এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • এক দুগুণে শূন্য - ৮

    Kishore Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ২৯ জানুয়ারি ২০২৩ | ৫২৯ বার পঠিত


  • যা ভাবা হয়েছিল তাই হয়েছে! নিচেয় বসার ঘরে গিয়ে ওরা দুজন দেখল, পৃথাদেবী সোফায় আর সনৎবাবু মেঝেয় লম্বা হয়ে শুয়ে,  নাক ডাকিয়ে তোফা ঘুমোচ্ছেন! এই দৃশ্য দেখে বিপদতারণ বলল, “বোঝো কাণ্ড। সবাই যে ঘুমিয়ে কাদা। গোপাল, চটপট সদরের চাবিটা খোঁজ। ওটা আগে দরকার”।
    “কোথায় খুঁজবো বলো তো?”
    “আমি সনৎবাবুর পকেটে দেখছি, তুই কাকিমার আঁচলে দেখ”।
    “শেষ অব্দি আমার হাতেই নারী শরীর তুলে দিলে, দাদা? আমার যে আবার কাঁচা বয়েস?”
    “বাজে বকিস না, তাড়াতাড়ি খোঁজ”।
    “আঁচলে নেই, দাদা”।
    “কোমরের খুঁটে?”
    “ইস্‌। তুমি খুব অশ্লীল দাদা...”।
    “ছেড়ে দে, মনে হচ্ছে পেয়েছি, বুড়োর কোমরে ঘুন্সি আছে, জানতিস? সেখানে ঝুলিয়েছিল”।
    “ওই চাবিটাই শিওর?”
    “হুম্‌, একবার চেক করে আসি, দাঁড়া”। বিপদতারণ সদর দরজার দিকে গেল, কিছুক্ষণ খুটখাট চেষ্টা করে ফিরে এসে বলল, “নাঃ রে, এটা নয়, বুড়োর ভূতের ভয়, তাই কোমরে লোহার ফালতু চাবি নিয়ে ঘোরে”।
    “হা হা, ঘাড়ে এমন একখানা জাঁদরেল মহিলা ভূত নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারপরেও ভূতের ভয়? কিন্তু চাবি?”
    “বুড়ির সব দেখেছিস?”
    “কী যাতা বলছো দাদা, ছোট ভাইয়ের চরিত্রের প্রতি তোমার এত সন্দেহ? তাই দেখা যায়?”
    “মেয়েরা এমন এমন জায়গায় টুক করে রাখে...”
    “ও দাদা, প্লিজ আর বলো না, আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি, আমি আর ওসবে নেই... খুব খিদে পেয়েছে..”
    “সেই ভালো... দেখ তো কী রান্না হয়েছে...আমি একটু চিন্তা করি...কোথায় থাকতে পারে?”
    গোপাল রান্নাঘরে গেল, একটু পরেই রান্নাঘর থেকে সে বলতে লাগল, “দাদা, ভাত আছে, আর আছে আলুসেদ্ধ, মাছের ঝোল”।
    “বাঃ কপালে মাছের ঝোল নাচছে, ঠেকাবে কে? আমিও যাবো? না বাড়তে পারবি?”
    “তা পারবো... দুটো থালা...পেয়েছি। ভাতের হাতা...পেয়েছি...দুটো আলু সেদ্ধ... সরষের তেল...নুনের ডাব্বা...দাদা, দাদা, একটা চাবি! মনে হচ্ছে এটাই...” গোপাল চাবিটা নিয়ে দৌড়ে বসার ঘরে এল।
    “কই দেখি, দেখি...হতে পারে...দাঁড়া চেক করে আসি”। বিপদতারণ আবার সদর দরজার কাছে গেল, আবার খুটখাট আওয়াজ। তারপরেই বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল, “হয়েছে...খুলেছে, চিচিং ফাঁক। ওফ্‌ গোপাল তুই সত্যি জিনিয়াস... তোর খিদে না পেলে...এতক্ষণে কত কী শ্লীলতাহানি, যৌন হেনস্থার কেলেংকারি হয়ে যেতে পারতো। চল চটপট খেয়ে নিই। এখনও অব্দি সব ঠিকঠাক চলছে”।
    “সবই মা বিপত্তারিণীর কৃপা”।
    দুজনেই এখন রান্নাঘরে গেল, ভাত বেড়ে আলুসেদ্ধ মেখে, রান্নাঘরের মেঝেতেই খেতে বসল, বিপদতারণ এক গ্রাস মুখে তুলে বলল, “বাঃ আলুভাতেটা দারুণ মেখেছিস তো, কাঁচা তেলের ঝাঁজ টের পাওয়া যাচ্ছে। একটা কাঁচা লংকা পেলে জমে যেত”।
    “আনব? কোথায় আছে, খুঁজতে হবে”।
    “ছেড়ে দে, অত তরিবতে কাজ নেই”। বেশ খানিকক্ষণ খাওয়ার পর, বিপদতারণ খাওয়া থামিয়ে বলল, “আচ্ছা, আমরা গতকাল যখন জেল থেকে ছাড়া পেলাম, তখন কী এত টাকার ফেরেব্বাজি করব, ভেবেছিলাম”?
    “পাগল? খুব জোর দশ-পনের হাজার..”।
    “কিন্তু এখন কত করলাম?” 
    এক মুখ ভাত নিয়ে গোপাল উত্তর দিল,
    “হুঁউউউ...চোদ্দ লাখ...”।
    “এটা কী ঠিক হচ্ছে?”
    “নাঃ একদমই হচ্ছে না। এত টাকা নিয়ে করবো কী?”
    “টাকা কী সঙ্গে যাবে?”
    “না, না কোত্থাও যাবে না - না জেলে না হেলে!”
    “হেলে মানে?”
    “মরার পর তো হেলেই যাবো, নাকি তুমি আবার স্বর্গে যাবে বলে স্বপ্ন দেখছো? আর খাবে না? ভাত আর মাছ পড়ে রইল যে?”
    “নাঃ রে, ভাল লাগছে না”।
    “আমি খেয়ে নিই?”
    “নে”।
    “যা নেব অঙ্গে, তাই যাবে সঙ্গে। টাকা যাবে না দাদা, কিন্তু এই ভাত মাছের ঝোল সঙ্গেই থাকবে”।
    “আমি একটা কথা ভাবছি, বুঝেছিস?”
    বিপদতারণের থালার বাকি ভাত ও মাছ খেতে খেতে বলল, “তুমি কী ভাবছো আমি জানি দাদা”।
    “জানিস? হ্যাঃ কী জানিস? ওস্তাদি করে বললেই হলো?”
    “তুমি অত টাকা নিতে চাইছো না। যা রয়, সয় - এই ধরো বিশ- ত্রিশ হাজার, তার বেশি নয়”।
    “সাবাশ, কী করে, বুঝলি হারামজাদা?”
    “জেলে আমরা আড়াই বছর দিনরাত একসঙ্গেই থাকতাম দাদা, তোমাকে চিনতে ভুল হয় নি, বলো?”
    “তা হয় নি, কিন্তু তুই কী বলিস?”
    “কী ব্যাপারে, দাদা?”
    “ওই যে টাকার ব্যাপারে?”
    “আমারও একই মত, বিশ- ত্রিশ, তার বেশী নয়। বলি বিবেক বলেও তো একটা ব্যাপার আছে নাকি?”
    “ঠিক বলেছিস”।
    “চলো দাদা, আঁচিয়ে আসি। তার পর টাকার প্যাকেট থেকে তিরিশ – আচ্ছা না হয় পঁয়ত্রিশ নিয়ে, চটপট কেটে পড়ি...।  বাকিটা পড়ে থাক যেমন আছে”!
    “পঁয়ত্রিশ নয়, ভদ্রলোকের এক কথা – চল্লিশ। তুই আর ও নিয়ে দরদাম করিস না”।
    “তোমার কথার অবাধ্য কোনদিন হয়েছি দাদা?”
    হাত মুখ ধুয়ে, এঁটো থালা দুটো নিয়ে রান্নাঘরে সিংকে ধুতে ধুতেই, সদর দরজার বেল বেজে উঠল, বার বার তিনবার। দুজনেই চমকে উঠল। গোপাল ভয়ে ভয়ে বলল, “কে হতে পারে দাদা? আমার মন কু গাইছে”।
    “আমারও। আমাদের নেমন্তন্ন করে, সরকারি অতিথি শালায় নিয়ে যেতে এসেছে”। আবারও বেল বাজল, সঙ্গে দরজায় ধাক্কা।
    “দরজাটা খুলি? নাকি ছাদ দিয়ে পিছনের আমগাছ ধরে পালাবে?”
    “পালানো যাবে? আটঘাট বেঁধেই এসেছে। খুলে দে। চল আরো কটা দিন সরকারি অন্ন ধ্বংস করে আসি”।
    গোপাল দরজা খুলতেই, দুজন ভদ্রলোক হুড়মুড় করে ঢুকল। বিকাশ ও প্রদীপ - পুলিশের উর্দি নেই, কিন্তু চিনতে ভুল হয় না। প্রদীপবাবু গোপালের হাত ধরল খপ করে। বিকাশবাবু জিগ্‌গেস করলেন, “আপনারা? সনৎবাবু, কমলবাবু কোথায়? সনৎবাবুর স্ত্রী? আপনারা কে?”
    বিপদতারণ বলল, “আমি নেপাল, ও হরি”।
    “ও নাম তো নয়, আমার কাছে খবর আছে একজন বিপদতারণ, অন্য জন গোপাল। তাহলে আপনারা আবার কোথা থেকে উদয় হলেন?”
    “আমরাই, আমি বিপদতারণ, ও গোপাল। অ্যালিয়াস”।
    “আচ্ছা। তোমরাই সেই ঘুঘু, ভেবেছিলে কোনদিন ধরা পড়বে না”।
    “আজ্ঞে না স্যার, আমরা আদত খাঁচার পাখি, খাঁচার দরজা খুলে দিলেও, বাইরে একটু ফুড়ুৎ-ফাড়াৎ করে, আবার খাঁচাতেই ফিরে আসি। গতকাল দমদমের খাঁচা থেকে বেরিয়ে, আজ আবার ধরা পড়ার উপায় করলাম”।
    “আচ্ছা? এঁরা দুজন কারা? আপনারা রয়েছেন, তার ওপর আমরা এলাম, এত লোকের কথাতেও নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন!”
    “আজ্ঞে ইনিই সনৎকাকু, উনি কাকিমা। আর কমলকাকুরও একই অবস্থা, দোতলায় ঘুমোচ্ছেন”।
    “তাই নাকি? এমন ঘুমের কারণ কী? ঘুমের ওষুধের কড়া ডোজ? তোমাদের কীর্তি?”
    “আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার ঠিকই ধরেছেন”।
    বিকাশবাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রদীপবাবু বললেন, “পাখি জাস্ট ওড়বার তাল করছিল, স্যার। আমাদের আসতে আর একটু দেরি হলেই ফুড়ুৎ”।
    বিকাশবাবু বললেন, “হুঁম্‌, এঁনাদের ঘুম কতক্ষণে ভাঙবে জানা আছে? নাকি ডাক্তার ডাকতে হবে? কিছু হয়ে গেলে কিন্তু মার্ডার কেস”!
    “ডাক্তার ডাকতে পারেন স্যার, তবে ভয়ের কিছু নেই...সাড়ে তিনটে নাগাদ ওষুধ পড়েছে, আরো কিছুক্ষণ এমন চলবে।
    “কী করবে প্রদীপ, হসপিটালে নিয়ে যাবে, নাকি অপেক্ষা করবে?”
    “কী দরকার স্যার রিস্ক নিয়ে, ভ্যানটাকে ডেকে নিই, তুলে হসপিটালে নিয়ে যাক। এদের দুটোকেও তো লকআপে ভরতে হবে। আর এদিকে আমি কমলবাবুর মিসেসকে ফোন করি”।  
    বিকাশবাবু বললেন, “সেই ভালো। এই গোপাল না হরি...এটাকে ছেড়ো না। আমি ধেড়েটাকে দেখছি”।
    বিপদতারণ ম্লান হেসে বলল, “পালাবো না, স্যার। ইচ্ছে ছিল হাজার চল্লিশ নিয়ে কেটে পড়বো, সে যখন আর হল না, পালিয়ে কী করবো”?
    “হাজার চল্লিশ? কমলবাবুর ছয় আর সনৎবাবুর আট, মোট চোদ্দ লাখ হাতিয়েছো? আমাদের কাছে খবর আছে”।
    “আজ্ঞে দোতলায় চলুন, বমাল পেয়ে যাবেন, দেখবেন কমলবাবু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কেমন আগলাচ্ছেন”!
    “এ মক্কেল কঠিন জিনিষ স্যার, এই অবস্থাতেও আপনার সঙ্গে রসিকতা করছে”! বিপদতারণের কথায় প্রদীপবাবু বললেন।
    বিকাশবাবু বললেন, “মিথ্যে বললে, আমার দাওয়াই কী জানে না তো... একনম্বর চোদ্দলাখ টাকার ফ্রডারি...”
    প্রদীপবাবু চটপট উত্তর দিলেন, “আই পি সি ৪১৬, ৪২০, ৪৪৭ আর ৩৭৯, স্যার”!
    “দুনম্বর তিনজন সিনিয়ার সিটিজেনকে জোর করে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে হত্যার চেষ্টা...”
    “আই পি সি ৩০৭, স্যার...”
    “এমন এমন সব কেস দেব না? বাছাধন যাবজ্জীবন খাঁচায় বসে থাকবে”!
    বিকাশবাবুর কথায় উচ্ছ্বসিত আনন্দে বিপদতারণ বলল, “থ্যাংকিউ স্যার। অনেক ধন্যবাদ স্যার। কী বলে যে আপনাদের কৃতজ্ঞতা জানাবো”!
    বিকাশবাবু খুব অবাক হয়ে বললেন, “সে কি? যাবজ্জীবনে এত উচ্ছ্বাস কিসের হে? সবাই তো হাতে পায়ে ধরে, পালাবার জন্যে ছটফট করে”।
    প্রদীপবাবু বিকাশবাবুর কাছ ঘেঁষে এসে বললেন, “পলিটিক্যাল সাপোর্ট নেই তো স্যার? লকআপে ভরলেই ফোন আসবে...ছেড়ে দিন...কেস উইথড্র করুন”।
    বিপদতারণ নির্দ্বিধায় বলল, “না স্যার, কোন ফোন আসবে না, স্যার। নিশ্চিন্তে লকআপে রাখতে পারবেন স্যার। তবে একটু তদ্বির করে, যদি তাড়াতাড়ি আদালত থেকে পানিশমেন্টটা করিয়ে দেন। একবার যদি কোন জেলে সেটল্‌ হতে পারি, স্যার, চিরজীবন আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো, স্যার”।
    বিকাশবাবু বিপদতারণের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “কি বুঝছো, প্রদীপ?”
    “ফিস অফ ডিপ ওয়াটার, স্যার”।
    “যাও তো প্রদীপ, গোপাল না হরিকে সঙ্গে নিয়ে। দোতলার কী অবস্থা দেখে এসো। টাকার বান্ডিলগুলোও পেলে নিয়ে এসো। আমি এখানেই থাকছি”।
    প্রদীপবাবু গোপালকে সঙ্গে নিয়ে ওপরে গেল। বিকাশবাবু বিপদতারণকে বললেন, “পালাবার বেকার চেষ্টা করো না, দেখছো আমার কাছে রিভলভার আছে!”
    “দেখেছি স্যার। ওটা না থাকলেও পালাবার চেষ্টা করতাম না”।
    কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে, বিকাশবাবু বললেন, “দেখে তো শিক্ষিত ভদ্রলোক বলেই মনে হয়। এই সব করে বেড়াও কেন? বার বার জেলে যেতে লজ্জা করে না?”
    “আজ্ঞে স্যার, এক কালে শিক্ষিত ভদ্রলোক ছিলাম, অস্বীকার করবো না। তবে সে সব এখন আর নই”।
    “কেন? এ সব জাল জোচ্চুরি অভাবে করা হয়? নাকি স্বভাবে?”
    “ঠিকই ধরেছেন স্যার, শুরু করেছিলাম অভাবে, এখন স্বভাব হয়ে গেছে”।
    “লেখাপড়া কদ্দূর?”
    “বললে বিশ্বাস করবেন না, স্যার। ইঞ্জিনিয়ার। বিশ্বাস না করলে, দমদম থেকে আমার ফাইলটা আনিয়ে দেখতে পারেন, স্যার। সার্টিফিকেটের জেরক্স জমা করা আছে”।  
    ইঞ্জিনিয়ার শুনে বিকাশবাবু প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেন, বললেন, “বলেন কী...ইয়ে, মানে বলো কী? তার পরেও এই চোরচোট্টা লাইনে”?
    “হে হে হে শিক্ষিত ভদ্রলোক হয়ে থাকার জন্যে একটা মিনিমাম মেন্টিন্যন্স কস্ট আছে স্যার, সেট মানবেন তো? সেই কস্টটা রোজগার করতে হয়। অনেকে চাকরি করে, কেউ ব্যবসা করে। যার সে সব না জোটে, সে ভিক্ষে কর, নয় ফেরেব্বাজি করে”!
    “আর ওই হরি, না গোপাল”?
    “ও আমাদের কলেজেরই ছেলে, স্যার। বছর দুয়েক আগে পাশ করেছে। আমার থেকে আট বছরের জুনিয়র। একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে আলাপ, তারপর থেকে সুখে দুঃখে এক সঙ্গে রয়েছি। নাঃ ভুল বললাম, সুখেই আছি। দুঃখ আর কোথায়?” 
    “বাজারে চাকরি-বাকরির অবস্থা খারাপ মানছি, তাই বলে চেষ্টা করলে দুজন ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি হয় না, এটা মানতে পারলাম না, ভাই। এ একধরনের আলসেমি কিংবা বজ্জাতি করে বড়োলোক হওয়ার সখ”।
    বিপদতারণ চুপ করে মাথা নিচু করে রইল। বিকাশবাবু ধমকে বললেন, “কী হল, উত্তর দিচ্ছ না যে?”
    “আপনি সরকারি অফিসার স্যার, ঠিক বলবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী? যদি অভয় দেন তবে একটা কথা বলি স্যার”?
    “খুব যে কিছু ভয় পেয়েছো, এমনতো মনে হচ্ছে না, তাও বলো”।
    “শহরের বড়ো বড়ো মলগুলোতে, শপিং প্লাজায় কী রকম ভিড় হয় দেখেছেন? খেলার মাঠে কী রকম ভিড় হয় সেও দেখেছেন। সবাই কী সুন্দর রোজগার করছে, তাই না? আবার অন্যদিকে দেখুন, স্যার, ক্লাসফোরস্টাফ আর পিওনের চারটে পোস্টের জন্যে দেড় লাখের বেশি অ্যাপ্লিকেশন পড়েছিল, জানেন? তাতে আমিও করেছিলাম। ওভার কোয়ালিফিকেশনের জন্যে ডাক পাইনি। আচ্ছা ওই দেড়লাখ লোক কী ওই সব মলে যায়, নাকি খেলা দেখতে মাঠে যায়? কে জানে? আমি তো যাই না”।
    “ওসব অজুহাত। আমাদের তিনটে হাত, জানো কী? দুটো কাজ করার জন্যে আর একটা না করার জন্যে, সেটাই অজুহাত”।
    “হে হে হে, এগুলো চমকদার কথার কারুকাজ, স্যার। শুনতে ভালো লাগে। ফেসবুক আর হোয়াট্‌স্‌ অ্যাপে খুব শেয়ার হয় স্যার। খুব লাইক পায়”। বিপদতারণ হাসতে হাসতে বলল। ওপর থেকে ব্যাগ সমেত গোপালকে নিয়ে প্রদীপবাবু নিচেয় নামল। বিকাশ বাবু জিগ্‌গেস করলেন, “কী? টাকার বাণ্ডিল ঠিক আছে”?
    “ব্যাংকের প্যাকেট হিসেবে চোদ্দটাই আছে। তবে প্যাকেটগুলো তো গুনতে পারিনি স্যার, সময় লাগবে। প্রত্যেকটা প্যাকেট না গুনলে বোঝা যাবে না। আর কমলবাবুও এঁদের মতোই নাক ডাকছেন খুব। এমন আরামের ঘুম মনে হচ্ছে বহুদিন ঘুমোননি!”
    “ভ্যানের জন্যে থানায় ফোন করেছেন”?
    “এই করছি, স্যার”।
    “তাড়াতাড়ি করুন, আমরা কী সারারাত বসে থাকবো নাকি? তা বিপদতারণবাবু ওরফে নেপালবাবু, টাকা আগেই হস্তগত হয়ে গেছিল, সাড়ে তিনটের সময় সবাইকে অঘোরে ঘুম পাড়িয়ে, এতক্ষণ কী করছিলে বলো তো? আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলে নাকি? আমরা তো এসেছি এই কিছুক্ষণ হল”।  
    প্রদীপবাবু হাসতে হাসতে বললেন, “অতি চালাকের গলায় দড়ি, বলে না, স্যার? হে হে হে হে”।
    “আপনি আগে ফোনটা করুন তো!” বিকাশবাবু একটু বিরক্ত হয়েই বললেন।
    বিপদতারণ বলল, “খুব খিদে পেয়েছিল স্যার। তাই একটু খাচ্ছিলাম – মাছের ঝোল দিয়ে ভাত। তাছাড়া এতগুলো টাকা নিয়ে কী করবো সেটা নিয়েও একটু চিন্তা করছিলাম। বেশ বুঝতে পারছিলাম চোদ্দ লাখ হজম করা আমাদের কম্মো নয়”।
    “আবার মিথ্যে কথা? যত্তো সব ঢপের কেত্তন? হজম করা কম্মো নয় তো করলে কেন? ধরা পড়ে ভালো সাজছো”?
    “জানি আপনি বিশ্বাস করবেন না, স্যার। আমরা যখন প্রথম টাকা ডবল করার টোপ দিয়েছিলাম, তখন কিন্তু আমরা পাঁচ-দশ হাজারের টোপই দিয়েছিলাম। কিন্তু এঁনারা দুই বন্ধুতে পাল্লা দিয়ে উঠে গেলেন লাখে। তাও সনৎকাকু বলেছিলেন পাঁচ আর কমলকাকু ছয়, কাকিমা সেই শুনে মেয়ের থেকে তিনলাখ ধার নিয়ে, করলেন আট। আমরা কিন্তু লাখের কথা ভাবিওনি, বলিওনি।
    “সনৎবাবুর মেয়ে দিল্লি থেকে সাড়ে তিনটে থেকে মোবাইলে ট্রাই করে যাচ্ছেন, আর এদিকে কমলবাবুর স্ত্রী আর ছেলে...ওঁদের ফোনে না পেয়ে, আমাদের খবর দিয়েছেন”।
    “সে বুঝতে পেরেছি। শিক্ষিত ভদ্রলোকের কথা বলছিলেন না, স্যার? এই দুজনকেই দেখুন না, নিজের বাড়ি, ব্যাংকে সঞ্চয়, ছেলে মেয়ে সকলেই প্রতিষ্ঠিত, তাও আরো আরো টাকার জন্যে কীরকম পাগল হয়ে উঠেছিলেন। অচেনা অজানা একটা লোকের স্রেফ কথার ফাঁদে পা দিয়ে দিলেন তিনজনে”!
    বিকাশবাবু মুচকি হাসলেন, বললেন, “এখন তো তুমি আর অচেনা অজানা নও, তুমি বমালসমেত ধরাপড়া একজন চোর। নিজের মুখেই সেটা তুমি স্বীকারও করে নিয়েছো। এত কিছু জেনেও তোমার সঙ্গে পুলিশের মতো আচরণ করতে পারছি না! কেন?”
    “কেন, স্যার”?
    “তোমার ওই চেহারা আর কথাবার্তার জন্যে। এমন একখানা শিক্ষিত-ভদ্রলোকের মুখোশ সেঁটে রেখেছো, বোঝে কার বাপের সাধ্যি!”
    “ওইটাই একমাত্র পৈতৃক সম্পত্তি, আর কিছুই যে নেই”!
    “প্রদীপ, এদের দুটোর হাতেই হাতকড়া পরান। আমাদের ভ্যানের সঙ্গে পাড়ার জনগণও জড়ো হবে। তারা আবার বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে পারে। বলতে পারে তাদের হাতে অপরাধীদের তুলে দেওয়া হোক”।
    প্রদীপবাবুও সমর্থন করে বললেন, “হ্যাঁ স্যার, পাবলিক একবার এদের হাতে পেলে কেলিয়ে হাতের সুখ করতে ছাড়বে না”।
    দুজনকে হাতকড়া পরালেন প্রদীপবাবু। বিকাশবাবু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “শালা সরলমতি জনগণ, হঠাৎ বড়লোক হবার লোভে বারবার আহাম্মকি করবে, আর ভুগতে হবে আমাদের। চোর ধরো, জনগণ সামলাও, জেলে চোরকে জামাই আদরে সুস্থ রাখো। উপযুক্ত প্রমাণ দাখিল করো, আদালতে তোলো! একটু উনিশ-বিশ হলেই বিচারকের এবং মানবাধিকারের হুড়কো খাও...সব শালা ওই সরলমতি অবুঝ জনগণের জন্যে”।
     
    (ক্রমশ)  
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২৯ জানুয়ারি ২০২৩ | ৫২৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন