মাসদুয়েক হল হারিয়েছি। ঠিক হারিয়েছি তা নয়, তবে চোখের সামনে ছিঁড়েখুড়ে পড়ে থাকতে দেখেছি। এখন মাঝেমধ্যে পকেট হাতড়ালে এক আধটা টুকরো পাই—এইমাত্র।
মনোযোগের কথা বলছিলাম আর কি।
শহীদ হয়েছেন ভদ্রলোক। তবে তাতে আর তাঁর দোষ কোথা? এত 'হ্যাপনিং' সময়ে বেঁচে থাকলে এমন তো হবেই।
প্রতিদিন সে কী ভিড় খবরের! খবর আর খবর। সবই আবার তার ব্রেকিং নিউজ। অগা টিভি চ্যানেলের বানানো, গা-জোয়ারি ব্রেকিং নিউজ না। সত্যিকারের।
এই এখুনি সরকারের কোনো এক মন্ত্রী জেলে গেলেন, পরমুহূর্তেই পদত্যাগ করলেন খানকতক উপাচার্য। ব্যাপার বোঝার আগেই ডিএ নিয়ে বনধের দিনে কাজে যোগ দিতে সরকারি হুমকি এলো, তাতে সাড়া দেবো কি দেবো না – স্থির করার আগেই হাওড়ায় তৈরি হল দাঙ্গা পরিস্থিতি।
রাজ্যের এহেন ঘটনার ঘনঘটায় ডুবে যে যাবো—সে সুযোগই বা পেলাম কোথায়? তার আগেই রাহুল গান্ধি পার্লামেন্ট থেকে বহিষ্কৃত হলেন—জেল, জামিন এসব হলো। আদানি আমার-আপনার গলাগুলি পা-দানি হিসেবে ব্যবহার করার মাসুল স্টকের দামে দিচ্ছিলেন, কিন্তু তার আর পোদান্মতি-র যোগসাজশের কথা উচ্চারণও করতে দেবে না বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের লোকেরাই পার্লামেন্টের কার্যক্রমে ব্যাগড়া দিতে শুরু করলেন।
এইসব খবর আর 'বিহারের সাসারাম স্টেশন' নিতে শেয়ার হওয়া বিজেপি আইটি সেলের হোয়াটসঅ্যাপ ফরোয়ার্ড পড়ে সমৃদ্ধ হবো ভাবছি, এমন সময় দুম করে গুয়াহাটি আইআইটি গরু নিয়ে কনফারেন্স ফেঁদে বসলো। কাশী-তামিল-সঙ্গমম্-এর কথা শোনা-ইস্তক কাশি তো হচ্ছিলোই, এবারে সন্দেহ হলো, হুপিং কিনা...
দেশজোড়া NEP-র প্রচলনের ঢেউ রাজ্যে আছড়ে পড়ার মুখেই, সর্বহারার নেতার অ্যাসেট ডিক্লারেশনে ২২ লাখের মারুতি শুনে লোকজন বিষম-টিষম খেয়ে অস্থির। কেউ টাকাটা শুনে, কেউ—ওই টাকা থাকা সত্ত্বেও 'মারুতি' কেনা দেখে। এসব অভিযোগ আবার করতে শুরু করলো সেই পার্টির লোক, যার আর কিছু না হোক, চুরির ব্যাপারে অভিজ্ঞতা বাকিদের থেকে বেশি।
রাজ্যজোড়া এত চোর জেনে মোটা ৭-লিভারের তালা কিনে দরজায় লাগাতেই যাচ্ছি, মুখমন্ত্রী আবার সব ডিএ আন্দোলনকারীদের 'চোর-ডাকাত' বলে দিলেন। বাম আমলে চিরকুটে চাকরি হওয়ার প্রসঙ্গ তুলে খুব খানিক হল্লা হচ্ছিলো বটে এইসময়, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর থেকে 'চোর' অপবাদ শুনে এতই মুষড়ে ছিলাম, যে ভালো মন দিতে পারিনি।
এই অন্যমনস্কতার সুযোগে তিলজলায় একটা বাচ্চা তন্ত্রমন্ত্রের ছ্যাঁচড়ামোর বলি হলো—লোকে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসারের কথা না বলে, বলতে শুরু করলো, এ সবই নাকি সাহিত্যের 'তারানাথ তান্ত্রিক'-এর ভূতের উপদ্রব।
সে সব কথার সত্যমিথ্যে জানিনে, তবে অমর্ত্য সেনের নোবেল পাওয়া যে পুরো গুল, সে নিয়ে হঠাৎ নিশ্চিত হয়ে গেলো কিছু লোক। এই অপরাধে বিশ্বভারতীর উপাচার্য তাঁকে ভিটেছাড়া করবেন মনস্থির করলেন। কিছুদিন আগে এক পদার্থবিদের পিছনে লাগায় খুব খানিক ছ্যাঁকা খেয়েছিলেন, তাই বোধহয় রাগটা বিশেষ নামেনি।
এইসময়, অমর্ত্য সেন বলেই যে শুধু—তা না, টাকা দিয়ে চাকরি পাওয়া স্কুলশিক্ষকদের প্রতিও রাজ্য সরকারের বিশেষ করুণা লক্ষ্য করা গেল। মুখ্যমন্ত্রী বিচারালয়ের উদ্দেশ্যে স্টেজ থেকে ভাষণ দিলেন। নিন্দুকেরা বললো, চোরে চোরে পিসতুতো ভাই, আর সমর্থকেরা বললো, "তবে যে বলেছিলি, সরকারি কর্মচারীদের কথা আমরা ভাবি না?" এইসব বলতে বলতে সরকার-সমর্থকরা এতই রেগে গেলো, যে রামনবমীর দিন বিজেপির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গনগনে মিছিল বের করে ফেললো সব মফঃস্বলের রাস্তায়। উৎসাহের আধিক্যে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই ধর্নায় বসে পড়লেন। 'কার বিরুদ্ধে?' জিজ্ঞেস করেছিল মনে হয় একজন। তাকে খানকয় চাঁটি খেতে হয়েছিলো।
এই ঘটনাপ্রবাহের সমসময়েই, গুগল-সভার মহাকবি (Bard) কিছু গোলমেলে কাজে জড়িয়ে পড়ে (তার বিরুদ্ধে অভিযোগ—তার ট্রেনিং-এর মধ্যে নাকি, প্রতিদ্বন্দ্বী লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল জিপিটি-৪-এর উত্তরও আছে) আর অন্তত একজন গুগল ইঞ্জিনিয়ার পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ বলতে মনে পড়লো, এইসময়েই আম্রিগায় ফেকুচূড়ামণি ট্রাম্প ইন্ডাইটেড হন।
এতসবের মধ্যে, এইমাত্র এক বাল্যবন্ধুকে দেখলাম, আরেক পরিচিতের পোস্টে গিয়ে কমেন্ট করতে, যে, গুরু(চণ্ডা৯) 'ছুপা' তৃণমূল, অনেকদিন ধরেই। তার নীচে আবার একজন গম্ভীর সমর্থন জানিয়ে লিখেছে, গুরুতে নাকি সব তৃণমূল আইটি সেলের লোফার, আর ওখানে নাকি ডিএ-আন্দোলনকারীদের খুব গালি দেওয়া হয়।
এ এক জ্বালা। কর্মস্থলের তৃণমূলের ঘোষিত সমর্থকদের বদ্ধমূল ধারণা—আমি সিপিএম। তা সিপিএমের ধারণা কী জানি না ('আমরা বনাম ওরা' নীতি বহুদিন মেনে চললে একটা বদভ্যাস তো তৈরি হয়ই), তবে অনেক সিপিএম-কার্ড হোল্ডারকেই চিনি, যারা আমার ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থানটা বিশেষ গায়ে মাখেন না।
বিজেপি-র কারুর ভুল করেও ধারণা হওয়া সম্ভব নয়, যে আমি ঐ দলের — সঙ্গত কারণেই। ওদের কাছে, আমি বিরোধী (সম্প্রতি বিবেক অগ্নিহোত্রী-র ইন্টারভিউতে যা শুনলাম, তাতে আমি আর্বান নক্সাল)।
কিন্তু এতদসত্ত্বেও, কিছুতেই মনে করতে পারছি না, তৃণমূলের আইটি সেলে কখন যোগ দিলাম? ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও তো দেখলাম, সেই এক গড়ের মাঠ!
সে যাই হোক, কী যেন একটা বলছিলাম? যাঃ, ভুলে গেছি। মনোযোগের যা অবস্থা! তা আর হবে না? এত খবর চাদ্দিকে! যে সে খবর না, সবই তার আবার ব্রেকিং নিউজ...