এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • এক দুগুণে শূণ্য -২

    Kishore Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১৮ ডিসেম্বর ২০২২ | ৯৭০ বার পঠিত


  • সকাল হতেই ট্রেনটা যেখানে দাঁড়াল, সেখানেই দুই মক্কেল নেমে পড়ল। দেখে মনে হয়, একজনের বয়েস মধ্য তিরিশ, অন্যজন একেবারেই ছোকরা। দুজনের কাঁধেই ব্যাগ – ধেড়ে লোকটার কাঁধে বড়ো, আর ছোটোর কাঁধে ছোট। লোকজন তেমন নেই, স্টেশনটাও তেমন জমজমাট নয়। অচেনা জায়গায় প্রথম নেমে, চারদিক দেখতে দেখতে তাদের চোখে পড়ল স্টেশনের হাতের বাইরের চায়ের দোকানটা। শুধু দুই বুড়ো বেঞ্চে বসে আছে, আর কেউ নেই।  চায়ের দোকান দেখেই যেন ওদের চায়ের তেষ্টা পেয়ে গেল। তারা গুটিগুটি পায়ে চায়ের দোকানের কাছে বেশ বড়ো একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াল। সেখান থেকে দুই বুড়োর কথাবার্তা শুনল বেশ খানিকক্ষণ। তারপর এগিয়ে গিয়ে অন্য একটা বেঞ্চে ব্যাগ রেখে পাশাপাশি বসল। তাদের দেখেই দুই বুড়োর জমাটি আড্ডায় ছেদ পড়ল।
    বেঞ্চে বসে ধেড়ে লোকটা হাঁক পাড়ল, “দাদাভাই, দুটো চা হবে নাকি?”
    ভেতর থেকে পতিত সাড়া দিল, “দু মিনিট বসেন, দিচ্ছি”।
    “চায়ের সঙ্গে আর কিছু হবে?”
    “ওই যে প্যালাস্টিকের বয়েমে বিস্যুট রয়েছে, কোনটা নেবেন, নিন”।
    ছোটটা ধেড়েকে বলল, “খিদেয় তো পেট ঝলসে গেল, দাদা”! তারপর পতিতকে বলল, “ওই লেড়ো? ও ছাড়া আর কিছু নেই?”
    “ডিম-টুচ হবে। চাটা নামিয়েই করে দিচ্ছি। টুচ-ঘুগনিও হবে, কিন্তু একটু দেরি হবে। আলুমটর সেদ্ধ আছে, একটু ছুঁকে দিলেই রেডি...”।
    সনৎবাবু আর কমলবাবু এতক্ষণ দুজনকেই ভুরু কুঁচকে নিরীক্ষণ করছিলেন। এই সামতাপুরে তাঁদের বহুদিনের বাস। দেখেই বুঝলেন, দুই মক্কেল এখানে নতুন, আলাপ করার জন্যে কমলবাবু বললেন, “আপনাদের এখানে নতুন মনে হচ্ছে! যাওয়া হবে কোথায়?”
    ধেড়েটা উত্তর দিল, “আমাদের বলছেন?” তারপর জোড়হাতে নমস্কার করে বলল, “নমস্কার। তা – হ্যাঁ নতুন বৈ কি! তবে পুরোনো করে নিতে কতক্ষণ?”
    “কোন কাজে? নাকি বেড়াতে?”
    কমলবাবুর প্রশ্নে ধেড়ে বেশ অবাক হয়ে বলল, “বেড়াতে? এ জায়গাটা বেড়ানোর মতো ট্যুরিস্ট স্পট, এমন তো জানতাম না”!
    “তা না। তবে বেড়াতে বলতে, কাকার বাড়ি, মামার বাড়ি, মাসির বাড়ি, বন্ধুবান্ধবের বাড়ি – লোকে বেড়াতে যায় না?”
    “এখানেও মামার বাড়ি, দাদা?”
    ছোটটা ফোড়ন দিতেই ধেড়ে খুব রেগে ধমকে দিল, বলল, “চুপ কর। হ্যাঁ সে রকম বেড়ানো হয়ই তো। মন্দ বলেননি, আমরা এসেছি কিছুটা কাজ, কিছুটা বেড়ানো, এই আর কি!”
    পতিতের চা হয়ে গেছিল, চার আঙুল চায়ে ডুবিয়ে, চার গ্লাস চা এনে একে একে চারজনকেই দিল, জিগ্যেস করল, “আপনারা ডিম-টুচ খাবেন তো? দু প্লেট বানাই?”
    ধেড়েটা বলল, “খুব দেরি হবে কী? আমাদের আবার একটু জরুরি কাজ আছে!”
    পতিত ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, “না, না, দেরি হবে কেন? আপনাদের চা খেতে খেতে বানিয়ে দিচ্ছি, দেখেন না”।
    চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে কমলবাবু বললেন, “জরুরি কাজের সঙ্গে শরীরের দিকে নজর দেওয়াটাও জরুরি। ওই দেখুন, আমি আবার একটু ইয়ে চর্চা করে ফেললাম, বোধ হয়। হে হে হে হে, কিছু মনে করবেন না”।
    ধেড়ে খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল, “ “ইয়ে” মানে, আপনি অনধিকার চর্চার কথা বলছেন কী? একটুও না। আপনারা আমাদের গুরুজন। গুরুজনের কথা আমরা মাথায় রাখি, কিন্তু মাথা খারাপ করি না। আমাদের আপনারা “তুমি”ও বলতে পারেন, কাকু”।
    সদ্য অপরিচিত যুবকের মুখে “কাকু” শুনে সনৎবাবু ও কমলবাবু খুশিই হলেন, চায়ে চুমুক দিতে দিতে সনৎবাবু বললেন, “বাব্বাঃ একেবারে কাকু?”
    ধেড়ে যেন খুব অপ্রতিভ হল, বলল, “এঃ হে, একটু ইয়ে করে ফেললাম কী? “দাদা” বললে ভালো হতো?”
    সনৎবাবু একগাল হেসে বললেন, “আরে না, না। আমাদের অনেকেই এখন “দাদু” বলে, তাই বলছিলাম!”
    ধেড়ের গলায় অবিশ্বাস, সে বলল, “য্যাঃ কী বলছেন? দাদু? আপনাদের বলে? কে? কারা বলে? কিছু মনে করবেন না, যারা বলে, তারা মোটেই সুবিধের লোক নয়। কী এমন বয়েস হয়েছে আপনাদের? পঁয়তাল্লিশ - কি বড়জোর আটচল্লিশ, তার বেশি তো নয়?”
    চায়ের গেলাস শেষ করে সনৎবাবু মুচকি হেসে বললেন, “আটান্ন”।
    ধেড়ে খুব নাটকীয় ভঙ্গীতে বলল, “সত্যি? অবিশ্বাস্য। বিশ্বাসই হয় না। আটান্নতে এই চেহারা? এমন টানটান, ভাবা যায় না, জাস্ট ভাবা যায় না”। 
    ধেড়ের কথায় দুজনেই খুব মজা পেলেন, কমলবাবু স্মিতমুখে বললেন, “আমি কমল। ও সনৎ। আমরা একই বয়সি, একই স্কুলের একই ক্লাসের বন্ধু”।
    ছোটটা ছোট্ট করে ফুট কাটল, “আমরাও একই কলেজের, একই ক্লাসের না হলেও, একই গ্লাসের বন্ধু”।
    ধেড়ে তাকে ধমক দিয়ে বলল, “চুপ কর্‌। আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে, আপনারা এখানে অনেকদিনের বাসিন্দা”।
    কমলবাবু বাঁধানো বত্রিশের বেশ কিছু বের করে বললেন, “হে হে হে হে, অনেকদিন কতদিনে হয় জানি না, তবে এই সামতাপুরে, আমাদের সাত পুরুষের বাস”।
    “বাব্বা, সাত পুরুষ? তাহলে তো আপনারা এখানকার সকলকেই চিনবেন”। 
    ধেড়ের এই কথায় কমলবাবু মুচকি হেসে বললেন, “সামতাপুর এমন কিছু বড়ো জায়গা তো নয়, না চেনার কী আছে?”
    “তাহলে মঙ্গল পোদ্দার স্যারকেও চিনবেন নিশ্চয়ই?”
    সনৎবাবু বললেন, “মঙ্গল পোদ্দার, মানে আমাদের মংলা, তাকে চিনবো না? সামতাপুরে অমন ধনী কজন আছে?”
    কমলবাবু জিগ্যেস করলেন, “তা মঙ্গলের সঙ্গেই কী আপনাদের জরুরি কাজ?”
    ধেড়েলোকটি বলল, “হুঁ। উনিই আমাদের ডেকেছেন”। চা শেষ করে মাটিতে গেলাস রেখে ধেড়ে আবার জিগ্যেস করল, “তা উনি লোক কেমন?”
    কমলবাবু একটু উচ্ছ্বসিতভাবেই বললেন, “লোক ভালোই! মানে ওই যেমন হয় আর কী! সজ্জন, তারপর ধরুন দিলদরিয়া। তার ওপর ইয়ে মানে, বিবেকবান”।
    “লগনচাঁদা লোক মশাই, ধুলিমুঠি থেকে সোনামুঠি – মা লক্ষ্মী ঘরে বাঁধা পড়েছেন”। উত্তেজিত হয়ে সনৎবাবু বললেন।
    ধেড়ে বলল, “তাই? কিন্তু তাহলে... আমাকে ডেকে পাঠালেন...”। এই সময় পতিত দু প্লেট গরম গরম ডিম-টোস্ট এনে দুজনের হাতে দিয়ে গেল। প্লেট দুটো হাতে নেওয়ার পর ধেড়ে আবার বলল, “আপনারা কিছু খাবেন না? আপনারা দেখবেন, আর আমরা বসে বসে খাবো?”
    “তাতে কি? তোমরা হচ্ছো এই শহরের অতিথি। অনেকদূর থেকে এসেছো। তোমরা খাও। পতিত দেখিস অতিথিদের যেন কোন অযত্ন না হয়। তা, মঙ্গলের বাড়িতে কিসের কাজ?”
    কমলবাবুর এই অমায়িক কথার উত্তরে ধেড়ে পাঁউরুটি চিবোতে চিবোতে বলল, “শুনেছি, কিছুদিন আগেও ওঁনার খুব ভালো অবস্থা ছিল। কিন্তু ইদানীং একটু কষ্টের মধ্যে পড়েছেন, তাই বোধহয় আমাদের ডাক পড়েছে”!
    কমলবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তা ঠিকই শুনেছো। দিন কী আর সমান যায়? আজ যে রাজা কাল সে ফকির। এতো হামেশা হয়”।
    সনৎবাবুও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “সত্যি কী ছিল আর এখন কী হয়েছে! মঙ্গলের মতো মানুষের কিন্তু এমন হওয়ার কথা ছিল না। জগতে ভালোমানুষদের কপালেই কি যত দুঃখ লেখা থাকে?”
    কমলবাবু গভীর দুঃখে মাথা নেড়ে বললেন, “যা বলেছিস। কিন্তু মঙ্গলকে এই কষ্ট থেকে তোমরা কীভাবে উদ্ধার করবে?”
    মুখে পাঁউরুটি নিয়ে ধেড়ে বলল, “ওটাই আমাদের পেশা। এবং নেশাও বলতে পারেন”।
    ছোটটাও আর চুপ থাকতে পারল না, বলল, “আমার দাদার দয়ার শরীর, মানুষের দুঃখ কষ্টে প্রাণ কাঁদে”।
    ছোটকে আগের মতোই ধমকে ধেড়ে বলল, “চুপ কর! দয়া-টয়া কিছু নয় কাকু, কর্তব্য। যার যা কর্তব্য সেটা না করলে অধর্ম হয় কি না বলুন?”
    সনৎবাবু জোর সমর্থন করে বললেন, “আলবাৎ হয়...তা সেই কর্তব্যটা কী?”
    আশেপাশে তাকিয়ে খুব নিচু স্বরে ধেড়ে বলল, “হাটের মধ্যে সব কথা কী বলা যায়, কাকু? নাকি যাকে তাকে সবকথা খুলে বলা যায়? কার মনে কী আছে ঠিক কি? উপকার করতে না পারুক, লোকের ক্ষতি দেখতে মানুষ খুব আনন্দ পায়”।
    কথাটা কমলবাবুর তেমন মনঃপূত হল না, মুখটা হাঁড়ি করে বললেন, “তাই বুঝি?”
    ধেড়ে ছোট্ট একটা ঢেঁকুর তুলে দুঃখ পাওয়া মুখে বলল, “কাকু রাগ করলেন নাকি? আপনাদের মতো লোককে বলা যাবে না, সে কথা বলিনি কিন্তু! আপনাদের মতো লোক রোজ রোজ পাবো কোথায় – এক আধদিনই দর্শন মেলে। আপনাদের সান্নিধ্য পেলে আমাদের মতো লোকেরা বর্তে যাই! আপনাদের বলবো না? ছ্যা, ছ্যা, এমনটা ভাবলেন কী করে?”
    এমন তৈলমর্দনে সনৎবাবু ও কমলবাবু দুজনেই বেজায় খুশি হলেন, কমলবাবু বললেন, “তাই বলো, আমরা তোমাকে ভুল বুঝছিলাম”!
    ডিম-টোস্ট সেরে ছোটটা জল খাচ্ছিল, জল খাওয়া থামিয়ে বলল, “ঠিক কি ভুল, সেটা পরে হয়তো টের পাবেন, কাকু”।
    তার দিকে কটমটে চোখে তাকিয়ে ধেড়ে বলল, “চুপ কর। কী জানেন কাকু, বিশ্বাস জিনিষটা সোনার পাথরবাটির মতো। যদি বিশ্বাস করেন, তাহলে বাটিটা সোনার, আর যদি না করেন, বাটিটা পাথরের!”
    কমলবাবু মুগ্ধ নেত্রে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ধেড়ের দিকে, বললেন, “ওফ্‌ সাংঘাতিক বলেছো, ভাই!  যত দেখছি, শুনছি, ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি! কী বলিস সনৎ, দেখতে সাধারণ কিন্তু কী অসাধারণ কথাবার্তা! কি উঁচু বিচার, বিশ্লেষণ, কী উচ্চ থাকের ভাবনা!”
    সনৎবাবুও আবেগে আপ্লুত হয়ে গদ্গদ স্বরে বললেন, “যা বলেছিস। তা এত কথা হল, ভাইপোদের নামগুলি জানা হলো না তো!”
    ছোট এবার চুলবুল করে উত্তর দিল, “দাদার নাম, বিপদতারণ বিশ্বাস। দাদার মা টানা পাঁচবছর খুব নিষ্ঠা ভরে বিপত্তারিণীর ব্রত করার পর দাদা মায়ের কোলে অব...মানে ওই ইয়ে কী বেশ যেন একটা হয়েছিলেন!”
    কমলবাবু জিগ্যেস করলেন, “অব...মানে ইয়ে অবতীর্ণ কি?”
    ছোট মাথা নেড়ে আঙুল নেড়ে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক বলেছেন কাকু। শক্ত শক্ত বাংলা শব্দগুলো জিভে আসতেই চায়না”!
    বিরক্ত ধেড়ে, মানে বিপদতারণ বলল, “আঃ গোপাল, তোকে কতবার বলেছি, আমার জন্মের এই অলৌকিক ঘটনার কথা, যাকে তাকে বলে বেড়াবি না! লোকে বিশ্বাস করবে না, ভাববে বুজরুকি! কী দরকার কাকু, নিজের কথা ঢাক পিটিয়ে সকলকে বলতে যাওয়ার? আপনারা তেমন আড়বুঝো লোক নন, জানি, আপনারা বিশ্বাস করবেন, কিন্তু অনেকে উপহাস করে, ঠাট্টা বিদ্রূপ করে। সে এক বেজায় লজ্জার ব্যাপার হয়ে ওঠে”!
    সনৎবাবু অত্যন্ত অবাক হয়ে বললেন, “কী বিপদ! মূর্খ লোক ঠাট্টা করবে বলে, তোমার জন্ম মহিমা আমাদের জানতে দেবে না, বিপদ? এ তোমার ভারি অন্যায়। বিপদ থেকে তুমি মানুষকে উদ্ধার করার ব্রত নিয়েছো বিপদ, তুচ্ছ লোকের ঠাট্টায় তোমার জন্ম রহস্য গোপন থাকবে?”
    সনৎবাবুকে সমর্থন করে কমলবাবু বললেন, “গোপন থাকবেই বা কেন? আর আমরা এসব কথা গোপন রাখবোই বা কেন? আমরা একবার যখন তোমাকে পেয়েছি বিপদ, আর তো তোমায় ছাড়ছি না! আমাদের বাড়ির সকল বিপদ তুমি কাটিয়ে দাও, বিপদ”।
    ছোট, যার নাম গোপাল, ওজস্বিনী ভাষায় উথলে উঠল, “সকলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে, তোমার বিপদের হাত বাড়িয়ে দাও বিপদদা, তোমার নিপুণ হাত-টানে বাড়ন্ত হয়ে উঠুক সকলের বাড়ি! এটুকু বাড়াবাড়ি তোমাকে করতেই হবে, বিপদদা”।
    বিপদতারণ তথাস্তু ভাবমাখা মুখে বলল, “কিন্তু এই চায়ের দোকান, এত মানুষের হাটে সব কথা তো বলা যাবে না, কাকু! আপনাদের এখানে কোন নিরিবিলি জায়গা নেই, যেখানে নিশ্চিন্তে বসে দুটো কথা বলা যায়?”
    কমলবাবু গর্বিত স্বরে বললেন, “বিলক্ষণ, নেই আবার? আমাদের কুমুদিনী উদ্যান! এই তো সামনেই, হেঁটে গেলে মিনিট পাঁচেক। এই সাত সকালে ওখানে তেমন কেউ থাকেও না, নির্জন, নিরিবিলি”।
    বিপদতারণ বলল, “বাঃ তবে তো ভালই হল! আপনারা এগিয়ে যান, আমরা চায়ের দাম-টাম মিটিয়ে দিয়ে আসছি”।
    সনৎবাবু আন্তরিক আপ্যায়নের সুরে বললেন, “ও কমল, আমরা থাকতে ওরা আবার দাম দেবে কী রে? পতিত, আমার খাতায় ওদের দুজনের হিসেবটাও লিখে রাখিস”।
    সনৎবাবুর কথায় পতিত তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল যেন, বলল, “আপনার তো হিসেব সাড়ে তিনশোর ওপর হয়ে গেল, বাবু, এমাসে এখনো পর্যন্ত একটা টাকাও ঠেকাননি...”।
    সনৎবাবু কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “আঃ তোর ওই হিসেবের জল নিয়ে পরে নাড়াচাড়া করবো, পতিত। এখন যা বললাম তাই কর”।
    বিপদতারণ স্বস্তির শ্বাস ফেলে গোপালের দিকে তাকিয়ে বলল, “দামটা আমরাই দিয়ে দিতে পারতাম, কিন্তু আপনারা গুরুজন, আপনাদের আদেশ অমান্য করার সাহস হয় না। আপনারা তাহলে এগিয়ে পড়ুন”।
    কমলবাবু অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন, “সে কি? তোমরা কুমুদিনী উদ্যানে যাবে না?”
    সান্ত্বনা দেওয়ার স্বরে বিপদতারণ বলল, “আসছি, আপনারা চলুন। অচেনা লোকের সঙ্গে আপনারা পার্কে ঢুকলে, লোকের কৌতূহল হবে। আলাদা আলাদা ঢোকাই ভালো”।
    সনৎবাবু সে কথা মেনে নিয়ে বললেন, “তা, বিপদ মন্দ বলেনি, চল আমরা এগিয়ে যাই, কমল। ওরা পিছনেই আসুক। বেশি লোক জানাজানি হলে, বিপদ বাড়বে! আচ্ছা, তাহলে আমরা আসি, তোমরা পেছনে এসো”।

    সনৎবাবু আর কমলবাবু একটু দূরে চলে যেতে, বিপদতারণ পতিতকে বলল, “পতিতবাবু, আমাদের সামনে সনৎবাবুর মতো মানী মানুষের ধারদেনার কথা বলাটা আপনার উচিৎ হয়নি”।
    পতিত খ্যাঁক করে বলে উঠল, “নিকুচি করেছে মানী লোকের। বউনি হবার আগেই দুই মক্কেল, নিত্যি এসে ধারে চা খেয়ে যায়। তিনমাস ধরে চিৎ হাত উপুড় করছে না, আমি কি দানছত্তর খুলেছি নাকি? দুটোই সমান সেয়ানা, চারটে শকুনি মরলে, ওইরকম দুই লোক হয় – যেমন কঞ্জুস, তেমনি বজ্জাত”। 
    গোপাল একটু চাপা গলায় বিপদকে বলল, “শকুন তো ভাগাড়েই থাকে, না দাদা? আমরা কী তবে ভাগাড়ে যাচ্ছি?”
    গোপালের কথার কোন উত্তর না দিয়ে বিপদ বলল, “সে না হয় একটু ধারদেনা করে ফেলেছেন, কিন্তু দুজনের মন খুব সাদা, তাই না, পতিতবাবু?”
    “সাদা না ছাই! সারাদিন শুধু কূটকচালি, এর কথা তাকে, তার অথা একে। একটু আগেই মঙ্গলের নিন্দেয় ধুলো ওড়াচ্ছিল, আপনার কথা শুনেই সেই মঙ্গল একেবারে বড়োমানুষ হয়ে উঠল!”
    গোপাল মুরুব্বি চালে বলল, “তাই? আপনার দোকানে ভালো সিগারেট কী আছে? দুটো দিন তো!”
    সেকথায় বেশ বিরক্ত হয়েই পতিত বলল, “সেটাও কী ধারে?”
    বিপদতারণ খুবই বিনীত সুরে বলল, “আহা, রাগ করছেন কেন, পতিতবাবু, চা আর ডিমটোস্টের দাম সনৎবাবুর খাতায়, আর সিগারেট দুটো কমলবাবুর। ধার আবার কোথায় হল?” পতিত দুটো সিগারেট এনে দিল।
    বিপদতারণ আর গোপাল সিগারেট ধরিয়ে আরামে দুটান দিল, তারপর বিপদতারণ বলল, “আমরা এখন আসি পতিতবাবু, দেখা হবে আবার। আশা করি আপনার ধারের ওই ধারালো বিপদ খুব শিগ্‌গির কেটে যাবে!”
    তার ওপর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়ার মতো গোপাল বলল, “ধার দেনা, টাকা-পয়সা নিয়ে মাথা গরম করবেন না, পতিতবাবু। টাকা কি চিরকাল থাকবে, নাকি সঙ্গে যাবে? আসি তাহলে?” দুজনেই পিঠে ব্যাগ ফেলে লম্বা পায়ে হাঁটা দিল কুমুদিনী উদ্যানের দিকে।
    পতিত ওদের যাওয়ার দিকে ফ্যালফেলে চোখে তাকিয়ে দেখে বলল, “যত্তো সব ফেরেব্বাজের দল কি আমার কপালেই জুটে যায়? এক পয়সা বউনি হল না সকাল থেকে, গুচ্ছের ধার!”
     
    (ক্রমশঃ)
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৮ ডিসেম্বর ২০২২ | ৯৭০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন