল হক চিত্রিত কাদামাটির ভূমির এত মিল। আমি তো এ স্মৃতিচিত্রণে আমাদের ব্রাত্য, অবহেলিত বাংলাকেই খুঁজে পাই। যতই পড়ি মনে হয় এ তো আমার গ্রামের কথাই বলছে।
ইমানুল হকের ‘কাদামাটির হাফলাইফ’ শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, আসামের, অপার বাংলার ইতিবৃত্ত।
আমরাও এমনি কাদা মাড়িয়ে ইশকুলে যেতাম। পিচ ঢালা পাকা রাস্তার অস্তিত্ব ছিল আমাদের স্বপ্নে। বিদ্যুতের আলোর কথা ভাবতেও পারতাম না। আলো ছড়ানো জোনাকি পোকা ধরে এনে পেঁপের ফাপা ডাঁটির ভেতর ঢুকিয়ে নিওন লাইট বানাতাম, প্রবল বর্ষণে মানকচুর গোল পাতা মাথায় দিয়ে বৃষ্টি আড়াল করে পাঠশালায় পৌঁছে যেতাম। ছয়ের দশকের মাঝামাঝি আমাদের এম-এল-এ সাহেব পি-ডবলিউ-ডি মন্ত্রী হলে গ্রামের কাঁচা রাস্তাটি পাকা হয়ে গেল। সারা গ্রাম উপচে পড়ল পিচ ঢালা মসৃণ রাস্তায় হাঁটতে। জাটিঙ্গা নদীর উপর ব্রিজ বানানোর বরাত দেওয়া হল গ্যামন কোম্পানিকে। ব্রিজের কাজ দেখা হয়ে উঠল আমাদের একটা মজার অভিযান। কিন্তু এখানেও সেই ছেলে ধরার কেচ্ছা। মানুষের রক্ত না পেলে ব্রিজ সম্পূর্ণ হয় না। এদিকে ছেলেধরাকে বলে খুচিধরা। শহুরে পরিবেশে এ শব্দটি উচ্চারণ করতে আমরা লজ্জা পেতাম। গ্রাম কাছাড়ের উচ্চারণ, বাকভঙ্গি ছিল আমাদের সংকোচের কারণ। শিষ্ট সমাজে তা গোপন করার চেষ্টা করতাম, কিন্তু পারিনি। পরে বুঝেছি আঞ্চলিক (উপ) ভাষাটি কেবল খাঁটি বাংলাই নয়, মূলস্রোত বাংলার প্রাণদায়ী ফিডার ল্যাঙ্গুয়েজও বটে। এই অশিষ্ট উচ্চারণ, বাকভঙ্গি, শব্দ, প্রবাদ প্রবচনই মান্যচলিত বাংলাকে জুগিয়ে আসছে তার প্রাণরস। মান্যচলিতকে আমরা বলতাম কলিকাতি বাংলা।
ইমানুল হক ফাদার দ্যাতিয়েনের মুখে শুনিয়েছেন –‘বাংলা বই পড়লেই গা ঘিন ঘিন করে। বাংলা কোথায়? সব তো ইংরেজি, নয় সংস্কৃত—বাক্যগঠন, চিন্তা ভাবধারা সব। বাংলা লেখায় বাংলা নেই।’ বেশ শুনিয়েছেন ইমানুল ভাই। পণ্ডিতপ্রবর সুধীর চক্রবর্তী লিখেছেন এই বেলজিয়ান সাহেবই নাকি দীর্ঘদিন পর কলকাতায় ফিরে এসে হাজির হয়েছেন এক লোকসংস্কৃতির সেমিনারে। ও বাবা উদ্বোধনীতে দেখেন রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশিত হচ্ছে, কলকাতায় থাকাকালীন তিনি এ গানটিই বহু উদ্বোধনীতে শুনেছেন। তাঁর বিস্ময়—‘গত বিগত তিরিশ বছরে আপনারা সভাসূচনায় গাওয়ার জন্য একখানা নতুন গানও তৈরি করতে পারলেন না!’ কাদামাটির পাতাটি খুলতেই এমনতর নানা প্রসঙ্গ অনুষঙ্গ মনে এল। মনের ভেতর তৈরি হতে থাকল এমনি সমান্তরাল আরেক বয়ান।
আমাদের ছিল কংগ্রেসি পরিবেশ, কিন্তু এ পরিবেশেও সেই পঞ্চাশ-ষাটের দু’এক পিস কমিউনিস্ট অপারেট করতেন। হেমাঙ্গ বিশ্বাসদারা স্বাধীনতার পরপরই এদিকে তেভাগা আন্দোলন শুরু করে দিয়েছিলেন। এক মণিপুরি মহিলা সহ পাঁচজন ( এর মধ্যে একজন প্রাক্তন চা শ্রমিক) কৃষকের রক্তে পাকা ধানের মাঠ ভিজিয়ে ওরা আন্দোলনে ইতি টানেন। তবে কমিউনিস্ট কর্মীরা তাদের শ্রেণিশত্রু আমার জেলখাটা স্বাধীনতা সংগ্রামী, ইংরেজ আমলের বিধায়ক পিতার আশ্রয়েও থাকতেন। একবার খেলাচ্ছলে এদের একজনেরই পরামর্শে আমার অগ্রজ তস্য অগ্রজকে নিয়ে বাড়ির টঙ্গিঘরে মিটিঙে ব্যস্ত গান্ধীবাদি পিতাকে শুনিয়ে ‘ইন কেলাব জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিয়েছিলেন। উত্তম মধ্যম দেবার পর অনুসন্ধান করলেন কে শিখিয়েছে এসব? না, এসব ওই কমিনিস্ট ব্যাটার কীর্তি, ইনি তো দুপুরে এ জমিদার বাড়িতে ভাত খেয়ে টঙ্গিঘরেই বিশ্রাম সেরে নিতেন। (আজ সপ্তাদিন হল এ অগ্রজ প্রয়াত হয়েছেন--তাঁরই মুখে শোনা এ গল্পটি এখানে ঢুকিয়ে দিলাম। ষাটের দশকে শিলিগুড়ি কলেজের মিউজিক সেক্রেটারি আমার এই অগ্রজ, একবার নকশালদের সঙ্গেই ভিড়ে গিয়েছিলেন। বালিশের নীচে কিছুদিন রেখেছিলেন লাল মলাটের বই ক’খানাও। অবশ্য অতঃপর জেলা আদালতে একজন সফল আইনজীবী হয়ে তিনি জাতীয়তাবাদী ক্যাম্পের প্রতি একটু সহানুভূতিশীলও হয়ে যান, যেমন বাংলায় আরও অনেকেই হয়েছেন)। বলছি আসামের কাছাড় জেলার সঙ্গে রাঢ় বাংলার গ্রামীন পরিবেশের বেশ মিল।
এদিকের গ্রামীন জীবনের পলিটিক্সে অনেক কিছুর সঙ্গে মিশে থাকত কংগ্রেস-কমিউনিস্ট বিষয়ও। কিন্তু হিন্দু-মুসলিম পলিটিক্স এক অর্থে ছিলই না। দেশ বিভাগ-পরবর্তী পরিস্থিতি তো এর অনুকূলই হবার কথা ছিল। এসব নতুন আমদানিও বলা যায়। তবে পনেরোই আগস্ট, ছাব্বিশ জানুয়ারি কিংবা গান্ধী জয়ন্তী, নেতাজি জয়ন্তীতে সম্প্রীতি ছাড়া অন্য কোন কিছুই শোনা যেতো না। জাতীয়তাবাদী প্রচারকেরা যতই কানাকানি করে থাকুন না কেন সিরাজদ্দৌল্লা, আলিবর্দি খান, কিংবা সাজাহানের পালায় হিন্দু মুসলিম উভয়েই চোখের জল ফেলেছেন। ব্রজেন দে’র ‘বাঙালি’ (বা শেষ নামাজ, এ-ই ছিল নাটকের নাম, আয়োজকের যার যে রকম সুবিধে হয়) পালার কথা বলেছেন ইমানুল হক। হিন্দু-মুসলমান, বামুন কায়েত, মুচি, চামার, আদিবাসী নারীপুরুষ রাত জেগে দেখত এ পালা যেখানে লুঙ্গি, টিকি, দাড়ি, টুপি পরে নামাবলি গায়ে চড়িয়ে কুশীলব সত্যপীর ডায়লগ দিচ্ছে আর শ্রোতা হাততালিতে ফেটে পড়ছে:
'হিন্দু ধর্ম বল, ইসলাম ধর্ম বল, সব বাজে। আমি বাঙালি জাতটাকে হিন্দুমান ধর্মে দীক্ষা দেব। হিন্দু কেউ থাকবে না, মুসলমান কেউ থাকবে না, সব হিন্দুমান হয়ে যাবে। '
সে নমাজ পড়ে না, পূজা করে না—তার আছে পূ-মাজ। ভগবান আর খোদা মিলে তাঁর আরাধ্য খোদাবান। সে বলে ‘আমি মন্দির আর মসজিদ ভেঙে ‘মন-জিদ’ তৈরি করব যেখানে হবে পূমাজ। নইলে বাঙালির উদ্ধারের আর আশা নেই।’ আর যে কথাটি জানানো প্রয়োজন মনে করছি লেখকের কমিউনিস্ট মতাদর্শী পিতৃদেব স্বয়ং নাটকের আবহসঙ্গীত হিসেবে কাঁসর বাদন ও হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল গানের সঙ্গে আজানের সুর শোনানো কর্মটি সমাধা করতেন।
রাঢ় অঞ্চলের ধর্মাধর্মের প্রসঙ্গ তেমন আলাদাভাবে না এলেও ইমানুল হকের প্রতিবেদনের মধ্যে বেশ ধরা পড়েছে। লেখক জানিয়েছেন ‘হিন্দু মুসলমানভেদ তো তখন ছিল না। বন্ধুদের মধ্যে দু সম্প্রদায়ের মানুষই ছিল।’ অবশ্য হিন্দু বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করলে মুসলমান অতিথিকে থালাটা ধুয়ে দিতে হত। রাঢ় অঞ্চলের এ চালচিত্তিরে কত বিচিত্র মানুষের সহাবস্থান—মুসলিমকে ‘সালাম’ বলা গ্রামের সবচেয়ে ধার্মিক মানুষটি, আর হিন্দুকে ‘নমস্কার’ বলা মুসলিম গ্রামবাসীর সাক্ষাত পাওয়া যায় এখানে। এখানে আছে ১৯৮৪ সালে শিখদাঙ্গার পর গুরুদুয়ারায় মাথায় রুমাল দেওয়া জ্যোতি বসুর উপস্থিতি, আছে বোহরা মুসলিমদের কাছে টুপি পরিহিত নরেন্দ্র মোদী, লক্ষ্ণৌতে মুসলিম ভোটারদের সমর্থনধন্য বাজপেয়ীজি, টুপি পরে ইফতার পার্টিতে যাওয়া নীতিশকুমার, রবিশঙ্কর প্রসাদের উপস্থিতিও।
তাছাড়াও এখানে আছেন দুর্গা মণ্ডপে গিয়ে সিঁদুর খেলা শেখ হাসিনা, এবং এ দৃশ্য দেখে তাঁকে হাসিনা দেবী বলে প্রতিক্রিয়া জানানো রাগী জামাতিয়ারা। তাছাড়াও আছে মাথায় ওড়না দেওয়া মমতাকে দেখে সংঘ পরিবারের উষ্মা প্রকাশের কথা। হিন্দুদের পূজা কমিটির কর্মকর্তা স্বয়ং ইমানুল হক জানান যে তিনি মাঝে মাঝে অঞ্জলিও দেন, অষ্টমী পূজার পর প্রতিবেশীরা তাঁর মাথায়ও আগুন ছোঁয়ান। ধন্য সে প্রতিবেশী। কেউ যে এ যজ্ঞাগ্নি বিধর্মীর ব্যাটার মাথায় না ঠেকিয়ে তাঁর কপালেই ঠুসে দেননি এটা আমাদের ভাগ্য।
লেখককে স্যালুট করতে হয় তাঁর সাহসী স্বীকারোক্তির জন্য, ‘আমার কোন ধর্ম নেই।’ এখন এসব কথা ভাবাও পাপ। হ্যাঁ, এই ‘সংস্কৃতি আর সহিষ্ণুতার পীঠস্থান’ পশ্চিমবঙ্গেও। এসব কথা সংঘী বিরাদরেরা ক্ষমাঘেন্না করে দিলেও সামাজিক মাধ্যম রেহাই দেবে না। আর আসাম হলে নির্ঘাত গণ্ডায় গণ্ডায় এফ-আই-আর হয়ে যেত।
কাদামাটির ‘হাফলাইফ’- বলা যায় একটি মুক্তগ্রন্থ, যার শুরু আছে, মধ্য বা অন্ত্য নেই। এ সমাপ্তি-বিহীন প্রতিবেদনে পাঠক যে-কোনও সময়েই ঢুকে যেতে পারেন নিজস্ব বয়ান নিয়ে। এ যেন গ্রামীন এবং আধা-নাগরিক জীবনের এক মহাকাব্য। এরকমই একটি বয়ান খাড়া করেছিলেন ‘বাংলার চালচিত্র’ প্রণেতা আব্দুল জব্বার—তিনি তাঁর লেখায় জীবন্ত ভাবে হাজির করেছিলেন দুনিয়ার অদেখা চোর ছ্যাচোর, ফড়ে দালাল, গরু ব্যাপারী, বরজওয়ালা, পান ব্যাপারী, মাছের ভেড়ির মালিক, তাঁতকর্মী, ফুলচাষী, গ্রামীন মাস্টারবাবু, ফন্দিবাজ ভদ্রলোক, চোলাই মদের পাইকার আর হাফ গেরস্তদের।
খালপারের এ মাস্টারমশায়ের বয়ানে শৈশব কৈশোরের খেলাধুলার বিবরণটি আমার কাছে তো বেশ মজাদার লেগেছে। রান্নাবাটি, লুকোচুরি, চু কিৎকিৎ, হা-ডু-ডু, মার্বেল, ডাঁটা খেলা, গুলিডাং ইত্যাদি খেলার বিচিত্র ভার্সন বাঙালির অপর অঞ্চলেও প্রচলিত ছিল, এখন লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আমরা খেলতাম মঙ্গল কাটাকুটি (লুড্ডোর মতোই, প্লাস্টিকের পরিবর্তে কচুর ডাঁটির ঘুটি দিয়ে), তুরি, গাত্তি (মার্বেল দিয়ে), টাঙ্গল-বেঙ্গি, এরি-দুরি ( এগুলোকে প্রত্নক্রিকেটও বলতে পারেন-- দেড়হাতি মূর্তা বেতের ডাঁটি দিয়ে টাঙ্গল বা ব্যাট, আর একই জিনিস দিয়ে দেড়ইঞ্চি বেঙ্গি, বলের বিকল্প)।
এখানে উল্লিখিত স্কুলমাস্টারদের কথা তো বিশেষ কৌতূহল উদ্দীপক। ‘নবকল্লোল’ পড়ার দোষে লেখক যে উত্তরপাড়ার স্যারের হাতে পিটুনি খেয়েছেন, এরকম অভিজ্ঞতা একটা সময়ে স্কুলপড়ুয়াদের অনেকেরই হয়েছে। আজ লুপ্ত হয়ে গেছে আমাদের লুকিয়ে পড়ার সেই উলটোরথ, প্রসাদ, ঘরোয়া, সিনেমা জগৎ। অবশ্য ‘নবকল্লোল’ এখনও বহাল তবিয়তে আছে। আজকাল ক’জন ছেলেমেয়েই আর টেক্সট বই ছাড়া অন্য কিছু পড়ে? তখন পাঠ্যবই ছাড়াও ছিল অ-পাঠ্য সামগ্রীর অঢেল জোগান-- ‘শিশুসাথী’, ‘শুকতারা, ‘কিশোর ভারতী, ‘দেব সাহিত্য কুটিরে’র বিশেষ সংখ্যা, ‘বিভাবরী’, ‘নীহারিকা’। এসবের পাতায় পাতায় থাকত শিশুকিশোরদের বিচিত্র খেয়াল, অভিযান, খেলাধুলা, স্কুলের বন্ধুবান্ধব, হোস্টেল জীবন, রাগী বোর্ডিং সুপার, স্কুল-পালানো ছেলের সচিত্র গল্প। লাগাম বিহীন কল্পনার জগতে বিচরণের কাহিনিতে ঠাসা ছিল এ পত্রপত্রিকা। আর ছিল ডিটেকটিভ বই, আট আনা দামের বিশ্বচক্র সিরিজ, পাঁচসিকে দামের রহস্য সিরিজের বই। আমরা পাঠ্যবইয়ের নীচে রেখে লুকিয়ে লুকিয়েই এসব সাবাড় করতাম, মাঝে মাঝে ধরা পড়লে পানিসমেন্ট ছিল বরাদ্দ। গ্রামীন স্কুলের লাইব্রেরিতে থাকত অজানা দ্বীপের অভিযান, সিংহ শিকারের কাহিনি, ইংরেজি থেকে অনূদিত গল্প গরিলা হান্টার্স, নির্জন সাগরদ্বীপ, আর ছিল সমুদ্র অভিযান, কলম্বাসের কাহিনি, সিন্ধবাদের কথা, আটলান্টিক মহাসাগরে ডাকাতি, তিমি শিকার। ইমানুল হকের জগতে ‘সোভিয়েত দেশ’ ম্যাগাজিন এর উল্লেখ দেখেই মনটা হুঁ হুঁ করে উঠল হারিয়ে যাওয়া বিদেশী গল্পগুলোর কথা ভেবে।
আগেকার সরকারি স্কুলে পড়ুয়াদের মাইনে দিতে হত মাত্র দু’টাকা, তিন টাকা, এডমিশন ফিজ প্রায় নেই। এডমিশনে গার্জেনদের যাওয়া কোন বাধ্যতামুলক কিছু ছিল না। পড়বে তো ছেলেমেয়েরা, মা বাবাকে নিয়ে টানাটানির কী প্রয়োজন! তখন স্কুলের জন্য আলাদা কোনও ড্রেস, টাই, ব্যাগ, এমন-কি ওয়াটার-বটল, টিফিন বক্স পর্যন্ত লাগত না। এ স্কুলে স্বল্প মাইনের যে সব টিচারদের কথা ইমানুল হকের লেখায় এসেছে এরা কিন্তু আজকের নিরিখে এক একজন সুপারস্টার অ্যাকাডেমিক পারসনেলিটি।
আশির দশক পর্যন্ত ছিল বাংলায় ফুটবলের স্বর্ণযুগ। ফুটবল উন্মাদনা বাঙালির সব ক’টি ভুবনেই সমান ছিল। দূর গাঁয়ে হই চই করে খেলা দেখতে যাওয়া এবং খেলাশেষে আলপথ দিয়ে ঘরে ফেরা, সঙ্গে হিপহিপ হুররে চিৎকার। লেখক মনে রেখেছেন ষাটোর্ধ ফুটবল প্রেমীর সেই আবেদনটি, ‘আমাকে না নিয়ে গেলে হারবি রে ব্যাটারা। আমার মতো গলার আওয়াজ আছে তোদের?’ এ তো বাঁধিয়ে রাখানোর যোগ্য সংলাপ।
খাবারদাবার প্রসঙ্গ এ বইয়ের পাতায় ঘুরে ফিরে এসেছে। ব্রাত্য শাকসবজি, কচু, আলুসেদ্ধ, আলু ভর্তা, বেগুন ছানা, বেগুন টমেটো, মশুরডাল ছানা, পালং, সিম, মুলোর ঘন্ট, কুচো চিংড়ি, সুটকি, মৌরালা মাছের ঝোলের স্বাদ তো আজকের প্রজন্ম পেল না।
মুড়ির কথাই বা কী করে অনুক্ত রাখি? প্রেক্ষাঘরে শ্রোতার গালের ভেতর মুড়ির মচমচে শব্দে গীতা ঘটকের প্রতিক্রিয়াও তো মনে রাখার মতোই—‘চলমান মুড়ির অর্কেস্ট্রা শুনব, না গান গাইব?’
সব কিছু বলে দিলে হবে কী? তা হলে সমান্তরাল ভাবে বরং একটা দীর্ঘ প্রবন্ধই লিখে নিলে হয়। তবুও চমৎকার কথাগুলো পাঠকদের আগাম না জানিয়ে থাকি কী করে? ইমানুল জানিয়েছেন বর্ধমানের লোকেরা খায় পাঁচবার (মানে খেত): সকালে এক জামবাটি চা আর মুড়ি, দশটায় আলুসেদ্ধ ভাত (না খেলে নাকি পাপ হয়) দুপুরে তো খেতেই হয়, বিকেলে কিছু না খেলে শরীর খারাপ হয়, আর শাস্ত্রেই লিখেছে রাতে খেতে হয়।
এরকম একটা বই আমাদের স্মৃতির হাজারটা দরজা খুলে দেয়। আমাদের অনেককেই লেখক হতে প্ররোচিত করে।
নিছক নস্টালজিক আখ্যান নয় এ প্রতিবেদন, এতে মৃদু একটা ভিন্নতর বার্তাও আছে। বইটি একাধারে Songs of Innocence এবং Songs of Experienceও বলা যায়। গ্রীষ্মের দুপুরে কয়েকজন বসে এরকম একখানা বই পাঠ ও শ্রবণ সত্যিই এক চমৎকার অভিজ্ঞতা হতে পারে। কিন্তু তা কি আর সম্ভব আজকের ভিন্নতর ব্যস্ততার দিনে? আপাতত নির্জন এককের পাঠই হয়ে থাকুক এ ‘কাদামাটির হাফলাইফ।’