শিরীন, একমাত্র ভারতীয় খেলোয়াড় যিনি একটি-দুটি নয়, তিন -তিনটি খেলায় আন্তর্জাতিক স্তরে দেশের জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন…
বিদেশের কিংবদন্তি ইয়ান বথাম, ভিভ রিচার্ডস, জন্টি রোডস…আর বিস্মৃত শিরীন কন্ট্র্যাক্টর কিয়াসের মধ্যে কোন মিল কি আদৌ আছে?...
অথবা ভারতের কোটার রামস্বামী, সোমনাথ চোপড়া, ইফতিকার আলী খান পতৌদি বা হালের সোহিনী কুমারী বা যুজবেন্দ্র চাহালের সঙ্গেই বা শিরীন কন্ট্র্যাক্টর কিয়াসের কতখানি মিল বা অমিল??
ক্রিকেট আগ্রহী পাঠকরা সকলেই জানেন ওপরের অনুচ্ছেদে উক্ত খেলোয়াড়রা সকলেই একাধিক খেলায় জাতীয় স্তরে নিজেদের দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। ঠিক যেমন করেছিলেন ১৯৭০ এর দশকের ভারতের দাপুটে খেলোয়াড় শিরীন।
কিন্তু এঁদের সব্বার থেকে শিরীন একেবারে আলাদা। কারণ তিনিই এখনো পর্যন্ত একমাত্র ভারতীয় খেলোয়াড় যিনি তিনটি আলাদা খেলা; হকি, বাস্কেটবল এবং ক্রিকেটে ভারতের জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। ২০০১ সালে ক্যানসার ধরা পড়ার পর হুইল চেয়ার বন্দি হয়ে যাওয়া শিরীন রসিকতা করে বলতেন, শরীর একটু সঙ্গ দিলেই তিনি চতুর্থ বারের জন্য দেশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ভারতীয় প্যারাঅলিম্পিক দলে সামিল হয়ে যাবেন ঠিক!!
লম্বা দোহারা চেহারা, মোটা কাঁচের চশমার ওপাড়ে উজ্জ্বল দুচোখ, ঢেউ খেলানো চুল ছোট্ট করে ছাঁটা, হাসিখুশি স্নেহ প্রবণ ব্যক্তিত্ব…শিরীন ছিলেন সত্যিই এক আশ্চর্য মানুষ! হকি খেলার মাঠে পুরুষ দর্শকরা মেয়ে খেলোয়াড়দের সঙ্গে অসভ্যতা করলে হকিস্টিক হাতে তেড়ে গিয়ে মেরে শায়েস্তা করতেন যেমন..তেমনি টিম-মেটদের সব সুখে দুঃখে পাশে থাকতেন সর্বদা। কখনো দূরের ক্রিকেট ক্যাম্পে বয়সে ছোটদের খেয়াল রেখেছেন, কখনো বা অপর্ণা ঘোষদের মতো জাতীয় দলের বাস্কেটবল খেলোয়াড়রা আর্থিক কারণে দামি জুতো কিনতে না পারলে নিজের বেতনের টাকায় কিনে দিয়েছেন নাইকির স্পোর্টস স্যু।
শিরীনের জন্ম বম্বে শহরে জন্ম হলেও তাঁর বেড়ে ওঠা আর খেলাধুলোর আগাগোড়ায় ছিল কলকাতার গলি আর কলকাতারই ময়দান। নিজের পার্সি মহল্লার ছেলেদের সঙ্গে চুটিয়ে ক্রিকেট হোক বা হকি, স্কুলে মেয়েদের সঙ্গে বাস্কেটবল খেলা…কিশোরী শিরীন ছিল সবেতেই সবসময় সেরা।
কেনই বা তা হবেনা? তাঁর অন্য বন্ধুরা যখন সারাদিনের কাজের পর রাতের ফাঁকা সময়ে গল্পের বই পড়ে, তখন সে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে ডান হাতে বল ছুঁড়ে ডান হাতেই ক্যাচ ধরা প্র্যাকটিস করে মাঝরাত অবধি। ডান হাত সড়গড় হয়ে গেলে বাঁ হাতেও শুরু হয় একই অনুশীলন। রাতের পর রাত নিজের অর্ধেক ঘুম বাদ দিয়ে অসীম অধ্যবসায়ে দুইহাতেই আলাদা ভাবে বল থ্রো আর ক্যাচের কৌশল আয়ত্ত করে ফেলে শেষমেশ মহাখুশি হয় শিরীন। এরপর যে আর কোন ম্যাচেই ক্যাচ মিস হবেনা তার!!
তবে তিনটে খেলার মধ্যে শিরীন পেশাদারি ভাবে হকি খেলাই শুরু করেছিলেন প্রথম। ১৯৬৫-র আগে থেকেই ক্লাব স্তরে হকি খেলা শুরু করলেও ১৯৬৬-থেকে হকিতে বাংলা দলের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন শিরীন। ১৯৬৭তে দিল্লিতে তৃতীয় এশিয়ান মহিলা হকি চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জজয়ী ভারতীয় টিমের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৬৯-৭০ সালেও দেশ-বিদেশে দেশের হয়ে নিয়মিত খেলছিলেন শিরীন।
হকির পাশাপাশি ১৯৬৬ থেকে ক্যালকাটা পারসি ক্লাবে বাস্কেটবল খেলা শুরু করেন তিনি। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ বছর বাংলা টিমের হয়ে দাপিয়ে বাস্কেটবল খেলেছেন যেমন, তেমনি ১৯৭০-এ কুয়ালালামপুরে এশিয়ান মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন শিরীন কন্ট্র্যাক্টর কিয়াস।
কিন্তু আদ্যন্ত খেলা পাগল শিরীনকে যে খেলতে হবে আরো আরো বেশি! অস্থির তরুণীটি চশমা সামলে এবার পেশাদারি ক্রিকেট পিচেও নামলেন। ১৯৭৫সালে জাতীয় দলে নির্বাচিত হয়ে ৩ টেস্ট ম্যাচের সিরিজে ভারত সফরে আসা অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে একটি টেস্ট খেলেন শিরীন। দিল্লিতে সুধা শাহের নেতৃত্বে সেই টেস্টে প্রথম ইনিংসে ২১ রান করেন ও শান্তা রঙ্গস্বামীর বলে ক্যাচ ধরে ডেভ মার্টিনকে প্যাভিলিয়নে ফেরান। দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁকে ব্যাট করতে হয়নি।
পরে দুঃখজনক ভাবে ১৯৭৫ এর অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলা টেস্টগুলিকে পরে
যৌক্তিক কোন সদুত্তর ছাড়াই 'আনঅফিসিয়াল টেস্ট' হিসেবে বাতিল করে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল। তাই ওই দুটি সিরিজের কোন রেকর্ডও যথাযথ ভাবে রক্ষিত হয়নি। সংগঠকদের তরফে পেশাদারিত্ব, অভিজ্ঞতা আর সদিচ্ছার অভাবে শুরুর দিকের সেসব মহিলা ক্রিকেট ম্যাচগুলোর স্কোরকার্ড কোনরকমে কাগজে লেখা হতো যা ম্যাচের পরে হারিয়েও যেত অনেক সময়। সম্ভবত সেজন্যেই ক্লাব বা আঞ্চলিক স্তরে শিরীনের ক্রিকেট কেরিয়ার সম্পর্কে এর থেকে বেশি তথ্য এখনো পর্যন্ত গবেষকরা খুঁজে পাননি।
খেলোয়াড় হিসেবে বহুমুখী প্রতিভার বুকের ভিতর শিরীন আগাগোড়া ছিলেন আশ্চর্য রকমের এক আবেগপ্রবণ মানুষ! মগজ নয়, মনের কথা শুনতেন বলেই হয়ত তাঁর পক্ষে এমন অসাধ্যসাধন সম্ভব হতে পেরেছিল। ক্লাব-অঞ্চল-রাজ্য বা জাতীয় স্তরে তিনটে আলাদা খেলায় একের পর এক ম্যাচ খেলে বেড়ানোর মাঝে কখন হঠাৎই ১৯৬৮ সালের শেষদিকে নিয়ে তিনি বিয়ে করে বসলেন তার ছোটবেলার প্রিয়বন্ধু খুশরো কিয়াসকে। খুশরো নিজেও ছিলেন একজন খেলোয়াড় আর তাঁর গোটা পরিবারও ছিল খেলা পাগল। কাজেই বিবাহিত শিরীনের খেলায় বাধা দেওয়ার প্রশ্ন মাথাতেই আসেইনি কিয়াস পরিবারের কারুরই।
বিয়ের ঠিক পর-পরই ম্যাচ খেলতে কলকাতা ছাড়ছিলেন শিরীন। স্টেশনে বাড়ির নতুন বউকে বিদায় জানাতে এসেছেন আনকোরা স্বামীটি সহ গোটা শ্বশুরবাড়ি। মনে মনে উথাল পাথাল বিরহে কাতর হলেও স্ত্রীকে আগাগোড়া উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন খুশরো। কিন্তু ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে প্রেমিক বুঝতে পারেন, স্ত্রীকে এতদিনের জন্য ছেড়ে থাকা তাঁর পক্ষে অসম্ভব!
এরপর কি হল? স্বামীর প্রেমের টানে খেলা ত্যাগ করে ট্রেন থেকে নেমে এলেন স্ত্রী? না না, হল ঠিক তার উল্টোটাই! পকেটে যে ক'টা টাকা ছিল, তার সঙ্গে বাড়ির লোকদের পার্সের সব টাকা কুড়িয়ে বাড়িয়ে প্রায় চলন্ত ট্রেনের দিকে দৌড় দিলেন খুশরো। দরজায় তখন দাঁড়িয়ে আছেন আনন্দে হতবাক হয়ে যাওয়া শিরীন কন্ট্র্যাক্টর কিয়াস। দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে মুহূর্তরা সিনেমাতেই কেবল সম্ভব হয়, কে বললো!!
যাইহোক, খেলার দৌলতে পূর্বরেলে চাকরি পেলেন শিরীন। ততদিনে তিনি দুই সন্তানের মা হয়েছেন। বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে কোর্টে বাস্কেটবল প্র্যাকটিস করতেন মা, কখনো বা তাদের নিয়েই চলে যেতেন খেলসফরে। আত্মীয়দের পাশাপাশি শিরীনের টিমের সবাই, তাঁর ক্লাব আর কোর্ট ক্যান্টিনের কর্মীরাও একসময় এই দুই শিশুর আরেকটি পরিবার হয়ে উঠেছিল। কোর্টের বা বাউন্ডারির ধারে মাখন পাউরুটি, দুধ-বিস্কুট খেতে খেতে শিরীনের ছানারা তাঁদের মায়ের খেলা দেখতো।
১৯৭৪ সালে তিনটি ভিন্নধর্মী খেলায় একসঙ্গে জাতীয়স্তর পর্যন্ত নিয়মিত খেলার অনন্য রেকর্ডের জন্য ১৯৭৫-এ কলকাতার 'লেডিস স্টাডি গ্রুপ'-এর প্রথমতম সম্মাননাও লাভ করেন তিনি। তাঁর সঙ্গে সে বছর বিজ্ঞানী অসীমা চট্টোপাধ্যায় এবং সমাজকর্মী রমলা সিনহাও এই পুরস্কার পেয়েছিলেন।
জানলে অবাক হতে হয় হকি,বাস্কেটবল, ক্রিকেট নিয়মিত খেলার পরেও- নিজের চাকরি আর সাংসারিক দায় দায়িত্ব সামলানোর পরেও শিরীন নিজের জন্য ক্লাবস্তরে টেবিল টেনিস, লন টেনিস আর ক্যারম খেলার সময় ঠিক বের করে নিতেন।
আমরা যারা দু-তিন রকমের কাজ করার পরে অন্য কিছু করে ওঠার "সময় পাইনা''...বলে আক্ষেপ করি, তাদের সামনে শিরীনদের মতো মানুষদের চেয়ে যোগ্যতর আইকন আর কেউ হতে পারেন কি?
সম্ভবত ১৯৮০'র দশকের কোন সময় দেশ ছেড়ে সন্তানদের নিয়ে পাকাপাকি ভাবে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি দেন শিরীন আর খুসরো কিয়াস। শিরীন সে সময় মধ্য ৪০। তবে নতুন মহাদেশের নতুনতর জীবনযাত্রা- চাকরি আর বাকি দায়দায়িত্ব সামলে আবার জখম হাঁটু নিয়েই খেলা পাগল শিরীন পেশাদারি স্তরে নেটবল খেলা শুরু করলেন। যেখানেই সুযোগ পেতেন, সেখানেই আয়োজন করে ফেলতেন কোন না কোন একটি খেলার প্রতিযোগিতা। শিরীনের গাড়ির ডিকি খুললে সবসময়ের জন্য একসঙ্গে দেখা দিত ক্রিকেট ব্যাট-বল, বাস্কেটবল আর ফুটবলও।
শিরীন ছিলেন ঠিক এমনই। ২০০১-এ ক্যানসার ধরা পড়ার পর ডাক্তারেরা বললেন, যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে ভর্তি হয়ে কেমোথেরাপি শুরু করতে হবে তাঁকে, কারণ তাঁর হাতে বাকি রয়েছে মাত্র ৬ সপ্তাহের জীবন। এসব শুনে চুপচাপ মাথা নেড়ে হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে ২০০১ এর সিডনি অলিম্পিক দেখতে ছুটেছিলেন শিরীন। মাঠে বা কোর্টে আর খেলতে না পারলেও ক্যানসার কালে জ্যাজ আর সালসা নাচ শিখেছিলেন, মোটর সাইকেল চালিয়েছিলেন, আর ২০০৬ এ মুম্বাইতে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বার বার - রোজ রোজ- নতুন নতুন ভাবে বেঁচে নিয়েছিলেন এই অনন্ত সুন্দর জীবনটাকে।
লিমকা বুক অফ রেকর্ডস শিরীন কিয়াসকে আখ্যায়িত করেছে ভারতের সবচেয়ে ক্রীড়াবিদ হিসেবে। শিরীনের মতো অনন্য কৃতিত্ব এখনো পর্যন্ত সন্দেহাতীতভাবে লিঙ্গ নির্বিশেষে আর কোন ভারতীয় খেলোয়াড়ের নেই। তবু গুগলে খুঁজলে তাঁর জন্মদিনটুকু অবধি খুঁজে পাওয়া যায়না। ছবিও মেলে হাতে গুনে দু-চারটেই। শিরীন কিয়াসের আজ পর্যন্ত পাওয়া হয়নি কোন পদ্ম-অর্জুন-রত্ন-বিভূষণ প্রজাতির পুরস্কার বা সম্মান- তাঁকে নিয়ে লেখা হয়নি বই- বানানো হয়নি কোন ফিল্ম।
শিরীন কিয়াস সমকালীন খেলোয়াড়ি পরিসংখ্যানে তাঁর কৃতিত্বের সুগন্ধটুকু রেখে কর্পূরের কেবল উবে গেছেন আপামর ভারতের মনন থেকে। যদিও তাঁর স্বপ্ন, সক্ষমতা আর উদ্যমের দমকে প্রমাণ করতে কোন পুরস্কার-টুরস্কারই যথেষ্ট নয়। তবু শিরীন কিয়াসকে নিয়ে আজকের প্রজন্ম আরো গবেষণা করুক.. আজকের ভারত শ্রদ্ধায় - ভালোবাসায় তাঁকে মনে করুক নতুন করে…। শিরীন কন্ট্র্যাক্টর কিয়াস বিস্মৃতি থেকে ফিরে আসুন তাঁর প্রাপ্য সম্মানের আলোয়।